জিজ্ঞাসু:—-আপনি বলছিলেন চিকিৎসা পদ্ধতিতে অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি ও আয়ুর্বেদ ছাড়াও আরো অনেক পদ্ধতি রয়েছে সেগুলি কি চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্মত ? এই পদ্ধতিতেও কি মানুষের রোগ সারে?
গুরু মহারাজ:—–কেন সারবে না ! তোমার ধারণা নাই __তাই তুমি এই কথা বলছো ! বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের চিকিৎসাবিজ্ঞান খুবই উন্নত ছিল ! কথিত আছে, স্বয়ং শিব-ই(যিনি আজ থেকে বহু হাজার বছর আগে এই পৃথিবীতে উন্নত মানব হিসাবে সত্য সত্যই শরীর ধারণ করেছিলেন।) ভারতবর্ষের চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ! আর এই সমস্ত প্রাচীন বিদ্যা ভারতবর্ষ থেকেই দূরে দূরে তৎকালীন উন্নত দেশসমূহে ছড়িয়ে পড়েছিল ! আয়ুর্বেদে যে শল্যবিদ্যা, শলাকাবিদ্যা ইত্যাদির কথা রয়েছে, তারমধ্যে শল্যবিদ্যাই হোলো আধুনিক surgery, যা বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞান খুব ভালোভাবেই গ্রহণ করেছে এবং মানুষ এর থেকে চরম সুফল ভোগ করছে ! কিন্তু আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের সব জ্ঞান এখন‌ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান নিতে পারেনি !
যাইহোক, আজকের এই আকুপাংচার ই হোলো শলাকাবিদ্যা, যা ভারতবর্ষ থেকে চীন, জাপান, কোরিয়া ইত্যাদি দেশগুলিতে ভগবান বুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বা বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকারীদের হাত ধরে গিয়েছিল । তারপর কালক্রমে(বিদেশিদের হাতে ভারতবর্ষ দেশটি চলে যাওয়ায়) আমাদের দেশে এসব বিদ্যার চল হারিয়ে ফেললেও, ওইসব দেশগুলিতে এই চিকিৎসা পদ্ধতি উৎকর্ষতা লাভ করেছে ! এখন যখন ওই সমস্ত দেশ থেকে বিদ্যাগুলি পূনরায় এই দেশে ফিরে আসছে, তখন এখানকার মানুষ সেগুলির খুব কদর দিচ্ছে ।
বর্তমান ভারতবর্ষে প্রচলিত ‘ইউনানী’ এবং ‘হেকিমি’ চিকিৎসাও ঠিক ঠিক ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি নয় ! বহিরাগতরা যখন ভারতের বিভিন্ন অংশ দখল করে এখানে বসবাস করতে শুরু করেছিল, তখন তাদের নিজ নিজ সমাজের চিকিৎসা পদ্ধতি ভারতীয় সমাজেও চালু করেছিল ! এইগুলি সেইরকমই চিকিৎসা বিদ্যা ! পরে যা হয় অর্থাৎ ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসার সাথে ঐগুলি মিলেমিশে একটা স্বতন্ত্র রূপ নিয়ে এখনও ভারতবর্ষের কোথাও কোথাও রয়ে গেছে ।
উত্তরপ্রদেশের বেনারসের কাছাকাছি বিভিন্ন স্থানে এবং শহরগুলোতেও একদল পুরুষানুক্রমিক হাতুড়ে চিকিৎসক রয়েছে, যারা রাস্তায় ইঁটের উপর বসে বা যে কোনোভাবে আসন পেতে বসে দাঁতের রোগীদের চিকিৎসা করে ! ওরা দাঁত তোলে এবং দাঁত তুলতে গিয়ে ব্লিডিং হোলে অথবা অন্য সমস্যা সৃষ্টি হোলে_ ওরা ওদের নিজেদের তৈরি ওষুধ‌ই ব্যবহার করে ! প্রথাগত অ্যালোপ্যাথি ওষুধ ব্যবহার করে না ! আর করলেও নিজেদের মতো কোরে করে –রেজিস্টার্ড ডাক্তারদের পরামর্শ মতো নয় !
ইউরোপীয়দের কাছে বা যে কোনো উন্নত দেশের মানুষজনের কাছে এটা একটা অত্যাশ্চর্য্য ব্যাপার ! ওরা যখন‌ই ইন্ডিয়া-তে আসে, তখন ওরা এখানকার এইসব ব্যাপারগুলো ভিডিও করে নিয়ে যায় এবং ওদের দেশের বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে বা অন্যান্য টিভি চ্যানেলে দেখায় এবং সকলকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দারা অর্থাৎ গ্রাম-গঞ্জের মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষেরা_এখনও কতোটা অনুন্নত, কতোটা অশিক্ষিত, কতোটা স্বাস্থ্যের বিষয়ে অসচেতন এবং অর্থনৈতিকভাবে তারা কতটা দুর্বল ! তাছাড়া রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো যে কতোটা খারাপ_তাও এইসব ভিডিওর মাধ্যমে ওরা দেখানোর চেষ্টা করে ! কারণ এইসব চিত্রের দ্বারা তারা এটাই বোঝে যে, আমাদের এই দেশের সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা__ হয় এই লোকগুলোর কাছে এখনো পৌঁছায়নি অথবা এই লোকগুলোর সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি কোনো আস্থাই নেই !
আমি তো ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরি__ আমি দেখেছি অর্শ, ভগন্দর ইত্যাদি রোগে “চাঁদসী”-র চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো কাজ দেয় ! ওটাও একটা প্রাচীন পরম্পরা । ওরাও পরম্পরাগতভাবেই এই শিক্ষা লাভ কোরে থাকে, কোনো প্রথাগত ডিগ্রী এদের নেই । এরাও নিজস্ব পদ্ধতিতে প্রস্তুত গাছ-গাছড়া থেকে প্রস্তুত করা ওষুধ ব্যবহার করে থাকে। Modern ও hygienic ব্যবস্থা ছাড়াই অপারেশন এবং তাদের নিজেদের তৈরি ঔষধেই ঘা গুলি খুব দ্রুত সেরে যায় !
আবার বিভিন্ন আদিবাসী সমাজে অর্থাৎ কোল-ভীল-সাঁওতাল ইত্যাদি জনজাতির মধ্যে বেশকিছু প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে, সেগুলিও বেশ কার্যকরী ! আমি আদিবাসী অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানোর সময় দেখেছিলাম_ ওরা হাড়জোড়া গাছের লতা(এক ধরণের বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ) ব্যবহার কোরে যেকোনো স্থানের ভাঙ্গা হাড় খুব সহজেই জোড়া লাগাতে পারে ! দু-চার সপ্তাহ ধরে কয়েক ধরনের লতা-পাতা, ভেঙে যাওয়া অঞ্চলে বেঁধে দিয়ে ওরা ভাঙা হাড় জোড়া লাগিয়ে দেয় । এটাও একটা আশ্চর্য ব্যাপার !
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওঝা ছাড়াও সমাজের আরো অনেকে পরম্পরাগতভাবে এই একই practice চালিয়ে যাচ্ছে। এদের‌ও প্রথাগত কোনো এ্যানাটমীর শিক্ষা নাই, শুধু পরম্পরাগত শিক্ষা রয়েছে ! আর তাতেই যেকোনো স্থানের হাড় ভাঙলে ওরা ঠিক নিখুঁতভাবে set করে দিতে পারে ! ….. (ক্রমশঃ)