[১৯৮৬-সালে কুম্ভমেলায় ঘোরার সময় কোটি মানুষের ভিড়ের মধ্যে পরম প্রেমময় , আনন্দময় গুরুজী – কৃপা করে দর্শন দিয়েছেন এবং কয়েক দিন ধরে গুরুজী সঙ্গ সুধা লাভ হয়েছে । আমাদের বৃন্দাবন-মথুরা যাবার কথা থাকলেও গুরুজীর নির্দেশে– আমরা দিল্লির পথে পাড়ি দিলাম।]

( পূর্বের প্রকাশিতর পর)

   পরের দিন এগারোটার সময় দিল্লি পৌঁছালাম। দিল্লি স্টেশন থেকে অটো করে শাকারপুরে ত্যাগীজীর বাড়ি পৌঁছালাম । দরজায় কলিং বেল টিপে কোনো সাড়া না পাওয়ায়, প্রথমটায় একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম  । ভুল জায়গায় এলাম না তো ? যদি দরজা না খোলে – তাহলে যাবো কোথায় ? অবশেষে কিছুক্ষণ পর দরজা খোলার আওয়াজ পেতে - মনে স্বস্তি পেলাম । দরজা খুলে গৃহস্বামী আমাদের দিকে তাকাতেই, আমি তাঁকে বললাম– "হরিদ্বার কুম্ভমেলা থেকে আসছি, গুরুজী আমাদের পাঠিয়েছেন।" একথা শোনামাত্রই উনি– " আরে আসুন- আসুন!" বলে দুই হাত নিচু করে সামনের দিকে ঝুঁকে একতলার দরজার কাছ থেকে দু-তলার একটা ঘরের সোফায় নিয়ে গিয়ে বসালেন ।

  ছোটোবেলায়  যাত্রাপালাতে দেখেছিলাম_ রাজাকে যেমন অমাত্যবর্গ বা ভৃত্যরা  যেভাবে সম্মান দেখিয়ে নিয়ে যায়  – ঠিক সেইভাবে উনি আমাদের নিয়ে গিয়ে সোফাতে বসালেন !

একজন বয়স্ক এবং সম্মানীয় মানুষের এইরূপ আত্যন্তিক বিনয় প্রকাশে আমরা খুব ই লজ্জিত হচ্ছিলাম ।

    এরপর শুরু হলো পরিচয় পর্ব ! গুরু মহারাজের সন্তান এটা তো উনি বুঝেই ফেলেছিলেন, তারপর 'কামারপুকুরে আমাদের বাড়ি'-- এই পরিচয় জানতে পেরে__উনি আমার বন্ধু দিলীপ(যে সোফার সামনের দিকে বসে ছিল)-এর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন । এরপরে আমার দিকেও ওনাকে আগিয়ে আসতে দেখে — আমি সাথে সাথে সোফা থেকে উঠে  ওনার হাত দুটো ধরে নিয়ে ওনাকে নিরস্ত করেছিলাম ।

  প্রাথমিক পরিচয় পর্ব ও কুশল বিনিময় শেষ হোতেই, আমি গুরুজীর লেখা চিঠিটা ওনার হাতে দিয়েছিলাম ! দেখলাম সেটি হাতে পাওয়া মাত্রই ত্যাগীজী আগে একবার খামটি মাথায় ঠকিয়ে নিলেন

_তারপর পাঠ করলেন।

    একজন মহাপন্ডিত ব্যক্তি হ‌ওয়া সত্ত্বেও_ ত্যাগীজীর ন্যায় এইরকম স্বাত্তিক , সহজ-সরল , শ্রদ্ধাবান , বিনয়ী ভক্ত-মানুষ খুবই কম দেখা যায়। ত্যাগীজীর ছেলে শৈলেন (বাবলু) কাছেই শুনেছিলাম —গুরুজী ত্যাগীজীর বাড়িতে ১৯৭৮ সালে প্রথম এসেছিলেন । তারপর থেকে গুরুজী দিল্লি এলেই – ত্যাগীজীর বাড়িতে একবার আসতেন‌ই ! এই বাড়িতে গুরুজী বহুবার অবস্থান করেছেন ।

