স্থান ~ পরমানন্দ মিশন ৷ সময় ~ ১৯৯০, জুন। উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ সব্যসাচী মান্না, পঙ্কজবাবু, নগেন ইত্যাদি ৷

জিজ্ঞাসু :— আপনার কাছে যে সমস্ত মানুষ আসে তারা প্রায়ই তো বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা এবং পারিবারিক সমস্যার কথাই বলে — তাই না?

গুরুমহারাজ :– সবাই নয়, তবে বলতে পারো বেশির ভাগই এই দলে পড়ে যাবে। আধ্যাত্মিক জগতে চার প্রকারের মানুষ আছে — আর্ত, অর্থার্থী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানী। যে কোনো জিনিস যদি খারাপ থেকে ভালো বাছাই করো__ তাহলে তা পিরামিডের আকার ধারণ করবে, অর্থাৎ নিচের দিকটা বিস্তৃত বা বেশি আর যত উপরে যাবে ততই বিস্তৃতি বা সংখ্যা কম হতে হতে একেবারে উচ্চবিন্দুতে শুধু বিন্দু বা সংখ্যার বিচারে হয়ত গুটি কয়েক। সেইরূপ এখানে সবরকম মানুষই আসে আর শুধু মানুষ কেন, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, এমনকি স্থূল শরীর নেই যাদের তারাও আসে। আর্ত অর্থাৎ যারা শরীর-মনে অসুস্থ। অসুস্থ শরীর বা অসুস্থ মন নিয়ে তো আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করা যায় না। তাই এখানে প্রথমেই শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার কৌশল শিখিয়ে দেওয়া হয়। পরমানন্দ মিশন মানুষকে শেখায় Art of Life and Art of Living অর্থাৎ জীবনের কলা এবং বাঁচার কলা।

 Art of Life and Art of Living শিক্ষার প্রথম উদ্দেশ্য হোল শরীর-মন সুস্থ রাখা। এরজন্য নিরামিষ আহার গ্রহণ, Auto-urine therapy বা স্বমূত্র চিকিৎসা, সহজ-সরল-অনাড়ম্বর জীবনযাপন, সংকীর্ণ চিন্তার পরিবর্তে উচ্চচিন্তন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা — এগুলি অবশ্য করণীয়। খাদ্যবিজ্ঞান follow করে শরীর সুস্থ থাকবে যে খাদ্যে, সেই খাদ্য গ্রহণ করাই মানুষের উচিত। দুপুর ১২ টার মধ্যে মধ্যাহ্নভোজন(lunch) এবং রাত্রির খাদ্য(dinner) হিসাবে সন্ধ্যার মধ্যে সহজপাচ্য খাবার অল্প পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। যারা রাত্রেও কাজ করে তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা অন্যরকম অবশ্যই হবে। মানসিকভাবে যারা অসুস্থ অর্থাৎ যারা অবসাদগ্রস্ত, মানসিক দুশ্চিন্তার শিকার, বাতিকগ্রস্ত — তাদের স্থূলশরীরেও নানা ব্যাধি দেখা যায়। আর এইসব মানসিক অসুস্থতা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে ধীরে ধীরে সেটি মারাত্মক ব্যাধিতে রূপ নেয়। মানসিক রোগীদের কোন সুস্থ ও সবল মনের মানুষের সান্নিধ্যে আসতে হবে। তিনিই তার মনের জটিলতাগুলো খুলে মনকে সহজ-সরল-স্বাভাবিক করে দেবেন। তাছাড়া এই ধরনের ব্যক্তিদের নিরামিষ সহজপাচ্য খাবার, অবগাহন স্নান, জলনেতি, সূত্রনেতি অভ্যাস এবং কিছু যোগাসন ও সহজ প্রাণায়াম করা উচিত। আর এর সঙ্গে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতি একান্ত অনুরাগ, ভক্তি, ধ্যান-জপ ইত্যাদি করতে থাকলে ধীরে ধীরে আর্তজনেরাসুস্থ হয়ে ওঠে।

