( পূর্বের প্রকাশিত পর)
[অনন্ত প্রেম স্বরূপ আনন্দময়, প্রেমময় পরমানন্দজী, আমাদের গুরুজী, তাঁর কুঠীয়ার দক্ষিণ দিকে বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে — তাঁর ছোটবেলার – সুদীর্ঘ হিমালয় ভ্রমণের কথা বলছিলেন । আর আমাদের মত কিছু ভাগ্যবান শ্রোতা, তা শুনে –দিব্য আনন্দ উপভোগ করছিল । গুরুজী বলছিলেন যে, দুজন নাঙ্গা যোগীর সাথে হিমালয়ের বিভিন্ন স্থান ঘুরে এবং বহু মনীষীর সঙ্গ লাভ করে ওনারা যেখান থেকে কৈলাস মানস সরোবর যাত্রা শুরু করেছিলেন সেখানে ঘুমা ছিলেন ….]
......জানিস, তারপর রাত্রিতে আমরা সবাই মিলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার সাথে থাকা দুই নাঙ্গা সন্ন্যাসী নেই।
শিব-স্বরূপ ঐ দুই সন্ন্যাসী আমার অনেক দিনের সাথী ছিলেন। নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও গেছে_ এই ভেবে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর – আশেপাশে চারিদিকে খুঁজতে লাগলাম।
বেশ কিছুক্ষণ ওই দুই নাঙ্গা সাধুদের খুঁজে না পেয়ে আমার মনে ওদের জন্য তীব্র বেদনা শুরু হলো । মন-প্রাণ অস্থির হয়ে গেল । ওদের যে করেই হোক খুঁজে বার করতে হবে। তাই আবার হিমালয়ের দিকে যাত্রা করলাম।
সেখানে পাহাড়ের পর পাহাড় অতিক্রম করে, বহু চড়াই-উতরাই পাড় হয়ে, খাওয়া দাওয়া ভুলে গিয়ে__ দিনের-পর-দিন মাসের-পর-মাস খোঁজ করে চলেছিলাম কিন্তু আর তাঁদের দেখা পাই নি।
চলতে চলতে পর্বতের অনেক উচ্চতায় এক যোগী সাধুর সাথে আমার দেখা হলো । আমাকে দেখে সাধুটি কাছে ডেকে বসিয়ে বললেন_ "তোমার তো খুব খিদে পেয়েছে , কিছু খাবে ?" আমি "হ্যাঁ" - বলাতে তিনি প্রথমে দুধ পান করালেন , তারপর "আমার কি মিষ্টি পছন্দ"? জিজ্ঞাসা করলেন ।
জানিস_ আমি মনে মনে ভাবলাম – সন্দেশ, রসগোল্লা বাঙালির পছন্দ সবাই জানে । আমি তাই বললাম “ল্যাংচা খাব” !
এই কথা শোনার পর উনি একটু ইতস্তত করছিলেন ,তারপর হাতে কিছুটা মাটি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দেখলাম সেটি ল্যাংচায় পরিণত হলো। আমার হাতে দিতেই খেয়ে দেখলাম –মিষ্টি নেই। তাই ফেরত দিয়ে বললাম– “মিষ্টি নেই তো!” তিনি আবার ঐ ল্যাংচা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন –তারপর আমাকে খাবার জন্যে দিলেন । খেয়ে দেখলাম মিষ্টি এবং তা খুবই সুস্বাদু !!
