(গুরুজী হরিদ্বারের আদিগঙ্গার পূর্বপাড়ে মা চন্ডী দর্শন করেন, সেই ঘটনা সহ 1986 সালে কুম্ভ মেলায় গুরুজীর সাথে আমার দেখা হ‌ওয়া পর্যন্ত__ প্রসঙ্গ আগে উল্লেখ করা হয়েছিল। এখন তারপর থেকে…!)

 প্রেমময় পরমানন্দ আমাদের গুরুজী । তাঁর প্রেমের টানে ভক্তরা বনগ্রাম আশ্রমে, বেশিদিন না গিয়ে থাকতে পারতো না !  সিটিং-এর জায়গায় গিয়ে বসার কিছু ক্ষণপরেই গুরুজী, কুটিরের দক্ষিণ দিকে বারান্দায় ইজি চেয়ারে এসে বসলেন। সাথে সাথেই যেন চারিদিকে আনন্দের ঢেউ বইতে লাগলো । সেই

আনন্দের ঢেউয়ে আমাদের মন প্রাণ সিক্ত হয়ে_ আমরাও দিব্য আনন্দে আনন্দিত হোতে লাগলাম ।

গুরুজী তাঁর ছোটবেলার ঘটে যাওয়া ঘটনা (দিব্য লীলা ) গুলি বলছিলেন।

গুরুজীর কৃপায় আমরা ৭/৮ জন জবা গাছের তলায় চাটাইয়ের উপর বসে সেই পরমানন্দ রস উপভোগ করছিলাম।

 গুরুজীর তখন বয়স 9– 10 বছর হবে , পরনে একটা ময়লা হাফপ্যান্ট আর গায়ে একটা জামা সম্বল__এই অবস্থায় উনি একাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা যিনি , আজ ভিখারী শিব হয়ে তিনি পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন— !

পরমানন্দের লীলা পরমানন্দ ই বোঝেন–আমাদের মতো সাধারন জীবে কি বুঝবে ! পরবর্তী শরীরে উনি যখন আবার লীলা করতে আসবেন, তখন তিনি ই তা অনুভব করতে পারবেন_এবং তৎকালীন ভক্তদের কাছে ব্যাখা করবেন !

আমরা সাধারণ মানুষ যেন কীটাণু-কীট , আমরা তা্ঁর লীলা কি বুঝবো  – । তিনি দয়া করে যতটুকু তাঁর দিব্য লীলার সঙ্গী করেছেন বা কৃপা করে যতটুকু দিব্য আনন্দ দিয়েছেন__ ততটুকুই আমরা তাঁর সেই পারমার্থিক লীলার স্বাদ পেয়েছি – ।


  সেইদিন গুরুজী বলছিলেন— "জানিস, ঐসময় ঘুরতে ঘুরতে আমি হরিদ্বারে এসে পৌঁছেছিলাম। ওখানে বেশ কয়েকদিন কাটানোর পর আমি হরিদ্বার থেকে ঋষিকেশে এসেছিলাম । অতদুর পর্যন্ত সমতল ভূমি , এরপর উত্তরে যতদূর দৃষ্টি যায়, দেখা যাবে---শুধু হিমালয় পর্বতমালার চুড়া আর চূড়া  ! প্রকৃতপক্ষে  হিমালয়ের অসংখ্য চূড়া । হিমালয়ের মধ্যে দিয়ে পবিত্র খরস্রোতা গঙ্গা বইছে। হরিদ্বারের চেয়েও ঋষিকেশে গঙ্গার স্রোত অনেক বেশি ‌ ।

    ঋষিকেশে ঘোরার সময় একদিন একটি অদ্ভুত সাধুকে দেখলাম। কোন দর্শনার্থী তাঁর কাছে গেলে বলছিলেন__" আগে পয়সা দাও, তারপর দর্শন করো।" আমি ওনার একেবারে কাছে পৌঁছে, ওনার দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম__ উনি একজন মহাত্মা। কিন্তূ  –'একজন মহাত্মা হ‌ওয়া সত্বেও উনি দর্শনার্থীদের কাছ থেকে পয়সা চাইছেন কেন ?'  তাই ওনাকে একটু দূর থেকে লক্ষ্য করতে শুরু করলাম । দেখলাম সারাদিনের পরে__ রাত্রিতে উনি ঐ সমস্ত পাওনা পয়সা__ গঙ্গার জলে ফেলে দিচ্ছেন।

