জিজ্ঞাসু :– গুরুজী ! বিভিন্ন কবি বা লেখকের লেখা পড়ে দেখেছি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো “প্রকৃতি বর্ণনা” – আর কেউ করতে পারে নি। এককথায় রবীন্দ্রনাথ অভূতপূর্ব !
গুরুমহারাজ :– অতোটা বোলোনা দিদিমণি ! কারণ নিসর্গ বর্ণনায় ভারতীয়দের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি হোলেন কালিদাস ! কালিদাসের মতো এতো নিখুঁত প্রকৃতি বর্ণনা করতে রবীন্দ্রনাথ‌ পারেননি। বরং বলা যায় উনি অনেক ক্ষেত্রেই কালিদাসের কাছ থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। আমি দেখেছি – “ঋতু” সংক্রান্ত কয়েকটি কবিতা লিখেছে রবীন্দ্রনাথ, যেগুলির মধ্যে প্রকৃতি বা পরিবেশের বর্ণনা যথাযথ হয়নি ! কবিতাগুলি শুধুমাত্র সুললিত ছন্দ-মাত্রা ও ভাষার গুনে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে এমনকি জনপ্রিয়তাও পেয়েছে !
এই কথাগুলি এখানেই আগে আমি আলোচনা করেছিলাম, তখন হয়তো তুমি (দিদিমণি) সেই সিটিং-এ ছিলে না, তাই আবার আজকে বলছি ! রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি বর্ণনা সংক্রান্ত কবিতার উদাহরণস্বরূপ আমি উল্লেখ করছি ‘শরৎ’ কবিতাটি ! এখানে বঙ্গদেশে শরতের বর্ণনা দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – “এসেছে শরৎ, হিমের পরশ – লেগেছে হাওয়ার পরে।”– কিন্তু এখানে অর্থাৎ বঙ্গদেশে ‘ভাদ্র-আশ্বিন’ এই দু-মাস শরৎকাল ! “এসেছে শরৎ”– মানে তো যখন শরৎ সবে এসেছে, কিন্তু তখন তো ভাদ্রমাস ! তখন হিমের পরশ কোথায় ? ভাদ্রমাসে একদিকে জলে-কাদায় প্যাচপ্যাচে – পচানো আবহাওয়া, অন্যদিকে তখন ভ্যাপসা অস্বস্তিকর গরম থাকে – ফলে কোথায় হিমের পরশ ? হিমেল ভাব আসে হেমন্তকালে – শরৎকালে নয়। আবার ঐ কবিতাতেই রয়েছে “শিউলির ডালে কুঁড়ি ভরে এলো”, আবার আছে “মালতীলতায় খোঁজ নিয়ে যায় মৌমাছি দুইবেলা”! অর্থাৎ শিউলি,মালতী ইত্যাদি ফুলগুলি ফুটেছে, আমলকি বনের পাতা ঝরার কাজ শুরু হয়েছে– ইত্যাদি ! কিন্তু এগুলির কোনোটাই ঠিকঠাক হয় না ! কারণ ভাদ্রের শুরুতে শিউলির ডালে কুঁড়ি দুটো-একটা ধরলেও ‘কুঁড়ি ভরে আসে না’। মালতীলতাতেও সেই সময় ফুল ফোটে না৷ আর আমলকির পাতা ঝরে শীতকালে ! এইভাবে যদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করো – তাহলে কবিতার মধ্যে অনেক কিছু গড়মিল পাওয়া যায়।
কিন্তু রবিঠাকুরের কবিতায় ছন্দ এবং শব্দের বিন্যাস এতো ভালো যে, পড়তে খুবই ভালো লাগে। আমার মনে হয় – এসব কবিতাগুলি রবীন্দ্রনাথ মেঘালয়ের “শিলং” পাহাড়ে বসে লিখেছিলেন। ওইস্থানে শরৎকালেই শীতের একটা ভাব আসে – তাই সেখানে শিউলিও একটু আগেই ফুটতে পারে, বঙ্গদেশে এমনটা হয় না।৷
অপরপক্ষে কবি কালিদাস “মেঘদূত” কাব্যগ্রন্থে বা অন্যান্য কাব্যে ঋতুর যে বর্ণনা করেছেন – তা সাংঘাতিকভাবে নিখুঁত ! বর্ষার বর্ণনা দিয়েছেন তো একেবারে বঙ্গে বর্ষার যেন চিত্ররূপ ! বর্ষা বর্ণনায় কবি কালিদাস যে সমস্ত ফুলের উল্লেখ করেছেন সেগুলি যথার্থই বর্ষাকালেই পাওয়া যায় ! এইভাবে সমস্ত ঋতু-বর্ণনাতে উনি যে সমস্ত ফুল,ফল বা প্রকৃতির রূপের বর্ণনা করেছেন _তা একেবারে নিখুঁত! তবে, কালিদাসের কাব্য তো সংস্কৃত ভাষায় লেখাবাংলায় নয় ! তাই সংস্কৃত জানা মানুষেরাই কালিদাসের কাব্যের রস আস্বাদন করতে পারে। আমি চিন্তা করে দেখেছি, প্রকৃতপক্ষে বাংলাভাষায় ঠিক তেমনভাবে ‘ঋতুবর্ণনা’ করে কবিতা লেখাই হয়ে ওঠেনি ! সেইজন্য আমি ছটা ঋতুকে নিয়ে-ই একটা করে কবিতা লিখেছিলাম। দাঁড়াও, আমি ঘর থেকে খাতাখানা বের করে নিয়ে আসছি – তোমাদেরকে কবিতাগুলি পড়ে শোনাই ! (উনি উঠে গিয়ে ঘরে ঢুকে কবিতার খাতা নিয়ে এসে, সেই কবিতাগুলি পাঠ করতে শুরু করলেন ! বর্ষাবর্ণনা কবিতার শুরু “ঐ আসে–বর্ষা আসে”, গ্রীষ্মকাল বর্ণনার কবিতার শুরুতে রয়েছে “ঐ আসে গ্রীষ্ম আসে”– এইরকম সব কবিতাগুলিই শুরু হয়েছে। কবিতা পাঠ শেষ হবার পর গুরুমহারাজ আবার কথা বলতে শুরু করলেন।) – এই কবিতাগুলি জয়দীপ ইংরেজিতেও অনুবাদ করছে। সাধারণতঃ এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় কবিতা translate করলে – তা অনেকাংশে “খেলো” হয়ে যায়, ভাষার পার্থক্যে ভাবের ভীষণ তারতম্য ঘটে যায় ! সেইজন্যেই আমার presence-এ এই অনুবাদগুলি করা হোচ্ছে – যাতে ভাব মোটামুটি অক্ষুন্ন থাকে। আমি খেয়াল করেছি যে, জয়দীপ কবিতাগুলির অনুবাদে প্রতিশব্দের ব্যবহার খুবই ভালো করছে !