[জিজ্ঞাসু:— পুরাণাদি শাস্ত্র পড়ে দেখেছি সেখানে শুধু বিভিন্ন গল্প-কাহিনী রয়েছে । আপনি যেমন সুন্দর করে আমাদেরকে শাস্ত্র-ব্যাখ্যা গুলি বোঝান, ওখানে সেইরকম তো কিছু পাওয়া যায় না? এই জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন গুরু মহারাজ। আজ পরবর্ত্তী(দ্বিতীয়) অংশ]
…… ভারতীয় পুরানাদি শাশ্ত্রে- অসুর, দৈত্য, রাক্ষস, দেবতা ইত্যাদি যেসব চরিত্রের রূপ দেওয়া হয়েছে__ সেগুলো স্থুলভাবে, তত্ত্বগতভাবে বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে বিচার করলেও দেখা যায়_ চরিত্র চিত্রায়ন একেবারে যথাযথ ! বর্তমান জীববিজ্ঞানীরা মেরুদন্ডী প্রাণীকূলকে আট ভাগে ভাগ করেছে(Mammalia, chordata, amphibia, raptilia, arthropoda, tetrapoda, insects and avis) !
ভারতীয় পুরানেও রয়েছে _কশ্যপ মুনির আটজন স্ত্রী(কশ্যপ হোচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার পুত্র) এবং ঐ আটজন স্ত্রীর গর্ভে আটটি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির সন্তানের বর্ণনা রয়েছে ! পুরাণে যেমন কদ্রুর সন্তানেরা ‘সর্প’ প্রজাতির বা ‘সরীসৃপ’ প্রজাতির, বিনতার সন্তানেরা পক্ষী প্রজাতি ! এছাড়া রয়েছে দিতির সন্তানেরা দৈত্য, দনুর সন্তানেরা দানব, সুষুমার সন্তানেরা রাক্ষস, অদিতির সন্তান দেবতা _ইত্যাদি, অর্থাৎ নিম্নতর চেতনার মানুষ থেকে দেবমানবের বিবর্তন।
এইসব দেখে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, আধুনিক জীবনবিজ্ঞানের গবেষণার মূল সূত্রগুলি এসেছে ভারতীয় শাস্ত্রাদি থেকেই ! বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এটা মানে ! আজো বিভিন্ন উন্নত দেশের বিজ্ঞানীরা ভারতীয় শাস্ত্র থেকেই গবেষণার সূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে । ভারতীয় পুরাণের ওই আট প্রকারের বিভাগ, হয়তো আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে ঠিক ঠিক মেলে না ! কিন্তু বর্তমানের বিজ্ঞান আরো উন্নত হোলে তখন দেখা যাবে, ভারতীয় ঋষিদের করা বিভাগটাই যথার্থ ! কারণ আধুনিক বিজ্ঞানীদের চিন্তা অনুযায়ী ভারতীয় শাশ্ত্র তৈরি হয় নি, ভারতীয় শাস্ত্রাদি থেকেই বর্তমান বিজ্ঞানের সূত্রগুলি এসেছে।
একেবারে সাধারণ মানুষকে উপনিষদের তত্ত্ব সহজে বোঝানোর জন্য‌ পুরাণ সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেখানে ‘ বিভিন্ন প্রাণীর উৎপত্তি এবং বিশেষ করে মানুষের প্রকৃতি সম্বন্ধে বিশদভাবে ধারণা করতে পারাটাই জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় শিক্ষা’–এটাই বিবেচনা করা হয়েছিল। এখানে অসুর, দৈত্য, দানব, রাক্ষস, দেবতা __এগুলি স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন মানুষের‌ই প্রকারভেদ ! স্থানভেদে এবং মানবের গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুযায়ী মানুষকে _অসুর-দৈত্য-দানব-রাক্ষস-মানব-দেবতা ইত্যাদি বিভিন্ন ভাগে অর্থাৎ নিম্নতর মানবচেতনা থেকে উর্দ্ধতর চেতনা পর্যন্ত বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল !
