স্থান – কুড়মুন ৷ সময় – এপ্রিল, ১৯৮৭ ৷

[উপস্থিত ভক্তবৃন্দ > রমেনবাবু, নগেন, জহর, আন্দ্রেজ, রবি ইত্যাদি।]

সুইডেনের আন্দ্রেজ গুরুজীকে জিজ্ঞাসা করলেন :— খাবার খেয়ে মানুষের শরীরে যে শক্তি লাভ হয় – সেই শক্তির সাহায্যেই কি ভগবদ্-লাভ হয় ?

গুরুজী :– খাদ্যগ্রহণের ফলে শরীরে যে শক্তির সঞ্চার হয় – তার ক্রিয়া এই স্থূলদেহে । তোমাকে আগেই বলেছি যে এইরূপ আরও দুটি দেহ আছে – সেগুলি হ’ল সূক্ষ্মদেহ এবং কারণ দেহ ৷ সুতরাং এটা স্বাভাবিক যে, স্থূলদেহের পরিবর্ধন ও পরিপুষ্টি জন্য যেমন আহার প্রয়োজন, যে কথা তুমি বলছ – সেইরূপ সূক্ষ্মদেহ বা কারণ দেহের পরিপুষ্টির জন্যও অন্য প্রকার আহারের ব্যবস্থা আছে । ভগবদ্-লাভে ইচ্ছুক ব্যক্তি তাঁর গুরুর কাছ থেকেই এই পুষ্টিলাভের উপকরণসমূহ সংগ্রহ করে থাকেন ।

সাধারণতঃ ত্রিবিধ শরীরকেই উপযুক্তভাবে গড়ে তোলাটা সাধকদের প্রথম লক্ষ্য ! ভগবদ্-শক্তির প্রকাশ যে আধারে ঘটবে সেই আধার কি কাঁচা হলে হয় !

বাউলগণ বলেন, “কাঁচা হাঁড়িতে গো হাঁড়িতে, রাখিতে নারিলি প্রেমজল”। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন – “কুঁড়েঘরে হাতি ঢুকলে কি অবস্থা হয়।” এই জন্য শরীরকে সবদিক থেকেই মজবুত বা উপযুক্ত করতে হয় – তবেই সেই শরীরে ঈশ্বরলাভ সম্ভব ৷

জিজ্ঞাসু(আন্দ্রেজ) :– স্থূল শরীরটাও যখন একটা factor, তখন বিভিন্ন মানুষের শরীরের যে ভিন্নতা – তা দেখে কি বোঝা যায় কে উপযুক্ত, কে নয় ?

গুরুজী :– তা যায় বৈকি ! স্থূল শরীরকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় – (১) Barrel Body, (২) Athlele Body এবং (৩) Picnic Body ৷

যারা খুব মোটাসোটা, যাদের বুক আর পেট পৃথক করা যায় না – এদের বলা হয় Barrel Body-র লোক । যাদের শরীর একটু পাতলাটে কিন্তু fit, চটপটে চঞ্চল – এরাই Athlete Body-র লোক । আর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ এই ধরনের যে শরীর, এইগুলি Picnic Body-র লোক । সুভাষচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এদের সবারও এই ধরনের দেহ । যাইহোক, তোমার কথার উত্তর পেলে আশা করি ।

জিজ্ঞাসু(আন্দ্রেজ):– অলৌকিক (Miracle) ঘটনা দেখানো_এগুলো সাধু-সন্তরা কিভাবে করেন ?

গুরুজী :— অলৌকিক বলতে তুমি ‘Miracle’- কথাটা ব্যবহার করছ, কিন্তু এগুলো অধিকাংশই Black Magic । Magic কথাটি আদি সংস্কৃত “মায়া” শব্দ থেকে এসেছে, পরে Latin-এ “মোজে-ইস্” থেকে ইংরেজিতে Magic শব্দে রূপ নেয় । এর থেকে বুঝতেই পারছ এই বিদ্যাটি ভারতেরই অবদান ৷ কিছু আচার, কিছু ক্রিয়া এবং কিছু কৌশলের সাহায্যেই এগুলি দেখানো হয় – বর্তমানে Instrument-ও ব্যবহার করা হচ্ছে ৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলির দ্বারা মানুষকে প্রতারণা করা হয় । সাধু-সন্ত বলতে_ যাদের কথা তুমি বলছো , এঁরাও সিদ্ধাই অর্জনের জন্য কিছু বিশেষ আচার বা অভিচার ক্রিয়া লাভের সাধনা করে থাকেন । পরে সেই সিদ্ধাই-এর এইভাবে অপপ্রয়োগ করে থাকেন I

