পরমপ্রেমময় গুরুজীর উপস্থিতিতেই যেন সারা প্রকৃতি আনন্দে ভরে উঠেছিলো, মনে হচ্ছিলো আমরা উপস্থিত কয়েকজন ভক্তরা কোন ছাড় – সারা প্রকৃতি যেন সেই আনন্দের স্বাদে মগ্ন। গুরুজী যখন ইজি চেয়ারে বসে হাস্যময় মুখে আমাদের দিকে তাকালেন , তখন যেন প্রেম ঝরে ঝরে পড়ছিল ! সেই প্রেমের টানেই তো আমাদের মতো ভক্তদের বারবার বনগ্রামে আসা । পরবর্তীতে শুধু আমরা উপস্থিত ভক্তরা নয় – গুরুজীর প্রেমের টানে হাজার হাজার মানুষ শুধু সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ থেকেই নয়, সারা ভারতবর্ষ এবং সারা পৃথিবী থেকে এসে হাজির হয়েছিল ।

  সেদিনকার সিটিং-এ গুরুজী বলছিলেন -- "জানিস , বেনারসে (কাশীতে) এক উড়িয়া বাবার সাথে দেখা হয়েছিল । তাঁর কাছে আমি গেলেই –  তিনি ভালোবেসে লাড্ডু দিতেন । আমার সাথে দেখা হবার পর থেকে তিনি আমায় খুব ভালবাসতেন । আমাকে আদর করে বলতেন "প্রহ্লাদ-- আও,  ইহা বৈঠো "। উনি জ্ঞানী ও প্রেমী সাধু ছিলেন ।

   আর একবার ঐ কাশীতেই ঘুরতে ঘুরতে উন্মাদ গোছের এক সাধুর সঙ্গে দেখা হলো। দেখি রাস্তায় কাগজ দেখলেই কুড়িয়ে কাগজটি পড়ে বগলে রেখে দিচ্ছিলো ।ঐরকম সবসময় বগলে কাগজ নিয়ে ঘোরার জন্য লোকে তাকে "ক্ষ্যাপা" ভাবতো । একদিন অন্য একজন সাধু, এই সাধুটির ময়লা কাগজ কুড়ানো দেখে বললেন -" কি ক্ষ্যাপামি করছেন "? শুনে (খ্যাপা-বেশি ) সাধুটি রেগে গিয়ে বললেন - "আমি ক্ষ্যাপা ? তুই খ্যাপা , তুই পাগল" ! একথা বলেই একটা কাগজ খুলে তাঁর সামনে ধরে বললেন__" দেখো, এতে তোমার জীবন লেখা রয়েছে ! দ্বিতীয় সাধুটি অবাক হয়ে দেখলো __সেই কাগজের মধ্যে তার নাম , ধাম এবং জীবনের বহু ঘটনা লেখা রয়েছে !

 সেদিন ঐ সাধুটি সহ সকলেই বুঝলো_ এ ক্ষ্যাপা নয়, ক্ষ্যাপার বেশে একজন বড় মহাত্মা । তাই দ্বিতীয় সাধুটি তৎক্ষণাৎ প্রথম সাধুর কাছে প্রণাম করে ক্ষমা চেয়ে নিল ।

সাধারণ মানুষের আর কি দোষ__তারা প্রকৃত সাধুকে চিনবেই বা কি করে ? বিভিন্ন মহাত্মা বিভিন্নভাবে থাকেন, যাতে সাধারণ মানুষ তাঁকে বিরক্ত না করে !

গুরু মহারাজ বলতে লাগলেন__" তারপর কাশীতে ঘুরতে ঘুরতে একদিন একটি সাধুর সাথে দেখা হোলো । আমাকে নিয়ে গঙ্গার পাড় ধরে যেতে যেতে হঠাৎ করে তিনি বললেন__' মাংস রুটি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে ' । আমি বললাম_ 'পয়সা কোথায়?'  সে কথা শুনে লোকে যেমন অভিনয় করে বলে–তেমনি সাধুটি উপরের দিকে চেয়ে বলল - "মা ,  রুটি মাংস দে- না , দু ভায়ে মিলে খাবো" । কি আশ্চর্য ! কিছু পরেই একজন রুটি-মাংস নিয়ে সাধুটিকে দিয়ে গেল ! আর আমরা দুজনে মায়ের প্রসাদ জ্ঞানে সেগুলি খেয়ে নিলাম।

  এরপরে ঘুরতে ঘুরতে এলাহাবাদে একদল অঘোরপন্থী সাধুদের সাথে দেখা হল । তাদের প্রেমপূর্ণ আচরণে মুগ্ধ হয়ে তাদের ডেরায় বেশ কয়েকদিন থাকলাম । অঘোরপন্থী তান্ত্রিক সাধুদের মোহান্ত আমায় বলল __'আজ রাতে মহাতন্ত্রের চক্র বসবে'। গভীর রাতে সেই মহাতন্ত্রের চক্র বসল । মহাতন্ত্রের চক্রের নিয়ম অনুসারে গোল করে সবাই বসলাম। চক্রের মাঝে রাখা রয়েছে মরা যুবকের ঝলসানো শরীর আর কারণবারি । এরপর সকলকে কারণ বাড়ি এবং ঝলসানো ওই মাংস দেওয়া হচ্ছিলো। আমার ভাগে ঝলসানো মরার হাতের পাঞ্জাটি পড়লো।  ওদের কাছে নর মাংসের হাতের পাঞ্জা টি খুবই সুস্বাদু, কিন্তু

আমি তো এইসব খাই না। আর খাবোই বা কি করে বল — ? কিন্তু ওখানে , – চক্রে বসে, খাবো না বললে চলবে না ! আবার চক্র ছেড়ে উঠে চলে যাওয়াও যাবে না। তাহলে তান্ত্রিকরা রেগে গিয়ে কোনো বিপত্তি ঘটাবে ! কি করা যায় ভাবছি। এমন সময় মা জগদম্বার ইচ্ছায় , পাশে বসে থাকা তান্ত্রিক সাধুটি , আমার অবস্থা বুঝে নিয়ে – আমার কাছ থেকে ঝলসানো হাতের পাঞ্জাটি নিয়ে নিলেন ।

    একটু পরেই আরতি শুরু হোলো কেউ শিঙ্গা বাজাচ্ছে, কেউ বাঁশি, কেউ কাঁসী, কেউ দামামা বাজাচ্ছে __ সবাই তখন উন্মত্ত এবং খুব নাচানাচি হচ্ছে ! এদের মধ্যে দেখেছিলাম__ দুই এক জন গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিল। এসব দেখেও তবু মনে হলো — এরা ভগবান শঙ্করের প্রীতির জন্যই এইসব করছে ‌। এই অবস্থায ওদের অগোচরে  ওখান থেকে চলে গেলাম "।

   পরমেশ্বর পরমানন্দ রবীন রূপে পথের বহু কষ্ট সহ্য করে , অনাহারে থেকেও – তাঁকে যারা যেভাবে ডেকেছে , তিনি তাদের কাছে গিয়ে তাদের অজ্ঞাতেই – তাদের কৃপা করছেন।

ঈশ্বরের লীলা বুঝা ভার । বোধিব্যক্তি ছাড়া – তাঁর লীলা কে-ই বা বুঝবে ?

   গুরু মহারাজ আবার বলতে শুরু করলেন___ "কখনো ট্রেনে, কখনো পায়ে হেঁটে ঘুরতে ঘুরতে আজমিরে এসে পৌঁছেছিলাম ।

জনিস ওখানে একজন ফকিরকে দেখেছিলাম, যিনি দিনের পর দিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলতেন— ‘আল্লাহ্ এক রুটি দো ‘ । একদিন এক একটি লোক সামনের দোকানিকে দেখে বলে -‘আহা! ওকে একটা রুটি দাও’ । শুনে দোকানি বলেছিল — ‘এমন কাজ করবেন না। দিতে গেলে গালি দিয়ে বলবে_ ‘শালা, তেরা পাস মাঙ্গা হে কেয়া ‘? অর্থাৎ উনি নিজের জন্য নয় , সাধারণ মানুষ যাতে রুটি পায় তার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। আমি সারারাত এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম ! একরাতে দেখি ঐ ফকিরবাবা শান্ত হয়ে এক জায়গায় বসে রয়েছে । আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে বললাম “কেয়া_ নিদ নাহি আতি” ? তিনি বললেন “উনহোনে নিদ্ চুরা লিয়া ! লেকিন তু ভি তো নাহি শোয়া!” আমি বললাম মেরা ভি ওহি হাল্ হ্যায়” । ফকিরটি বলল “আল্লাহ্ কখন যে আসবেন__তা কেউ জানেনা ! আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি, তখন যদি আসেন – তাহলে তো আর আমার দর্শন ( বোধ)হবে না !’

   স্বয়ং ঈশ্বর রবীন-রূপে মানুষের শরীরে তার কাছে গেছেন - কিন্তু সেই ফকির বাবা তাঁকে চিনতে পারেন নি ।

বনগ্রামে – একবার গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যার সময় গুরুজী আর আমি মাঠে ঘুরছিলাম ! বাতাসে গুরুজীর পাঞ্জাবি আমার গায়ে মাঝে মাঝে লাগছিল । হটাৎ আমি গুরুজীকে জিজ্ঞাসা করলাম–”ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ 100 বছর পর বর্ধমানের উত্তরে জন্ম নেবো বলেছিলেন”…! আমার কথা শেষ হবার আগেই গুরুজী আমায় বললেন “ভগবান তোর গায়ে গা ঘষলেও,কি তুই তাঁকে চিনতে পারবি “?

সত্যিই তো বোধি ব্যক্তি ছাড়া ভগবানকে কে চিনবে? আমি বা আমরা যদি চিনতে পারতাম, তাহলে তো আমরাও "বোধি ব্যক্তি" হয়ে যেতাম !

             ক্রমশ - - -