  তুমি এটা ঠিকই বলেছো যে, অধ্যাত্মজগতের মানুষের কাছে এই আর্তরাই বেশি আসে। তবে এমনও নিদর্শন রয়েছে যে, প্রথমে কোন মহাপুরুষের কাছে কোন ব্যক্তি আর্ত হিসাবে এসেছে পরে সেই সদগুরুর শরণাপন্ন হয়ে, ঐ ব্যক্তি  নিষ্ঠাসহকারে গুরু নির্দেশিত কর্ম করতে করতে সাধনার চরম মার্গে পৌঁছে গেছে।

  যে সমস্ত ব্যক্তিরা পারিবারিক সমস্যা, অভাব বা ব্যবসার উন্নতি, ছেলের চাকরি, মেয়ের বিবাহ ইত্যাদি সমস্যা সমাধানের জন্য কোন সাধু-মহাত্মার কাছে যায় তারাই 'অর্থার্থী'। এদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। আশ্রমে আসা যাওয়া করতে করতে হয়তো এদের সমস্যার কিছুটা সমাধান হলো বা ঈপ্সিত ফললাভ হয়ে গেল, কালক্রমে দেখা যায় তারাও ভক্ত হয়ে গেল। তারপর সেই মহাপুরুষের আদর্শে শুধু তার জীবনই নয় তাদের পরিবার সহ সকলের জীবন পর্যন্ত অনুপ্রাণিত হয়ে যায়_এমনটাও দেখা যায়। আশ্রম থেকে কোন না কোন ভাবে উপকৃত ব্যক্তিরা আবার সমাজে তাদের আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের কাছে তাদের সুফল-লাভের গল্প করতে থাকে। এইভাবে এক একটা সৎ-প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে একটা বিরাট ভক্তমন্ডলী গড়ে ওঠে।

এদের মধ্যে অনেকেরই যেমন অধ্যাত্মজীবন লাভ হতে থাকে, তেমনি সমাজজীবনেও এরা একটা শুভ প্রভাব ফেলতে থাকে। আর্তরা কিছুটা তামসিক প্রকৃতির কিন্তু অর্থার্থীরা রাজসিক প্রকৃতির এবং বিত্তশালী। ফলে এরা ফললাভ করার পর সেই মহাত্মার আশ্রমের বিল্ডিং করে দেওয়া, ভিন্ন ভিন্ন শাখা স্থাপনের ভার নেওয়া বা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে যায়। সুতরাং আর্ত বা অর্থার্থীকে আশ্রয় দিয়ে মহাত্মা-মহাপুরুষগণ যে শুধু সেই ব্যক্তির কল্যাণ করেন তাই নয় তাদের প্রভাবে সামগ্রিকভাবে মানবকল্যাণ হয়ে থাকে।

 এর পরের স্তর জিজ্ঞাসু। এরা পূর্ব-পূর্ব জন্মের অভিজ্ঞতাপুষ্ট সংস্কার নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। মহাকালের বিচারে বলতে পারো এরা অপেক্ষাকৃত senior ! জীবন-জগৎ-ঈশ্বর সম্বন্ধে অন্তরে জিজ্ঞাসার উদয় হয়েছে মানেই বুঝতে হবে _এরা চেতনায় উন্নত। হয়তো দেখবে কোন ছেলে ছোটবেলা থেকেই সাধু-মহাত্মার কাছে যায় — তার অনেক জিজ্ঞাসা, সে অনেক কিছু জানতে চায় ! এইজন্য পারিপার্শ্বিক তথাকথিত বড়রা বিরক্ত হয় বা বলে, 'ছেলেটার মাথা খারাপ', 'ছেলেটা বড় জ্যাঠা, বেশি বোঝে' ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব ছেলেরা এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে ঠিক কোন না কোন মহাত্মার সাক্ষাৎ পেয়ে যায়। তাঁর সান্নিধ্যে ও সংস্পর্শে জীবনের দিশা খুঁজে পায়। তারপর ছেলেটি জিজ্ঞাসার পর জিজ্ঞাসা করতে করতে বুঝতে পারে জগত-রহস্য, জীবনরহস্য ও ঈশ্বররহস্য। খুঁজে পায় — 'যাকে পেলে সব পাওয়া যায়।' জিজ্ঞাসু ব্যক্তিদের মধ্যে সবাই অধ্যাত্ম জগতের রহস্য জানার জন্য সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করে __এমনটা বলা যায় না, বরং বলা যায় এদের বেশিরভাগই, 'অনেক জেনেছি' এইভাব নিয়ে আবার সমাজ-জীবনে সাধারণভাবে জীবনযাপন করে এবং পারিপার্শ্বিক লোকের যন্ত্রণার কারণ হয়। কেউ কেউ আবার সমাজ-শিক্ষক হয়ে সমাজের মঙ্গল করেন। আর কতিপয়জন অধ্যাত্মজগতের গভীরে ঢুকে অন্তর্লীন হয়ে যান।

