উপস্থিত ব্যক্তিগণ:–জয়দীপ, লেখক (কোলকাতার) দেববাবু, ন”কাকা, মেজো কাকা (রমাপ্রসাদ বাবু), তপি মা, রেবা মা, রীতা দি(সিঙ্গুর) প্রমুখেরা।
জিজ্ঞাসু(গুরু মহারাজের পিছনে বসে থাকা মেয়েদের মধ্যে থেকে একজন):—আগামীকাল পয়লা জানুয়ারি ! এই দিনে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ কল্পতরু হয়েছিলেন কাশীপুর উদ্যানবাটীতে ! আমরাও তাই আগামীকালের প্রতীক্ষায় রয়েছি, কি ঘটে তা দেখার জন্য ?
[ গুরু মহারাজ এই জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন। আজ তার শেষাংশ]
……. শ্রীমদ্ভগবতগীতায় পাওয়া যায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভক্তপ্রবর অর্জুনকে এই কথাই বলেছিলেন__”অসংশয়ো মহাবাহো….!” অর্থাৎ_ “হে মহাবীর অর্জুন ! তুমি অসংশয় হও!” দ্যাখো, এখানে ‘নিঃসংশয়’ হোতে বলা হয়নি_ ‘অসংশয়’ হোতে বলা হয়েছে ! যেখানে ‘নিঃসংশয়’__সেখানে ‘সংশয়’-ও আসতে পারে_কিন্তু ‘অসংশয়’ হোতে পারলে ‘সংশয়’-এর আর কোনো অবকাশ থাকে না। এই রকম অসংশয় ছিলেন একমাত্র ব্রজ-গোপীনীরা অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন-লীলার সঙ্গী, রাধারানী সহ তাঁর সমস্ত সহচরীবৃন্দ ! তাইতো তাঁরা অক্লেশে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সামনে নির্বসনা হোতেও দু’বার ভাবেন নি ! তবে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে ‘নির্বসনা’ অর্থে ‘নির্বাসনা’ ! বাসনাই জীবের অন্তঃকরণের আবরণ ! জীবের অন্তরে বাসনা থাকতে কখনোই ‘পরাজ্ঞান-লাভ’ সম্ভব হয়না ! তাই তোমরাও প্রথমে ‘নির্বাসনা’ হও, তবেই তোমরা ‘রাধা’ বা অন্যান্য গোপীদের ন্যায় সুদৃঢ় বিশ্বাস বা প্রত্যয় অর্জন করতে পারবে, প্রকৃতঅর্থে ‘নির্বসনা’ হয়ে উঠতে পারবে । বৃন্দাবনের বাল-কৃষ্ণ থেকে মথুরার রাজা-কৃষ্ণ পর্যন্ত, ভগবান কৃষ্ণ যখন যে লীলাই করেছেন__ তাতেই জগত চমৎকৃত হয়েছে ! তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের ভিন্ন ভিন্ন লীলা দেখে অনেকসময় উচ্চ উচ্চ অবস্থার মানুষেরাও সন্ধিহান হয়েছেন, কিন্তু ব্রজগোপীরা কখনোই আত্মবিস্মৃত হননি ! কখনোই তাঁদের বিশ্বাস থেকে তাঁরা এতোটুকু সরে আসেননি ! তাঁরা যে কৃষ্ণতে একবার পূর্ণব্রহ্ম-রূপে ‘নিশ্চয়-বুদ্ধি’ স্থাপন করেছিলেন_ সেখান থেকে আর তাঁদের তিলমাত্র চ্যুতি ঘটেনি ! বৈষ্ণবশাস্ত্র পাঠে এমনটা জানা যায়(ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও বলেছিলেন এ কথা ! যা শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত গ্রন্থে রয়েছে) যে, শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে চলে যাবার পর রাধারানী শ্রীকৃষ্ণ চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকতে থাকতে নিজেই কৃষ্ণবৎ হয়ে গিয়েছিলেন ! মা যশোদা পুত্রবিরহে কাতর হয়ে পড়লে, মাঝে মাঝে উনি কৃষ্ণ-রূপী রাধার সঙ্গ করেই মনের দুঃখ মেটাতেন । রাধাসহ ব্রজ-গোপীদের এই যে লীলা, এমনটি পৃথিবীগ্রহে আগে কখনো হয়নি__ তাই বলা হয় বৃন্দাবন-লীলাই ভগবানের শ্রেষ্ঠ লীলা।।
এই যে তোমরা এখানে আমার সামনে বসে আছো, তোমরা এতো কথা শুনছো_ এবার কাজের কাজটি করো দেখি ! এখন থেকে তোমরাও ভগবৎ-পরায়ণ হয়ে ওঠো, ভগবানের প্রিয় হয়ে ওঠো ! যেমন গোপীগণ ভগবানকে ভালবেসে তাঁর প্রিয় হয়েছিলেন__ তোমরাও তদ্রুপ হও-এটাই আমার আন্তরিক ইচ্ছা !
অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নানান জ্ঞানের কথা বললেন_ বিশ্বরূপ দেখালেন, কিন্তু তারপরেও কি অর্জুনের চেতনার জগতে বিরাট বা বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটেছিল ? এরপরেও তো অর্জুন সংসার করলো, ছেলেপিলে হোলো, আবার তপস্যাও কোরলো__এইসব কত কি করলো ! তাই নয় কি ?
তাহলে এখান থেকে কি বোঝা যাচ্ছে, সবাই সবকিছুর জন্য উপযুক্ত নয় ! আর ঠিক ঠিক উপযুক্ততা না থাকলে, ভগবান কৃপা করলেও_ সেই কৃপার বোধ হবে না ! আনন্দের আস্বাদন হবে না ! দ্যাখো, ভগবান তো কৃপাময় ! তিনি সবসময়েই ‘কৃপা’ করে চলেছেন__কিন্তু নেবার লোক কোথায় ! ভগবান নিত্য কল্পতরু ! তাঁর কৃপাদানের কোনো দিনক্ষণ নাই ! আধার(সাধকের শরীর-মন) প্রস্তুত হোলেই কৃপার অনুভূতি লাভ হয় !
তবে মজার ব্যাপার কি জানো__ এসব কথা তোমাদেরকে আগেও অনেকবার বলেছি, কিন্তু তোমরা তো এক একজন ভোলানাথ অর্থাৎ ভুলে যাও, আর তাছাড়া তোমরা ভুলে যেতে ভালোবাসো ! এইজন্যই আমি তোমাদেরকে মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দিই ! ‘হরি সে লগন লাগাতে রহ রে ভাই, তেরি বনত বনত বনি যাই !’
সুতরাং তোমরা ‘লগন’ লাগাতে থাকো, ধীরে ধীরে সব হয়ে যাবে ! সেই অর্থে__ হঠাৎ করে কিছুই পাওয়া যায় না__একটু একটু করেই পথ তৈরি করতে করতে আগাতে হয় ! আর এটা অবশ্যই মনে রাখবে যে, অধ্যাত্মজগতে কোনো back-door নাই, নিজেকেই কষ্ট করে সবকিছু করতে হয় !