(জিজ্ঞাসু:— পুরাণাদি শাস্ত্র পড়ে দেখেছি সেখানে শুধু বিভিন্ন গল্প-কাহিনী রয়েছে । আপনি যেমন সুন্দর করে আমাদেরকে শাস্ত্র-ব্যাখ্যা গুলি বোঝান, ওখানে সেইরকম তো কিছু পাওয়া যায় না?এই জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন গুরু মহারাজ। আলোচনাটি বেশ কয়েকটি এপিসোড ধরে চলছিল। আজ ঐ আলোচনার শেষাংশ) ….. গুরুরূপী ঘটক‌-ই একমাত্র পারেন এদের মধ্যে মিলন ঘটাতে ! গুরুর কাছে মন্ত্রদীক্ষা গ্রহণ করে এবং ক্রিয়াযোগ শিখে নিয়ে কিছুদিন অভ্যাস পড়লেই প্রাণ অপানে এবং অপান প্রাণে স্থিত হয় এবং তখনই সাধকের মন একাগ্র হয়, প্রাণ স্থির হয় ! আর মনের সম্পূর্ণ একাগ্রতা এসে গেলেই তখন সুষুম্না-দ্বার খুলে যায় এবং মহাবাহু হু-হু করে সুষুম্না পথ ধরে উপরে উঠতে শুরু করে ! এরপর একে একে শরীর অভ্যন্তরস্থ ষটচক্রের প্রতিটি চক্র খুলতে থাকে এবং চক্র স্থিত পদ্মগুলি প্রস্ফুটিত হোতে থাকে ! এক একটি চক্রে অবস্থিত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পাপড়িযুক্ত পদ্ম রয়েছে ! যোগ বিজ্ঞানে এই পদ্মগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা রয়েছে ! এখানে ‘পদ্ম’ বলতে পদ্মফুল নয় _ শরীর-অভ্যন্তরস্থ এক একটি চক্র বা একেকটি গ্রন্থির উন্মোচনের ফলে প্রকটিত রূপের সঙ্গে ষড়দল, দ্বিদল, সহস্রদল কমলের তুলনা করা হয়েছে ! আর এটা করা হয়েছে ওই চক্রগুলির বিকাশের সময়কালীন সুক্ষ্ণরূপ অনুযায়ী ! ভারতীয় যোগী বা ঋষিদের এ এক অনন্য আবিষ্কার এবং অপূর্ব উপস্থাপনা ! সাধারণ মানুষের ধারণা নেই বলে, এগুলো ঠিকমতো বুঝতে পারে না ! কিন্তু যাঁরা সাধক বা যোগী তাঁরা এই তত্ত্ব ঠিকই বুঝতে পারেন ! আর সাধকের সাধনার অন্তিম পর্যায়ে সহস্রারে অবস্থিত সহস্রদল কমল সম্পূর্নরূপে প্রস্ফুটিত হয় ! বৈষ্ণবমতে এই অবস্থাকেই বলা হয়েছে “রাসমঞ্চ”, হটযোগ বা রাজযোগীদের ক্ষেত্রে এই অবস্থাই “জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন”, জ্ঞানযোগীরা এই অবস্থায় পৌঁছে ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার করে থাকেন! যাইহোক, এবার বুঝলে তো ঊপনিষদে বর্ণিত প্রাণ-অপাণের ক্রিয়াই, পুরাণে কোনো না কোনোভাবে প্রেমিক-প্রেমিকাকে পরস্পরের অন্বেষণ জনিত প্রেমের গল্পে রূপ পেয়েছে ! মানুষ পুরাণাদি শাস্ত্র পড়ে এটাকে ‘প্রেমের গল্প’ মনে করেই রস পায় ! একমাত্র আধ্যাত্মিক ব্যক্তিরাই পুরাণের গল্প থেকে আধ্যাত্মিক তত্ত্বগুলি খুঁজে বের করতে পারে ! পুরাণের গল্পগুলির মধ্যে রূপকাকারে লুকিয়ে থাকা আধ্যাত্মিক রহস্য জানার জন্য, সাধারণ মানুষকে কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি বা সদ্গুরুর পদপ্রান্তে বসে জেনে নিতে হবে । অন্যথায় সে কেমন করে পারবে ? সাধারণ মানুষের সেই সাধনা কোথায় ? দ্যাখো, পুরাণ জলে-দুধে মেশানো রয়েছে, সেখান থেকে জল ফেলে শুধু দুধটা গ্রহণ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সত্যিই অসম্ভব ! রাজহংস যেমন দুধ থেকে জলকে আলাদা করতে পারে, তেমনি একমাত্র পরমহংস-স্থিতির মহাপুরুষরাই পারেন পুরাণের প্রকৃত রহস্য ভেদ করতে ! আর তাঁরা সমাজে শরীর ধারণ করে এটাই করে থাকেন । যুগে যুগে মহাপুরুষরাই সমাজে এসে সাধারণ মানুষকে শাশ্ত্রাদির মধ্যে রূপকাকারে লুকিয়ে থাকা প্রকৃত শিক্ষার উন্মোচন করে থাকেন ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, পুরাণাদিতে ‘সত্য’ যেন “সারে-মাতে” আছে ! সেখান থেকে সার-টা গ্রহণ করতে হয় !” এই কথার অর্থ হোলো আখ থেকে যে গুড় প্রস্তুত হয়, সেই গুড় বাড়িতে কিছুদিন রাখলেই গুড়ের সারভাগটা নিচে নেমে যায় এবং ঝোলাগুড় বা তরল অংশটা উপরে উঠে আসে ! সেটাকে গ্রাম বাংলায় ‘মাতগুড়’ বলে ! আসল গুড়ের স্বাদ পেতে হোলে ঐ ‘মাত’ অংশ ফেলে দিয়ে ‘সার’ অংশটা খেতে হয় ! পুরাণাদি শাস্ত্র থেকে প্রকৃত ‘সত্য’ তুলে আনতে হোলে এই রকমভাবেই অনেককিছু বাদসাদ দিয়ে গ্রহণ করতে হয় ! আর রূপকগুলি ব্রহ্মজ্ঞ গুরুর কাছে বসে বুঝে নিতে হয় ! অন্যথায় এগুলি সাধারণ মানুষের কাছে নিছক গালগল্প বলেই মনে হয়। ফলে পরম সত্য, জগৎ-জীবন-ঈশ্বরের প্রকৃত রহস্য সাধারণ মানুষের কাছে অধরাই থেকে যায়। সুতরাং যদি প্রকৃত‌ই ‘পরম সত্যে’-র সন্ধান পেতে চাও_তাহলে কোনো ব্রহ্মবিদ সদগুরুর পদপ্রান্তে বসে শ্রদ্ধাযুক্ত চিত্তে তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করো। তাঁকে প্রসন্ন করার চেষ্টায় ব্রতী হ‌ও, তাঁর কৃপা লাভ হোলেই তোমার জীবনের উদ্দেশ্য সফল হবে।।