জিজ্ঞাসু :– এখন দেখা যাচ্ছে সমাজে সবলেরা অর্থাৎ অত্যাচারী-অনাচারী-দুরাচারী বা ব্যভিচারীরাই বেশ সুখে-শান্তিতে রয়েছে, অপরপক্ষে সমাজের পিছিয়ে পড়া সাধারণ মানুষেরা দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং অসহায়ভাবে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে ! এখন থেকে এইরকমটাই কি চলতে থাকবে গুরুদেব ?
গুরুমহারাজ :– তুমি বললে “সুখে-শান্তিতে” আছে ! দ্যাখো বাবা, ‘সুখে’ এবং ‘শান্তি’তে থাকা কি অতোই সহজ ? তোমার ভাবনা অনুযায়ী তুমি এই জগৎ-কে বিচার করছো, তোমার বিচারে ‘সুখ’ এবং ‘শান্তি’র সংজ্ঞা হয়তো একরকম – কিন্তু প্রকৃত ‘সুখ’ বা প্রকৃত ‘শান্তি’-র সংজ্ঞা তোমার জানা নাই ! বিষয়-বাসনা মুক্ত পুরুষ-ই প্রকৃতপক্ষে ‘সুখী’ ! কামনা-বাসনা মুক্ত, সর্বত্যাগী, ঈশ্বরে সর্বতোভাবে সমর্পিত ব্যক্তিই ‘শান্তি’তে রয়েছেন ! যিনি সদা সন্তুষ্টচিত্ত, কোনো কিছুতেই চিত্তে তাঁর কোনো বিকার পরিলক্ষিত হয় না – সেইরকম ব্যক্তি শান্তিতে রয়েছেন।
এবার তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারো যে, ‘কি করে তুমি বুঝবে যে ঐরূপ কোনো ব্যক্তি প্রকৃত শান্তিতে রয়েছেন’ ? এর উত্তরে আমি বলবো_ ঐরূপ ব্যক্তির যদি সন্ধান পাও তাহলে তার কাছে কিছুক্ষণ চুপটি করে বসো, কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাবে তোমার চির-অশান্ত মন কেমন গুটিয়ে এক জায়গায় এসে শান্ত হয়ে গেছে ! এই যে তোমরা যারা এখানে অর্থাৎ এই আশ্রমে এসে আমার সামনে সিটিং-এ বসে আছো_ এখানে এসেও তোমাদের সেই একই অভিজ্ঞতা হয় না কি ? তাহলে বুঝতে পারলে তো ব্যাপারটা ?
বর্তমানের মনুষ্যসমাজ যেটা তোমরা দেখছো – এটা বহু লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফল। সেই এককোষী প্রাণী জীবাণু/বীজাণু থেকে শুরু হয়ে বহুকোষী প্রাণীও উদ্ভিদ। এরপরে উদ্ভিদের বিবর্তন ছাড়াও প্রাণীর বিবর্তনে কীটাণু হয়ে অন্ডজ, জরায়ুজ, বানর, নর– এই ‘ক্রম’ এবং এটা একটা দীর্ঘযাত্রা ! প্রাণের অভিবিকাশের এই পথটা পুরোটাই সংগ্রামের পথ। দুর্বলের insecured অবস্থা থেকে অপেক্ষাকৃত secured অবস্থার দিকে সবলের এগিয়ে যাওয়াটাই বিবর্তন ! যে হেরে গেছে- হারিয়ে গেছে, লড়াই করতে পারে নি – সে অভিযোজনে পিছিয়ে পড়েছে – হয়তো অবলুপ্ত‌ই হয়ে গেছে প্রকৃতি থেকে !
সুতরাং তুমি তোমার আশেপাশে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা দেখে হয়তো একটা ব্যাপারে সিদ্ধান্ত করে বসছো –কিন্তু এটা জেনে রাখবে যে, এইগুলি (সবল ও দুর্বলের ব্যাপারটা) নতুন কিছু নয়। জীব সৃষ্টির শুরু থেকেই এইটা চলে আসছে। তুমি জানো না –কিন্তু তুমি যখন মাতৃগর্ভে প্রথম ‘জাইগোট’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলে, তার আগেও অজস্র শুক্রাণুর মধ্যে compitition হয়েছিল, লড়াই হয়েছিল ! যেটি সুস্থ-সবল সেটি অপর সকল শুক্রাণুদেরকে হারিয়ে মাতৃগর্ভের ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়ে ঐ ‘জাইগোট’-টি গঠন করেছিল !