এবার ওনার কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসার উদ্যোগ নিচ্ছি এমন সময়ে সাধুটি আমায় বললেন –" শিখতে ইচ্ছা হয়না__এসব কেমন করে করলাম !" আমি বললাম _"না , এ বিদ্যা শিক্ষা করে কি ঈশ্বর দর্শন হবে ?" উনি বললেন _ "না, তা হবে না।" তখন আমি বললাম _"যে বিদ্যায় ঈশ্বরের বোধ হয় না, সেই বিদ্যা আমার দরকার নেই!" _ এইকথা বলে আমি ওখান থেকে চলে গেলাম ।
আসলে এই সাধু একজন সূর্য বিজ্ঞানী ছিলেন। সূর্য বিজ্ঞান হলো Energy (শক্তি) থেকে সরাসরি Matter (পদার্থ) বানাবার বিজ্ঞান। একটি এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে রুপান্তর করার বিজ্ঞান ।
চলতে চলতে আবার এক সাধুর সাথে দেখা হলো । তিনি সবসময় খুবই গালিগালাজ করেন । আমি ওনার কাছে যেতে আমাকেও কয়েকটা গালি দিলেন। ওনার দিকে ভালো করে কিছুক্ষণ তাকাতেই দেখলাম_ উনি একজন মহাত্মা । ওনাকে জিজ্ঞাসা করলাম - "ভগবন!_ কি করে ঈশ্বর লাভ হয় ?" উনি বললেন – "হাওয়াইয়ের কোথায় আগুন দেয় ? রকেটের কোথায় দেয় ? হনুমান কোথায় দিয়েছিল ?
পিছনে বা ল্যাজে তাই না ?
পিছনে আগুন দে– । মূলাধারে আগুন লাগা । মূল ছেড়ে – সহস্রারে কেমন করে যাবি ?”
ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার হিমালয়ের পথে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলছি । চলতে চলতে দেখা হলো *ব্রজোযোগিনীদের* একটা দলের সাথে । ওদের দলে আমাকে নেবার পূর্বে– ওদের আচার্য আমার শরীরের চিহ্ন দেখে বললেন– দেহের চিহ্ন একশ ভাগ মিলে গেছে । এবার তিনি আমায় জিজ্ঞাসা করলেন – "কোথা থেকে এসেছো ? কি নাম " ?
আমি মৌন থাকায় আচার্য খুশি হয়ে বললেন – “বাঃ! এটিই(মৌনতা) হলো যথার্থ উত্তর “।
আরো কিছু কথা হলো। তারপর ওদের দলের সাথে বেশ কিছুদিন কাটালাম ।
চলতে চলতে দিনের বেলায় বনে জঙ্গলে কিভাবে চলতে হয় , বিভিন্ন পশু পাখির হাত থেকে – কিভাবে
রক্ষা পাওয়া যায় , আলোচনা করতেন। সন্ধ্যা হলেই সবাই এক জায়গায় বিশ্রাম নিতাম । ওই সময়ে আচার্য আধ্যাত্মিক আলোচনা করতেন ।
পাহাড়ের উপর চলতে চলতে ওই পাহাড়েরই উপরদিকে একটী রাস্তা চলে গেছে । ওই রাস্তা দিয়ে কিছুটা ওঠার পর দেখলাম লেখা আছে "উপর উঠ্না মানা হ্যায়" ।
তবুও আমি পাহাড়ের ওপরে উঠতে লাগলাম । অবশেষে কাঁটা জঙ্গল সরিয়ে – , পাহাড়ের উপরে একটি গুহার মধ্যে , ধুনি জ্বালিয়ে – গভীর ধ্যানে মগ্ন , একটি সাধুকে দেখলাম।
আমি কয়েকবার “ভগবন্–ভগবন্” বলে ডাকলাম । কিন্তু কোন সারা পেলাম না ।পাথর ঠুকে ঠুকে আওয়াজ করাতে উনি আমার দিকে তাকিয়ে রেগে গিয়ে বললেন “দেখা নাহি নিচে কেয়া লেখা হ্যায় “? আমি বললাম_ “দেখা” ।
উনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন__”তুম কাঁহা সে আয়া ?” “ভগবন ,– ঐ হি পুছনে তো আয়া হুঁ” – আমি বললাম।
এই কথা শোনার পর উনি খুবই প্রসন্ন হলেন । আমাকে প্রেম সে ডাকলেন– “বাচ্চো , ইধার আও , মেরে পাস বৈঠ “।
উনি আমাকে ধুনির কাছে বসালেন এবং খাবার খেতে দিলেন ।
খাবার পর , গুহার ভিতরে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
দেখলাম –সাধুটি সারারাত ধুনি জ্বালিয়ে ধ্যান করছেন । সকালে ওনার কাছে বিদায় নিয়ে আবার পথ চলা শুরু করলাম ।
(ক্রমশঃ)