স্থান_শিবপুর, হাওড়া।সময়_জুন-জুলাই,৮৮!
উপস্থিত ব্যক্তিগণ__এনাঙ্ক বাগচী, গঙ্গা বাবু প্রমুখ শিবপুরস্থ অন্যান্য ব্যক্তিরা।

জিজ্ঞাসু:—- রামায়ণ তো নানান ভাষায় লিখিত হয়েছে। ‘বাল্মিকী রামায়ণ’ আদি হলেও অনেক ভাষাভাষীর লোকেরা তাদের মাতৃভাষায় লিখিত রামায়ণের ঘটনাসমূহকেই প্রামাণ্য বলে মনে করে! যদিও কোনটার সাথে কোন টার যথাযথ মিল নেই! এমতাবস্থায় আপনি কোন ভাষায় লিখিত রামায়নকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন ?

গুরুজী:— দ্যাখো, আমি কোন রামায়ণ পড়িনি! কাজেই কোন্ ভাষার রামায়ণ ঠিক, আর কোনটা বেঠিক অথবা কোনটা শ্রেষ্ঠ তার জানিও না , বা বলা চলে জানার চেষ্টাও কোনদিন করিনি! চেষ্টা কেন করিনি_ তার কারণ রয়েছে, কারণটা হোল_ আমি ‘রাম’-কে জানি! তাই, কোন্ রামায়ণে কি লেখা আছে_ তা নিয়ে মাথা ঘামাতে যাব কেন? জীবনে কোনটা জানলে প্রকৃত তত্ত্ব জানা যায়_ সেটিকে পূর্বেই বিচার করে স্থির করে নিতে হয়! তারপর সাধনার দ্বারা সেই লক্ষ্যে উপনীত হতে পারলেই প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞান হয়!

বর্তমানে দেখছি__মানুষের কাছে ‘লক্ষ্যে’র চাইতে ‘উপলক্ষ’ প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে ! তাই কোন বিষয়ের‌ই ধারণা ঠিক হচ্ছে না । এখনো হিন্দু সমাজে রাম ,কৃষ্ণ, দুর্গা, কালী– ইত্যাদি পৃথক পৃথক দেবদেবীর উপাসনা করা হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপাসনা যেন উৎসব অনুষ্ঠান বা festival- এ রূপ নিয়েছে! ফলে জমকালো প্যান্ডেল, ঝলমলে মূর্তি _এসব নিয়ে চলে competition! কোন পূজা কমিটির কত টাকা বাজেট ,কোথায় বিচিত্রা অনুষ্ঠানের কত বেশি খরচা, কোন্ কমিটির থিমে কত নতুনত্ব __এইসব নিয়েই মানুষ আলোচনা করে ! পূজার যে ‘মূল তাৎপর্য’–সে ব্যাপারে আলোচনা হয় না ! এবার বলতো _ঋষিদের প্রবর্তিত উপাসনা পদ্ধতির কার্যকারীতা, এর দ্বারা কতটা লাভ হয়! সেই জন্যেই বলছিলাম _লক্ষ্য বস্তুর চেয়ে উপলক্ষকে বড় করে দেখলে প্রকৃত তত্ত্বের আস্বাদন কখনোই হয় না! অথচ দ্যাখো, মানুষের জীবনের উদ্দেশ্যই হলো আস্বাদন _ রসাস্বাদন! কিন্তু সেটা তো নিজের অন্তর্জগতে প্রবেশ করে_নিজেই নিজেকে আস্বাদন করা! বৃথা এখানে ওখানে ঘুরে, বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠানে আস্বাদনের চেষ্টায় ব্রতী হয়ে লাভ কি? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন,_” আম খেতে এসেছিস_ আম খা! কোন গাছে কত পাতা, কত ডালপালা _এসব খুঁজে তোর কাজ কি!

