[ “জিজ্ঞাসু:— তা ঠিকই বলেছেন মহারাজ ! সেই সময় দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের খুব কাছাকাছি থেকেও প্রতাপ হাজরার আধ্যাত্মিক উন্নতি তো হোলোই না, বরং অবনতিই হোলো এবং ওকে দক্ষিণেশ্বর ত্যাগ করতে হোলো ! আপনি এইরকমটাই কিছু বলতে চাইছিলেন কি??”

এই জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছিলেন গুরু মহারাজ। আজ তার পরবর্তী অংশ… ]

…… কিন্তু ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এইসব কথা কখনো মথুর বাবুকে বলেননি ! তিনি তো জানতেন__ মা জগদম্বার ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাটিও নড়ে না, তাঁর ইচ্ছাতেই সবকিছু হয়! প্রতাপ হাজরা ওখানে ( দক্ষিণেশ্বরে) থেকে ধান্দা করতো এবং অনেক লোককে ভাগাতো ঠিকই কিন্তু ও ওখানে থেকে ছাঁকনির কাজ করতো। ধনী এবং বাবু গোছের লোক দেখলেই, প্রতাপ তাদেরকে ডেকে ডেকে হুঁকো খাওয়াতো আর টাকা পয়সা চাইতো । তার সাথে ওদের কাছে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে যা তা উল্টোপাল্টা কথা বলতো । ঠাকুর সম্বন্ধে প্রতাপের কাছে শুনে অনেকেই পালাতো ! এই সমস্ত নানান বাধা পেড়িয়ে যারা ঠাকুরের সংস্পর্শে আসতে পেরেছিল__ তারাই ঠাকুরের কৃপা লাভ করেছিল।
সুতরাং এটা বোঝা যাচ্ছে যে, মা জগদম্বার ইচ্ছাতেই প্রতাপের মতো মানুষেরও ওখানে থাকা দরকার ছিল । কারণ তৎকালীন কলকাতায় কৌতুহলী জনগণের অভাব ছিল না(সবসময়েই এই ধরণের মানুষ বর্তমান থাকে)। হুড়মুড় করে প্রচুর লোক দক্ষিণেশ্বরে চলে এলে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যে কাজ করতে এসেছিলেন __সেই কাজের খুবই অসুবিধা হোতো। তাই মা জগদম্বার এইরকম ব্যবস্থা !
কেশবের অর্থাৎ কেশব চন্দ্র সেনের যখন ঠাকুর সম্বন্ধে ধারণা পাকা হোলো__তখন থেকে কেশব বক্তৃতার মাধ্যমে, লেখার মাধ্যমে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রচার শুরু করে দিয়েছিল। তখনকার দিনে কোলকাতায় কেশবের প্রচুর নামডাক ছিল। ফলে তার এই ব্যাপক প্রচারে দলে দলে মানুষ দক্ষিণেশ্বরে আসতে শুরু করেছিলো । কিন্তু এর কিছুদিনের মধ্যেই ঠাকুরের ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে গেল। ব্যস্_ এর ফলে আবার ওই দলে দলে আসতে থাকা লোকজনের ‘আগমনের জোয়ার’-টা কমে গেলো । যারা থাকার তারাই থাকলো__ বাকি জনগণ যারা এক-আধবার আসা যাওয়া শুরু করেছিল, তারা ঠাকুরের ক্যান্সার রোগ হয়েছে শুনে পুনরায় জন-অরণ্যে মিশে গেল।
দেবেন (দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর)-ও বেশ কয়েকবার শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে দেখেছিলেন(ব্রাহ্মসমাজে বার কয়েক যাওয়ার সুবাদে) ! সেখানে তার সঙ্গে ঠাকুরের কথাবার্তা হয়েছিল । তারপরেও দেবেন(দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর)__ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিল যে,_” ও যদি ঠাকুর পূজা বা মূর্তি পূজা করা ছেড়ে দেয় তো ওকে আমরা ব্রাহ্ম করে নিতে পারি।”
এই কথাগুলি পরবর্তীকালে কতোটা হাস্যকর হয়ে উঠলো বলো দেখি !! একবার কোনো একটা বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে নিমন্ত্রণ করেছিল, কিন্তু শর্ত ছিল ঠাকুরকে ভালো জুতো, ভালো জামাকাপড় পড়ে__ বেশ সভ্য হয়ে, ভদ্রস্থ হয়ে আসতে হবে ! শ্রীরামকৃষ্ণ এই শর্ত মেনে না নেওয়ায়_ পরে আবার সেই নেমন্তন্ন ফিরিয়ে নিয়েছিল দেবেন। ব্রাহ্মসমাজের অন্যান্য সভ্যরা এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় দেবেন( দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর)বলেছিল_ “লোকটা অসভ্য! ভালো করে কথা বলতে পারেনা, কথায় কথায় খিস্তি ব্যবহার করে, তাছাড়া খালি গায়ে থাকে_ পরনের কাপড়েরও ঠিক থাকে না । ওই ধরণের মানুষকে আমাদের সমাজে নেমন্তন্ন করা উচিত নয়–এটা বিবেচনা করেই আমি নিষেধ করেছিলাম।”
তৎকালীন কলকাতার বাবু সমাজে তখন ইউরোপীয় সভ্যতার প্রভাবের জোয়ার চলছে বাবুরা সবাই তখন হ্যাট্-কোট্ পড়ছে, পশ্চিমী কায়দায় কেতাবুরস্ত হয়ে থাকছে, গায়ে বিদেশি আতর ব্যবহার করছে ! ওদের ধারণা ছিল সেইরকম একটা সোসাইটিতে ঠাকুর রামকৃষ্ণ যেন বড্ড বেমানান ! ….. (ক্রমশঃ)