অধ্যাত্মজগতে আগমনকারী চতুর্থশ্রেণীর মানুষেরা হচ্ছেন জ্ঞানী। সাধারণের চোখে, মহাপুরুষের নিকট এঁদের গমনাগমনের মধ্যে কোন বিশেষ বৈচিত্র্য লক্ষ্যণীয় হবে না। কারণ এঁরা নিজেরাই মহাত্মা, তাই এঁরা যখন কোন মহাত্মা বা মহাপুরুষের নিকট আসেন তখন নীরবে এবং নিভৃতে আসেন, ভিড়-ভাট্টায় নয়। আর যদিও ভিড়ের মধ্যে থাকেন তাহলেও চুপচাপ থাকেন।

  এর‌ও উপরের বা উন্নত স্তরের ভক্ত যাঁরা মহাপুরুষদের কাছে আসেন_তাঁরা হোলেন প্রেমিক। এঁরামহাপুরুষের কাছে কিছু চাইতে বা নিতে আসেন না_তাঁরা দিতে আসেন! এমন কেউ এখানে এলে দেখবে_ আমি যেন কেমন হয়ে যাই, পরস্পরের মধ্যে প্রেমের আদান-প্রদান হোতে শুরু করে! উপস্থিতজনেদের মধ্যে একটু উন্নত আধার থাকলে সে ও এর স্পর্শ পেতে পারে!!

জিজ্ঞাসু :— গুরুজী, ভাষার বিভিন্ন রূপ সম্পর্কে যদি একটু বলেন —তাহলে বড়‌ই কৃতার্থ হই ?

গুরুমহারাজ :— মানুষ সহ যে কোন জীব-জন্তুর মনোভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ‘ভাষা’। মানুষের ভাষা সাধারণত চাররকম উপায়ে প্রকাশিত হয়ে থাকে — পরা, পশ্যন্তি, মধ্যমা ও বৈখরী। অক্ষর বা শব্দ ব্যবহার করে শব্দ সৃষ্টিকারী যে ভাষা তাই ‘বৈখরী’। আবার মনকে মাধ্যম করে বা অন্যান্য ইন্দ্রিয়কে মাধ্যম করে যে ভাষা ব্যবহার করা হয় তাই ‘মধ্যমা’। যেমন ধরো, সঙ্গীত যদি বৈখরীতে আওয়াজ করে গাওয়া হয়, তাহলে সেই সংগীতের যে নৃত্যরূপ তা ‘মধ্যমা’। কারণ এখানে নৃত্যের ভঙ্গিমার মাধ্যমে ঐ সঙ্গীতের পুরো ব্যাপারটাকে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।