  রাত্রিতে ওনাকে কিছু না বলে , পরের দিন ওই সাধুকে গিয়ে বললাম  –" ভগবন, আপনি রাত্রিতে গিয়ে সব পয়সা গঙ্গার জলে ফেলে দেন  ,তাহলে আপনি দর্শনার্থীদের কাছে পয়সা চান কেন "?  সাধুটি আমায় বললেন -  "তুমি এইসব দেখে ফেলেছ নাকি !  এর আগে কেউ দেখেনি । সবাই জানে যে সাধুকে দর্শন  করলে পয়সা দিতে হবে _ ফলে দর্শনার্থী কম হয় । আর আমি শান্তিতে বিরাজ করতে পারি । বেশি দর্শনার্থী হোলে এরকম শান্তিতে বিরাজ করতে পারতাম না।"

  আধ্যাত্মিক জগত এক বিচিত্র জগত ! কত মহাত্মা_ কত ভাবে থাকেন, তা ক'জন‌ই বা জানতে পারে ।

 শত সহস্র সাধকের মধ্যে কেউ কেউ হয় জ্ঞানী  । হাজার হাজার জ্ঞানীর মধ্যে একজন হয় যোগী। হাজার হাজার যোগীর মধ্যে একজন হয় ভক্ত ! হাজার হাজার ভক্তের মধ্যে একজন  হয় প্রেমী !!

আমি যে ছোটোবেলা থেকে, পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছি– এই প্রেম অন্বেষণের জন্য‌ই ! আমার উদ্দেশ্য ছিল_ এইরকম প্রেমী সাধুর সঙ্গ করা এবং প্রেম-আস্বাদন করা!!

এরপর ওখান থেকে বেরিয়ে, হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরছি , ঘুরতে ঘুরতে একটা জায়গায় দেখলাম খাবার বিলি হচ্ছে । আমার তখন দুদিন কোনো খাবার জোটে নি। অনেকে খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিচ্ছিলো। আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম । প্রচন্ড খিদের জ্বালা অনুভব করছিলাম, তাই খাবার পাওয়া মাত্রই খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম এবং কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আবার লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিলো_ বোধহয় পেট এখনো ভরেনি ! তাই দ্বিতীয়বার লাইন দিয়ে খাবার নিয়ে, সেগুলিকেও খেয়ে ফেললাম। এরপর তৃতীয়বার লাইন দিলাম, কারণ দু'বার খাওয়া সত্ত্বেও তখনও আমার পেট ভরেনি ! তাই তৃতীয়বার খাবার নিয়ে বসে আয়েশ করে খেতে যাচ্ছি__এমন সময় একটা লেংটা যুবক সাধু এসে আমার খাবারটা হাত থেকে টেনে নিয়ে ফেলে দিয়ে বলল ·–"শালে বহুৎ ভুখা হ্যায়  — চল শালে !" বলে হাত ধরে টানতে টানতে কিছুদূরে এক বয়স্ক বিশাল চেহারার নাগা সন্ন্যাসীর কাছে_আমাকে নিয়ে গেল। উনি ধুনো জ্বালিয়ে বসেছিলেন, আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে__ তাঁর যুবক নাগা সন্ন্যাসী-শিষ্যকে

আমাকে পেট ভরে খাওয়ানোর জন্য বললেন।

 উনি আমাকে কাজু, কিসমিস, পোস্ত, আখরোট দুহাত ভরে দিলেন। খাবার পর যুবক নাগা সন্ন্যাসী আমার কাঁধের কম্বল, কৌপিন এবং একটি ভিক্ষার পাত্র আমার কাছ থেকে নিয়ে ধূনির আগুনে সব ফেলে দিয়ে বললেন__ "এইগুলির জন্য তুমি ঈশ্বরের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর ছিলে না। এখন তুমি সম্পূর্ণ ঈশ্বরের

উপর নির্ভরশীল!” ম

নে মনে ভাবলাম,_ মা জগদম্বার যা ইচ্ছা তাই হচ্ছে ।”[ক্রমশঃ]

₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹₹_