প্রশ্ন—আমরা শুনেছি— পিতা-মাতা আমাদের পরম দেবতা, আচ্ছা তাহলে জীৱন-অভিবিকাশের মূলে পিতা-মাতার—বিশেষ করে মাতার কিরূপ ভূমিকা আছে এবং মাতৃজাতির প্রতি মানব জাতিরই বা কেমন ব্যবহার হওয়া উচিত ?—এই সম্পর্কে আপনার নিকট হতে কিছু শুনবার আমার প্রবল আগ্রহ হচ্ছে ।
উত্তর—প্রিয় আত্মন্—আমি এখন ‘মাতৃত্ব’ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করছি—তুমি মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর ।
ওঁ
মাতৃদেবো ভব
প্রিয় আত্মন্, মাতৃস্থান জগতে শ্রেষ্ঠ ও মহান এবং মাতৃসেবায় পরমেশ্বর অধিক প্রসন্ন হন। নারী মানবের জন্মভূমি—মাতৃভূমি ও জননী। যেদিন হতে মানবজাতি নারীকে কেবলমাত্র বিলাসভূমি ভেবেছে, সেদিন হতে মানবজাতির অধঃপতন শুরু হয়েছে এবং সভ্যতা বিপন্ন হয়েছে। যখন মানব নারীকে ভোগের সামগ্রীরূপে ভেবেছে, ঠিক তখনই জননী তাদের নিকট নরকের দ্বাররূপে পতিত হয়েছে।
যে জাতি বা যে সমাজ যখনই নারীজাতিকে নরকের দ্বাররূপে ভেবেছে, সেই জাতি বা সেই সমাজ তখনই আপন প্রগতির পথকে রুদ্ধ করেছে এবং ততোধিক তাদের অধ্যাত্মশক্তি বা আত্মতেজ ক্ষীণ হয়েছে। অসহজ সামান্য বুদ্ধিবশতঃ জননীতে নরক দর্শন—এটা হতে চরম দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে ! মানব যতক্ষণ জৈবিক আদিমতা কাটিয়ে না উঠছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভগবতীস্বরূপা জননীকে হীনবুদ্ধিবশতঃ অপমান করে থাকে। এটা তো মানবের উচ্চ বা মহান ভাব নয়—প্রকারান্তরে এটা অতি হীন অসভ্যতা। ঐ সকল মানব করুণার পাত্র । তাদের প্রতি মহাপুরুষগণের কৃপা একান্ত আবশ্যক।
যে জাতি বা মানব-সমাজ নারীকে সম্মান করে না, সেই মানবসমাজ বিনষ্ট হয়ে থাকে । যে রাষ্ট্র নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে থাকে, সেই রাষ্ট্র অবক্ষয়মুখী ধ্বংসের সম্মুখীন হয় ।
নারী ভ্রষ্ট হলে সংসার অধঃপাতে যাবে এবং নারীর পবিত্রতায় সংসারের মঙ্গল হবে, কল্যাণ ও শান্তি আসবে—এটাই সুনিশ্চিত।
প্রিয় আত্মন্—যাঁদের পবিত্র গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছি—যাঁদের বক্ষসুধাপানে জীবনধারণ করেছি—যাঁদের স্নেহের ছায়ায় পুষ্ট ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছি—যাঁদের অপরিমেয় স্বার্থত্যাগ ও করুণা আজও আমাদের ধমনীতে স্পন্দিত হচ্ছে—তাঁদের প্রতি যদি মানবজাতি অবিচার, অনাচার ও অপমান করে থাকে, তাহলে মানবজাতিকে কে আর রক্ষা করবে ? কারণ প্রকৃতির নিয়মে প্রতিটি শুভ ও অশুভ কর্মের প্রতিক্রিয়া আছে ।
সুতরাং মোহ-অগ্নিতে জ্বলে অকারণ তেজ হারিয়ে ফেলা ঠিক নয়। স্ত্রী-জাতি মাত্রই ভোগভূমি এটা না ভেবে সাক্ষাৎ জগদম্বা ভাবতে হবে। অপমান, অমর্যাদা এবং অনাচার না করে এপথ হতে বিরত হতে হবে। কারণ মানবজাতিকে একমাত্র নারীজাতি রক্ষা করতে পারে। চণ্ডীগঞ্জ সাগর
এবার মাতৃজাতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে কিছু বিশ্লেষণের প্রয়োজন, বিশেষ করে মাতৃত্ব সম্বন্ধে।
