স্থান:– বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন, সময়:– 1991সাল, নভেম্বর মাস, কালীপুজোর পর দিন। উপস্থিত ব্যক্তিগণ:— মুখার্জি বাড়ির ছোট কাকা(গোলোকপ্রসাদ), সেজো কাকা(উমাপ্রসাদ), খোকন মহারাজ, উদয় মহারাজ প্রমূখ‌।
জিজ্ঞাসু:– বলা হয়, নরলীলায় ভগবানকে চেনা যায় না ! আপনাকেও তো আমরা কিছুই চিনতে পারলাম না। এখন আপনিই বলে দিনভগবানকে চেনা যায় কি করে ? গুরু মহারাজ:— ভগবান কৃপা করে তাঁর সম্বন্ধে না জানালে_ মানুষ কিছুই জানতে পারে না, তাঁকে চেনা তো অনেক দূরের কথা ! এটা ধ্রুব সত্যি কথা যে, ‘ভগবানের নরলীলা’ ধরতে পারা খুবই শক্ত ! দ্যাখো, সাধারণ মানুষ কি অপর আর একজন মানুষকেই ঠিক ঠিক পুরোটা বুঝতে পারেযে সে ভগবানকে বুঝবে !! ভগবান যখনই মানুষের শরীর ধরে লীলা করতে আসেন, তখন তাঁর সাথে বেশ কিছু লীলা সহচরেরাও আসেন । শরীর গ্রহণের পর সেই লীলা-সহচরেরাই “ভগবান”কে চিনতে পারে না ! স্বয়ং ভগবান‌ই খুঁজে খুঁজে তাদেরকে বের করেন অথবা আকর্ষণী মুদ্রা প্রয়োগ করে তাদেরকে তাঁর কাছে টেনে আনেন ! তাহলে সাধারণ মানুষ কিভাবে ভগবানকে চিনবে বলো ! যাদের ঈশ্বরের অবতার অর্থাৎ “ভগবান” সম্বন্ধে কোনো ধারনাই নাই তারা কি করে তাঁকে চিনবে ?
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পার্ষদদের মধ্যে যোগেন(পরবর্তীতে স্বামী যোগানন্দ) প্রথম প্রথম দক্ষিণেশ্বরে আসা শুরু করার সময় একদিন দেখলেন_
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে তাঁর ঘরটিতে বসে বেদ-বেদান্ত, ত্যাগ-বৈরাগ্য এইসব নিয়ে আলোচনা করতে করতে মাঝে মাঝেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন ! কথা বলতে বলতে কেবল বাইরের দিকে তাকাচ্ছেন ! তারপর হঠাৎ করে নিজেই আসন ছেড়ে উঠে বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে খাজাঞ্চিকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন” ক‌ই হে বাপু আমার জন্য বরাদ্দ শীতলের প্রসাদ তো এখনো এসে পৌঁছালো না ! এ্যাতো দেরি হোচ্ছে কেন_ আজকে আর দেবেনা নাকি ?” যোগেন এই পুরো ব্যাপারটা নজর রাখছিলো ! এতক্ষণে সে বুঝতে পারলো যে, ঠাকুরের ঐরকম ঈশ্বরীয় কথা বলতে বলতে চঞ্চল হয়ে পড়ার কারনটা কি ! দু-একটা পাশ করা, সদ্য যুবক হয়ে ওঠা যোগেন মনে মনে ভাবলো ঠাকুর মুখে যতই বেদ-বেদান্তের কথা বলুক_ আসলে তো চাল-কলা বাঁধা পুরোহিত ঠাকুরের বাড়ির ছেলে ! সুতরাং নজরটা তো ওইদিকে থাকবেই ! তবুও সে সুযোগ পেয়ে একসময় ঠাকুরকে কথাটা জিজ্ঞাসা করলো_ ওইভাবে চেয়ে চেয়ে ভুজ্জি-প্রসাদ আদায় করার কারণটা কি ? যোগেনের কথা শুনে ঠাকুর হাসতে হাসতে বলেছিলেন_ “রানী রাসমনি বেঁচে থাকতেই এই ব্যবস্থা করেছিলেন যে, আমি মন্দিরে পূজা করি আর নাই করি _ ভোগ বা প্রসাদের একটা থালা রোজ এখানে আসবে ! সেই মতোই হয়ে আসছিল কিন্তু এখন দেখছি ওরা(মন্দিরের নতুন পুরোহিতরা) প্রসাদের থালাটা দিতে প্রায়‌ই ভুলে যায় ! তাই আমি সময় পেলেই চেয়ে নিই ! আর আমি চেয়ে নিই কেন জানিস_ রানী রাসমণি আমার দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করার সময়, এই সংকল্প করেছিলেন যে, মন্দিরে নিয়োজিত তার অর্থের একাংশ থেকে দেবসেবার সাথে সাথে যেন ভক্তসেবা, সাধুসেবা, অতিথি সেবা ইত্যাদিও হয় ! এখানে নিত্য দেবসেবা হোচ্ছে ঠিকই কিন্তু রোজ রোজ তো মায়ের প্রসাদ দিয়ে ‘সাধুসেবা’ হয়না ! এখন যারা পুরোহিত রয়েছে ওদের মধ্যে কয়েকজনের স্বভাব-চরিত্র ভালো নয়, এখানকার নৈবেদ্যের প্রসাদে ‘সাধুসেবা’ হবে কি_ ওদের হাত দিয়ে সেই প্রসাদ বেশ্যাবাড়িতে চলে যায় ! কিন্তু আমার জন্য নির্দিষ্ট প্রসাদের থালা যদি এখানে আসে, তাহলে তোদের মতো শুদ্ধসত্ত্ব ভক্তরা সেই প্রসাদ খায় ! আর এতেই প্রকৃত সাধুসেবা হয় এবং এর দ্বারা রাণীর সংকল্প সিদ্ধ হয় ! তাই ওরা দিতে ভুলে গেলেও আমি ছদ্ম-রাগ দেখাই, চেঁচামেচি করি” !
তাহলেই বোঝো_ ভগবানের লীলা ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সেদিনের কথায় যোগেন লজ্জিত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু শিক্ষাও লাভ করেছিল । আর শুধু যোগেনই বা কেনআমরা সকলেই ঠাকুরের ঐ কথার দ্বারা শিক্ষালাভ করলাম ! যাই হোক, এই ঘটনার পরদিন থেকে যোগেন আর কখনোই ঠাকুরের কোনো ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেনি ! কিন্তু আমাদের মতো যারা সাধারন মানুষ,আমাদের তো সবেতেই সংশয় ! তবে সাধারণ মানুষদের‌ই বা দোষ দিই কি করে বলোতো ! অজ্ঞানতার অন্ধকারে ডুবে থাকা মানুষ, কোনো সাধু-মহাত্মার এই ধরনের বাহ্যিক রহস্যপূর্ণ আচরণ দেখলে_ ভুল তো বুঝবেই__ তাই নয় কি ? ….. (ক্রমশঃ)[পরের দিন বাকি অংশ]