আমিও তোমাদেরকে সেই কথাই বলি__ রামায়ণ পড়া তো ‘রাম’ কে জানার জন্য! কিন্তু শাস্ত্রে ‘রাম’ নাই __তাহলে রাম কোথায় আছে? “যো রাম দশরথকা বেটা ,ওসি রাম ঘট্ ঘট্ মে লোটা!” ‘আত্মতত্ত্বে’ই _ ‘রামতত্ত্ব’ রয়েছে! শাস্ত্র তো শুধুমাএ information বা তথ্য দেয়। আর আত্ম-উপলব্ধিতেই তত্ত্ব জ্ঞান হয়‌ । আর তত্ত্বজ্ঞান হলে সব সংশয় দূর হয় _’ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বশংশয়াঃ।’

জিজ্ঞাসু:—— ‘বেদ ভিত্তিক সাম্যবাদ’- কথাটির অর্থ যদি একটু বুঝিয়ে বলেন? গুরুজী :—–“বেদভিত্তিক সাম্যবাদ”_কথাটির কোনো ভিত্তি নেই, কারণ ‘বেদ’ কোন ‘বাদ’ নয়, ঋষি দের উপলব্ধ সত্য বা জ্ঞান ই ‘বেদ’। এবার কথা হচ্ছে ‘বাদ’ যেখানে আছে, সেখানে বিবাদ উপস্থিত হবেই । তাই ‘বেদ’ কেন বিবাদের ভিত্তিভূমি হতে যাবে? বেদ সেই সত্যকে বর্ননা এভাবে করেছেন__ “দ্বন্দাতীতং,ত্রিগুনরহিতং,গগনসদৃশং”! সুতরাং সকল ‘বাদে’র ঊর্ধ্বে যাও! দ্বন্দ্বাতীত, ত্রিগুণরহিত, আকাশবৎ হ‌ও! যুগ যুগান্তরের মনীষীদের সাধনার সঞ্চিত ধন, উপলব্ধির ফসল হলো_ ‘বেদ’। যাতে আছে বোধের কথা ,কোন ‘বাদ’ বা বাদের কথা নাই। তাই কথাটা ‘সাম্যবাদ’ কেন হবে__ ‘সাম্যবোধ’! পরম প্রেমিক শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আচন্ডালে প্রেম বিতরণ করলেন এই ‘সাম্যবোধ’ থেকে! কোন ‘বাদ’ দিয়ে, কোন ব্যক্তির জীবনেই ‘সাম্য’ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়__ তাই সাম্যবাদ দিয়ে কোন সমাজের বা দেশের প্রকৃত মঙ্গল হবে কি করে?

আসলে ব্যাপারটা কি জানো__জীবন ও জগতের ‘মূল রহস্য’টি ঠিক ধরা যাচ্ছে না বলেই যত ‘বাদ’ আর যত ‘বিবাদ’ সমাজে এসে হাজির হয়! দ্যাখো, বৈচিত্র্যই প্রকৃতির ধর্ম । এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করে বা harmony খুঁজে পেয়ে, মূল ছন্দে নিজের জীবনকে মিশিয়ে দিতে পারলেই আর বিবাদ থাকেনা। কিন্তু সমাজে যতরকম ‘বাদ’ সৃষ্টি হয়েছে সেগুলি প্রকৃতিকে ডিস্টার্ব করে বা প্রকৃতির মূল ছন্দের পতন ঘটিয়ে! আর তার ফলেই সমাজে সাম্য আসে না। ‘বাদ’ দিয়ে সমাজের কল্যাণ করা_ যেন ‘সোনার পাথরবাটি’! এটি hypothesis হয়েই থাকে বাস্তবে কখনো রূপায়িত হয়না! তাই ব্যক্তি জীবন সুস্থিত করো, তোমার নিজের জীবনে সাম্য আনো_ দেখবে সমাজ‌ও সুস্থ হবে সমাজেও সাম্য আসবে।

