গুরু মহারাজ :— হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো। তবে শুধু প্রতাপ হাজরা কেন, সে ছাড়াও তৎকালে ঠাকুরের সংস্পর্শে কলকাতার বা বিভিন্ন এলাকার আরো অনেক সাধারণ মানুষ এবং নামীদামী লোকেরাও এসেছিল । তারাই বা ঠাকুরের কতটুকু বুঝেছিল। প্রতাপ হাজরা ঠাকুরের জন্মভূমি কামারপুকুর এলাকারই লোক ছিল এবং দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের পাশের ঘরে থাকার সুযোগ লাভ করেছিল। সময় সময় সে ঠাকুরকে ‘ঈশ্বরের অবতার’ বলে মানতো, আবার লোকের সামনে নিজেকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের চেয়েও বড় সাধক হিসাবে প্রচার করতো । ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে লোকের সামনে ছোটো এবং হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করতো। কলকাতার কোনো ধনী বাবু নতুন নতুন এসে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের খোঁজ করলে__ও তাদের সামনে ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে জোরে জোরে বলতো__ ” কাকে খুঁজছেন? ও-ও-ও_ গদাই ! ওকে তো আমি ছোটবেলা থেকেই দেখছি, কামারপুকুরে ‘মা’- ‘মা’ করে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল ! সেই জন্যই তো ওর আর বেশি কিছু হোলো না।”
নরেন্দ্রনাথ (পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দ) প্রতাপ হাজরাকে প্রথম দিকে একটু-আধটু পাত্তা দিতো। কারণ দক্ষিণেশ্বরের গিয়ে নরেনের তামাক(হুঁকো) খাবার জায়গা ছিল প্রতাপ হাজরার ঘরটা। প্রতাপ হাজরা নরেন্দ্রনাথকেও একবার বলেছিল__ “তোর মধ্যে দেখছি ‘বারো আনা’ মতন আছে(আধ্যাত্মিক শক্তি)। আর আমার আছে ‘পাঁচ শিকে পাঁচ আনা’ ! প্রতাপ তো জানতো না নরেন্দ্রনাথ কি জিনিস !! নরেন সবই বুঝতো, তবু মজা করে জিজ্ঞাসা করতো_” তা না হয় বুঝলাম যে, আমার ‘বারো আনা’ আর আপনার ‘পাঁচ শিকে পাঁচ আনা’; কিন্তু তাহলে ঠাকুরের ক’আনা ? প্রতাপ অম্লান বদনে বলতো_ “ওর আর হোলো কই ? এখনো পাল্টি খাচ্ছে।”
এখানে ‘পাল্টি খাচ্ছে’ বলে প্রতাপ বলতে চাইতো যে, ঠাকুরের এখনও আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রায় কিছুই হয়নি !!
প্রতাপ হাজরা কতো লোককে যে দক্ষিণেশ্বর থেকে ভাগিয়েছে তার ইয়ত্তা নাই ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে তাদেরকে দেখাই করতে দেয়নি। ওই তাদের সঙ্গে দু’চারটে শাশ্ত্রকথা বোলে, তাদের কাছে দক্ষিণা নিয়ে, রানীর বাগান দেখিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছে ! একদিন কথামৃতকার শ্রীম(মহেন্দ্র গুপ্ত)-কেই প্রায় ভাগিয়ে দিয়েছিল ! ঘরের ভিতর থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ সবটা দেখতে পেয়ে ইঙ্গিত করে মহেন্দ্রকে ডেকে নিয়েছিলেন।
তাহলে এগুলোকে কি বলবে বলো? ঠাকুর কি পারতেন না__ প্রতাপ হাজরাকে আগেই ওখান থেকে সরিয়ে দিতে! নিশ্চয়ই পারতেন । কারণ তখনো মথুর বাবু শরীরে ছিলেন । আর মথুর বাবু ঠাকুরকে যতদিন মানেননি, ততদিন অতোটা পাত্তা দেননি_এটা ঠিটই। কিন্তু যখন থেকে মেনেছিলেন, তখন থেকে ঠাকুরের জন্য প্রাণ দিতেও কুন্ঠা বোধ করতেন না !
রানী রাসমণির ইচ্ছা অনুযায়ী তখন বহিরাগত সাধু-সন্ত, অতিথি-ফকিরদের থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত ছিল দক্ষিণেশ্বরের অতিথিশালায় । সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েই প্রতাপ হাজরা সাধুর বেশ ধরে ওখানে থাকতো । আর বড়লোক বাবু দেখলে তার কাছে টাকার ধান্দা করতো। এরূপ করার একটা কারণও ছিল। দেশে অর্থাৎ কামারপুকুরের ওখানে বেশ কয়েক হাজার টাকা দেনা করে পাওনাদারদের ভয়ে ও দক্ষিণেশ্বরে পালিয়ে এসেছিল । তার আগে অবশ্য ছেলে মেয়েদের বিয়ে-থা দিয়ে, সংসার গুছিয়ে দিয়ে তবেই এসেছিল । এইসব সত্যি কথা জানতে পারলে মথুর বাবু ওকে আগেই তাড়িয়ে দিতো। ….[পরবর্তী অংশ পরের দিন] (ক্রমশঃ)
জিজ্ঞাসু:— তা ঠিকই বলেছেন মহারাজ ! সেই সময় দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের খুব কাছাকাছি থেকেও প্রতাপ হাজরার আধ্যাত্মিক উন্নতি তো হোলোই না, বরং অবনতিই হোলো এবং ওকে দক্ষিণেশ্বর ত্যাগ করতে হোলো ! আপনি এইরকমটাই কিছু বলতে চাইছিলেন কি??