     পরের দিন সন্ধ্যার আগে গুরুজী – ত্যাগীজীর বাড়িতে এলেন । ঐদিন রাত্রি আটটার সময় গুরুজীর অন্য এক ভক্তের আমন্ত্রণে গুরুজীর সাথে আমি আর দিলীপ তাঁর বাড়িতে খেতে গেলাম। রুটি , আচার আর একটা আঙ্গুলের ডগায় যতটুকু ওঠে, ততটুকু আলুর তরকারি এবং তার সঙ্গে ছোট্ট এক চামচ টক দই এক গ্লাস জলে গুললে যেমনটা হয়_তেমন দ‌ই ! যিনি নিমন্ত্রন করেছিলেন, উনি নিজেও আমাদের সাথেই অতীব আনন্দচিত্তে, অত্যন্ত খুশি মনে খাচ্ছিলেন।  কিন্তু গুরুজীর মতো মানুষকে নিমন্ত্রণ করে এইরকম নিম্নমানের খাবার খেতে দেওয়ায় আমি ঠিক ততটাই কষ্ট পাচ্ছিলাম !  আর সত্যিটা হলো এই যে – এই ধরনের খাবার খাওয়া আমাদের মতো বাঙালিদের কাছে খুবই কষ্টের !

কোনরকমে সেই ভক্তের বাড়ির খাবার খেয়ে, তাকে বিদায় জানিয়ে ত্যাগীজীর বাড়িতে যখন ফিরলাম ।  তখন দেখলাম ত্যাগীজীর ঘরভর্তি দিল্লি্র সব ভক্তরা  উপস্থিত হয়ে গেছে। ঘরের ভিতরে একটি খাট পাতা ছিল__ গুরুজী সেই খাটে বসলেন , আমরা খাটের নিচে বসলাম। উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে কয়েকজন আমাকে খাটে গুরুজীর পাশে বসার জন্য অনুরোধ করতে লাগল__ আমি কিন্তু খাটের নিচেই বসে রইলাম ! আমার অস্বস্তি এড়াতে গুরুজী ওনাদেরকে বললেন –"এটাই ভারতীয় পরম্পরা , গুরুর সমানে শিষ্যরা কখনোই বসবে না ।আর মৃণাল এটাই করছে।" উপস্থিত ভক্তরা, যারা মেঝেতে বসলেন, গুরুজী কিছুক্ষণ  তাদের সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। তারপর ভক্তদের জিজ্ঞাসা অনুসারী গুরুজী অনেকক্ষণ ধরে আধ্যাত্মিক আলোচনা করতে শুরু করে দিলেন। এইভাবে অনেকটা রাত্রি হয়ে গেলে উপস্থিত ভক্তরা সব একে একে নিজের নিজের বাড়ি চলে গেলেন । 

ঐ রুমের মধ্যে খাটের উপর গুরুজীর বিছানা হলো , মেঝেতে আমার আর দিলীপের বিছানা হলো । রাত্রিতে গুরুজীর সাথে একই ঘরে ঘুমালাম । পরমপ্রেমময় গুরুজী কৃপা করে সুযোগ করে না দিলে– এরকম অতীব সুখকর স্মৃতি জীবনে পেতাম না ! হয়তো আমার মতো আরো কোনো কোন ভক্ত গুরুজীর কৃপায় — এইরকম সুযোগ  পেয়েছে ।

  গুরুজী আগের রাতেই আমাকে বলেছিলেন – "সকালে আমি অন্য জায়গায় চলে যাব"। আমরা ঘুম থেকে উঠে দেখি – গুরুজী চলে গেছেন। সেদিন আর আমাদের সাথে গুরুজীর দেখাই হলো না ।

আমি আর দিলীপ আরো দু-চার দিন ওখানে থেকে গিয়েছিলাম। ত্যাগীজীর ছেলে শৈলেন (বাবলু)আমাদেরকে কয়েকদিন ধরে দিল্লির দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরে দেখিয়েছিল । একদিন ট্রাভেলার বাসে করে আমরা মথুরা-বৃন্দাবন-তাজমহল ঘুরলাম । ইতিমধ্যেই আমরা ফেরার confirm রিজার্ভেশন টিকিট পেয়ে যাওয়ায় পর কামারপুকুরে- অনেক সুখকর আনন্দময় স্মৃতি নিয়ে — ফিরে এলাম । স্বয়ং পরমেশ্বর গুরুজী কে এত আপন করে পাওয়ার আনন্দ সারা জীবন সুখ স্মৃতি হয়ে থাকবে।।