সুতরাং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমগ্র জীবনটাই তো সংগ্রাম বাবা ! প্রকৃতিতে সবসময়েই সবল, দুর্বলের উপর প্রভাব বিস্তার করে, অত্যাচার-উৎপীড়ন করে, তার খাদ্য কেড়ে খায়, তাকে দাস বানায় ! পশুজগতে দেখা যায়_ সবলেরা দুর্বলকেই খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে ! মনুষ্যজগতেও এর ব্যতিক্রম হয় না – জিনে প্রবণতা রয়েছে যে, তাই এইরকমটি ঘটে !
এখানেই মহাপুরুষের ভূমিকা ! যুগে যুগে বিভিন্ন মহাপুরুষগণ, মহাজনেগণের এইজন্যেই আগমন হয় ! তাঁরা মানুষের কাছে কাছে গিয়ে তাদের বিবেকের জাগরণ ঘটান। কারণ তাঁরা জানেন একমাত্র বিবেকের জাগরণ হোলেই মানুষ মানুষকে “মানুষ” হিসাবে দেখতে শেখে। ‘দুর্বল মানুষ- মানেই তার কামনা-বাসনা মেটানোর বস্তু’ বা ‘তার উপর সবরকম অত্যাচার করার অধিকার ঐ সবল ব্যক্তির রয়েছে’ – এই ভাবনা আর থাকেনা। দুর্বল ব্যক্তির প্রতি দমন-পীড়ন, উৎপীড়ন, অত্যাচার করার পরিবর্তে ঐ ব্যক্তির অন্তঃকরণে তখন দয়া, ক্ষমা, মমতা, প্রেম-ভালোবাসার জন্ম নেয়। তখন ঐ ব্যক্তি অপরের ভালো করার জন্য নিজের স্বার্থত্যাগ করার প্রেরণা লাভ করে। এইভাবেই সমাজে ভালো মানুষ, উন্নত মানুষের জন্ম হয়। উত্তরকাল এদেরকেই ‘দেবমানব’, মহামানব ইত্যাদি আখ্যা দেয়।
সুতরাং এটা বুঝতে পারলে তো যে, দুর্বলের উপর সবলের অধিকার কায়েম এই ব্যাপারটা প্রকৃতিতেই রয়েছে, একমাত্র বিবেকবান মানুষেরা এমনটা করেন না। তাঁরা জানেন, অন্যায়কর্ম করলেই কর্মফল ভোগ করতে হয়। কিন্তু অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন মানুষ এটা জানেনা, জানতে পারলেও মানে না। তারা হয়তো সমাজের বিজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছে শোনে – কিন্তু মানে না বা বিশ্বাস করে না। তবে এটাই বিজ্ঞান ! যেমন কর্ম করবে তেমনি ফল পাবে ৷ হিন্দিতে বলে, “যিতনা করণী উতনা ভরণী”। জড়বিজ্ঞানের সূত্রেও রয়েছে ‘ক্রিয়ার সমান প্রতিক্রিয়া’-র কথা ! দ্যাখো, ‘প্রকৃত বিজ্ঞান’ সেটাই, যা স্থূল-সূক্ষ্ম-কারণ সব অবস্থাতেই এক নিয়মে চলে। অপকর্মের ফল যে ঐ মানুষটাকেই ভুগতে হয়, সেই কথাটা অন্তরের সঙ্গে জানলে অর্থাৎ বোধ করতে পারলে__ কখনো কোনো মানুষ জীবনেও অপরের প্রতি অত্যাচার-অনাচার করতো না। একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছি – দ্যাখো যদি বুঝতে পারো ! ….[উদাহরণটা পরের এপিসোডে]
(ক্রমশঃ)