কোন কোন দেশে, কোন কোন দেশনেতা administration-এর সাহায্যে সাময়িকভাবে কোন না কোন “বাদ’কে__ সেই দেশের জনগণকে মানতে বাধ্য করতে পারে! কিন্তু কালের নিয়মে আবার তার গতিপরিবর্তন হবে, অন্য কোন মতবাদ এসে পূর্বের ‘বাদ’ কে অগ্রাহ্য করে সমাজে হবে প্রতিষ্ঠিত! কিছুদিনের মধ্যেই, সেটাও একদিন পুরোণো হয়ে যাবে_ আবার আসবে নতুন ‘বাদ’! এই ভাবেই কালের আবর্তনে প্রকৃতির খেলা ঘটে চলেছে_ অনাদিকাল হতে! আমার মুখের কথা তোমরা যদি বিশ্বাস করতে না চাও_ তাহলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাস খুলে দেখো, সেখানেই এর প্রমাণ মিলবে। এই জন্যই ঋষিরা বলেছিলেন _”বোধি হও”! ‘বোধ’ ছাড়াএই আবর্তন-বিবর্তনের হাত থেকে জীবের নিস্তার নাই। এটাই বেদের সার শিক্ষা। এই শিক্ষা গ্রহণ করো ‘বাদ’ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি?

জিজ্ঞাসু:—–আচ্ছা বাবা কৈবল্য স্থিতিটা ঠিক কি রকম অবস্থা?

গুরুজী:—“কৈবল্য স্থিতি” বা “সহজ সমাধি”- হয় ঈশ্বরকোটি মহাপুরুষদের! যাঁরা নির্বিকল্প সমাধির উচ্চভূমি থেকে ফিরে এসেও_ যুগ প্রয়োজনে জীবকল্যানের নিমিত্ত ,কোন না কোন একটা ‘আমি’কে আশ্রয় করে কিছুকাল শরীর ধারণ করে লীলা করেন। আমরা তাঁদেরকেই “ভগবান” বলি। এনাদের জীবনেই এইরূপ ‘সহজ সমাধি’ অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়! যেমন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের এইরূপ অবস্থা ছিল__ এই সীমায়, আবার এই অসীমে! এই সাধারন মানুষের মত কথা বলছেন, রোগ-শোকের কোথাও হয়তো হচ্ছে, হয়তো নিজের রোগের জন্য নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করছেন__ আবার তক্ষুনি অসীমের দোরগোড়ায় পৌঁছে নির্লিপ্ত, ক্ষমাসুন্দর হয়ে যাচ্ছেন! তখন তাঁর মধ্যে যন্ত্রণার লেশমাত্র নাই_ মুখে প্রশান্ত হাসির ছোঁয়া!এই অবস্থাই_”কৈবল্য স্থিতি” বা “সহজ সমাধি” অবস্থা! একে শুধু “সহজ অবস্থা”ও বলা হয়। যাঁর এরূপ অবস্থা হয় জানবে, “তিনি সহজ _তিনি সাঁই! সাঁই-এর উপরে আর কেহ নাই।” ওই ব্যক্তি সাক্ষাৎ ঈশ্বর-স্বরূপ, শুধুমাত্র লীলাচ্ছলে ‘ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু’- রূপ ধারণ করে রয়েছেন!

জিজ্ঞাসু:—আচ্ছা বাবা আর একটা কথা_শ্রীমদ্ভগবদগীতায় রয়েছে সাধুদের রক্ষার জন্য এবং দুষ্কৃতীর বিনাশের জন্য ভগবান যুগে যুগে অবতীর্ণ হন। কিন্তু বারবার আসার প্রয়োজন টা কি?

গুরুজী:—-আমার গুরুদেব রামানন্দ অবধূতজী বলতেন_”কাল(সময়) বহুৎ বলবান হ্যায়”! অনাদি অনন্ত ‘কাল’-কে বলা হচ্ছে ‘মহাকাল’! এই মহাকালের অন্তর্গত‌ই অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কাল সমূহ। অবতার সমূহ বা ভগবানের লীলা যখন প্রকটিত হয়__ তাও ঘটে এই মহাকালের অন্তর্গত কোন সীমায়িত ‘কালে’র মধ্যেই ! সুতরাং সেই বিশেষ যুগের ‘যুগধর্ম’ বজায় রাখতে বা ‘নতুন কিছু’ প্রবর্তন করতে তাঁর অবতরণ হয়।এইভাবে কেটে যায় বেশ কিছু ‘কাল’, কিন্তু কালপ্রবাহে যখন আজকের ‘বর্তমান’ _’অতীত’ হয়ে যায়, তখনই আবার নতুন একটা ‘যুগে’র সূচনা হয় !ফলে প্রয়োজন হয় _ নতুন যুগধর্ম প্রবর্তনের। সেই নতুন যুগের নতুন যুগধর্মের সহায়করাই ‘সাধু’ এবং বিরোধীরাই ‘দুষ্কৃতী’! ব্যাপারটা বুঝতে পারছো!!

কিন্তু মজাটা কোথায় জানো, তুমিও তো ‘বর্তমানে’ রয়েছো অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট ‘কালে’র মধ্যে আছো। ‘কালে’র মধ্যে থেকে যখন তুমি বিচার করছ বা বুঝতে চাইছো তখন ‘কালাশ্রিত’ ভগবানের লীলার‌ই সন্ধান পাবে, ‘কালাতীত’-কে কি বুঝতে পারবে? ‘কালেশ্বর’ হয়েও ‘কালাশ্রিত ভগবান’ ‘কালে’র নিয়ম যথাযথমেনে চলেন। তাই নরলীলায় ভগবানকে মানুষের মতো আচরণ করতে হয়। যদিও তিনি সর্বশক্তিমান, সকল নিয়মের স্রষ্টা এবং সকল নিয়মের তিনি ঊর্ধ্বে_তবুও শরীর ধারণ করে ‘লীলা’ করার সময় ভগবানকে মানুষের মতোই আচরণ করতে হয়! কারণ তিনি কালের নিয়মসমূহকে যত্ন পূর্বক মেনে চলেন এবং উপস্থিত সকলকে প্রকৃতির নিয়মাবলীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখান। কারণ তিনি জানেন, তিনি নিজে যদি ‘ষোল টাং’ করেন, তবে বাকিরা হয়তো ‘এক টাং’ করবে! এইজন্যই যুগ পাল্টালে ‘যুগধর্ম প্রবর্তক’-কে বারে বারে আসতে হয় এবং যে যুগের যিনি যুগধর্ম প্রবর্তক তাকে অনুসরণ করলেই সমকালীন মানবের আধ্যাত্মিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়!

স্থান_হাওড়ার রমেশ দত্তের বাড়ি। সময়__জুন-জুলাই,৮৮

উপস্থিত ব্যক্তিগণ__রমেশবাবু,নরেশ বাবু,ভবতোষ বাবু প্রমুখ অন্যান্য ব্যক্তিরা।

_________________________

জিজ্ঞাসু:—-আমরা সংসারী মানুষ সংসারের উন্নতির জন্য, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার মঙ্গলের জন্য সর্বদাই কাজে ব্যস্ত ।ঈশ্বর চিন্তা করার প্রায় সময়ই হয় না_ তাহলে এই যে কাজগুলো আমরা করি, এগুলো করা কি ঠিক নয়? এসব করার জন্য‌ই কি আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতি হচ্ছে না?

গুরুজী:—–‘আমরা’ , ‘আমাদের’ _এই শব্দগুলো ব্যবহার কোরনা, তুমি ‘তোমার’ কথাই বলো, কারণ এখানে উপস্থিত সবাই গৃহস্থী নয়! আর আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হলেও অনেকে হয়তো প্রকৃতপক্ষে তা নয়! যাইহোক, তুমি সংসারী মানুষ _ তাই সংসারের কাজকর্ম তো তোমাকে করতেই হবে ।দ্যাখো, এই বিরাট বিশ্বসংসার এর মধ্যে আমরা সবাই পড়ি __ তাই সেই অর্থে আমরা সকলেই সংসারী! বেদে রয়েছে ‘চতুরাশ্রমে’র কথা! তার মধ্যে ‘সন্ন্যাস আশ্রম’ যেমন রয়েছে তেমনি ‘গার্হস্থ্য আশ্রমে’র কথাও বলা রয়েছে। ‘সন্ন্যাস আশ্রম’ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ‘গার্হস্থ্য আশ্রমে’ তার ব্যবহারিক প্রয়োগ করতে হবে। এটা ঠিকমতো করতে পারলে গার্হস্থ্য আশ্রমেই শিব- শিবানী বা লক্ষ্মী-নারায়ণের অধিষ্ঠান হবে! তুমি শিব স্বরূপ এবং তোমার স্ত্রী শিবানী স্বরুপা হবেন!

