বনগ্রাম যাবার আহ্বান — মনের মধ্যে সর্বদা আলোড়ন হতে রইল ,
কি অদ্ভুত একটা তীব্র আকর্ষণ অনুভব করছিলাম !
ঠিক যেন কুঠী বাড়ীর ছাদে উঠে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ডাকে —এবং তার তীব্র আকর্ষণে , ত্যাগী এবং শুদ্ধসত্ত্ব গৃহী ভক্তরা ঠাকুরের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছিল।
সচ্চিদানন্দ ভগবানের আহ্বানে তাঁর সৃষ্ট জীবেরা কি না যেয়ে থাকতে পারে – ?
তাই একদিন সকালে বাসে করে কামারপুকুর থেকে আরামবাগ এবং আরামবাগ থেকে বাসে করে বর্ধমান গেলাম। বর্ধমান থেকে কালনাগামী বাসে চেপে কন্ডাকটারকে ভাড়া দেবার সময় বললাম_ “আমাকে ‘বনগ্রামে’ নামিয়ে দেবেন”। যথারীতি হাটগোবিন্দপুর পার হয়ে কিছু দুরে গিয়ে ‘বনগ্রাম’ নামে একটা জায়গায় কালীমন্দিরের নিকটে সে আমাকে নামিয়ে দিলো। সেখানকার মা কালীকে প্রণাম করে পূজারীকে জিজ্ঞাসা করলাম_ “এখানে পরমানন্দজীর আশ্রমটা কোথায়” ? ওনার নির্দেশমতো কিছুটা বর্ধমানের দিকে হেঁটে এসে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করার পর –এক বৈষ্ণব গুরুর বাড়িতে এলাম। তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে , তাদের বাড়িতে অনেক লোকজন এসেছে। আমার মতো একজন অপরিচিতকে হটাৎ করে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেখে বৈষ্ণব-গুরু সাধনদাস বৈরাগ্য জিজ্ঞাসা করলেন_ “কিছু বলবেন ? আমি বললাম _”আমি বনগ্রামে পরমানন্দজীর আশ্রমে যাবো” । উনি বললেন “এখান থেকে বাস ধরে জাবুইডাঙ্গায় নামতে হবে । তারপর ওখান থেকে বাঁদিকে বেশ কিছুটা হেঁটে যেতে হবে । এই জায়গাটাও বনগ্রাম, আর আমারও একটা আশ্রম রয়েছে। তাই ওইখানে যাবার সময় অনেকেই ভুল করে আমার কাছে চলে আসে। যাই হোক _ এখন
দুপুর হয়ে গেছে, এখানে খাওয়া-দাওয়া করে_ তারপরে যেও।”
অচেনা-অজানা রাস্তা ধরে বনগ্রাম আশ্রমে যেতে হবে, যেতে কতোটা সময় লাগবে_তার ঠিক নাই ! ওখানে খেতে রাজি হ’লাম না। তবু ওনাদের আন্তরিক অনুরোধে কিছু খেতেই হয়েছিল! উনার স্ত্রীএকটা প্লেটে অনেকটা মিষ্টি এবং এক গ্লাস জল নিয়ে এসে বললেন—” ঠাকুরের প্রসাদ খেয়ে নাও”। সেই প্রসাদ ও জল খেয়ে বাস ধরার উদ্দেশ্যে পিচ রাস্তায় এলাম। অল্প সময়ের আলাপেই ঐ বৈষ্ণব-বাবাজীর এবং ওনার স্ত্রীর মিষ্টি ব্যবহার আমার খুবই ভালো লেগেছিল।
যাইহোক, কিছুক্ষণ পরে জাবুইডাঙ্গায় নামলাম । জাবুইডাঙ্গায় নেমে বাঁদিকে পিচ রাস্তা ধরে বনগ্রামের দিকে হেঁটে চলেছি ! চলেছি তো চলেছিই ! এতো রাস্তা হাঁটার তো অভ্যাস নেই। অবশেষে ভান্ডুল মোড়ে এসে পৌঁছালাম। এবার ভান্ডুল মোড় থেকে ডানদিকে মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম ! হাঁটতে হাঁটতে আশ্রমে ঢুকতে প্রায় বিকাল আড়াইটা হয়ে গেল ! আশ্রমটির চারিদিকেই মাঠ , একদমই ফাঁকা জায়গা , খেলার মাঠের ডানদিকে একটি অপেক্ষাকৃত পুকুর এবং বাঁদিকে ছোটো একটা পুকুর। মাঝামাঝি জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটা প্রাচীন বটগাছ । আশ্রমে পৌঁছেই দেখলাম__ বটগাছের তলায় স্বামী পরমানন্দজী বসে আছেন ।
