জিজ্ঞাসু:– তাহলে তো পুরানে বর্ণিত ঘটনাগুলির মধ্যে অনেক সত্য লুকিয়ে রয়েছে?

গুরু মহারাজ:– এটা আবার কি বললে ! সত্য অনেক হয় না, ‘সত্য’ সত্যই ! ভারতীয় ঋষিরা ধ্যানের গভীরে ডুব দিয়ে পরম সত্যের বোধ করেছিলেন__ যার ফসল বেদ-উপনিষদ। ঋষিদের উপলব্ধ সেই সত্য যখন সমাজের সাধারন বা অতি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার প্রয়োজন হয়েছিল তখনই সৃষ্টি হয়েছিল পুরাণ ও মহাকাব্য ! তার আগে বহুকাল পর্যন্ত বেদ-বেদান্ত ছিল শ্রুতির আকারে অর্থাৎ শুনে শুনে এইসব শিক্ষা গুরু পরম্পরায় বাহিত হোতো হাজার হাজার বছর ধরে।

সুতরাং এটা জেনে রাখবে, পুরাণগুলিতে গল্পের আকারে বিভিন্ন তত্ত্বের তথ্যই পরিবেশিত রয়েছে! “ধর্মস্য তত্ত্ব নিহিত গুহায়াং”_ যুধিষ্ঠির এই কথা বলেছিলেন ধর্মরাজকে । এখানে ‘গুহা’ বলতে পর্বতের গিরি-গুহাকে বোঝানো হয়নি। ‘গুহা’ বলতে বোঝানো হয়েছে হৃদয়রূপ গুহাকে(যদিও বিদেশি আক্রমণের সময় ভারতীয় প্রাচীন বহু শাশ্ত্র গিরি-গুহাতেও লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।) ! মানুষের অন্তর্জগতেই সব জ্ঞান বিদ্যমান, সব তত্ত্ব বিরাজমান । সেইসব তত্ত্বকে জানতে গেলে ধ্যান করতে হবে, ধ্যানের গভীরে ডুব দিতে হবে। ‘ধ্যান’ বলতে কি বোঝায় ? শুধু মনের একাগ্রতা বা concentration of mind বললেই ‘ধ্যান’-কে ঠিকমতো বোঝানো যাবে না । ঠিকমতো বলতে গেলে বলতে হয়_concentration of mind within mind_ এটাই ‘ধ্যান’!

‘ধ্যান’ কখনো নির্বিষয় হয় না, আবার নিরাকারের ও ধ্যান হয় না । প্রাথমিক পর্যায়ে ধ্যানাভ্যাস করতে গেলে মনে কোনো না কোনো বিষয় চাই-ই ! অভ্যাস করতে করতে মনে একাগ্রতা আসে। শাস্ত্র মনের এই একাগ্র অবস্থা বোঝাতে_”নিরবচ্ছিন্ন তৈলধারার ন্যায়” বলে বর্ণনা করেছেন! নিরবচ্ছিন্নতাই concentration _ আর এতেই মন একাগ্র হয় ।
চিত্তের একটি বৃত্তি হোলো মন। চিত্তের পাঁচটি অবস্থার কথা ভারতীয় শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে_ মুঢ় চিত্ত, ক্ষিপ্ত চিত্ত, বিক্ষিপ্ত চিত্ত, একাগ্র চিত্ত এবং নিরুদ্ধ চিত্ত । এই একাগ্র চিত্ত অবস্থাকেই আমরা সাধারণত মনের একাগ্রতা বলে থাকি । কিন্তু তারও পরের অবস্থা হোলো নিরুদ্ধ চিত্ত অবস্থা। এই অবস্থাতেই মনের লয় হয়।
দ্যাখো, যে কোনো জিনিসের গভীরতায় যেতে গেলেই ধ্যানের প্রয়োজন হয়। রবীন্দ্রনাথের উচ্চ চিন্তাযুক্ত কবিতাগুলি পড়ে বুঝতে গেলেও ধ্যানের প্রয়োজন হয়। একটা বাঁশের বেড়াও যদি কেউ দেয়_ তাকে নিখুঁত করে দিতে গেলেও মনের একান্ত একাগ্রতা বা ধ্যানের প্রয়োজন হয়।
ধর্মই হোলো সনাতন, শাশ্বত । জগতে যত কিছু দর্শন রয়েছে, সেগুলি কোনো না কোনো মনীষীর মত অথবা মতবাদ । সার্বিক অর্থে ধর্মই সবকিছুকে ধরে আছে । তবে প্রতিটি individual -এরও পৃথক পৃথক ধর্ম রয়েছে, যা বৃহৎ অর্থে সেই প্রকৃত “ধর্ম”-এর মধ্যেই রয়েছে । যেমন জলের ধর্ম ‘সিক্ততা’, আগুনের ধর্ম ‘দাহিকা’ ইত্যাদি। তেমনি মানুষেরও ধর্ম রয়েছে আর তা হোলো__ মনুষত্ব । হ্যাঁ, যে কোনো মানুষের জীবনের প্রথম এবং প্রধান কাজ হোলো _মনুষ্যত্ব অর্জন করা !
“ধর্ম” কি তা বোধ করতে হয়_বোধে বোধ। এই জন্যেই বলা হয় ধর্মবোধ। তাই বলছিলাম_ ধর্মকে বোধ করতে হয়, তত্ত্বকে বোধ করতে হয়! কোনরকম ‘বাদ’ বা -ism দিয়ে কোনোদিনই সমাজে ভালো কিছু হয়নি, আর হবেও না । দেখবে, মানবের জীবনে বাদ উপস্থিত হোলেই তার সাথে সাথেই নানাপ্রকার বাদানুবাদ, বিতর্ক, বিভেদ উপস্থিত হয়।
সমাজে অনেকেই বলে যে_ ‘সে নাস্তিক’ ! কিন্তু প্রকৃত অর্থে পৃথিবীতে নাস্তিক কেউই নাই । জগতে ঈশ্বরে অবিশ্বাসীও কেউ নয় ! হয়তো অনেকে মুখে বলছে_ ‘আমি নাস্তিক’– ‘আমি অবিশ্বাসী’, কিন্তু এই যে ‘আমি’ কথাটি সে ব্যবহার করছে__ এই ‘আমি’ সম্বন্ধে তার ধারণা কোথায়? প্রকৃতপক্ষে ‘আমি আছি’__ এটাই ‘অস্তি’ ! ভারতীয় সনাতন শাস্ত্রে পরমেশ্বরকে বলা হয়েছে সচ্চিদানন্দ অর্থাৎ সৎ-চিৎ-আনন্দ বা অস্তি-ভাতি-প্রিয় ! তাহলে যেখানে ‘আমি’ আছি, সেখানে আমি__ আমার আপন অস্তিত্বকে বিশ্বাস করছি । অতএব যে আপন অস্তিত্বকে বিশ্বাস করছে সে আস্তিক এবং বিশ্বাসী ! সেই অর্থে পৃথিবীতে নাস্তিক এবং অবিশ্বাসী কেউই নয়।।