স্থান:–বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন! সময়২৬শে জানুয়ারি থেকে ২-রা ফেব্রুয়ারি,১৯৯২! উপস্থিত ব্যক্তিগণ:–জয়দীপ, কোলকাতার দেববাবু(লেখক), উত্তর ভারতের ডঃ সুধীর ও তার পরিবার, দক্ষিণ ভারতের সত্যমজী ও তার পরিবারের সদস্যরা এবং আরও অনেক ভক্ত বৃন্দ ! জিজ্ঞাসু:—মন কেন নিম্নগামী হয় গুরুজী ? এতো চেষ্টা করিতবু মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না কেন ?
গুরু মহারাজ:—দ্যাখো, এই পৃথিবী গ্রহের তো নিজস্ব একটা ধর্ম রয়েছে ! তাই সাধারণতঃ তার প্রভাব পড়ে মানুষের মনেও ! কি বলছি বুঝতে পারছো_ পৃথিবীতে দেখবে যে কোনো জড়বস্তুরই নিচের দিকে নামার জন্য সর্বদা একটা টান অনুভুত হয়_ একে gravitational force বলে ! ‘নিম্নগামীতা’– এই ধর্ম রয়েছে বলেই তো ঝরনার জল, নদীর জলে প্রবাহের সৃষ্টি হয়, উঁচুতে থাকা যে কোনো বস্তু নিচের দিকে পড়ে। এবার তোমাদের একটা রহস্য বলছি শোনো, সাধারণভাবে জলের ধর্ম নিম্নগামীতা কিন্তু সেই জলকে ঊর্ধ্বমুখী করা যায় কিভাবে বলোতো ? তুমি যদি জলকে আগুনের উপর রেখে, ওই জলকে বাষ্পীভূত করতে পারো_ তাহলে বাস্পরূপী জলের গতি ঊর্ধ্বমুখী হয় ! তেমনি যদি তুমি তোমার মনকে ঊর্ধ্বমুখী করতে চাও, তাহলে তোমাকে তোমার কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করতে হবে ! কোটি সূর্যসম তেজ ঐ কুলকুণ্ডলিনীর_ শাস্ত্রে এই কথাই বলা হয়েছে । একেই আদ্যাশক্তি রূপেও কল্পনা করেছেন ভারতীয় ঋষি-মুনি-যোগীরা । কুলকুন্ডলিনীর জাগরণ হোলে এর তেজের প্রভাবে সাধকের শরীরস্থিত শক্তি ঊর্ধ্বমুখী হয় । আর একবার ঊর্ধ্বমুখী হোতে শুরু করে দিলে, তা সহজে তা আর নিম্নগামী হোতে চায় না ! এই অবস্থায় মন কোনো পার্থিব বিষয়ে আর নিবদ্ধ হয় না ! সাধকের আত্মতত্ত্বের অন্বেষণে নিয়োজিত হওয়াটাই হোচ্ছে তার মনের ঊর্ধ্বগামীতা! সাধকের জীবনে এটা দেখতে পাওয়া যায় যে, কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণের পর তার পার্থিব বিষয় আলুনি বোধ হোতে শুরু করে ! তখন শুধুই পরমার্থ লাভের জন্য অন্তর ব্যাকুল হয়ে ওঠে, এই অবস্থা প্রাপ্ত হোলেই মন হু-হু করে উপরে উঠে, একে একে মানব-চেতনা বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে প্রথমে সবিকল্প এবং পরে নির্বিকল্প ভূমিতে প্রবেশ করে ! এই অবস্থায় জীবের আত্ম সাক্ষাৎকার হয় এবং মানবজীবনের উদ্দেশ্য সফল হয়। কিন্তু এইসব তত্ত্বকথা তো যুগে যুগে সকল মহাপুরুষেরাই বলে গেছেন আবার এখনো বলে চলেছেন ! বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রেও এইসব কথার উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু তাতেও সাধারণ মানুষ কতখানি সচেষ্ট হোলো বলোতো ? জলে না নামলে যেমন কেউ সাঁতার শিখতে পারে না_ তেমনি যোগ-সাধন ইত্যাদি শুরু না করলে তো কোনোরকম আধ্যাত্মিক অনুভূতি বা উপলব্ধি কিছুই হবে না ! তাই শুরুটা করতেই হবে !!
ধ্যানের গভীরে ডুবে যাও ! শ্যামাসঙ্গীত গানে আছে” ডুব ডুব ডুব ডুবসাগরে আমার মন ! তলাতল পাতাল খুঁজলে পাবি রে প্রেম রত্নধন !” ধ্যান করতে করতে, ধ্যানের গভীরতায় ডুবে যেতে হবে, তবে তো নানারকম রত্ন-ধন পাওয়া যাবে ! আর তুমি যে মনের নিম্নগামীতার কথা বললে, ওটা সাধারণ অবস্থার কথা ! নিষ্ঠা সহকারে ধ্যান-জপ করতে শুরু করলে দেখা যাবে যে, ধীরে ধীরে মন আর নিম্নগামী হোচ্ছে না।। জিজ্ঞাসু(ডাক্তার):–আচ্ছা গুরুজী ! শিশুরা ‘বাবা’ বলার আগে ‘মা’ কথাটা উচ্চারণ করতে শেখে। এমনকি অনেকক্ষেত্রে দেখেছি ‘কাকা’ উচ্চারণটাও আগে শেখে ! এমনটা কেন হয় ?
গুরু মহারাজ:—হ্যাঁ, এটা তুমি ঠিকই পর্যবেক্ষণ করেছো ! শিশুরা ‘ব’বলার আগে ‘ক’ বলতে আগে শেখে ! আসলে যে কোনো শিশু ব্যন্জনবর্ণের মধ্যে ক-বর্গের বর্ণগুলিই আগে উচ্চারণ করতে পারে_ এটাই মানুষের সহজতা ! এইজন্যই ঋষিরা, বর্ণমালা সৃষ্টির সময় ক-বর্গকে(ক, খ, গ, ঘ, ঙ) ব্যঞ্জনবর্ণের প্রথমে বা আগে রাখলেন_ তারপরে যথাক্রমে ‘চ’-বর্গ, ‘ট’-বর্গ, ‘ত’-বর্গ, এবং ‘প’-বর্গ রেখে বর্ণমালা তৈরি করেছিলেন ! আর ‘ম’ বা ‘মা’ উচ্চারণের কথা বলছো তো দ্যাখো, প্রকৃতপক্ষে অ–উ–ম এই তিনটে শব্দের উচ্চারণ শুধু শিশুরা কেন, সকলেই এমনকি বোবারাও বলতে পারে !
যেহেতু সৃষ্টির ‘আদি শব্দ’ বা নাদ” হোলোওঁ(অ-উ-ম), আর সেখান থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি, ফলে”অ-উ-ম”–এই তিনটি অক্ষরের উচ্চারণে কারোর কোনোরকম অসুবিধা হয় না ! সুতরাং এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো_শিশুরা ‘বাবা’ বলার আগে, ‘মা’ উচ্চারণটা কেন সহজেই শিখে যায় !