স্থান:— বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন। সময়:–২৬-শে ডিসেম্বর,১৯৯১(এই বছরেই প্রচন্ড বৃষ্টির জন্য গুরু মহারাজের জন্মদিনের উৎসব সব পন্ড হয়েছিল। সেবারই গুরু মহারাজের উপস্থিতিতে শেষ ২৫-শে ডিসেম্বর পালন)।
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:— সিঙ্গুরের ভক্তগণ, আশ্রমের মহারাজগণ এবং কিছু বাইরের ভক্ত !
জিজ্ঞাসু:—আচ্ছা মহারাজ ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে তো ভগবান বলা হয় ! দক্ষিণেশ্বরে আসার পর মথুরবাবু, রানী রাসমণি, নরেন্দ্রনাথ সহ অন্যান্য ভক্তরা না হয় ঠাকুরকে অনেকটাই চিনতে পেরেছিল ! কিন্তু ছোটবেলায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে যেমন ভগবানত্বের প্রকাশ পেয়েছিল, ঠাকুরের মধ্যে তেমন কিছু প্রকাশ পেয়েছিল কি ?
গুরু মহারাজ:—-দ্যাখো, প্রথম কথা হোচ্ছে ঈশ্বরের লীলা সবসময় একই রকম হয় না ! প্রতিটি লীলাই, অন্যটা থেকে আলাদা হয়ে থাকে! যুগ অনুযায়ী বা যুগের প্রয়োজনে ঈশ্বরের অবতরণ হয় ! তাই যে যুগে যেমন শক্তির প্রকাশ ঘটানোর প্রয়োজন, ঠিক তেমনটাই হয়, তার বেশিও না কমও নয় ! সুতরাং বাইরে থেকে_ এইভাবে তুলনামূলক বিচার করতে যেও না, এটা জানবে যে ঈশ্বরতত্ত্ব একই কিন্তু লীলা ভিন্ন ভিন্ন ! এবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় আসি ! একটা কথা আছে জানো তো সংযোগ-সম্পর্ক-সম্বন্ধ ! যখন কোনো অবতারপুরুষ শরীর ধারণ করেন, তখন অনেকের সঙ্গেই তাঁর সংযোগ হয় এদের মধ্যে অনেকে তাঁর সংস্পর্শে আসে, কিন্তু তাদের সকলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থাপন হয় না ! আবার সম্পর্ক স্থাপন হয়তো অনেকের সঙ্গেই হয়, কিন্তু সবার সাথে সম্বন্ধ তৈরি হয় না ! যাদের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ তৈরি হয় সে দু-চারজন ! আর যাদের হয় তারাই ঈশ্বরের অবতারকে “ভগবান” হিসাবে ঠিক ঠিক চিনতে পারেন ! প্রকৃতঅর্থে বলতে গেলে, যাদেরকে তিনি কৃপা করে চেনা দেন তারাই তাঁকে চিনতে পারে, নাহলে কার সাধ্য ভগবানকে চিনতে পারবে !!
তাঁর সঙ্গে যাঁরা লীলাসঙ্গী হয়ে আসেন, তাঁরাই সব ভুলে গিয়ে মহামায়ার মায়ায় ভেসে যান তো সাধারন মানুষের কি কথা !
তবে দ্যাখো, ভগবানের সংযোগ স্থাপনটাও কিছু কম কথা নয় ! তারই বা সুযোগ কজন পায় ? ঈশ্বরের নিকটস্থ হোতে গেলে সাধকগণকে কতো কঠিন কঠোর সাধনা করে বৈকুণ্ঠে যেতে হয়তাই না ! আর দ্যাখো, ঈশ্বরের অবতরণ হোলে, যো সো করে একবার শুধু তাঁর কাছে পৌঁছানো ! ব্যাপারটা কতো easy বলোতো ! এইভাবে সংযোগটা হয়ে যেতে পারে, এবার যাওয়া-আসা শুরু হোলেই তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক স্থাপন হয়েই যায় ! গুরু, বাবা, দাদা ইত্যাদি নানারকম সম্পর্ক পাতাতে অসুবিধা টা কোথায় ! এইরকম সম্পর্ক পাতাতে পারলে কত জন্মের সাধনার অগ্রগতি হয়ে যায়মানুষ কোনোদিনই তা জানতে পারে না ! দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘর ঝাঁট দিতো, ধোয়া-মোছা-পরিষ্কার করতো একজন মহিলা ! তার নাম ছিল বৃন্দে ! সবাই বলতো ‘বৃন্দে ঝি’ ! ‘কথামৃত’-কার মাস্টারমশাই শ্রী মহেন্দ্রলাল গুপ্ত যেদিন প্রথম দক্ষিণেশ্বরের মন্দির দর্শন করে ঠাকুরের কাছে গিয়েছিল, তখন একেবারে সন্ধ্যাহ্নিক করার সময় ! ফলে সেইসময় ঠাকুর ঘরের ভিতরে ছিলেন । বাইরে বৃন্দে ঝি কিছু কাজকর্ম করছিল। তাকে কাছে পেয়ে, মাস্টারমশাই তাকেই_ ঠাকুর সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলেন ! কথায় কথায় একবার যখন মাস্টারমশাই বলে ফেলেছেন “আচ্ছা, উনি বুঝি অনেক বই পড়েন ?” তখন বৃন্দে ঝি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়েছিল “আর বাবা বই-টই ! বেদ-বেদান্ত সব ওনার মুখে !”
তাহলে বুঝতে পারছো, এই অশিক্ষিত মহিলাটিরও ঠাকুর সম্বন্ধে সম্যক ধারণা হয়ে গিয়েছিল ! ওর তো তেমন কোনো সাধন-ভজনও ছিল না ! সে নিতান্ত গৃহস্থ-মহিলা, অভাবের তাড়নায় রানী রাসমনির মন্দিরে ধোয়া-মোছার কাজ নিয়েছিল ! কিন্তু শুধুমাত্র ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে থাকার সুবাদেই তার অন্তরজগতে “ধারণা” পাকা হয়ে গিয়েছিল !
যোগশাশ্ত্রে রয়েছে অষ্টাঙ্গিক ক্রমের কথা ! তার শেষ তিনটি ধাপ হোলো_ ধারণা, ধ্যান ও সমাধি ! তার মানে হোচ্ছে, যার ‘ধারণা’ পাকা হয়ে গেছে পূর্ণতা লাভের পথে তার মাত্র আর দুটি ধাপ বাকি থাকলো_ ধ্যান ও সমাধি ! ব্যাপারটা বুঝতে পারলে কি ? এইরকম অবস্থায় তুমি ভগবানকে হয়তো ঠিকমতো চিনতে পারছো না কিন্তু ধারণা করতে পারছো যে, ইনি নিশ্চয়ই কেউ এমন একজন মানুষ, যিনি আর পাঁচজন মানুষের চেয়ে আলাদা ! …. (ক্রমশঃ)