স্থান:—বর্ধমান,হীরুদাদের বাড়ি। সময়_১৯৯১,২৫শে নভেম্বর।
জিজ্ঞাসু:—কিন্তু গুরুজী ! মুসলমানদের food-habit-টা আমার একদম ভালো লাগে না ! শুধু গোমাংসের কথাই বলছি না, যে কোনো খাবারকে অতিরিক্ত মশলা দিয়ে অথবা খাবারগুলো বাসি করে খেতে ভালবাসে।
আর দেখেছি_ ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং গোঁড়ামি ওদের মধ্যে খুব বেশি ! তাছাড়া ওরা খুবই অপরাধপ্রবণ__ এগুলো কিন্তু আপনাকে মানতেই হবে, যুক্তি দিয়ে খন্ডন করতে পারবেন না?
গুরু মহারাজ:—এটা তুমি কি বলছো ! তোমার কথা আমাকে মানতেই হবে ? তার মানে ?? তুমি তোমার মতামত নিশ্চয়ই বলতে পারো__ কিন্তু সেটা যে সার্বজনীন হবে বা সবাইকে মানতেই হবে__ এমন তো কোনো মানে নাই !! দ্যাখো, সত্যি কথা বললে_সবাই নিতে পারে না ! আমি যদি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি__”মুসলমানদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা রয়েছে, আর অন্য কোনো ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রবণতা নাই ? হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে নাই ? তোমার মধ্যে সংকীর্ণতা নাই ??” তুমি মনের সংকীর্ণতার কথা বলছো তো ? সংকীর্ণতার জন্য প্রধানত যেটা দায়ী,__ সেটা হোচ্ছে অশিক্ষা এবং কুশিক্ষা ! অশিক্ষা–তাও ভালো কিন্তু ধর্মীয় নেতাদের শেখানো কুশিক্ষার জন্য এই ধর্মীয় গোঁড়ামি মানুষের মধ্যে প্রবেশ করে এবং সেখান থেকেই যতরকম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় ! তবে তুমি যে কথাটা বললে__ অর্থাৎ গরুর মাংস ও মসলাযুক্ত খাবার ব্যবহারের কথা_____ এগুলি শরীরের উপরে effect করে, মনে খাদ্যের তেমন খুব বেশি একটা প্রভাব পড়ে না!
আরও একটা কথা তোমাকে বলা যায়__ তুমি আমাদের দেশের মুসলিমদের নিয়ে কথা বলছো তো ! কিন্তু ওরা কয় পুরুষের মুসলমান, যে খাদ্যাভ্যাসের বদলের ফলে ওদের genetic-characteristic-এর পরিবর্তন হয়ে যাবে বা ওদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়ে যাবে ?
সত্যি কথা বলতে কি__ খাদ্যাখাদ্য ব্যাপারটা এমন কিছু নয়, আসল কারণ ওই যে বললাম_ ‘অশিক্ষা এবং কুশিক্ষা’ ! তুমি একটা পরিসংখ্যান নিয়ে দ্যাখো যে, হিন্দুদের থেকে মুসলিমদের অশিক্ষার হার কত বেশি__আর সেই অনুপাতে অপরাধ প্রবণতার হার বিচার করো__ তাহলে আমার কথাটা ভালোভাবে বুঝতে পারবে।
স্বামী বিবেকানন্দ এই শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাটা বুঝেছিলেন ! তাই উনি তখন থেকেই ভারতবর্ষে শিক্ষাবিস্তারের উপর প্রচন্ড জোর দিয়েছিলেন ! উনি ওনার শিষ্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন __”গ্রামে গ্রামে গিয়ে এক একটা চণ্ডীমণ্ডপ দেখে বসে পড়্ ! আর সেখানে গিয়ে রামায়ণ-মহাভারতের গল্প বলে বলে শিক্ষা দে ! যদি গল্প শুনতে লোক না আসে, তাহলে দু বান্ডিল ‘বিড়ি’ নিয়ে পাশে রেখে দিবি ! দেখবি, বিড়ি খেতে লোকজন আসবে, তখন তাদেরকে শিক্ষা দিবি” !
