জিজ্ঞাসু:–আচ্ছা গুরু মহারাজ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে তো ভগবান বলা হয় ! দক্ষিণেশ্বরে আসার পর মথুরবাবু, রানী রাসমণি, নরেন্দ্রনাথ সহ অন্যান্য ভক্তরা না হয় ঠাকুরকে অনেকটাই চিনতে পেরেছিল ! কিন্তু ছোটবেলায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে যেমন ভগবানত্বের প্রকাশ পেয়েছিল, ঠাকুরের মধ্যে তেমন কিছু প্রকাশ পেয়েছিল কি ?
(এই জিজ্ঞাসার উত্তরের আজ শেষ অংশ….)]
……….. সেদিন কালনায়, ভগবান দাস বাবাজীর আখড়ায় তখন বিভিন্ন বৈষ্ণব অপরাধে অপরাধীদেই বিচার চলছিল ! ঠিক এই সময়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ নৌকাযোগে ভাগ্নে হৃদয়রামকে সঙ্গে নিয়ে ঐ আশ্রমে এসে হাজির হয়েছিলেন ! ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণের জীবনে এক একসময়, এক একভাবের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যেতো এবং তাঁর শরীরকে কেন্দ্র করে সেইসব ভাবের লক্ষণ ফুটে উঠতো ! যে সময়ের কথা হোচ্ছে, সেই সময় ঠাকুরের শরীর থেকে সবসময় একপ্রকার দিব্য জ্যোতি বেরোতো ! এই অবস্থায় ওনাকে যে দেখতো, সেই অবাক হয়ে যেতো ! অনেক পরবর্তীতে সারদা মা সেই সময়কালীন ঠাকুরের বহিঃ সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছিলেন। উনি বলেছিলেন–‘ঠাকুরের তখন গায়ের বর্ণ কাঁচা সোনার মতো উজ্জ্বল হয়ে গিয়েছিল, হাতে যে সোনার তাবিজ ছিলতা বর্ণ আর ঠাকুরের গায়ের রং এক হয়ে গিয়েছিল !’ যাই হোক, সেই সময়ে উনি গায়ে জামা রাখতে পারতেন না কিন্তু সেদিন তিনি যেহেতু বাইরে এসেছেন এবং যাতে করে সেখানকার সাধারণ মানুষজনের দৃষ্টি আকর্ষিত না হয়, তাই উনি কাপড় দিয়ে সারা গা ঢেকে-ঢুকে ভগবান দাসের আশ্রমে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। ঠাকুর যখন ভগবান দাসের আশ্রমে গিয়ে প্রবেশ করলেন, সেখানে তখন অনেক বৈষ্ণব ভক্তরা উপস্থিত ছিল ! কারণ ওই যে বলা হোলো সমগ্র পূর্বাঞ্চলের বৈষ্ণবদের কেউ কোনো অপরাধ করলে, তার বিচারের ব্যবস্থা করা হোতো ওখানে ! তাছাড়া ভগবান দাসের কাছে বৈষ্ণব-শাস্ত্র পাঠ শুনতেও দুর-দুরান্ত থেকে ভক্ত মানুষেরা ওখানে এসে হাজির হোতো ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ হৃদয়কে সঙ্গে নিয়ে ওই উপস্থিত লোকজনদের মাঝেই বসে পড়েছিলেন ! ভগবানদাস বাবাজী একটু দূরে একটি উচ্চ আসনে বসে বসে ভাগবতের ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং ফাঁকে ফাঁকে বৈষ্ণব অপরাধের বিচারও করছিলেন ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যেই মুহূর্তে ওই আশ্রমে প্রবেশ করেছিলেন, ভগবানদাস কিন্তু সেই মুহূর্তেই টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে, এখানে একজন মহাপুরুষের আগমন ঘটে গেছে ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তার শরীরের দিব্য জ্যোতি কাপড়ে ঢেকে নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ভগবানের