আর সংসারের জন্য কর্ম বলতে তো অর্থ উপার্জন, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয়_ ইত্যাদি কর্মগুলিকে বোঝাচ্ছ তো? তা এগুলো নিশ্চয়ই প্রয়োজন! কারণ তোমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে তুমি রোজগার করে খাওয়াবে না, তো কি ওপাড়ার হরি মুদি,রামা বাগ্দী খাওয়াবে পড়াবে! সুতরাং উপার্জন করতেই হবে কিন্তু সেই সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে যে, তুমি যে দেশে জন্মেছ _সেটা তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশ! তার একটা সাধারন ইকোনমিক স্ট্যান্ডার্ড আছে , জীবনযাত্রার একটা সাধারন মান আছে। তাই তোমাকে দেখতে হবে তোমার পরিবারের জীবনযাপনের মান _যেন সেই সাধারন মানের ঊর্ধ্বে না যায়! তা যদি যায় তাহলে জানবে, আর কাউকে শোষণ করে তুমি তার ন্যায্য ভাগ নিজে ভোগ করছো।তোমার পরিবারের সকলের ভরণপোষণের জন্য তুমি নিশ্চয়ই অর্থ উপার্জন করবে, তোমার পুত্রকন্যার শিক্ষার উন্নতির জন্য তুমি নিশ্চয়ই সচেষ্ট হবে _ কিন্তু এইসব করার জন্য তোমাকে যেন কোন অসাধু উপায়ে অবলম্বন করতে না হয় বা অন্য কাউকে বঞ্চিত করতে না হয়!তাহলে অন্তত আর কিছু না হোক _ তোমার নৈতিক অধঃপতন ঘটবে না এবং সমাজ তোমার দ্বারা কোনো ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না’।

জিজ্ঞাসু:—-কিন্তু ‘সাধারণ মানে’-র জীবন যাপন করার জন্য তো বেশি অর্থের প্রয়োজন হবে না! তাহলে মানুষকে বেশি কর্ম‌ও করতে হবে না, সেক্ষেত্রে মানুষ অধিক সময় নিস্কর্মা হয়ে থাকবে না কি?

গুরুজী:—– তা কেন? সৎ পথে থেকে তোমার যদি অধিক অর্থ উপার্জনের উপায় থাকে, তবে সেই অর্থ তুমি সমাজকল্যাণে ব্যয় করবে !দুস্থ,অসহায়,অনাথ _কতই তো রয়েছে সমাজে! ভাবতে হবে তাদের হয়েই তুমি রোজগার করছো। এটাই তো সমাজসেবার শিক্ষা!

দ্যাখো, সাধারণ মানুষ এইসব চিন্তা নিয়ে কর্ম করে না! অথচ ‘কর্ম করছি’ – ‘কর্ম করছি’ বলে চিৎকার করে। মানুষ কি কর্ম করে বলোতো__ “আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা” অর্থাৎ কামনা জড়িত কর্মই তো মানুষ করে থাকে!

