[জিজ্ঞাসু:— পুরাণাদি শাস্ত্র পড়ে দেখেছি সেখানে শুধু বিভিন্ন গল্প-কাহিনী রয়েছে । আপনি যেমন সুন্দর করে আমাদেরকে শাস্ত্র-ব্যাখ্যা গুলি বোঝান, ওখানে সেইরকম তো কিছু পাওয়া যায় না?’–এই জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন গুরু মহারাজ। আজ পরবর্তী অংশ।]
…. যাই হোক, যেটা বলা হচ্ছিলো_ পুরাণ ও মহাকাব্যের মাধ্যমে বেদ-উপনিষদের শাশ্বত সত্যকেই বিভিন্ন গল্প-কাহিনীর মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে বেদে বা ঊপনিষদেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে গল্পের মাধ্যমে তত্ত্বকে বোঝানো হয়েছে, কিন্তু সেখানে প্রায় কোনো ভেজাল ঢোকেনি বললেই চলে । এগুলিকে নিয়ে একটু চিন্তা করলেই পরিষ্কারভাবে গল্পগুলির মধ্যেকার অন্তর্নিহিত তত্ত্বটি বোঝা যায় ! অপরপক্ষে,সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করানোর জন্য পুরাণের গল্পগুলিতে প্রচুর character ঢোকাতে হয়েছে, নানান আজগুবি গল্প এবং অশ্লীলতারও আশ্রয় নিতে হয়েছিল ! আর এইসব করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের গ্রহণযোগ্য হয়তো হয়েছিল কিন্তু তাদের পক্ষে প্রকৃত তথ্য বোঝার ক্ষেত্রে আরো মুশকিল হয়ে গিয়েছে ! তাছাড়া, মূল পুরাণগুলি রচনা হওয়ার অনেক পরে কোনো না কোনো অহংকারী পন্ডিতেরা অথবা রাজাদের নির্দেশে তাদের সভাপণ্ডিতেরা_ পুরাণের মধ্যে নিজেদের রচিত কিছু শ্লোকের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দিয়েছে ! এইভাবে বর্তমানে ভারতবর্ষের প্রাচীন শাশ্ত্রগুলিতে অনেক কিছুই গন্ডগোল হয়ে আছে । বেদেও ‘ইন্দ্র’-এর উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু বেদের ইন্দ্র দেবরাজ নয়, সেখানে ‘ইন্দ্র’ হোলো ‘বিশ্ব মন’। উপনিষদের একটা গল্প বলছি শোনো, তাহলেই পুরাণের গল্পের সঙ্গে এর পার্থক্য বুঝতে পারবে ! বৃত্তাসুর বধের পর দেবতাদের মধ্যে একটা ‘অহংভাব’ এসেছিল ! এতো পরাক্রমশালী একটা অসুরের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ের পর প্রত্যেকেরই মধ্যে একটা relaxing mood এসে গিয়েছিল ! প্রত্যেকে তখন আসব পানে মত্ত হয়ে, তাদের নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজন বা অনুচরদের কাছে সে বৃত্তাসুর বধে কতটা বীরত্ব দেখিয়েছে_ এই নিয়ে বড়াই করছিল, আস্ফালন করছিল ! দীর্ঘদিন ধরে এইসব চলতে থাকায় স্বর্গের কাজকর্ম তখন প্রায় বন্ধ হবার মুখে ! দেবতাদের এ হেন আচরণ দেখে ব্রহ্মের জ্যোতিঃস্বরূপ “মহাশক্তি”, দেবতাদের ঐ অহংকার ভাঙার জন্য সেখানে উপস্থিত হোলেন ! হঠাৎ করে স্বর্গপুরীর প্রবেশদ্বারে অসম্ভব উজ্জল জ্যোতি প্রকাশিত হওয়ায়, সকল দেবতারাই নিজের নিজের অহংকারের জগত থেকে নেমে এসেছিল এবং ঐরকম একটা অত্যাশ্চর্য ব্যাপার সম্বন্ধে কৌতুহলী হয়ে দেবরাজের কাছে এসে জড়ো হোলো । ব্যাপারটা কি_ তা জানার জন্য দেবরাজ অগ্নিকে আদেশ দিলেন, “যাও, দেখে এসো ব্যাপারটা কি ! ঐ অদ্ভুত জ্যোতি কি বা কে ?”
অগ্নি সেই জ্যোতির কাছে পৌঁছে, তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করায়_ সেই অদ্ভুত জ্যোতি থেকে উত্তর ভেসে এলো,_ “আগে বলো তুমি কে ? তোমার নিজের পরিচয় দাও!” গর্বিত অগ্নি নিজের পরিচয় দিলো_ ”আমি অগ্নি । আমার তেজ এবং দাহিকা শক্তি অসাধারণ ! আমি ইচ্ছা করলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারি !” সেই অদ্ভুত জ্যোতি থেকে উত্তর ভেসে এলো_ “তাই নাকি ! তাহলে তোমার সামনে পড়ে থাকা ওই শুস্ক তৃণখণ্ডটি পুড়িয়ে দেখাও তো ! দেখি, তোমার কতো শক্তি !” এই কথা শুনে অগ্নি উপহাসের হাসি হেসে সেই জ্যোতিকে দেখানোর জন্য তার ‘আংশিক শক্তি’ ওই তৃণখন্ডটির উপর প্রয়োগ করলো ! কিন্তু তৃণের কোনো পরিবর্তনই হোলোনা ! এইটা দেখে বিস্মিত হয়ে অগ্নিদেব তার ‘অর্ধ শক্তি’ প্রয়োগ করলো কিন্তু এতেও তৃণখণ্ডটির কিছুই হোলো না ! রেগে গিয়ে এবার অগ্নি ঐ তৃণখন্ডের উপর তার ‘পূর্ণ শক্তি’ প্রয়োগ করলো ! কিন্তু তাতেও তৃণখন্ডটি এতোটুকুও পুড়লো না ! এবার অগ্নি আরো রেগে গিয়ে, এবার সে তার ‘সম্পূর্ণ শক্তি’ প্রয়োগ করলো কিন্তু তাতেও তৃণটির কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটলো না ! এইটা দেখে অগ্নি ভয় পেয়ে, সেই স্থান ত্যাগ করে দেবরাজের কাছে ফিরে এলো। … আলোচনাটি চলবে