এবার পশ্যন্তির কথা বলি! ধরোকোন মহাত্মা বা মহাপুরুষ উপস্থিত জনেদের দিকে শুধু তাকিয়ে রয়েছেনমুখে কোন কথা বলছেন না! কিন্তু তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের স্থূলশরীরের গভীরে যে সূক্ষ্মশরীর_ আবার সূক্ষ্মশরীরের গভীরে যে কারণশরীর তাও হয়তো তিনি দেখে নিচ্ছেন। তিনি শুধু তাকিয়ে থেকে দেখছেন যে এই স্থূল শরীরটা জন্ম-জন্মান্তরের কর্মরাশির একটা gist বা সংক্ষিপ্তসার এবং তিনি এও দেখছেন যে এই সংস্কাররাশি এগিয়ে চলেছে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে, পরিণতির দিকে ! ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-এর দ্রষ্টা বা কালদ্রষ্টা যিনি তিনি পশ্যন্তির মাধ্যমে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোন স্থানে, যে কোন স্তরে তাঁর বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন অথবা সেই স্তরের কোন বার্তাকে receive করতে পারেন। কোন উন্নত মহাত্মার সঙ্গে অপর কোন উন্নত মহাত্মার কথা হয় সাধারণত পশ্যন্তিতে।

 কিছুদিন আগে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন উন্নত প্রান্ত থেকে message আসছিল পৃথিবীগ্রহকে উদ্দেশ্য করে। আমার কাছেও আসছিল! তাতে বলা হচ্ছিল যে, 'সৌরমণ্ডলের এই গ্রহটি বিপদাপন্ন এবং এখানকার living অধিবাসীরা যেন সচেতন থাকে'। হয়তো কোন মহাজাগতিক কোন উল্কা বা অন্যকিছু নেমে আসছিল এই গ্রহের উপর, সেটা calculate করে ওরা সতর্কবার্তা পাঠাচ্ছিল। আমাদের এখানকার বিজ্ঞানীমণ্ডলও এই ঘটনাটার একটা আঁচ করেছিল। দেখবে খবরের কাগজে "অমুক তারিখে পৃথিবী গ্রহ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে"_এমন সব হেডলাইনে খবর ছেপেছিল। কিন্তু ব্যাপারটা কিছুই ঘটল না ___কেন জানো? বৃহস্পতি গ্রহের মাধ্যাকর্ষণে মহাজাগতিক বস্তুটি অন্যদিকে ঘুরে গেল বা তার ক্রিয়াশীলতা হারিয়ে গেল। পৃথিবীগ্রহের "গুরু" বলা হয়েছে বৃহস্পতিকে। আধ্যাত্মিক গুরু যেমন শিষ্যের বিপদ-আপদ থেকে সযত্নে তাকে রক্ষা করে, তেমনি বহু প্রাচীনকাল থেকেই অধ্যাত্মবিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করে আসছেন যে, পৃথিবী গ্রহের বহু বিপদ-আপদ থেকে বৃহস্পতি গ্রহ এই গ্রহটিকে রক্ষা করে আসছে। তাই বৃহস্পতি গুরু।

যাইহোক যা বলছিলাম, এইভাবেই উন্নত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরা বিভিন্নভাবে communication করতে পারেন অপরের সঙ্গে। অনেক সময় শুনতে পাবে কেউ দৈববাণী শুনতে পেয়েছে। হজরত মহম্মদ আল্লাহর বাণী শুনতে পেতেন। অনেকেই বিপদকালীন মুহূর্তে বা অন্য সংকটকালে ঐশ্বরিক কোন নির্দেশ পায় বা সতর্কবাণী স্পষ্ট শুনতে পায়। এগুলি কি করে হয়? উন্নত গুরু বা গুরুকুল হয়তো সুদূর হিমালয় থেকে কিংবা পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে বসে এইরূপ কোন নির্দেশ দিচ্ছেন! তাঁরা হয়তো কখনও কারো কাছে প্রকট‌ও হয়ে যেতে পারেন — ঠিক যেন মনে হবে স্থূল ঘটনা ! এগুলো কিন্তু বাস্তব — সত্যি সত্যিই হয় !সব সময় জানবে স্থুলতত্ত্ব নিহিত আছে সূক্ষ্মতত্ত্বে, সূক্ষ্মতত্ত্ব নিহিত আছে কারণতত্ত্বে আর কারণতত্ত্ব নিহিত রয়েছে আদিকারণ বা মহাকারণ তত্ত্বে। বৈখরীতত্ত্ব রয়েছে মধ্যমা তত্ত্বে, মধ্যমাতত্ত্ব রয়েছে প্রশ্যন্তিতত্ত্বে আর পশ্যন্তিতত্ত্ব সহ সকল তত্ত্বই নিহিত রয়েছে পরাতত্ত্বে। তাই যিনি মহাকারণ বা আদিকারণ-তত্ত্বকে জেনেছেন, তিনি বাকি সকল তত্ত্বই জ্ঞাত। ফলে তাঁর দ্বারা কারণজগতের ক্রিয়া যেমন সম্ভব, তেমনি সূক্ষ্ম বা স্থূল জগতের ক্রিয়া ঘটানোও বিচিত্র তো নয়ই বরং আর পাঁচটা সাধারণ ঘটনার মতোই তা ঘটে থাকে।

