[ পাহাড়ি বা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরাই জন্মচক্রের বিবর্তনে সভ্য, শিক্ষিত, শহুরে মানুষ হয়ে জন্মায়এইসব নিয়ে কথা হচ্ছিলো। সেই প্রসঙ্গেই আবার নতুন জিজ্ঞাসা…..] জিজ্ঞাসু :– তাহলে এই so-called সভ্য সমাজে বাস করে আমাদের ঠিক কেমনটা হওয়া উচিত ?
গুরুমহারাজ :– মানুষের মত ‘মানুষ’ হওয়া উচিত ! সমস্ত জীবের মধ্যে মানব শ্রেষ্ঠ-জীব ! তাই মানবের প্রথম কর্তব্য-ই হোলো ঠিক ঠিক মানুষ হয়ে ওঠা ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন – “মানুষ – মান-হুঁশ”! অর্থাৎ যার মান এবং হুঁশ রয়েছে সেই মানুষ ! আর আমি বলছি –অন্য আর কোনো কিছুরই দরকার নাই, মানুষের শুধু “হুঁশ” থাকলেই হবে ! ফারসি শব্দ হুঁশ বা ‘হৌঁশ’ অর্থে ‘বিবেক’ ! মানুষের যদি বিবেক জাগ্রত হয়ে যায় – তাহলেই সে মানুষ !
দ্যাখো, ছোটবেলা থেকে অধিকাংশ শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা-মায়েরা তার শিশুদেরকে ছোটো থেকেই শেখায় – ‘তোকে বড় হয়ে অনেক লেখাপড়া শিখতে হবে’, ‘তোকে ডাক্তার হোতে হবে’, ‘তোকে ইঞ্জিনিয়ার হোতে হবে’ – কিন্তু কোনো বাবা-মা-ই তার সন্তানকে শেখায় না – ” বাবা ! বড় হয়ে তোকে একটা ভালো মানুষ হয়ে ওঠতে হবে_ তারপর না হয় অন্য কিছু হবি ! আগে মানুষ হয়ে উঠে, তারপর তুই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-প্রফেসর-শিক্ষক যা হবি হ !” – এই কথাগুলি ক’জন পিতা-মাতা তাদের সন্তানদেরকে বলে বলো তো !!
বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও কি এটা ছাত্রদেরকে শেখায় ? না তাও শেখায় না ! আগেকার দিনে কিছু আদর্শবান শিক্ষক ছিলেন – তাঁরা তাঁদের ছাত্রদেরকে কিছুটা নৈতিক শিক্ষা, আদর্শের শিক্ষা দিতেন। কিন্তু এখনকার শিক্ষাব্যবস্থায় তেমন শিক্ষকও আর বড় একটা নাই – আর ওই ধরনের শিক্ষা দেবার পরিবেশ বা পরিস্থিতিও বিদ্যালয়গুলিতে নাই !! দ্যাখো, সকল মানুষের মানুষশরীর লাভ করার পর প্রথম শর্তই তো হওয়া উচিত ঠিক ঠিক ‘মানুষ’ হয়ে ওঠা। অর্থাৎ জীবনে মানবের গুনসমূহের (স্নেহ, প্রেম, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, প্রশংসা, করুণা, দয়া, ক্ষমা, অহিংসা ইত্যাদি) পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো এবং অমানবিক গুণগুলি (হিংসা, পাশবিকতা, ঘৃণা, মারামারি, রক্তপাত ইত্যাদি)-র অবলুপ্তি ঘটানো ! কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠছে কই ? বর্তমান সমাজে শিক্ষায়, ঐশ্বর্যে, ক্ষমতার দিক থেকে যারা উঁচুর দিকে রয়েছে, অর্থাৎ ধরে নাও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি অফিসার বা পুলিশ অফিসার, রাজনৈতিক নেতাদের বেশিরভাগ মানুষ, এরা তো দুর্নীতিগ্রস্থ !! উকিল-ব্যারিস্টারেরা, এমনকি বিচারকেরাও এখন টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে !! এইসব ঘটনা ঘটার কথা তো আমরা খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাই ! সর্বোপরি এগুলো তো বর্তমানের বাবা-মায়েরা নিজেরাই সমাজে ঘটতে দেখছে, কিন্তু তবু তারা তাদের ছেলে-মেয়েদের ওইসব profession-এ পাঠানোর জন্যই ছোটো থেকে তাদের মনোজগতে প্রজেক্ট তৈরি করে দিচ্ছে ! তাহলেই ভেবে দ্যাখো – এখনকার সমাজের মানুষের মানসিকতা এখন কোথায় নেমে গেছে ! প্রকৃতপক্ষে মানুষ এখনো ঠিক ঠিক ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পারেনি বলেই তো সমাজে এত বিশৃঙ্খলা – এত অশান্তি ! তাই তোমরা যারা আমার কথা শুনছো – তারা অন্তত প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করো এবং তোমরা তোমাদের সন্তানদের, তোমাদের ছাত্রদের ‘মানুষ’ হিসাবে গড়ে তোলো। আগে নিজেরা মানুষ হয়ে ওঠোতারপর তাদেরকে তৈরি করো _ Be and make !
নিজে না হয়ে উঠলে কিন্তু তোমার সন্তানও তোমার কথা শুনবে না ! তাই আগে নিজে হয়ে ওঠো । আজ থেকেই লেগে পড়ো! সিদ্ধিলাভ হবেই হবে।৷