[ ‘নরলীলায় ভগবানকে চেনা যায় না, গুরুজীকেও চিনতে পারা গেল না’এই আক্ষেপ নিয়ে গুরু মহারাজকে এক ভক্ত জিজ্ঞাসা করেছিল,‘কি করলে ভগবানকে চেনা যায়?’ গুরু মহারাজ তার উত্তর দিচ্ছিলেন। আজ সেই আলোচনার পরবর্ত্তী অংশ। আলোচনাটি দীর্ঘ ছিল, তাই ‘ক্রমশঃ’ দিয়ে আরও ২/১টি এপিসোডে শেষ করা হবে। ]
…… এই প্রসঙ্গে মহাপ্রভুর জীবনের একটা ঘটনা বলছি শোনো_ মহাপ্রভু তখন উড়িষ্যার পুরীধামে রয়েছেন ! তাঁর ভক্তদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন কাশীশ্বর মিশ্র । তাঁর স্ত্রী-ও ছিলেন খুবই ভক্তিমতী মহিলা ! তাঁর মনে খুব ইচ্ছা ছিল যে, অন্তত একবারের জন্য হোলেও মহাপ্রভুকে নিজের হাতে নানাবিধ অন্ন-ব্যন্জন রান্না করে খাওয়াবেন। ভক্তবর কাশীশ্বর সেইমতো সব ব্যবস্থা করে সপার্ষদ মহাপ্রভুকে একদিন নিজের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজনের জন্য আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন । কাশীশ্বরের ভক্তিমতী স্ত্রী, ভোররাতে উঠে নিজের হাতে 52(বাহান্ন) ব্যঞ্জন পদ রান্না করে, মহাপ্রভুকে ঘরের মধ্যে আলাদা করে আসন পেতে খাবার ব্যবস্থা করেছিলেন ! মহাপ্রভুর আগমন উপলক্ষে সেদিন কাশীশ্বরের মেয়ে ‘মাধবী’ এবং তার স্বামীও ওখানে উপস্থিত ছিল ! মাধবী ছোটো থেকেই মহাপ্রভুকে দেখেছে, তাঁর আদর-ভালবাসা পেয়েছে_ ফলে তার মহাপ্রভুর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার অভাব ছিল না। কিন্তু তার স্বামী ছিল নিতান্ত সাধারণ মানুষ, আর ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ! চৈতন্য মহাপ্রভুর ব্যাপারেও তার মোটেই ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল না !
যাই হোক, কাশীশ্বরের ভক্তিমতী স্ত্রী তার অন্তরের সমস্ত ভক্তি দিয়ে যা যা রান্না করেছেন, সেই সবের কিছু অংশ কাঁসার একটি বড় বগি-থালাতে সাজিয়ে মহাপ্রভুকে খাবার পরিবেশন করেছিলেন এবং বাকি পদ-গুলি থালার চারিপাশে বিভিন্ন বাটিতে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। ভক্তিমতী মা-টি প্রভুকে রন্ধনকৃত পদগুলি এগিয়ে এগিয়ে দিচ্ছেন, আর মহাপ্রভু সেই সমস্ত কিছুই খেয়ে নিছেন !
প্রকৃতপক্ষে ভগবান কি খান !! ভগবান ভক্তের ভক্তিই গ্রহণ করেন ! কিন্তু কাশীশ্বরের জামাই বাইরে থেকে মহাপ্রভুর খাবারের বহর দেখে, আর থাকতে না পেরে বলে উঠেছিল ” লোকটা ভগবান না ছাই ! ওটা একটা রাক্ষস তাই ওইরকম খাচ্ছে !!”
এই কথাগুলো জামাই বাবাজি বেশ জোরে জোরেই বলেছিল, ফলে সকলেই সে কথা শুনতে পেয়েছিল_ শুধু মহাপ্রভু ছাড়া(অন্তর্যামী ভগবান সব‌ই জানেন! এই লীলার ঘটনাকার তো তিনিই স্বয়ং!) ! কারণ ভগবান যখন যেটা করেন, তখন তাতেই তাঁর একশভাগ মনোযোগ থাকে ! তাই তাঁর কর্ণে এসব কোনো কথাই যায়নি ! তিনি আপন মনে আনন্দ সহকারে শিশুর মতো খেয়েই যেতে লাগলেন ! কিন্তু কাশীশ্বরের ভক্তিমতী স্ত্রী তার জামাইয়ের এইরূপ গর্হিত আচরণ সহ্য করতে পারলেন না ! তিনি দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এসে জামাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন“ছিঃ ছিঃ! আমার জামাই ‘এমন’ ? ঐরকম জামাইয়ের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো!” অতি উচ্চস্তরের সাধিকা ভক্তিমতী মা-টির অন্তরের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা এই আর্তি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই মহাপ্রকৃতি accept করে নিয়েছিল ! ফলে ওনার ঐ কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই জামাইটির ভেদবমি শুরু হয়ে গিয়েছিল ! আরো আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অল্প সময়ের মধ্যেই ছটফট করতে করতে সে মারাও গিয়েছিলো ! ইতিমধ্যে মহাপ্রভুর খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছিলো ! উনি ওই বাড়িতেই তাঁর জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে তখন বিশ্রাম করছিলেন ! কাশীশ্বরের কন্যা মাধবী ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল, তারপর যখন ব্যাপারটা গুরুত্ব বুঝতে পারলো, তখন কাঁদতে কাঁদতে একছুটে মহাপ্রভুর পায়ে গিয়ে পড়লো ! বললো“মায়ের কথা রেখেছো, এবার আমার কথা রাখো ! আমার শাঁখা-সিঁদুরের মর্যাদা রাখো ! আমার স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে দাও!” চৈতন্যদেব ব্যাপারটা যেন কিছুই জানেন না(তিনি অঘটন-ঘটন পটিয়সী, তিনি অন্তর্যামী_ সবই তিনি জানেন, কিন্তু নরলীলায় মানুষের মতোই আচরণ করতে হয় । ওই ঘটনাটা যেহেতু উনি নিজের চোখে দেখেননি_ তাই ভান করলেন যে, উনি জানেন না!)এমন ভাব নিয়ে মাধবীর সব কথা শুনলেন, তারপর উঠে গিয়ে যেখানে জামাইটি পড়ে আছে সেখানে গেলেন এবং মৃত জামাই বাবাজির গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন” জামাই-এর কি হয়েছে ! কই কিছুই তো হয়নি! ওঠো -ওঠো -জামাই বাবাজি ! উঠে পড়ো!” সকলকে অবাক করে দিয়ে জামাই বাবাজি চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে পড়লো ! তারপর গায়ের ময়লা এবং কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করে ফিরে এসে মহাপ্রভুর পা-দুটো চোখের জলে ধুয়ে দিলো ! … (ক্রমশঃ)