এই যে পারমার্থিক জগতের কথা তোমাদেরকে বলা হলো — এগুলো হয়তো তোমরা আগেও শুনেছো বা কোন না কোন মহাপুরুষের গ্রন্থে পড়েছো, এর ফলে তোমাদের অনেকেরই ধারণা হয়েছে কিন্তু তা তো বোধে পরিণত হচ্ছে না। অষ্টাঙ্গিক যোগমার্গের যে ক্রম তার শেষ তিনটি ধাপ হচ্ছে — ধারণা, ধ্যান ও সমাধি। ফলে শুধু ধারণা হলে তো অজ্ঞানতা দূর হবে না, এরপর এই ধারণাকে পাকা করার জন্য ধ্যানের গভীরে যেতে হবে। যেখানে তোমার কাছেই পরিস্ফুট হবে কেমন করে স্থূলতত্ত্ব সূক্ষ্মতত্ত্বে এবং সূক্ষ্মতত্ত্ব কারণতত্ত্বে ধীরে ধীরে অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছে। আবার সেখান থেকেই কি করে পর্যায়ক্রমে স্থূলে ফিরে আসছে। অনুলোম-বিলোম বা আগম-নিগম তত্ত্ব আপনা-আপনিই তোমার কাছে ধরা দেবে। আর সমাধিতেই একমাত্র তত্ত্বজ্ঞান বা পরমবোধ হয়। Ascending body ওখান থেকে আর ফেরে না। নুনের পুতুল লবণসমুদ্রে মিশে যাওয়ার মতই ব্যাপারটা তবু একটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম identity থাকে। যাকে কেন্দ্র করে ঈশ্বরকোটীরা জগৎকল্যাণের নিমিত্ত অবতাররূপে আবার ফিরে আসতে পারেন, এঁরাই Descending body. নিগমানন্দ সরস্বতী বলেছিলেন যে, তিনি অবতার নন তিনি Ascending body-র লোক কিন্তু সাধনার স্তর অতিক্রম করতে করতে তিনি সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছেছেন। ঈশ্বরের ইচ্ছায় তাঁর শরীর অনেকদিন ছিল এবং তিনি জগৎকল্যাণমুখী অনেক কাজ করে গেছেন। তাঁর লেখা বইগুলো পাঠ করে আজও বহু মানুষ অধ্যাত্মমুখী হয়। তাঁর শিষ্যরাও ছিলেন এক-একজন দিকপাল। কিন্তু দ্যাখো, এই ব্যক্তি অধ্যাত্মজীবনে প্রবেশ করেছিলেন একজন জিজ্ঞাসু হিসাবে। তাঁর স্ত্রীর অকাল বিয়োগে কাতর হয়ে তিনি এই সংকল্প নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন যে, মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীকে আবার একবার দেখা যাবে কিনা? তারাপীঠের মহাভৈরব বামদেব নলিনী (নিগমানন্দ) -কে তা দেখিয়েছিলেন। ব্যস্ _আর পিছু ফিরে তাকাননি নিগমানন্দ, তরতর করে সাধনার সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন। এইভাবে সাধন-জগতে এমন অনেক মহাত্মা রয়েছেন যাঁরা আর্ত বা অর্থার্থী হিসাবে এই মার্গে এসেছিলেন কিন্তু পরে সাধনজগতের চূড়ান্তে পৌঁছেছিলেন। তাই মহাজনগণ তাঁদের সান্নিধ্যে আসতে সকলকেই স্বাগত জানান। কেননা সকলের মধ্যেই পূর্ণত্বের সম্ভাবনা বিদ্যমান, সকলেই পূর্ণ থেকেই এসেছে আর প্রকৃতপক্ষে সকলেই পূর্ণস্বরূপ কেবল জ্ঞানী ছাড়া বাকিরা ভুলে গেছে যে — সে পূর্ণ, এই যা।

