এইরকম ঘটনা যে শুধু মাস্টারমশাই-এর জীবনে ঘটেছিল তা নয় – ঠিক এমনই অনেক ঘটনার কথাই আমার জানা আছে ! সুতরাং আমার জানার বাইরে গুরুমহারাজ তাঁর শত-সহস্র ভক্তদের সামান্য কষ্ট নিবারনের জন্য কতোটা বেশি তৎপর হোতেন_ সে সমস্ত রহস্য তিনি নিজে ছাড়া আর কে-ই বা জানবে ! সাধে কি আর ভগবানকে করুণাময় বলা হয় !! সদা সর্বদা তাঁর মধ্যে দিয়ে সকল জীবের জন্য করুণা ঝরে পড়ে বলেই তো তিনি ‘করুণাময়’ !!
আপনাদের হয়তো আগে একবার এই কথাটা উল্লেখ করেছিলাম – তবু আরো একবার বলি ! আমাদের খুবই স্নেহের পাত্র শ্রীমান শান্তনু চট্টোপাধ্যায় (যার কাটোয়ার কাছে কুর্চিতে বাড়ি) একবার কলকাতা থেকে (কারন ‘ও’ তখন কলকাতা থেকে পড়াশুনা করতো এবং খুবই ধ্যান-জপ করতো) সরাসরি বনগ্রামে গেছে গুরুজীর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে ৷ ও যখন গিয়ে পৌঁছেছিল তখন বর্ষার ভাব ছিল এবং টিপটিপ করে বৃষ্টিও পড়তে শুরু করেছিল।
আশ্রমে পৌঁছে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই শান্তনু তার লক্ষ্য স্থির রেখে(সমস্ত ভক্তেরই তখন ঐরূপ এক লক্ষ্যই থাকতো) অর্থাৎ ‘গুরুজীর সাথে যদি একবার দেখা হয়’ – সেই উদ্দেশ্যে গুরুমহারাজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলো ৷
গুরুমহারাজের ঘরের কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে, হঠাৎ ও দেখে কি – গুরুমহারাজ একটা ছাতা মাথায় দিয়ে আশ্রমের খেলার মাঠের দিকে এগিয়ে আসছেন ৷ আহ্লাদে আটখানা হয়ে শান্তনু গুরুমহারাজকে এক প্রকার ছুটে গিয়ে প্রণাম করেছিল ৷ সেই ফাঁকে গুরুমহারাজও ওকে কুশল জিজ্ঞাসা করছিলেন। এমনটা চলতে চলতেই গুরুজী শান্তনুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন – ” তুই বৃষ্টিতে ভিজছিস তো ! কলকাতা থেকে আসছিস – কিছু খাওয়াও তো হয় নি ! যা – যা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে খেয়ে নে !” এইকথা বলতে বলতেই গুরুমহারাজ ছাতাটিকে নিজের মাথা থেকে সরিয়ে তাঁর শ্রীহস্ত সামনের দিকে লম্বা করে বাড়িয়ে শান্তনুর মাথায় ধরেছিলেন ৷
ঘটনার আকস্মিকতায় শান্তনু ঘাবড়ে গিয়েছিল ৷ তারপর যখন দেখলো – তার জন্য গুরুজী ভিজছেন__ তখন ‘ও’ গুরুজীর কাছে বিদায় নিয়ে এক দৌড়ে রান্নাঘরে চলে গিয়েছিল ৷ গুরুজীর কথার মান্যতা দিয়ে শান্তনু রান্নাঘরের নির্দিষ্ট স্থান থেকে থালা-গ্লাস নিয়েছিল এবং রান্নাঘরের বাইরে থালা-বাসন ধোওয়া বা হাত-মুখ ধোওয়ার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে এসে থালায় জল বুলিয়ে হাতে-মুখে জলও নিয়েছিল । কিন্তু এইসব করতে করতেই সে আর নিজেকে সামলাতে পারছিল না _যেন একেবারে ভেঙে পড়ছিল ৷ অযাচিতভাবে গুরুজীর ওই অসম্ভব প্রেম ও করুণার সংস্পর্শে আসায় এবং সেই কথা ভাবতে ভাবতেই __সেই নির্জন সন্ধ্যায় (গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল বলে বাইরে তখন কেউ ছিল না।) থালা হাতে আশ্রমের পুকুরটির ওপারে অবস্থিত গুরুজীর ঘরের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেলেছিল শান্তনু !