শরীরের গন্ধ তো আর ঢাকতে পারেননি ! ফলে বাবাজি ঐ দিব্য গন্ধটা পেয়েছিলেন এবং কোনো না কোনো মহাপুরুষের আগমনবার্তা টের পেয়ে গিয়েছিলেন ! ভগবানদাস চারিদিকে ভালো করে তাকিয়েও তেমন কাউকে “বিশেষ” বলে চিহ্নিত করতে পারলেন না, কারণঠাকুর নিজেকে ঢাকাঢুকো দিয়ে গুটিসুটি মেরে, মাথা নিচু করে বসেছিলেন ! তখন ভগবান দাসজী একটা কৌশল অবলম্বন করলেন ! একজন ব্যক্তির বৈষ্ণব অপরাধের বিধান চাওয়া হয়েছিল, তাকে উদ্দেশ্য করে ভগবানদাস বাবাজী জোরে জোরে বলতে লাগলেন,_ “তোমরা ওই বৈষ্ণবের কন্ঠি(গলার মালা, বৈষ্ণবের অন্যতম লক্ষণ) কেড়ে নাও, বৈষ্ণব সমাজ থেকে ওকে দূর করে দাও ! আমি বলছি_ তোমরা এটা করো! আমি পূর্ব ভারতের বৈষ্ণব সমাজের শিরোমনি ! আমি-ই সব, আমি যা বলবোএখানে সেটাই হবে !” ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক কিছু বলতে শুরু করে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ এই ধরনের নানা রকম ভাবে ভগবানদাস ছদ্ম-অহংকার প্রদর্শন করতে শুরু করে দিয়েছিলেন ! আর তাতেই কাজ হয়ে গেল !
কিছুক্ষণ বাবাজীর অহংকার পূর্ণ বক্তব্য শুনতে শুনতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবস্থ হয়ে গেলেন এবং গায়ের কাপড় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন “ওরে ! “সোহহং-সোহহং” করিস না ! (আগে একটা “দা” বসা !) বল্ ‘দাসোহহং’ !” এই কথা বলতে বলতেই ঠাকুর এগিয়ে গেলেন ভগবানদাসের দিকে ! তাঁর অঙ্গ-জ্যোতিঃতে তখন ওই আশ্রম আলোয় আলোয় ঝলমল করে উঠেছে ! ভগবান দাসের প্রকৃত ভগবানকে চিনতে কোনো অসুবিধাই হোলো না ! উপস্থিতজনেরাও কিছু একটা বিশেষ ঘটনা ঘটতে পারে ভেবে উৎসুক হয়ে পড়লেন। ভগবানজীও আসন থেকে নেমে এসে কাঁদতে কাঁদতে ঠাকুরের চরণে লুটিয়ে পড়লেন ! তখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে ধীরে ধীরে তুলে নানান উপদেশ দিয়েছিলেন !
সেইদিনই ওখান থেকে ভগবানদাস বাবাজী ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ যথার্থই ঈশ্বরের অবতার, মহাপ্রভুর উত্তরসূরি ! তাই পেনেটিতে (বা পানিহাটিতে) মহাপ্রভুর আসনে উঠে দাঁড়ানোর জন্য বৈষ্ণবসমাজ__ এনার উপরে যে দোষারোপ করেছে, তা সম্পূর্ণভাবে খন্ডন করা হোলো !’
এইভাবেই সেদিন তৎকালীন সময়ের এক অন্যতম ভক্তের সাথে ভগবানের অন্তরঙ্গ লীলা সংঘটিত হয়েছিল !
তাহলে বোঝা গেলো তো, যে ভগবান বা যে কোনো উন্নত মহাপুরুষদেরকে চেনার ক্ষমতা থাকলে এবং যোগ্যতা থাকলে এনাদেরকে চেনা যায় ! তবে এটাও বলা যায়, মহাপুরুষেরা তাদের কাছেই নিজেকে প্রকাশিত করেন অথবা চেনা দেন, যারা চেনার উপযুক্ততা অর্জন করেছে ! দ্যাখো না, ঐক্ষেত্রেও তো তেমনটাই হয়েছিলো ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যদি সেদিন কালনায় না আসতেন, তাহলে তো আর বাবাজীর সাথে তাঁর দেখাই হোতো না এবং ঐ ঘটনাটাও ঘটতো না ! কিন্তু সবই কার্য-কারণ সম্পর্কে বাঁধা ! ঘটনা এরকমটাই ঘটার ছিল, তাই ঘটেছিল !