প্রিয় আত্মন্—মাতৃত্বই রাষ্ট্র ও জাতির জীবনের কাঠামো এবং অভিবিকাশের মূল । মানব-সমাজ ও রাষ্ট্র তখনই অবনতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে, যখন পবিত্র বুদ্ধিমতী মাতার অভাব হয়ে পড়ে। মাতৃজাতি যখন বুদ্ধিহীনতাহেতু আপন কর্তব্য হতে চ্যুত হন, তখন তাঁদের গর্ভে হীনবুদ্ধি, কর্তব্যহীন ব্যক্তির জন্ম হয়। মাতৃজাতির কর্তঅবহেলাহেতু জড়বুদ্ধি, রুগ্ন, সংকীর্ণচেতা, কর্মবিমুখ, শ্রমকাতর, আত্মবিস্মৃত ও বিকৃত মানব জন্মলাভ করে থাকে। ফলে অভাব হয়ে পড়ে সুমহান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিক্ষক ও আচার্যের অভাব হয়ে পড়ে সুমহান, আত্মসচেতন আদর্শ মানবের বা শ্রেষ্ঠ মহামানবের। আর এইজন্য জীবনবিরোধী অনুষ্ঠান ও আচরণে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মানব-সমাজ ও রাষ্ট্র। গোঁড়ামিতে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে নবীন মানব সমাজ । ভাবের বিশুদ্ধতা হারিয়ে অনাচারে লিপ্ত হয় ছাত্র সমাজ। নির্বোধ ও চিন্তাশক্তির হ্রাসহেতু আসে মনোবৈকল্য আর জন্ম নেয় পৃথকতাবাদী মনোভাব, উপস্থিত হয় স্বার্থপরতা ও বিচ্ছিন্নতাকামী পাশবিক স্বভাবের ।
তখন সমাজে চলতে থাকে নির্দ্বিধায় শোষণ, বঞ্চনা, ব্যক্তিস্বার্থ-পরায়ণতা, অবহেলা, প্রভুত্বের অত্যাচার, বিবাদ ও সংঘর্ষ। চরম দারিদ্র্যের এক অভিশপ্ত বিষময় আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। এককথায় মানবসমাজ হয়ে পড়ে বিকৃত ভাবাপন্ন
সুতরাং রাষ্ট্র ও জাতির জীবনের অগ্রগতির মূলে এই মাতৃজাতি ।
প্রিয় আত্মন্, ব্যক্তির আবির্ভাব বা জন্ম মুহূর্তে পিতার অংশগ্রহণ সাময়িক, কিন্তু মাতার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । অবশ্য পিতা ও মাতা উভয়েরই ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তবুও মাতার তুলনায় পিতার ভূমিকা সাময়িক। মাতার ভূমিকা অপরিসীম।
জীবনধারা প্রকটিত হতে থাকে জীবনের ভিতর দিয়ে। জীবনকে বাদ দিয়ে নয়—জীবনের মধ্য দিয়ে জীবনের ধারাটি বহমান। পুরাতনকে কেন্দ্র করে নূতনের আবির্ভাব সাধিত হচ্ছে। এই কারণে জীবনধারাটি অক্ষুণ্ণ রয়েছে জীবনকে কেন্দ্র করে। বাস্তবিক এটাই জীবন রহস্য বা জীবনের বিজ্ঞান। যাঁদের কেন্দ্র করে নূতন জীবনটির আবির্ভাব হবে, তাঁদের ওপর নির্ভর করে নূতন জীবনটির দৈহিক ও মানসিক গঠন, প্রাণপ্রাচুর্য, চরিত্রের দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠতা । দেহ, প্রাণ, মন, বুদ্ধি ও চেতনার বিকাশ সম্ভব হয় তাঁদের স্বভাবের গঠন ও চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য অনুসারে । সুতরাং মানবের স্বভাব-গঠন নির্ভর করে পিতা ও মাতার ওপর, বিশেষতঃ মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
জীবনধারাটির আগমন ঘটে থাকে পিতার মধ্য দিয়ে, সেহেতু পিতার মানসিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ছাপ জীবনটির ওপর পতিত হয় । বিশেষতঃ আগমন মুহূর্তটি পিতার মানসিক স্থিতি-অনুসারে প্রভাবিত হয় এবং ঐ স্থিতি জীবনটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। পিতার ঐ মুহূর্তের চেতনার স্থিতি আগামী জীবনটির চারিত্রিক প্রবণতায় ছাপ পড়ে।
কিন্তু মাতার ভূমিকা ও দায়িত্ব আরও গুরুত্বপূর্ণ ও গভীর। কারণ পিতার মধ্য দিয়ে আগত ঐ জীবনধারাটিকে পূর্ণাঙ্গ ও সার্থক রূপদান করে তোলেন মাতা । অর্থাৎ জীবনের সার্থক ও পূর্ণাঙ্গ রূপদান মাতার দ্বারা সূচিত হয়। সেহেতু মায়ের দেহ-প্রাণ-মন-বুদ্ধি ও চেতনার অবস্থা অনুযায়ী জীবনটি পরিপূর্ণতা ও পূর্ণাঙ্গ লাভ করে । বিশেষ করে জন্ম-মুহূর্তকাল হতে প্রসবকাল পর্যন্ত—এই বিরাট সময়টা মাতৃগর্ভে থাকাকালীন প্রতি নিমেষে জীবনটার গঠন-ক্রিয়া, বৃদ্ধি এবং বিকাশ সূচিত হয়। নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে তার রূপদান ও গঠনক্রিয়া—একটু সময়ের জন্যও বিরাম থাকে না । এইরূপে অবিরাম ধারায় চলতে থাকে রূপদানের প্রতিক্রিয়া ।