মানব সৃষ্টির একেবারে প্রথমাবস্থায় মানবজাতির আদি পিতা মাতা সন্তান-সন্ততি সহ একই স্থানে বসবাস করতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি হওয়ায়, খাদ্যের অপ্রতুলতার কারণে এবং নিজেদের মধ্যে অশান্তির কারণে__ এক একটি দল বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যত্র বসবাস করতে শুরু করেছিলো ! এইভাবেই পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী, ভিন্ন ভিন্ন মানবসমাজ গড়ে উঠতে লাগলো।
সৃষ্টির আদিতে পৃথিবী ছিল অখণ্ড এবং সেই সময় স্থলভাগ খুবই কম ছিল, তাই মানব সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী স্থলপথেই সেই অখন্ড পৃথিবীর চারিপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলো ! বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী এর পরেই ভূ-অভ্যন্তরস্থ প্লেটগুলির দ্রুত সঞ্চালনের ফলে, মহাজাগতিক বৃহৎ উল্কাপাতের ফলে অথবা হয়তো অন্য কোনো কারণে__ পৃথিবী বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত হয়ে, একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যায় । এর ফলে, ঐ ফাঁকগুলিতে মহাসাগরের জল ঢুকে তাদেরকে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ! সেই সময় গাছপালা, জীবজন্তু, এমনকি মানুষসহ এক একটি বিশাল ভূখণ্ড_অপরটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল ! এইভাবে পৃথিবীর বিস্তার হয়ে যাওয়ার পর ঐ সমস্ত স্থানের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, উষ্ণতা, আবহাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলি সেই স্থানের উদ্ভিদ, জীবজন্তু বা মানুষ সবার উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করলো । জৈব বিবর্তনে, অভিযোজনের সাহায্য নিয়ে যারা survive করতে পারলো, তারা টিকে গেল__ আর বাকিরা পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে গেল ! যেমন দেখা যায় যে, কুকুর পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় পাওয়া গেলেও__ মেরুপ্রদেশ বা শীতপ্রধান অঞ্চলে কুকুরের গায়ের লোম অনেক বড় বড় হোলো (শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে), কিন্তু ক্রান্তীয় বা উষ্ণ ক্রান্তীয় অঞ্চলের কুকুর সহ অন্যান্য জীবের লোম ছোট ছোট হোলো।
শীতপ্রধান দেশের মানুষের গায়ে সূর্যালোকের উত্তাপ কম লাগতো, তাছাড়া শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে এসব অঞ্চলের মানুষেরা সবসময় বস্ত্রাবৃত হয়ে (প্রথমাবস্থায় গাছের ছাল, পশুর চামড়া, গাছের বড় বড় পাতা) হয়ে থাকতে বাধ্য হোতো ! তাই তাদের শরীরে মেলানিন-এর অভাব দেখা দিতে শুরু করলো এবং ধীরে ধীরে হাজার হাজার বছরের বিবর্তনে তারা ফর্সা বা সাদা চামড়ার মানুষে পরিণত হোলো । অপরপক্ষে ক্রান্তীয় অঞ্চলের মানুষের শরীরে সবসময় রোদের উত্তাপ লাগতো এবং তারা সব সময় খালি গায়েই থাকতো ! তাই তাদের গায়ের রং কালোই থাকলো ! কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি অঞ্চলের লোকেরা নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় থাকে, তাই তারা না সাদা–না কালো অর্থাৎ তারা তামাটে বর্ণের হোলো । এই ভাবেই স্থানভেদে, প্রকৃতিভেদে__ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, গায়ের রঙ__ইত্যাদি অনেককিছুই পাল্টে গিয়েছিল এবং এখনও তা পাল্টে চলেছে ! এর ফলেই ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের মানুষের দেহের গঠন, মুখের আদল, ভাষার ব্যবহার ইত্যাদি সবকিছুই পৃথক পৃথক হয়ে যায় এবং এই জন্যেই আজ পৃথিবী জুড়ে মানুষের মধ্যে এতো বৈচিত্র্য, এতো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় । …[আলোচনাটি চলবে] (ক্রমশঃ)