তোমাদের দেশ সুইডেনেও প্রাচীন ভারতীয়দের একটা শাখা যাদের Pagon বলা হতো – ওর বাস করতো ! ওরা খুব Black-Magic জানতো । (আন্দ্রেজ জানালো যে ওদের দেশে এখনও এক শ্রেণীর মানুষ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেনি – ওরা জানে যে Non-Christian মানেই Pagon)।

তবে প্রকৃত সাধু-সন্ত বা মহাপুরুষগণের জীবনে যেসব অলৌকিক ঘটনা ঘটে থাকে – সেগুলির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Miracle’ নয় – একে বলা হয় “বিভূতি” ৷ লোক দেখানো বা প্রদর্শনীর জন্য কখনও এগুলির প্রয়োগ হয় না । কখনও কখনও প্রাকৃতিক নিয়মেই বলো, আর মা জগদম্বার ইচ্ছাতেই বলো – কোন কোন মহাপুরুষকে কেন্দ্র করে বিভূতির প্রকাশ ঘটে যায় ! কতিপয় সৌভাগ্যবান সেই ঘটনার সাক্ষী হবার সুযোগ লাভ করেন । অনেক সময় এমন হয় যে, যাঁকে(কোন মহাপুরুষ) কেন্দ্র করে বিভূতির প্রকাশ ঘটেছে তিনি আদৌ ঘটনাটি হয়তো জানেনই না – স্বয়ংপ্রকাশ হয়ে থাকে ! এবার নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছ লোক দেখানো Miracle আর বিভূতির ব্যাপারটা !

জিজ্ঞাসু:— আচ্ছা, আপনাকে একটা প্রশ্ন করছি – প্রাচীন ভারতের কোন ইতিহাস-ই তো নেই । ইংরেজ পূর্ববর্তী কোন ভারতীয় ঐতিহাসিক বা কোথায় ? এছাড়া তখনকার দিনে কোন লিপিবদ্ধ পুস্তক ছিল _এমনও Record নেই! তবে প্রাচীন ভারতের কথা আপনি বলছেন কিভাবে ?

গুরুজী :– ‘প্রশ্ন করছি’ – একথা বলবেন না, বলুন ‘জিজ্ঞাসা’। মাস্টারমশাই ছাত্রদের প্রশ্ন করে , অর্থাৎ নিজে জেনে, অপরে তা জানে কিনা যাচাই করতে চাইলে বলে ‘প্রশ্ন করা’, আর যে আদৌ জানেনা, জানতে চাইছে – তাকে বলে ‘জিজ্ঞাসা’ বা ‘পরিপ্রশ্ন’ ? আপনি এই পার্থক্যটা জানেন না ? আপনি আরও অনেক কিছুই জানেন না ! শুনুন – প্রাচীন রোহিলাখন্ডে (বর্তমান রাজগৃহ বা রাজগীর) যে সমস্ত লাইব্রেরী ছিল – তাতে এত বেশি সংখ্যক পুস্তক ছিল যে, মুসলমান শাসকেরা যখন ঐ সমস্ত অঞ্চল অধিকার করে – তখন কয়েক হাজার মুসলিম সৈন্য কয়েক মাস ধরে সেই সকল প্রাচীন পুঁথি-পত্রগুলি পুড়িয়ে পুড়িয়ে রান্না করেছিল ৷ তাহলেই ভাবো একবার যে, ঐ একটা স্থানেই যদি এত বই থাকে – সমগ্র ভারতে আরও কত ব‌ই ছিল ! তখনকার ভারতীয় রা সেগুলো রক্ষা করতে পারে নি।তোমাদের দুর্বলতাতেই একদিন এসব নষ্ট হয়েছে– এখন তোমরাই হা-হুতাশ করছো !

আর প্রাচীন ভারতের ইতিহাস লিপিবদ্ধ নাই বলছো__ আছে বইকি ? তবে, যেহেতু ইংরেজরা লিখেছে ভারতের ইতিহাস, তাই সেখানে ভুল-ভাল লেখা আছে ৷ যখন ভারতীয়রা_ ভারতীয়দের ইতিহাস লিখবে, তখনই জানতে পারা যাবে ভারতের প্রকৃত ইতিহাস ।

জিজ্ঞাসু:– মুক্তি কি ? মুক্তির জন্যই কি ভক্তির প্রয়োজন ? তা যদি না হয় তবে ভক্তি কি ?

গুরুজী :— মুক্তি বা মোক্ষ বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে বেরিয়ে আসা । “পুনরপি জনমম্ পুনরপি মরণম্ ; পুনরপি জননী জঠরে শয়নম্”– এই যে জন্মচক্র অনিবার- অনাদিকাল থেকে প্রবাহমান, এটা Beginningless but not Permanent ! এই জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে বেরিয়ে আসাই মুক্তি বা মোক্ষ ।

তবে বাবা! মুক্তি বা মোক্ষ সুলভ চাওয়া । ভক্ত কখনই মুক্তি চায় না – ভক্তি চায় । ভগবান বলেছেন “মুক্তি দিতে কাতর নই, আমি ভক্তি দিতে কাতর”। একটা গল্প আছে শোন – জেলার সাহেবের গল্প :~

এক কয়েদী জেলার সাহেবের নামে খুব গুণগান করে আর কাঁদে, জেলার সাহেবের নামে দোহাই পারে – ” হে জেলার সাহেব, তুমি কত দয়াময় – তোমার দয়ায় কত পাপী-তাপী তরে গেল – আমাকেও জেলখানা থেকে মুক্তি দাও।” অন্নজল স্পর্শ না করে অনবরত ক্রন্দন আর জেলারের নামে দোহাই পারা দেখে , জেলের অন্যান্য কর্মচারীরা জেলার সাহেবকে খবর দিলেন এবং কয়েদীর অদ্ভুত আচরণের কথা জানালেন । জেলার সাহেব ঘটনা শুনে খুবই কৌতুহলী হলেন এবং কর্মচারীদের আরও কিছুদিন কয়েদীটির উপর নজর রাখার জন্য নির্দেশ দিলেন ৷ দিন কেটে যেতে লাগল কিন্তু কয়েদীটির আচরণের কোন ইতরবিশেষ হলো না । জেলার সাহেব এইসব কিছুই নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন! হঠাৎ তিনি একদিন কর্মচারীদের Order দিলেন – “দাও, ঐ কয়েদীটিকে ছেড়ে দাও”৷ হয়ে গেল মুক্তি !

তাহলে বাবা দেখা যাচ্ছে – এতে মুক্তি হলো বটে, কিন্তু জেলার সাহেবকে দর্শন-ই হলো না, স্পর্শন বা সঙ্গলাভ তো দূরের কথা ! সার্ষ্টি, সালোক্য, সামীপ্য, সারূপ্য, সাযুজ্য, এইসব পরপর যে ভক্তের অবস্থান্তরগুলোর কথা শাস্ত্রে রয়েছে – ভক্ত কেন সালোক্য বা সামীপ্যে এসে থেমে যাবে ? শুধু মুক্তি সে কি চায় ? সে চায় ভক্তি – সে চায় সর্বক্ষণের লীলাসঙ্গী হতে ৷ তার প্রার্থনা – “ওই চরণে সদাই রেখো, চরণ ছাড়া করো না হে”। এইজন্য বলা হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলাই শ্রেষ্ঠ লীলা – ভক্তের সঙ্গে ভগবানের লীলা! ভক্ত হওয়াই শেষ কথা – ভক্তি লাভই শ্রেষ্ঠ বাসনা ৷ ভগবানের কাছে চাইতে যদি হয় তো ‘ভক্তি’ চাইব, ‘মুক্তি’ কেন ? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন ” রাজার কাছে কি লাউ কুমড়ো চাইব ?”