সুতরাং গর্ভে থাকাকালীন সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর ঐ জন্য মাতার ওপর নির্ভর করে ভবিষ্যৎ জীবন ও ব্যক্তির আবির্ভাব ।
তারপর প্রসবের পরেও শিশুর অভিবিকাশে মাতার দায়িত্ব অধিক গুরুত্বপূর্ণ । মাতার সাহচর্যে শিশুর সর্বাধিক অভিবিকাশ সূচিত হয় । কারণ প্রতিটি মানব শিশুর চরিত্রের প্রাথমিক স্ফুরণ হয় তার আপন বাড়ীর পরিবেশ ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। প্রথম অবস্থায় সে যা দেখতে থাকে, তার অনুকরণ বা অনুশীলন করার চেষ্টা করে । আর সর্বাপেক্ষা সে বেশী করে দেখে এবং অনুকরণ করে তার নিজের মাকে। অতএব প্রতিটি মানব শিশুর চরিত্র এবং উত্তরজীবন নির্ভর করে থাকে তার আপন মায়ের ওপর । শত শিক্ষক বা আচার্যের তুলনায় একজন আদর্শ মাতার অবদান বা ভূমিকা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানবের চরিত্রগঠনে তার মায়ের অবদান অপরিসীম। বীরত্ব শ্রেষ্ঠত্ব—মহত্ব ও ঋষিত্ব সমস্তই মাতৃত্বে বাঁধা। আর মাতৃত্বের ওপর নির্ভর করে ঐগুলির মহান আবির্ভাব।
প্রিয় আত্মন্—চরিত্র হল মানবের আসল পরিচয়। চরিত্র মানবের এমন এক সম্পদ, যা মানবকে সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ ও দায়িত্বশীল করে তোলে। চরিত্রই মানবকে আপন ব্যক্তিত্ব এবং নীতিতে অবিচল থাকবার প্রেরণা যোগায়। সুতরাং প্রতিভার অনেক পরে চরিত্রের স্থান। চরিত্রবল দ্বারা জগতে অসাধ্যসাধন সম্ভবপর হয় । মানবের যতই গুণ থাকুক না কেন, যদি তার চরিত্রবল না থাকে, তাহলে তার সমস্ত কিছুই বৃথা। মানবকে সৎ অবশ্যই হতে হবে। এইজন্য মানবের যতই প্রতিভা বা গুণ থাকুক না কেন, সে যদি সত্যনিষ্ঠ না হয়, তাহলে তার সমস্ত কিছু নিষ্ফল প্রতিপন্ন হয়।
প্রিয় আত্মন্ ৷ মাতৃত্বই রাষ্ট্র ও জাতি-জীবনের অগ্রগতির মূল । মাতৃত্বের অভাবে এগুলির অবনতি ঘটে। মানবসমাজ তখনই বিপন্ন বোধ করে, যখন মাতৃজাতি অবৈজ্ঞানিক চিন্তাপ্রসূত হন এবং নির্বুদ্ধিতাহেতু বিশুদ্ধ বিজ্ঞানবোধ হারিয়ে ফেলেন। জাতির জীবনে নেমে আসে অভিশাপ ৷ সেইহেতু মাতৃজাতির শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন । যে সমাজে মাতৃজাতি শিক্ষা হতে বঞ্চিতা সেই সমাজ অভিশপ্ত। মাতৃজাতির শিক্ষার প্রসার না ঘটলে ধর্ম—রাষ্ট্র—জাতি-জীবনে—সমস্ত কিছুতে সর্বনাশ এসে উপস্থিত হয়। যে সমাজে মাতৃজাতি যত বেশী শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী এবং পবিত্রসম্পন্না, সেই সমাজে তত বেশী আদর্শ মানব এবং সুমহান চরিত্রসম্পন্ন ব্যক্তির আবির্ভাব হয় ।
মাতৃজাতির শিক্ষা ও উন্নতিতে রাষ্ট্রজীবনের বা সমাজ জীবনের প্রভূত উন্নতি হবে । বিশ্বের কল্যাণ ও শান্তি আসবে। মাতৃত্বের কাঠামোর ওপরই সমাজের ভবিষ্যৎ জীবন ৷
প্রিয় আত্মন্ । আমাদের মাতা সাক্ষাৎ জগদম্বা উমা এবং পিতা সাক্ষাৎ উমাপতি শঙ্কর ৷
“জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী ।”
ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ৷৷