উপস্থিত ভক্তগণ:– স্বামী স্বরূপানন্দ মহারাজ, স্বামী আত্মানন্দ(খোকন)মহারাজ, নগেন ও অন্যান্য ভক্তবৃন্দ।
জিজ্ঞাসু:– ঠাকুর কিসে প্রসন্ন হয় ?
গুরু মহারাজ:– তুমি কিসে প্রসন্ন হও? বলো, তুমি কিসে সবচাইতে প্রসন্ন হও ? তোমার প্রতি যদি কেউ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা (বা স্নেহ) প্রদর্শন করে অথবা কেউ যদি তোমাকে আন্তরিকভাবে সেবা করে__ তাহলে তুমি প্রসন্ন হও__ তাই নয় কি ? তাছাড়া যদি কেউ(সদগুরু বা কোনো মহাপুরুষ) তার সাধনা লব্ধ প্রজ্ঞার দ্বারা তোমার জিজ্ঞাসার অবসান ঘটাতে পারে_ তাহলেও তোমার চিত্ত প্রসন্ন হয়। এইভাবে নিজেকে দিয়ে বিচার করবে, তাহলে অনেক কথার উত্তর তুমি নিজে নিজেই পাবে । আবার কোনো আচার্য বা গুরুর কাছে যদি তাঁর শিষ্যরা শ্রদ্ধা-পূর্বক জিজ্ঞাসা দ্বারা জ্ঞান লাভে আগ্রহী হয় অথবা আত্মবোধের প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়__তাহলেও সেই আচার্য বা গুরু প্রসন্ন হ’ন।
তুমি এখানে ‘ঠাকুর’ কিসে প্রসন্ন হয়_ সেই কথা জানতে চাইছো তো! তা_ ঠাকুর বলতে তুমি নিশ্চয়ই ঈশ্বরকে বোঝাতে চাইছো_ তাই না! কোনো ব্যক্তি অর্থাৎ ‘সাধক’ যখন জ্ঞানের গভীরে ডুব দেয় অথবা কেউ যখন নিত্যানিত্যের বিচার করতে করতে বোধ করে যে ‘ব্রহ্ম’ই সত্য, আর সবই অনিত্য অর্থাৎ ‘বোধি’ অবস্থা প্রাপ্ত হয়_ তখন সেই সব সাধকের প্রতি ঈশ্বর প্রসন্ন হ’ন। আবার সাধক যখন প্রেমের গভীরে ডুব দিয়ে, সর্বাপেক্ষা প্রিয় যে দেহ_ তাও ভুলে গিয়ে প্রত্যাশা বিহীনভাবে সর্বজীবে এমনকি সবকিছুকেই তার প্রিয়তমের রূপ ভাবতে পারেন_ সকল কিছুকে ভালবাসতে থাকেন_তখনও ঈশ্বর অবশ্যই প্রসন্ন হ’ন । আবার আত্মসুখের তিলমাত্র বাসনা না রেখে সাধক যখন শিবজ্ঞানে জীবসেবায় নিজেকে উৎসর্গীকৃত করেন_ তখনও ঈশ্বর প্রসন্ন হ’ন।। আমি কি বলতে চাইলাম_সেই ব্যাপারটা বুঝতে পারলে কি!
দ্যাখো, তোমার ভাবনা ধরে এতোগুলি কথা বললাম কিন্তু যদি আমার নিজস্ব মত জানতে চাও__তাহলে আমি বলবো, আমি জানি যে ঈশ্বর সদা প্রসন্ন, সদা করুনাময়, সদা কল্পতরু! সেখানে বিষন্নতার অবকাশ কোথায়! কিন্তু আমাকে তো তোমাদের সবার চেতনার level, তোমাদের বিশ্বাস, তোমাদের সংস্কার অনুযায়ীই কথা বলতে হয়__নাহলে যে তোমরা গ্রহণ করতেই পারবে না! তাই তোমাদের মতো করে কথা বলে থাকি।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সহজ ভাবে ও সহজ ভাষায় বলেছিলেন_ ‘যো সো করে তাঁকে(ঈশ্বরকে) প্রসন্ন করতে পারলেই হোলো!’ ঈশ্বরের প্রসন্নতাই মানব জীবনে পূর্ণতা এনে দেয়।
দ্যাখো, সাধারন মানুষ__ আত্মীয়-স্বজন, নিজের স্ত্রী বা স্বামী, মহাজন, রাজনৈতিক নেতা, অফিসের বস্ ইত্যাদিদেরকে প্রসন্ন করতে গিয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়। কিন্তু তারা প্রসন্ন হোলে কি আর এমন বেশি কিছু হোতে পারে? হয়তো এই জীবনে তোমার কিছু জাগতিক উন্নতি হোতে পারে__ এর বেশি তো কিছু নয়! কিন্তু মানুষের জীবন কি শুধু একটাই ? জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল কোন সূদুর অতীতে– যা ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে, জন্ম থেকে জন্মান্তরে_ পূর্ণতা প্রাপ্তির লক্ষে ।
জীবের এই এগিয়ে চলার এক একটা ধাপ হোলো এক একটা জীবন, আর প্রতিটা ধাপেই ঘটে চলেছে বিবর্তন বা evolution! কিন্তু মনুষ্য শরীর লাভের পর আর শরীরের বিবর্তন হয় না, তখন হয় সংবর্তন বা involution অর্থাৎ তখন মানবের চেতনা চৈতন্যমুখী হবার জন্য শুরু হয় এক নতুন অভিব্যক্তি বা সংবর্তন। মনুষ্য শরীর যেহেতু এই পৃথিবী গ্রহের সবচাইতে উন্নত শরীর_ তাই মানুষই একমাত্র পারে evolution-কে revolution-এ পরিণত করতে এবং সেটা পারে ঐকান্তিক সাধনার দ্বারা !
তবে এটা জেনে রাখবে যে, এই সংসারের প্রতিটা ব্যক্তির নির্দিষ্ট সাধন পদ্ধতি রয়েছে, আর সেই সাধন_ তাকে দিতে পারেন একমাত্র সদগুরু! এইজন্যই সবার বীজমন্ত্র আলাদা, গণ দীক্ষা বা সবার জন্য এক মন্ত্র__ এমনটা বিজ্ঞানসম্মত হোতেই পারে না।
সদগুরুই মানুষকে ঈশ্বরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই জন্য শাস্ত্র বলেছে_ ‘গুরুই মর্তের ভগবান! ‘সুতরাং ঈশ্বরকে প্রসন্ন করতে হোলে প্রথমে গুরুকে প্রসন্ন করতে হয় । গুরু প্রসন্ন হোলেই জানবে ঈশ্বর অবশ্যই প্রসন্ন হয়েছেন। এছাড়াও শাস্ত্রে আরও একটি কথা আছে __”প্রণিপাতেন পরি প্রশ্নেন সেবয়া!” প্রণিপাত বা ভক্তিপূর্ণ প্রনাম অর্থাৎ শ্রদ্ধা-ভালবাসা ও ভক্তির দ্বারা, সেবার দ্বারা(শারীরিক ও মানসিক সেবার দ্বারা) এবং পরিপ্রশ্ন বা অধ্যাত্ম জিজ্ঞাসার দ্বারা গুরু প্রসন্ন হ’ন । আর গুরু প্রসন্ন হোলেই ঈশ্বর ও প্রসন্ন হ’ন।