জিজ্ঞাসু:– জানেন তো গুরুজী_ আপনার মুখ থেকে নিরামিষাশী হওয়ার সুফল জেনে অনেক ভক্ত(পরমানন্দ মিশনের)-ই এখন নিরামিষাশী অর্থাৎ তারা খাদ্য সংযম করছে। এটা অবশ্য খুবই ভালো লক্ষণ। তাহলে এরাও কি ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিক হয়ে উঠছে না?

গুরু মহারাজ:— আর বাবা_ খাদ্য সংযম !! খাদ্য সংযম হওয়া কি মুখের কথা ! খাদ্য সংযম হোলে অজগর বৃত্তি হয়। যখন জুটবে তখন খাবে_ অন্যথায় খাদ্য গ্রহণের জন্য কোনো ব্যস্ততা বা ব্যাকুলতা থাকবে না। তোমরা কি পারবে তেমনটা করতে _পারবে না ! খাদ্য সংযম ব্যাপারটা অতো সহজ নয় !

দ্যাখো, বলা হয় ‘নোলা’ আর ‘তলা’ ! ‘নোলা’ অর্থাৎ খাদ্যের প্রতি লালসা ঠান্ডা না হোলে ‘তলা’ অর্থাৎ কাম প্রবৃত্তি ঠান্ডা হয় না ! ব্যাপারটা বুঝতে পারছো তো_ জিহ্বার সাথে উপস্থ বা লিঙ্গের যোগাযোগ রয়েছে। ‘নোলা’ এবং ‘তলা’ ঠান্ডা হওয়াটাই যথার্থ খাদ্য সংযমীর পরিচয় । ওই অবস্থা প্রাপ্ত হোলে, তখন আর আমিষ নিরামিষ এগুলো কোনো factor-ই নয় । খাদ্যের প্রতি লালসাহীনতাই প্রকৃত খাদ্য সংযম । ঐ অবস্থায় ব্যক্তি(সাধক)শরীর ধারণের জন্য খাদ্য গ্রহণ করবে ঠিকই কিন্তু কোনো খাদ্যেই তার কোনোপ্রকার লালসা নাই__ ব্যাপারটা বুঝতে পারছো তো !

