[“নরলীলায় ভগবানকে চেনা যায় না”–এই নিয়ে গুরু মহারাজ আলোচনা করছিলেন।আজ সেই আলোচনার পরবর্ত্তী অংশ…!]
…..দ্যাখো, সত্যি কথা বলতে কি মানুষের দিকে তাকালে আমার কষ্ট হয় ! মানুষ যেন নানান বেদনায়, নানান জ্বালায় পুড়ে পুড়ে যাচ্ছে ! স্বামী বিবেকানন্দ‌ও বুকে একরাশ বেদনা নিয়ে এই পুড়তে থাকা মানুষজনকে দেখেই বলেছিলেন “বজ্রাহত বৃক্ষ” ! মানুষের জীবন সর্বদা জ্বলছে, নানান দুঃখ-ক্লেশ-শোক-কামনা-বাসনার অনলে ! এইসব হোলো জ্বালার উৎস ! মানুষের জীবনে আনন্দের আস্বাদন আর কতটুকু হয় ? বেশিরভাগটাই দুঃখ, বেদনা আর নানান জ্বালায় জ্বলতে থাকা ! অনেকেই দুঃখ ভুলতে মদ খায় বা অন্য নেশা-ভাঙ করে, কিন্তু তাতেও কি সে আনন্দ পায় ? দ্যাখো, যদি মদ খেয়ে বা অন্য কিছু নেশা করে যদি আনন্দ পাওয়া যেতো, তাহলে আমি তোমাদের সকলকে বলতাম ‘তোমরা খুব বেশি বেশি করে মদ খাও ! নেশা-ভাঙ করো !’ কারণ আনন্দ পাওয়াটাই তো মানবজীবনের উদ্দেশ্য ! তাহলে যে যেটাতে আনন্দ পায়, সেটা করতে আমি নিষেধ করবো কেন ? কিন্তু আমি তো জানি_ মানুষ ওই সব কিছুতে প্রকৃত আনন্দ পায় না, যেটা পায়_ সেটা হোলো ক্ষণিকের জন্য একটু সুখ ! আনন্দের অতি অল্প একটু touch ! এইজন্যই ঋষিরা বলেছিলেন_ “নাল্পে সুখমস্তি, ভূমৈব সুখম্ কেবলম্ !” ভূমাতেই সুখ বা আনন্দ ! মানুষ সেই ‘ভূমা’ বা প্রকৃত আনন্দের সন্ধান পায় না, অবশ্য তারা সন্ধান পেতেও চায় না ! শুধু দুঃখের আগুনে পুড়ে পুড়ে মরে ! ‘পোড়া’বলতে শুধু আগুনে পোড়াই নয়, আর একরকম ‘পোড়া’ রয়েছে, সেটা হোলো “acid- এ পোড়া” ! স্বর্ণকাররা জানে সোনাকে ঠিক ঠিক acid- এ পোড়াতে পারলে সোনা নিখাদ হয় ! আর তাতে সোহাগা বা borax মেশালে ওই সোনা ঝকঝকে হয় !
সাধকের জীবনে ভক্তি-রস‌ই যেন acid ! শ্রদ্ধা এবং নিষ্ঠা যেন সোহাগা ! মানুষ তার দেহের জন্য, বিষয়ের জন্য, পরিবারের জন্য দুঃখ পায়কাঁদে, কিন্তু আত্মজ্ঞান লাভের জন্য বা ঈশ্বর লাভের জন্য কজন কাঁদে ? ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে অশ্রুপাত করাই হোলো ভক্তের ভক্তির প্রকাশ ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য নিজেরা নিজেদের জীবনে আচরণ করে দেখালেন_ ঈশ্বর লাভের জন্য কিভাবে কাঁদতে হয়, কিরকম ব্যাকুল হোতে হয় ! কি নিদারুন বিরহানলে পুড়তে হয় ! এই পোড়াই acid-এ পোড়া ! এতেই সাধক pure হয় ! আর এই purity-র সাথে যদি ভক্তি, আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ঐকান্তিক নিষ্ঠা সবসময় বজায় রাখা যায় তাহলেই “সোনায় সোহাগা”, অর্থাৎ একজন্মেই “পরমজ্ঞান” লাভ করা সম্ভব হয় !
অন্তরে ব্যাকুলতা নাই, আন্তরিক প্রার্থনা নাই, মহামায়ার বাঁধন কাটানোর প্রচেষ্টা নাই অথচ শুধু মুখে “ঈশ্বর”- “ঈশ্বর”করছে, তাঁর নামজপ করছে_ এতে কতোটা কি হবে বলোতো ? মুখে “জল”- “জল”_ বারবার বললে কি তৃষ্ণা নিবারণ হয় ? বারবার “চিনি”-“চিনি” বললে কি মুখ মিষ্টি হয় ? হয় না !! তাই নাম-জপের উদ্দেশ্য না বুঝে শুধু ‘আমি ভগবানের নাম করি’, এটা সকলকে বলে বেড়ানো বা নিজেকে ভক্ত হিসাবে অপরের কাছে project-করা ভালো তো নয়ই, বরং এতে একটা অভিমান তৈরি হয়, যা আরো খারাপযা সাধকের অগ্রগতির পথে চরম বাধাস্বরূপ ! ঈশ্বরের উপর নিস্কপট ভালোবাসা, অপকট বিশ্বাস কজনের আছে বলোতো ? কজন ভাবে “আমি তোমার নামজপ করছি, আমার আবার চিন্তা কি ? নাম-নামী তো অভেদ, তাই তোমার নাম করছি মানে সর্বদাই তো তোমার নজরে নজরে রয়েছি ! আমার সমস্ত ভালো-মন্দের কর্তা তো তুমিই ! আমার তুমি আছো আমার আবার ভাবনা কি !”এইরূপ ভাব হোলো ঠিক ঠিক ভক্তের ভাব ! এই ভাব নিয়ে চোখের জল ফেলতে পারলে _সেখানে যে কোনো তথাকথিত অলৌকিক ক্রিয়াকাণ্ড‌ আজও ঘটে যেতে পারে ! … (ক্রমশঃ)