জিজ্ঞাসু:– আচ্ছা গুরুজী, আপনিও তো একজন মহাপুরুষ ! এই যে বহু মানুষ আপনাকে দর্শন করতে বনগ্রাম আশ্রমে আসছে, তারা আপনাকে স্পর্শ করছে, আপনার শ্রীমুখ থেকে ভগবৎ কথা শ্রবণ করছে। হয়তো তারা অতোটা সাধন-ভজন করতে পারছে না_ তবু আপনার দর্শন-স্পর্শন এবং আপনার বানী শ্রবণ__ এতেও তো তাদের কল্যাণ হবে ? গুরু মহারাজ:—“আপনিও একজন মহাপুরুষ!”–এইসব আবার তুমি কি বললে ! একজন মহাপুরুষ‌ই ঠিক ঠিক অন্য কোনো মহাপুরুষ‌কে চিনতে বা জানতে পারে ! তাহলে, কোনো মহাপুরুষকে চিনতে গেলে তোমাকেও একজন মহাপুরুষ‌ হয়ে উঠতে হবে__তাই না ! সুতরাং শুধু তুমিই ন‌ও, বেশিরভাগ মানুষেরাই এইরকম ভুল -ভাল কথা বলে থাকে। তবে আমি তোমাদের দোষ ধরি না, আমি জানি যে_ এই পৃথিবী গ্রহের মানুষ এইরকমটাই করে থাকে। তবে, এটা ঠিক‌ই যে_কোনো মহাত্মা মহাপুরুষের সঙ্গ করলে সাধারণ মানুষের কিছু না কিছু উপকার হয়। কিন্তু শাশ্ত্রে একটা কথা বলা হয়েছে __’সংযোগ-সম্পর্ক-সম্বন্ধ’। তুমি যে সমস্ত ভক্তদের কথা বলতে চাইছো( যারা শুধু আশ্রমে আসা যাওয়া করে)_এদের সাথে আমার সংযোগ ঘটছে কিন্তু হয়তো সম্পর্ক স্থাপন হোচ্ছে না! আবার এমনও রয়েছে–যাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে কিন্তু সম্বন্ধ স্থাপন হোলো না। শুধুমাত্র এইজন্মেই যাদের সাথে সংযোগ হোলো __তারা নিজস্ব প্রচেষ্টায়(সাধন-ভজন, সেবা, শ্রদ্ধাপূর্ণ জিজ্ঞাসার দ্বারা জ্ঞানার্জন ইত্যাদি) আমার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে এবং এটা করতে পারলে _ ‘এই জীবনে তাদের অনেকটাই অগ্রগতি হোলো’–এটা ধরে নেওয়া যায়। তবে, যাদের সাথে আমার সম্বন্ধ স্থাপন হয়েছে _ জানবে আমার সাথে তাদের অনেক জন্মের যোগাযোগ রয়েছে।। যাই হোক, তুমি জানতে চাইছিলে_এখানে যারা শুধু যাওয়া আসা করছে বা বসে ধর্মালোচনা শুনছে, তাদের অগ্রগতির কথা_ তাই তো ! দ্যাখো, ভক্তিশাশ্ত্রে রয়েছে _সালোক্য, সামীপ্য, সারূপ্য, সাযুজ্য ও সার্ষ্ঠী এইসব বিভিন্ন ক্রমের কথা। তাছাড়া সাধকদের উদ্দেশ্য করে আরও বলা হয়েছে যে, _ ‘ভগবানের নিকটস্থ অনেকেই হোতে পারে কিন্তু লীলা প্রবিষ্ট হয় কজন ?’ এই যে তুমি বলছিলে _ ‘অনেকেই আমাকে দর্শন করে’ (অনেকেই গুরুজীর নামডাক শুনে দেখতে আসতো) কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ‘আমাকে’ কে দর্শন করে? ‘আমাকে’ কে প্রণাম করে? যা কিছু করে সে তো এই খোলটাকে (স্থুলদেহ) ! ‘আমা’-তে না মিশলে ‘আমাকে’ চিনবে কি করে? ওই যে বললাম হয়তো সালোক্য বা সামীপ্য লাভ করছে__আর তার জন্য যে ফলটুকু পাবার কথা, তা নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে। কিন্তু এতে করে লীলার আস্বাদন হয় কি ? হয় না! লীলা-আস্বাদন করতে গেলে গোপী হোতে হয়। নির্বসনা গোপী, নির্বসনা অর্থে__ “নির্বাসনা”, অর্থাৎ চিত্তবৃত্তিনিরোধ অবস্থা ! মানবের মনোজগতের বৃত্তির অবসান হ‌ওয়াটাই শেষ কথা ! অন্যথায় কি হয় ? অনেক সাধকেরই ঈশ্বর দর্শন হয়, কেউ হয়তো ইষ্টের সঙ্গে কথা বলতেও পারে কিন্তু জেনে রাখবে এগুলিও কল্পনা। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ এই ব্যাপারে খুব সুন্দর সুন্দর আলোচনা করেছিলেন যেগুলি শ্রী শ্রী ‘রামকৃষ্ণ-কথামৃত’ বা সারদানন্দের ‘লীলা প্রসঙ্গ’ গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়। জানো, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যেন একটা লাবরেটরি বা গবেষণাগার ! তিনি অধ্যাত্ম জগতের বিভিন্ন ধারার সাধন পদ্ধতিগুলির গবেষণা করে পৃথিবীর মানুষকে হাতে কলমে কতো কিছু দেখিয়ে গেলেন ! আমরা তাঁর জীবনী থেকে পাই __বালক বয়স থেকেই উনি ✓রী মায়ের দর্শন লাভ করার জন্য ব্যাকূল হয়েছিলেন। তার জন্য উনি কতো কেঁদেছেন,কতো মাটিতে মুখ ঘসে রক্তপাত করেছেন, এমনকি মায়ের হাতের খাঁড়া কেড়ে নিয়ে নিজের গলায় বসাতেও গেছেন !! ঐসব গ্রন্থে লিখিত রয়েছে যে, তাঁর এই আন্তরিক আহ্বানে ✓রী মা তাঁকে দয়া করলেন। তিনি মাকে দর্শন করলেন, মায়ের সাথে কতো কথা বললেন, কতো খুনসুটি করলেন__তাই না! কিন্তু যখন দক্ষিণেশ্বরে তোতাপূরী এলেন, এবং তাঁকে অদ্বৈত মন্ত্রে দীক্ষিত করলেন, তখন তাঁর এই অদ্বৈত সাধনার শেষভাগে অর্থাৎ নির্বিকল্পের ঠিক আগে __সেই ✓রী মা-ই অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালো। এরপর ঠাকুর কি করলেন, না— জ্ঞানকে অসি(খড়্গ বা খাঁড়া) করে সেই মাতৃ মূর্তিকে দ্বিখণ্ডিত করলেন!! এরপর পরবর্তী সময় আমরা দেখলাম __ঠাকুরের জীবনে আর ✓রী মায়ের সঙ্গে কথা বলা বা তাঁকে বিভোর হয়ে পুজো পাঠ করা অথবা তাঁর সাথে খুনসুটি করা __এসব কিছুই আর ঘটেনি!! এইভাবেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর জীবন দিয়ে পরবর্তী কালের মানুষদের কাছে প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা কি–তা এবং সাধন জগতের ক্রমগুলিও সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। যাই হোক, তাহলে তোমরা এইসব সংক্রান্ত অনেক কথা তো শুনলে !! কিন্তু এই ঘটনা-পরম্পরা থেকে আধ্যাত্মিক জগতের প্রকৃত রহস্যটা বোঝার চেষ্টা করলে কি ? ধরতে পারছো না__তাইতো ! আচ্ছা আমিই বলছি শোনো__ দ্যাখো, চিত্তবৃত্তি নিরোধ অবস্থাই নির্বিকল্প সমাধি। আর একমাত্র নির্বিকল্প সমাধিতেই জীবের সব কিছু লীন হয়, স্বরূপের বোধ হয় এবং একমাত্র তখনই ওই সাধক লীলা আস্বাদনের উপযুক্ত হয়ে ওঠে । সাধনার উচ্চ উচ্চ অবস্থায় আর সাধকের স্থুল কোনো কিছুর visualisationহয় না, ‘ideal -এর visualisation’ হয়ে থাকে! আর চূড়ান্ত পর্যায়ে হয় realisation _বা বোধে বোধ।। সুতরাং সর্বদা মনে রাখবে সাধন কালে কোনো বিশেষ শক্তি লাভ করা, দর্শন করা, ইষ্টের সাথে কথা বলা__ এগুলিও সাধনার শেষ কথা নয় ! একমাত্র realisation-ই শেষ কথা। এই জন্যই তো বলা হয়েছে_ “আনন্দ প্রতিষ্ঠিত পরমেশ্বরের মহিমা অপার!” তোমরা পূর্ণ হও এবং আনন্দের আস্বাদন করো ৷৷