জিজ্ঞাসা :— পৃথিবীতে দুঃখ আছে কেন?
মীমাংসা :– সাধারণ মানুষ বলে দুঃখ অজ্ঞতার ফলস্বরূপ।
জিজ্ঞাসা :– অজ্ঞতা কি ?
মীমাংসা :– মানুষের ধারণা — অজ্ঞতা হল কোন বিষয়, কর্ম এবং মনুষ্যসহ জীব সম্বন্ধে ভুল ধারণা।
জিজ্ঞাসা :– সাধারণ মানুষের ধারণায় অজ্ঞতা যে দুঃখের মূল এবং মানুষের স্বভাব অজ্ঞতাকে সমস্ত দুঃখের জন্য
দায়ী করা — তা বুঝলাম। আপনি সাধারণ লােকের ধারণার কথা বললেন। আমরা বুঝতে পারলাম না ৷ সুতরাং এ বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতার কথা বলুন।
মীমাংসা :– বিষয়, কর্ম এবং মানুষ সমেত সমস্ত জীব সম্বন্ধে যে ভুল ধারণা বা অজ্ঞতা – তা মানুষের দুঃখের কারণ নয়। কোন বিষয়, কর্ম এবং মানুষ সম্বন্ধে যে ধারণা মানুষের আছে তা দিয়ে মানুষ তাদের মনােভাব, আচার, আচরণ এবং স্বভাব ঠিক ঠিক প্রয়ােগ করতে পারে না যখন তারা এগুলাের সংস্পর্শে আসে। লােকে ভাল করেই জানে পৃথিবীতে তাদের কাজের ধরন অমানবীয় সত্তার কাজের ধরন থেকে আলাদা। তাদের মনােভাব, আচরণ এবং স্বভাব অমানবীয় সত্তার মনােভাব, আচরণ এবং স্বভাব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মানুষ তার নিজের জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করতে পারে না।
জিজ্ঞাসা :— শুধু ‘সত্তা’ না বলে অমানবীয় জীবের ক্ষেত্রেও আপনি ব্যক্তি সত্তা (individual) কথা প্রয়ােগ করলেন। এর কারণ কি?
মীমাংসা :– সত্তার কোন ব্যক্তি অহং নাই। সেজন্য তাদেরকে পৃথক করা যাবে না। সত্তার কোন ইন্দ্রিয় নাই। সেজন্যে তারা চিন্তা করতে পারে না। কিন্তু ব্যক্তি সত্তা (individual) এমন কি উদ্ভিদ এবং অমানবীয় জীবের ক্ষেত্রে অন্যরূপ।
জিজ্ঞাসা :– কোন শাস্ত্রে মানুষ ব্যতীত অন্য কোন জীবের ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তি সত্তা’ কথার প্রয়ােগ দেখি নাই।
মীমাংসা :– হ্যাঁ, তাই। কিন্তু তােমরা নিশ্চয়ই শাস্ত্রে দেখেছ যে, ‘সত্তা’র কোন অজ্ঞতা নাই, তারা ‘অমর’। কিন্তু শাস্ত্রে এও দেখেছ যে ‘সত্তা অন্ধকারে আছে তারা তাদের সামনের পর্দা সরাবেই। তারা দুঃখ পায়। তারা মুক্তি পাবেই।’ কথাগুলি পরস্পর বিরােধী। ‘সত্তা’ এবং ‘ব্যক্তি সত্তা’ শব্দ সম্বন্ধে এগুলি গােলমাল পাকিয়ে দেয়।
জিজ্ঞাসা :– তাহলে আমরা কোন অর্থে ধরব ?
মীমাংসা :– বিস্তারিত এবং স্পষ্ট ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। মন দিয়ে শােন, তােমার অনুভূতির দরকার, শাস্ত্রজ্ঞান নয়।
জিজ্ঞাসা :– মানুষের কোন অজ্ঞতা নাই ?
মীমাংসা :– আছে। সাধারণ মানুষের যে অজ্ঞতা তা বিষয়, কর্ম এবং নিজেদের সম্বন্ধে নয়। এ অজ্ঞতা হল –এ সবের যে ভিত্তি এবং এদের অস্তিত্বের যে মৌলিক সূত্র –সে সম্বন্ধে অজ্ঞতা ৷
জিজ্ঞাসা :— এই অজ্ঞতাই কি দুঃখের কারণ নয় ?
উত্তর :– না, এই অজ্ঞতা দুঃখের কারণ নয়। সাধারণ মানুষের জ্ঞান অনুযায়ী কাজ করার যে অক্ষমতা –তাই হল দুঃখের কারণ।
জিজ্ঞাসা :– এই অক্ষমতার কারণ কি ?
মীমাংসা :— মানুষের সূক্ষ্ম চেতনা যথাযথ কাজ করে না। –এটাই কারণ।
জিজ্ঞাসা :– এটাও কি অজ্ঞতার জন্য নয় ?
মীমাংসা :– না। এটা অজ্ঞতার জন্য নয়। সূক্ষ্ম চেতনায় গুণগত এবং পরিমাণগত শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে থাকে না। সেজন্যে এরূপ হয়।
জিজ্ঞাসা :– এই অপর্যাপ্ততার কারণ কি ?
মীমাংসা :– কাণ্ডজ্ঞান সম্বন্ধে মানুষের অসাবধানতা বা উপেক্ষা।
জিজ্ঞাসা :– কাণ্ডজ্ঞান কি ?
মীমাংসা :– পরে আলােচনা করা হবে ।
জিজ্ঞাসা :– সূক্ষ্ম চেতনা কি ? মানব সত্তার সঙ্গে এর কি সম্বন্ধ ?
মীমাংসা :– চেতনা হচ্ছে শক্তি। সূক্ষ্ম চেতনা মানব সত্তার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত, মানব শরীরের সঙ্গে নয় ।
জিজ্ঞাসা :– কোন কোন চেতনার সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ আছে ?
মীমাংসা :– পুনঃসৃজন এবং সৃজন চেতনা।
জিজ্ঞাসা :– ওগুলাের কাজ কি?
মীমাংসা :— শরীর যে খাবার খায় সেই খাবার থেকে পুনঃসৃজন (recreative energy) শক্তি তৈরী করা পুনঃসৃজন চেতনার কাজ। এর ফলে পুনঃসৃজন চেতনা নিজেদের মধ্যে ঐ শক্তি সঞ্চালিত করে যথাযথ কাজ করতে সক্ষম হয়।
জিজ্ঞাসা :– এই পুনঃসৃজন শক্তি কি ?
মীমাংসা :— সাধারণতঃ মানবীয় এবং অমানবীয় শরীরের রক্ত এবং উদ্ভিদের রসকে পুনঃসৃজন শক্তি বলে ৷
জিজ্ঞাসা :– তাহলে রক্ত হচ্ছে পুনঃসৃজন শক্তি এবং যে স্নায়ুর মধ্য দিয়ে এই রক্ত সঞ্চালিত হয় তা হল পুনঃসৃজন চেতনা।
মীমাংসা :— ঠিক তাই।
জিজ্ঞাসা :– সৃজন শক্তি (creative energy। কাকে বলে ?
মীমাংসা :– পুনঃসৃজন শক্তির পরিমাণগত বৃদ্ধির ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তাকে সৃজন শক্তি বলে। … [ক্রমশঃ]
[ স্বামী বাউলানন্দজীর মূল রচনা ‘SPIRITUAL ENQUIRY’ থেকে স্বামী কেশবানন্দ কর্তৃক অনূদিত ]