আমাদের বাড়িটি হুগলি জেলায় কামারপুকুরে। 'পরমানন্দ কথা' শুরুর আগে কামারপুকুর সম্পর্কে একটু বলে নেওয়া যাক্ । আমাদের গ্রামের তিন কিলোমিটার দূরে দেরেগ্ৰাম। দেরেগ্রামের জমিদার রামানন্দ রায় তার পরিবারের সত্যনিষ্ঠ পুরোহিত ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়কে কোনো এক মামলায় মিথ্যা স্বাক্ষী দিতে বলেছিল । শর্ত ছিল হয় এই কাজ করতে হবে, অন্যথায় রাতের মধ্যে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে ! ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় কোনো উত্তর না দিয়ে চিন্তিত মনে ১৫০ বিঘা জমি, ঘরবাড়ি, ঘরের মজুদ গোলাভরা ধান-চাল, আসবাবপত্র_ এই সবকিছু ছেড়ে স্ত্রী-ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে বেড়িয়ে পরতে হবে পথে ? আর যাবেন্ই বা কোথায়? এইরূপ চিন্তিত মনে বাড়িতে এসে চন্দ্রমণি দেবীকে সমস্ত কথা বললেন ।

সমস্ত কিছু শোনার পর চন্দ্রমনি দেবী বললেন– “চিন্তা কি? আমাদের সাথে রঘুবীর আছেন তো।” রাত্রিবেলায় পুত্র ও কন্যার হাত ধরে রঘুবীরকে মাথায় নিয়ে ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং চন্দ্রমণি দেবী স্বগ্রাম ছেড়ে কামারপুকুরে এসে পৌঁছেছিলেন । তাঁদের পদস্পর্শে কামারপুকুরের মাটি ধন্য হয়েছিলো। বর্ধমান রাজার গুরুদেব ও ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু শুকলাল গোস্বামী বসতবাটি জায়গা ও জমি দিয়ে ওনাদের কামারপুকুরে থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন।

সত্যের জন্য যাঁরা সবকিছু ত্যাগ করেছে, চরম ও পরম সত্য পরমেশ্বর— সেই সত্যের মর্যাদা দিতে নিজে পুত্র রূপে চন্দ্রমনি দেবীর কোলে আবির্ভূত হলেন পূর্ণ সত্য ,পূর্ণ চৈতন্য, পূর্ণ আনন্দ, সচিদানন্দঘনবিগ্রহ রূপে!!

ধন্য হলো পৃথিবী গ্রহ, ধন্য হলো ভারতের হুগলি জেলার কামারপুকুর ! আনন্দে পাখিরা গান করে উঠলো, সমস্ত প্রকৃতি আনন্দে নেচে উঠলো , হালদার পুকুরের জলে আনন্দের ঢেউ উঠল ! ভাগ্যবান কামারপুকুর বাসী , ভগবানের অতি মনোহর রূপ দেখে আনন্দে নিজেকে মহাভাগ্যবান মনে করলো।

ক্ষুদিরামের পর্ণকুটিরে

এসেছে প্রেমের ঠাকুর,

ধন্য হইল জগত বাসী

ধন্য কামারপুকুর।

দানিলো অভয়, দিলে বরাভয়,

কহিল সকলে মাভৈঃ মাভৈঃ

পাপী তাপী জন লইল শরণ ,শঙ্কা হইল দূর ।

বিশ্বের ধাতা তুমি যে বিধাতা ,

করেছ সৃজন পালন ।

তরাইলে জীবে, আসিলে এভাবে ,

তুমি চির সনাতন।।

সবার ধর্ম আপনি আচরি

ভেদাভেদহীন দেখালে শ্রীহরি।

জয় রামকৃষ্ণ , শ্রীরামকৃষ্ণ

বন্দিত সুরাসুর ।।

 ঠাকুরের বাড়ির পাশেই আমাদের বাড়ী । আমার বাবার দাদু কবিরাজ শ্রীনাথ সেন। (কথামৃতে, ঠাকুরের ভাষায় ছিনাত হাতুড়ে)

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব, ছোটোবেলায় মাঝে মাঝেই শ্রীনাথ সেনের কাছে আসতেন । এমনকি দক্ষিনেশ্বর থেকে তিনি যখন কামারপুকুরে আসতেন তখনো শ্রীনাথের কাছে আসতেন। অনেকক্ষণ ধরে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ করতেন —তারপর অনেক রোগী বসে আছে দেখে , বলতেন – “তোমার অনেক ক্ষতি করে দিলাম গো “! শ্রীনাথ সেন সেকথা শুনে বলতেন – “না গো, তুমি এলে আমার খুব ভালো লাগে । (এই কথাগুলি আমাদের পরিবারের কেউ জানতো না ! গুরুজী অর্থাৎ স্বামী পরমানন্দজীর কাছে আমরা শুনেছিলাম।)