এখনো যখন ‘ও’ গুরুজীর প্রেম ও করুণার কথা বলতে গিয়ে ওই ঘটনার কথা স্মরণ করে, তখন বলে – ‘ জানো শ্রীধর দা ! উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের লেখা ‘ড্যাফোডিল’ নামে একটা কবিতা পড়েছিলাম ৷ সেখানে উনি লিখেছিলেন – “একবার ভ্রমণকালীন সময়ে এক নির্জন পাহাড়ি প্রান্তরের উপত্যকায় মৃদুমন্দ বাতাসে দুলতে থাকা একসাথে অনেক ‘ড্যাফোডিল’ ফুলের শোভা দেখে উনি আনন্দে খুবই আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন ৷ সেই অপূর্ব সৌন্দর্যের একেবারে গভীরে এমনভাবে উনি ঢুকে গিয়েছিলেন যে, উনি সেই অপার্থিব সৌন্দর্য-আস্বাদন থেকে সরতেই পারছিলেন না। কাজের তাগিদে ওনাকে সেই স্থান ত্যাগ করতেই হয়েছিল। কিন্তু বহুকাল পর্যন্ত উনি একা একা ঘরে বসে বা অন্য কোথাও যখনই অলস সময় কাটানোর সুযোগ পেতেন – তখনই চোখ বন্ধ করলে তাঁর মানসপটে সেই ফুল্লকুসুমিত ড্যাফোডিলের সৌন্দর্যের ‘ফ্লাশিং’ হোতো ৷ যা তাঁকে অতি বিষন্নতায় মাঝেও আনন্দ দান করতো ৷ আমার(শান্তনুর)-ও এমনটাই হয় _শ্রীধরদা!’
গুরুমহারাজের সাথে ঘটে যাওয়া ঐরূপ ছোটো ছোটো প্রেম ও করুণার স্মৃতি যেন ভক্তদের কাছে ঐরকমই বা তার থেকেও উন্নত সুখস্মৃতি এবং আনন্দের খনি — যা স্মৃতিতে আসলেই চোখে জল ভরে আসে, মন পরমার্থিক আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে !
এই প্রসঙ্গে বলেই রাখি — এক শেষ চৈত্রের দুপুরে ঘর্মাক্ত কলেবরে গুরুমহারাজের ঘরে (১৯৮৫ সাল) এই সংকলকও ঢুকেছিল এবং আশীষ মাস্টারমশাই-এর মতোই অভিজ্ঞতা লাভ তারও হয়েছিল। গুরুজী হাতপাখা দিয়ে আমাকে হাওয়া করতে শুরু করেছিলেন। তারপর ওনার প্রসাদ রাখার বড় বেলের খোলটা টেনে নিয়ে তাতে ভর্তি করে রাখা থোকা থোকা আঙুরগুলি দিয়ে বলেছিলেন – “এইগুলি খা !” আমি অবাক বিষ্ময়ে শুধু সেই করুণাময়ের মুখের দিকে তাকিয়েই ছিলাম – কিছু বলতে পারিনি। সেদিন ওনার করূনার রূপটি একদম কাছ থেকে দেখে_ শুধু অবাক হয়েছিলাম- আর চোখের জল বাধা মানছিল না। এখনোও যখনই সেইদিনের কথা বা ওই ধরনের ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা স্মরণে আসে – তখনই চোখে জল আসে ৷ তবে আমার মনে হয় _এইরূপ অভিজ্ঞতা আমাদের গুরু ভাই বোনেদের অনেকেরই রয়েছে।।
(আপনারা “মন্তব্যে” সকলে আপনাদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন।)