জিজ্ঞাসু’:– গুরুজী, আমি অন্য একটা প্রসঙ্গে আপনার কাছে জানতে চাইছি! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরবর্তী শরীরে “বাউল” হয়ে আসতে চাইলেন কেন? অন্য কিছু রূপে নয় কেন??
গুরু মহারাজ:–‘বাউল’ মানে হোচ্ছে ‘সহজ’! ‘সহজ’ অর্থাৎ যেখানে কোনো গোপনীয়তা নাই, রাখ-ঢাক নাই ! জানোঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন যুগাবতার, তাই যুগ-প্রয়োজনে তাঁর জীবদ্দশায় উনি সকলকে সব কথা বলতে চেয়েও বলতে পারেননি ! আর এই নিয়ে তাঁর মনে খুবই অনুতাপ ছিল । ব্রহ্মচারী-সন্ন্যাসীদের তিনি যে শিক্ষা আলাদা করে দিতেন, গৃহী ভক্তদের কাছে সেই কথাগুলি বলতে পারতেন না। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গৃহীদের মতো করে কথা বলতে হোতো তাঁকে, যাতে কোরে ওই অবস্থা থেকেই তাদের উন্নতি হয় । দরজা বন্ধ করে সন্ন্যাসী ভক্তদের সঙ্গে আলাদা করে সিটিং করতেন ! লাটুকে দরজার সামনে পাহারায় বসিয়ে রাখতেন, আবার মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে নিজেও দেখতেন এবং লাটুকে বলতেন’ একবার দেখে আয়, আশেপাশে কেউ আছে কিনা ! এমনকি কথামৃতকার শ্রীম(মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত বা মাষ্টারমশাই)-এরও প্রবেশাধিকার ছিল না সেখানে। তাই সন্ন্যাসীদের উদ্দেশ্যে তাঁর বক্তব্য বা উপদেশ বাণীগুলি কি ছিল, তা সাধারণ মানুষের কাছে আজও প্রকাশিত হয়নি ! পরবর্তীকালে ঠাকুরের সন্ন্যাসী সন্তানদের নিজেদের লেখায়, বক্তব্যে এবং তাঁদের সম্বন্ধে কোনো জীবনীকারের লেখায় কিছু কিছু হয়তো প্রকাশ পেয়েছে ! কিন্তু স্পষ্টভাবে, পরিষ্কারভাবে বা সম্পূর্ণভাবে ঠাকুরের সব কথা মানুষের কাছে পৌঁছায়নি ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের লীলায় এই ঘটনা ছাড়াও আরো একটা ঘটনা ঘটেছিল ! ঠাকুর সমস্ত ত্যাগী ভক্তদেরকে যা বলতেন নরেন্দ্রনাথকে আবার তার থেকেও আলাদা ক’রে কথা বলতেন, আলাদা নির্দেশ দিতেন ! এর ফলেই ঠাকুরের অন্তর্ধানের পরে নরেন্দ্রনাথের কথাবার্তা শুনে, তাঁর কাজকর্ম দেখে ওনার গুরু ভ্রাতারা অনেক সময় তাঁকে ভুল বুঝতো। ভাবতো_ নরেন্দ্রনাথ বোধ হয় গুরুর পথ থেকে সরে যাচ্ছে, কিন্তু তা তো নয় ! গুরুদেব তাঁকে যে কথাগুলি বলেছিলেন সেগুলি অন্যান্য গুরুভ্রাতারা জানতোই না ! যাইহোক, পরে অবশ্য তাদের এই ভুলটা ভেঙেছিল।
ঠাকুরের(শ্রীরামকৃষ্ণের) ব্যাপারটা কেমন হয়েছিল জানো? ঠিক যেন ভোজবাড়িতে নেমন্তন্ন করা লোকজন অর্থাৎ যারা রবাহুত তাদেরকে পেটপুরে খাওয়ানো ! জানো তো, গ্রামাঞ্চলের ভোজবাড়িতে দুই ধরনের লোক যায়_ একদল রবাহুত অর্থাৎ যাদেরকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়, আর একদল অনাহুত এরা শুধু পেট ভরানোর জন্য বা দুটো খেতে পাবার লোভে সেখানে হাজির হয়ে থাকে। নিমন্ত্রিতদের সমস্ত রকম খাদ্যের আইটেম দিয়ে পেট ভরে খাওয়ানো হয়ে থাকে, আর যদি কিছু খাবার বেঁচে যায়_ তাহলে সেই খাবার ইতর সাধারণের মধ্যে অর্থাৎ অনাহুত মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়। এটাকেই বলা হয়” মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ।।” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে এমনটা করতে হয়েছিল স্থান-কাল-পাত্র বিচার করে ! তবে, এই কাজ তাঁকে করতে হয়েছিল বটে কিন্তু এতে তিনি তৃপ্ত হোতে পারেননি। তাই পরবর্তীতে তিনি “বাউল শরীর” নিতে চেয়েছিলেন ! এবার আর ভোজবাড়ি নয়, আর রবাহুত অনাহুতের বাছবিচার নয় এবার যেন মেলা! বাউল মেলা ! কোথাও কোনো গোপনীয়তা নাই ! উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন, সাদা-কালো ইত্যাদির কোনো বিচার নাইসবকিছু সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত !! দোকানের পসরা থরে থরে সাজানো রয়েছে, যে কেউ এসে ঘুরে ফিরে_ যার যেটা ভালো লাগলো, সে সেটা নাড়লো-চাড়লো-খেলো, কেউ আবার কিছু কিনে বাড়ি নিয়ে গেলো ! সবার জন্য সবই সাজানো আছে, যার যেমন সামর্থ্য__সে সেই অনুযায়ী নিতে পারলেই হোলো, কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নাই। এখানে সবকিছুই যেন open to all !!!