ওনার আশেপাশে বেশ কয়েকজন বসে ছিল । আমি গিয়েই ওনাকে প্রণাম করলাম । উনি আমায় বললেন – “এত দেরি হল “? আমি পথে বিভ্রাটের ঘটনাটা ওনাকে বিস্তারিত বললাম। আমার সবকথা শুনে উনি বললেন‘হ্যাঁ, ওখানেও একটা বনগ্রাম আছে । অনেকেই এইরকম ভুল করে “। তারপর উনি আমাকে বললেন“তোমার তো এখনো খাওয়া-দাওয়া হয়নি” ! তারপর ছোট্ট একটা কুটিয়ার দিকে হাত দেখিয়ে বললেন–”আগে ওখানে গিয়ে খেয়ে আসো” ।
পাশাপাশি দুটি মাটির ছোট্ট ছোট্ট ঘর । মাঝে একটি কল ,বাঁদিকে পেছনে একতলা ছোট্ট একটা পাকা বাড়ি। প্রথম কুটিয়াটিতে রান্না ও খাওয়া হয় । ওইখানেই ভাত খেলাম । মুরারি (নিষ্কামানন্দ) মহারাজ খেতে দিলেন। এতো স্নেহভরে খেতে দিলেন , যেন মনে হচ্ছিলো বাড়িতে মায়ের হাতে খাচ্ছি ! উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথা থেকে আসছো ? কি নাম তোমার?” প্রাথমিকভাবে আলাপ হয়ে যাবার পর, উনিই আমাকে বললেন _ পাশের ঘরটি গুরু মহারাজের অর্থাৎ স্বামী পরমানন্দজীর ঘর “। দেখলাম ঘরের সামনেটায় কয়েকটা জবা ফুলের গাছ, আর একটু ফাঁকা জায়গা । তারপর উঁচু পুকুরের পাড় , জংলি গাছে ভর্তি । ঘড়িতে তখন তিনটে বেজে গেছে। পুনরায় বটতলায় মহারাজের কাছে এলাম। উনি বললেন _”আজ থাকবে তো” ? আমি বললাম, “থাকবো না, আজ ই ফিরবো।”
উনি বললেন_” তাহলে এখনি বেরিয়ে পড়তে হবে, কামারপুকুরের রাস্তা তো অনেক দূর !”
আমি আবার ওনাকে প্রণাম করলাম। মহারাজ বললেন “বাস ভাড়ার টাকা দেবো?” আমি বললাম “না-না ! আমার কাছে ভাড়ার টাকা আছে।”
ওনাকে আপত্তি বলে – পুনরায় হাঁটতে শুরু করলাম। জাবুইডাঙ্গায় এসে পুনরায় বাসে চাপলাম ! বর্ধমানের দিকে যাচ্ছি__ যেতে যেতে চোখের সামনে ভাসছে বটগাছের তলায় মহারাজের প্রেমময় , আনন্দময় মুখটি, আর মুখে সদা_হাস্য ! মাথার চুল কৃষ্ণের মতো ঘাড় পর্যন্ত। সেই সময় ওনার ছিল হালকা গোঁফ , ছোট ছোট দাড়ি__ মনে হচ্ছিলো, এই সবে ওনার দাড়ি গজিয়েছে ! এতো সুন্দর- এতো মিষ্টি লাগছিলো যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না ! হৃদয়-মন জুড়ে আনন্দে ভরে আছি , কখন যে বর্ধমান বা বর্ধমান থেকে আরামবাগ এসে পৌঁছেছি__ জানতেই পারিনি !
ওনার কি অমোঘ আকর্ষণ– ছেড়ে আসতে ইচ্ছা করছিল না।
এই ব্যাপারটা মনে হয় না শুধু আমার একার। যারা গুরুজীর(স্বামী পরমানন্দ জী) কাছে গিয়েছে এবং কিছুক্ষণ গুরুজীর সাথে সময় কাটিয়েছে—। আমার মনে হয় তাদের প্রত্যেকেরেই এই উপলব্ধি হয়েছে।
বাড়িতে বলেছিলাম, আজই ফিরবো_সেই কথা রাখতেই চলে এসেছিলাম।
গুরুজীর সঙ্গ–মানে হৃদয়ে দিব্য আনন্দের তীব্র স্রোত !!
এর বিয়োগব্যথা– মন তা মানতে চাইছিল না !!
ক্রমশ -- --