তবে কিনা স্বর্ণকার যেমন নিখাদ সোনা বের করার জন্য খাদযুক্ত সোনাকে পুড়িয়ে পিটিয়ে গলিয়ে তার খাদটুকু বের করে নেয়, তেমনি প্রকৃত ভক্তকেও ভগবান বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে দুঃখ, ক্লেশ, শোক, তাপ-এর মধ্যে দিয়ে নিয়ে যান । এই সব ঘাত-প্রতিঘাতেও যদি ভক্তের ভক্তি অটুট থাকে – ভগবান তখন তাকে আদরে ভক্ত বলে গ্রহণ করেন, ধুলো ঝেড়ে কোলে তুলে নেন । আর তখন ভক্ত ছাড়লেও ভগবান আর ছাড়েন না, শয়নে-স্বপনে, নিদ্রায়-জাগরণে বাঁশির প্রাণ আকুল করা সুর সে শুনতে থাকে ! ভক্ত বলছেন, “বাপু হে, বন্ধ করো তোমার বাঁশী, আমি আর শুনতে চাই না”। ভগবান বলেন, “কিন্তু আমি যে চাই, আমার চাওয়াই তোমার চাওয়া”।

ভক্তের মধ্যেই ভগবানের প্রকাশ, তাই ভক্তের সঙ্গেই ভগবানের লীলা প্রকট হয় ! বলা হয় ‘ভক্তের ভগবান’ অথবা ‘ভক্তই ভগবান’ ।আবার কেউ কেউ বলেছেন ‘ভক্ত ভগবানের চেয়েও বড়’ ৷ ভক্তের কাছে ভগবান শিশু, ভগবান অসহায় কিনা – তাই একথা বলা হয় । দেখোনা মা যশোদাকে,– বালক শ্রীকৃষ্ণ দুষ্টমি করছেনবলে তাঁকে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছেন ! বাঁধনের যন্ত্রণায় ভগবান কাঁদছেন আর বলছেন “মাগো! আমায় ছেড়ে দে মা, আমি আর ননী চুরি করে খাবো না , আমি আর প্রতিবেশীনীদের জ্বালাতন করবো না – আমায় ছেড়ে দে-মা”৷

দেখেছো ! ভক্তের কাছে ভগবান কি অসহায় ! আর ভক্তের ভক্তির কি ভীষণ জোর ! তাই বলা হয় “কোটি জীব মাঝে মুক্ত হয় কোন কোন জন । আর কোটি মুক্ত মাঝে ভক্ত হয় একজন”। নিশ্চয়ই বোঝা গেল মুক্তি ও ভক্তির রহস্য । (গুরুজি আরও বলতে লাগলেন) – শাস্ত্রে এইরূপ লেখা আছে যে, শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসকালে ১২ জন ঋষি তাঁকে পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণরূপে চিনতে পেরেছিলেন এবং বলেছিলেন, “যো রাম দশরথকে বেটা – ওহী রাম ঘট ঘটমে লোটা”। তাঁদের প্রতি কৃপা পরবশ হয়ে রাম তাঁদের বর দিতে চাইলে তাঁরা আর কি চাইবেন ? তাঁরা চাইলেন শ্রীরামের লীলা সঙ্গী হতে । কিন্তু রামচন্দ্র তাঁদের বলেছিলেন যে, এই জন্মে অর্থাৎ রামরূপে তাঁদের সাথে লীলা করার আর উপায় নেই (কারণ রামরূপ পরিগ্রহণের আগেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী (Divine Plan) এই জন্মের কার্যাবলী পূর্ব নির্ধারিত হয়ে আছে)। তাই ঐ ঋষিকুলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হ’ল দ্বাপরে ৷ ঐ ঋষিকুল গোপী হয়ে জন্মালেন বৃন্দাবনে এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাসঙ্গিনী হয়ে ভগবৎ প্রেম আস্বাদন করলেন তাঁরা৷

তাহলে দেখা যাচ্ছে, জ্ঞানের চরমভূমিতে অবস্থান করেন যে ঋষিকুল, তাঁরাও ভগবান রামচন্দ্রের কাছে চাইলেন ভক্তি – ভক্ত হয়ে ভগবানের লীলাসঙ্গিনী হবার জন্য ! জেনে রাখবে __জ্ঞান সূর্যের উদয় হলে ভক্তিহিম গলে তরল হয়ে যায়, আর এই দ্রবীভূত তরল অবস্থাই প্রেমের অবস্থা ! এইজন্যই আমি সকলকে বলি ‘সৎ হও,সুন্দর হও, নিষ্কপট হও – প্রেমিক হও’।