‘ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।

পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।’

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ ।।

জিজ্ঞাসু :– বৈখরী, মধ্যমা ও পশ্যন্তি সম্বন্ধে ধারণা হল, এবার ‘পরা’ সম্বন্ধে কিছু বলুন।

গুরুমহারাজ :– ‘পরা’ সম্বন্ধেও ধারণা দিলাম। পূর্ণত্বের ধারণা দেবার পর আর কি বলার থাকে? এতক্ষণ যা আলোচনা হল_ তারপর আবার জিজ্ঞাসার অবকাশ কোথায় — এবার শুধু “বোধে বোধ” করার ব্যাপারটাথাকে! যাইহোক, ‘পরাবাক’ হচ্ছে মহাকারণস্বরূপ বিশুদ্ধ চৈতন্য। আর চৈতন্যময় পরাবাক-ই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মূল আধার। এটি-ই প্রণবরূপে উদগীত। অর্থাৎ মহাকারণস্বরূপ অস্ফুট অবস্থা থেকে প্রথম যে স্ফুট অবস্থা তাই প্রণব। আধুনিক বিজ্ঞানীরা এটাকেই বলছে ‘Bang’. “সুতরাং সৃষ্টির সমস্ত তত্ত্ব এই প্রণবে নিহিত। পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চমহাভূত, পঞ্চতন্মাত্রা এবং অন্তঃকরণচতুষ্টয় নিয়ে যে চতুর্বিংশতি তত্ত্ব তা প্রণবেই নিহিত ছিল, যা প্রণবের প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জগদরূপে প্রতীয়মান হয়েছে। এই জগতের যা কিছু — সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট ছন্দ বা সুর রয়েছে আর সেগুলির সামগ্রিকরূপই প্রণব। তাই একে কোন শব্দ দিয়ে বা চিহ্ন দিয়ে প্রকাশ করতে পারা যায় নাচেষ্টা করা হয় মাত্র। কোন ধ্বনির সংঘাতে এটি সৃষ্ট নয় বলেই ‘প্রণব’-কে বলা হয় “অনাহত” অর্থাৎ যা আহত বা কোন সংঘর্ষে সৃষ্ট নয়। প্রণবের যে বিস্তার বা গতিশীলতা এটিই কালের আবর্তনে সৃষ্টি ও স্থিতির রূপ ! এই বিস্তার রূপটিকেই রূপকাকারে ‘ওঁ’ ধ্বনি (এবং চিহ্ন) দ্বারা প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়েছে, এটি অবরোহ গতি। আবার আরোহ গতিতে এটি ‘ব্যোম’ ধ্বনি অর্থাৎ প্রলয়। সুতরাং পরাবাকের অবরোহ গতি হল পরা, পশ্যন্তি, মধ্যমা ও বৈখরী আর এর অবরোহগতি বৈখরী, মধ্যমা ও পশ্যন্তি এবং পরা। এই ভাবেই বিশ্বসৃষ্টি রহস্যের অন্তর্নিহিত তত্ত্বটি রয়েছে প্রণবতত্ত্বে বা পরাবাকতত্ত্বে। বর্তমান বিজ্ঞানীরা Black hole এবং White hole-এর রহস্য জানতে পারলে হয়ত ওঁ তত্ত্ব এবং ব্যোমতত্ত্বের ধারণা পাবে।