দ্যাখো, কোনো সমাজের সামগ্রিকভাবে সচেতনতা আনতে চাই__ ‘শিক্ষা’ ! শিক্ষার ফলে মানুষ নৈতিক বা আধ্যাত্মিক হয় না___ সে কথা মানছি ! কিন্তু শিক্ষা __মানবজীবনের অগ্রগতির একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে দেয়, উত্তরণের ভিতটা তৈরি করে দেয়। যে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে মানবজীবনের প্রয়োজনীয় বাকি শিক্ষাগুলি সহজে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে !
USA বা EUROPE-এর উন্নত দেশগুলিতে অর্থাৎ যাদেরকে আমরা প্রথম বিশ্বের দেশ বলি,__ সেইসব দেশগুলিতে আজ যে চিত্র দেখতে পাচ্ছি –সেটা হোলো যে, ওখানকার স্কুলগুলি উন্নতির শিখরে পৌঁছে গেছে ! বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে ওরা যে চূড়ান্ত success পেয়েছে, তার কারণ সার্বিক শিক্ষার প্রসার ! আজ থেকে প্রায় একশোর ও বেশি বছর আগে, স্বামী বিবেকানন্দকে ওরা কিভাবে নিয়েছিল বলো তো !! মুক্তমনের অধিকারী না হোলে কি একজন অখ্যাত, পরাধীন দেশের নাগরিককে—শুধুমাত্র তার মুখের কথায় অতোটা মর্যাদা দিতে পারতো ? সেটা যে পারলো__তা তো ওই platform তৈরি ছিল বলেই_ তাই না ? অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সেভাবে স্বামীজীকে তখন নিতেই পারেনি ।
তৎকালীন সময়ের অশিক্ষায় ভরা স্বামীজীর স্বদেশ ভারতবর্ষ‌ই তাঁকে ঠিকমতো নিতে পারলোনা__ অন্যান্য দেশের কথা আর কি বলবে !
ভারতবর্ষ-সহ তৃতীয় বিশ্বের সমস্ত দেশ গুলির এখন একান্ত দরকার শিক্ষা ! ইতিহাস-ভূগোল_জড়বিজ্ঞান এবং বিভিন্ন দেশের দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষা ! এইগুলি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভালোভাবে শেখাতে হবে ! এইসব শিক্ষা লাভ করলে মানুষের মন অনেকটা সংকীর্ণতা মুক্ত হয়, বিশালতার স্পর্শ পেয়ে মানুষের মন উদার হয় ! বিভিন্ন ধর্মের মূল কথা জানতে পারলে, নিজের ধর্মমতের সঙ্গে একটা তুলনামূলক বিচার করতে পারা যায় ! এভাবেই মানবের মন সংকীর্ণতা-মুক্ত হোতে পারে !
তাই বলছিলাম_সমাজের সকলকে ‘শিক্ষা দেওয়া’, মানে হোলো যেন __platform তৈরি করা ! যেখানে দাঁড়িয়ে সকল মানুষকে নৈতিক শিক্ষা, আধ্যাত্মিক শিক্ষা ইত্যাদি সহজেই দেওয়া যায় । আর একথাও বলা যায় যে, মানুষ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোলে, সে আরো অন্যান্য শিক্ষা অতি সহজে নিজেরাই গ্রহণ করতে পারে !
তুমি যেটা বলতে চাইলে অর্থাৎ এখানকার ঐ সম্প্রদায়ের মধ্যে গোঁড়ামির ব্যাপারটা__ওটি শুধুমাত্র অশিক্ষার কারণেই ! জানো__এরা এতটাই গোঁড়া যে, আরব দেশের প্রকৃত মুসলমানেরাও এদের কিছু কিছু আচরণে অবাক হয়ে যায় ! তবে এটা নিশ্চিত সত্যি কথা জানবে যে, অশিক্ষা এবং একেবারে নিচের level-এর ধর্মীয় নেতাদের শেখানো কুশিক্ষাই ঐ সম্প্রদায়ের মানুষকে এতোটা গোঁড়া বা উগ্র মৌলবাদী করে তুলছে_কোনো খাদ্যাখাদ্য বা food-habit এরজন্য দায়ী নয় !