তাছাড়া কোনো ব্যক্তি নিরামিষাশী মানেই যে সে খাদ্য সংযমী বা আধ্যাত্মিক হয়ে গেল__ এটাই বা ভাবছো কেন ! আহা কি খাদ্য সংযমী তোমরা ! আমার তো মনে হয় নিরামিষ আহার গ্রহণকারীরাই বেশি ভোজন রসিক, বেশি চালাক। আমিষ আহারে variety খুব একটা বেশি করা যাবে না, কারণ মাছ মাংস আর ডিম_এই তিনটি থেকে কতো আর variety করবে ? না হয়_ একটু ভিন্ন ভিন্ন ভাবে রান্না করা হোলো অথবা হয়তো ভিন্ন ভিন্ন মসলা প্রয়োগ করা হোলো, কিন্তু তাতেই বা কতো আর variety হবে বলো ! অপরপক্ষে নিরামিষ আহারের variety গুনে শেষ করতে পারবে না ! এটা মনে রাখবে যে, ভারতবর্ষে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন বা বাহান্ন ব্যঞ্জন রান্না করে ঠাকুরের ভোগ দেওয়ার যে প্রাচীন রীতি ছিল__ সেগুলি নিরামিষেই বানানো সম্ভব, আমিষে নয় !
সাহেবরা ( ইউরোপীয় বা আমেরিকানরা) যখন থেকে নিরামিষাশী (বৌদ্ধ প্রভাব এবং পরবর্তীতে ইসকন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে) হোলো, তখন থেকে আমিষের অনুকরণে ভেজিটেবল চপ-কাটলেট ইত্যাদি বানানো শুরু হয়েছিলো । ‘চপ’ বা chop কথাটা এসেছে চপার(chopper) থেকে ! মাংস কাটার কাটারিকে ‘চপার’ বলা হয়। চপার দিয়ে কাটা গোল গোল মাংসের চপ বানানো হোতো। নিরামিষাশীদের কাছে ওই আমিষ চপের আদলে নিরামিষ চপ পরিবেশন করা হোলো। এতে করে এরা যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে লাগলো । এইভাবে নিরামিষাশীরা এখন নানা রকম আমিষ জাতীয় খাদ্যদ্রব্যের অনুকরণ বানিয়ে ফেলেছে। নিরামিষাসীদের জম্পেশ করে রান্না করা এবং খাওয়ার বহর দেখলে বোঝা যায় এদের ‘নোলা’ এখনো যায়নি ! তাই খাদ্য সংযমের গল্প আমাকে বলতে এসো না। তাহলে আমি সব গোপন রহস্যের দরজা খুলে দেবো।।
সুতরাং তোমরা যারা আমার কাছে প্রকৃত সত্যের পাঠ গ্রহণ করছো__তোমরা যেন এইসব দিয়ে আধ্যাত্মিকতার বিচার করতে যেও না ! জানবে, সত্যি সত্যি খাদ্য সংযম যার হয়, তার ভিতর(অন্তরজগৎ) থেকেই হয় । জোর করে বা নিয়ম করে লালসার নিবৃত্তি হয় না । ঈশ্বরের কৃপা লাভ হোলে অথবা নিষ্ঠাপূর্বক সাধনা করতে থাকলে__ ধীরে ধীরে সবকিছুই (spiritual achivement) লাভ হোতে থাকে । অন্যথায় ঐ পর্যন্তই অর্থাৎ ঈশ্বরের কৃপালাভ অব্দি প্রাপ্তি হোতে পারে__ তার বেশি কিছু নয় ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন _’সংসারে মা-ই জানেন, কোন্ ছেলের পেটে কি সয়, অর্থাৎ যার যেমন প্রকৃতি _ঈশ্বর তাকে সেই রূপ খাবার সুযোগ করে দেন।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ নরেন্দ্রনাথকে মিছরি, মাখন ইত্যাদি জোর করে করে খাওয়াতেন ! তৎকালীন কলকাতায় পীর মোহাম্মদের দোকান থেকে খাবার খেয়ে আসলেও নরেনকে উনি কিছুই বলতেন না, অথচ নিরঞ্জন( ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আর এক ব্রহ্মচারী শিষ্য এবং বলিষ্ঠ চেহারার যুবক) একদিন রাত্রিতে খাবার সময় রুটির সাথে একটু ঘি বা মাখন খেতে চেয়েছিল বলে ঠাকুর তাকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন_ ‘তোরা কি এসব খেয়ে লোকের ঘরের মেয়ে-বউ বের করবি নাকি ?’ তাহলে বুঝতে পারছো তো__ রহস্যটা কি ?
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব তার ত্যাগী ভক্তদেরকে শেখাতেন প্রকৃত সংযম ! বারবার তিনি তাঁর ব্রহ্মচারী শিষ্যদের নিষেধ করতেন কামিনী-কাঞ্চন থেকে দূরে থাকার ! আর খাদ্যের বিষয়ও তিনি খুবই কড়াকড়ি করতেন !
আমরা সবাই জানি যে, ত্রৈলোক্যনাথের আমলে দক্ষিণেশ্বর থেকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে একপ্রকার বিতারিতই হোতে হয়েছিল। সেখান থেকে যখন নরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে অন্যান্য ব্রহ্মচারীগণ সহ কয়েকজন গৃহী ভক্ত__ঠাকুরকে আলমবাজার কয়েকদিন রেখে, finally কাশীপুরের উদ্যানবাটিতে নিয়ে গেলেন(ওখানে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ খুবই কম সময় ছিলেন। হয়তো বছর দুয়েক!)_তখন উনি ত্যাগী ভক্তদেরকে খুব‌ই সংযম শেখাতেন । এই সময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ভক্ত-শিষ্যেরা ‘রাত্রিতে কে কটা রুটি খাবে’__ তারও বরাদ্দ করে দিয়েছিলেন ! তখন ওই ছেলেগুলোর প্রায় সবারই জোয়ান বয়স, কিন্তু ঠাকুরের বরাদ্দ ছিল কারো জন্য দুটি রুটি, কারো জন্য চারটে রুটি। কিন্তু তাতে কি তাদের পেট ভরতো ? বিশেষতঃ তাদের তখন যুবক বয়স ছিল__ তারা ওই বরাদ্দের কটি রুটি পাতে দেওয়া মাত্রই খেয়ে নিতো, আর তারপর বসে বসে থালা চাটতো_ আসন ছেড়ে উঠতে চাইতো না ! সারদা মা তখন ওখানেই থাকতেন ! ওরা মায়ের আসার পথ চেয়ে বসে থাকতো_ভাবতো মা বোধহয় ওদের জন্য আরো দু-চারটি রুটি আনবেন ! ছেলেগুলোর ক্ষুধামাখা ওই ধরনের মায়াভরা মুখ দেখে মায়ের‌ও খুবই কষ্ট হোতো । দু একদিন এরকম দেখার পর উনি ছেলেগুলোকে বললেন_ “তোমরা পেট ভরে খাও, আমি তৈরি করে দিচ্ছি!” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কানে একথা যেতেই তিনি তাড়াতাড়ি সারদা মায়ের কাছে গিয়ে_ রাতে বেশি খেলে যুবক ছেলেদের ব্রহ্মচর্যের হানি হোতে পারে, তবু তাদেরকে রুটি বেশি বেশি করে দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। জগজ্জননী মা সারদা বললেন_”ওরা জোয়ান ছেলে, দু-চারটে রুটিতে ওদের পেট ভরে না _ বসে বসে থালা চাঁটে, আর আমার পানে মায়া-ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ! এটা দেখে আমার বুক ফেটে যায় ! মা হয়ে আমি এটা সইবো কি করে _ তাই দিয়েছি !” ঠাকুর তখন বলেছিলেন__” কিন্তু এতে যদি ওদের কোনোরূপ ক্ষতি হয়?” সারদা মা একটু চিন্তা করে বলেছিলেন_ ‘সে ভার আমার ! আমি ওদের দায়িত্ব নিলাম!” ঠাকুর এ কথা শুনে খুব খুশি হয়ে আনন্দ করতে করতে চলে গিয়েছিলেন।
এইটা ছিল মায়ের কৃপা! সারদা মায়ের মতো ঐরূপ অসাধারণ মাতৃত্বের স্থিতিতে যদি কেউ পৌঁছাতে পারে _ তাহলে তার জন্য আর এই পৃথিবী গ্রহের অর্থাৎ মহামায়ার জগতের কোনো নিয়ম খাটে না ! কিন্তু বাকিদের জন্য নিয়ম পালন করতেই হবে। অন্ততঃ প্রথম দিকটায় নির্দিষ্ট নিয়ম বিধি পালন করেই সামনের দিকে অগ্রসর হোতে হয়।।