শ্রীমদ্ভগবতগীতায় তিন প্রকার কর্মের কথা বলা হয়েছে_সঞ্চিত কর্ম , প্রারব্ধকর্ম এবং ক্রিয়মান কর্ম।পূর্বাপূর্ব জন্মের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ চিত্তে বীজাকারে সঞ্চিত রয়েছে যা, তাই সঞ্চিত কর্ম! ইহজীবনে তার প্রকাশ ঘটে না বলে সঞ্চিত কর্মের পরিমাণ যে কত ,তা জানা যায় না। ‘প্রারব্ধ কর্ম’ হোল সেইটুকু__সঞ্চিত থেকে যেটুকু নিয়ে বর্তমানের শরীর ধারণ ও পিতামাতা বা পরিবেশ নির্ধারিত হয়েছে! ফলে প্রারব্ধ কর্মবশতঃই জাতকের পিতা-মাতা ও পরিবার বা পরিবেশ নির্ধারিত হয়। আর এই জীবনে যেসব কর্ম করা হচ্ছে অর্থাৎ সুকর্ম, দুষ্কর্ম, অপকর্ম_এগুলি ক্রিয়মান কর্ম। এইসব কর্মের ফল, মৃত্যুর পরে আবার ‘সঞ্চিত কর্মে’র সাথে যুক্ত হয় সুতরাং দেখা যাচ্ছে কর্ম যাই করা হোক কর্মফলের ভোগ দ্বারাই সঞ্চিত কর্ম ক্ষয় হয়।

দেখা যায় ,ভোগ-ভোগান্তির দ্বারাই মানুষের সঞ্চিত কর্মফল ধীরে ধীরে কাটতে থাকে।জন্ম জন্মান্তর ধরে সাধারণ মানুষেরা এই কর্ম চক্রের বাইরে বেরোতে পারছে না ! এখানে একটা জিজ্ঞাসা আসতে পারে__তাহলে জীবনের কৌশল বা বাঁচার কলাটি কিরূপ হলে মানুষের জন্ম-জন্মান্তরের ওই সঞ্চিত কর্মভান্ডার একেবারে নিঃশেষিত হয় এবং মানুষকে আর ভোগরূপ শরীর ধারণ করে বারবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে ফিরে আসতে হয় না? এর উত্তর__’নিষ্কাম কর্ম’! শুধুমাত্র নিষ্কাম কর্মের দ্বারাই ‘সঞ্চিত কর্মে’র ভান্ডার শেষ করা সম্ভব! এটাই একমাত্র পথ! নিষ্কাম কর্ম দ্বারাই সঞ্চিত কর্মের পরিমাণ কমতে কমতে একদিন শুন্য(০)-তে দাঁড়ায়! তখন আর কোন কর্মের জন্য‌ই কর্মফল ভোগ করতে হয় না। এখানে হয়তো আবার একটা জিজ্ঞাসা আসবে__ ‘নিষ্কাম কর্ম’ কি করে করা যায়? গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন_”যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি”_ অর্থাৎ “যোগ যুক্ত হয়ে কর্ম করো”। ভগবানের কাজ করছ মনে করে, সর্বদা তার স্মরণ মনন করতে করতে কর্ম করাই_ কর্মকৌশল! কর্মের মাধ্যমে ভক্তের সঙ্গে ভগবানের ‘যোগ’ হয়, তাই এর নাম “কর্মযোগ”! একটা উদাহরণ দিয়েছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, তিনি বলেছিলেন _”বাবুদের বাড়িতে থাকে ‘ঠিকে ঝি’! সে সেই বাড়ির সব কাজ করে_ সবকিছুতেই ‘আমার’- ‘আমার’ করে কিন্তু তার মন পড়ে থাকে তার নিজের ঘরে, যেখানে তার নিজের সন্তান রয়েছে_ তার উপর! এখানে সংসারী মানুষকে ঐ ‘ঠিকে ঝি’-এর মত সংসারে থাকতে হবে! ঈশ্বর তার একমাত্র আপন, সর্বদা এই জ্ঞানে পরিবার-পরিজনের ভরণপোষণ আদি সব কর্ম করতে হবে ।তাহলে তার কর্ম‌ও ‘কর্মযোগ’ হয়ে যাবে! এইভাবে কর্মযোগে সিদ্ধ ব্যক্তিদেরই কর্মে-অকর্ম এবং অকর্মে-কর্ম হয় অর্থাৎ তাদের কর্ম সর্বদাই “বহুজনহিতায়- বহুজনসুখায়”হয়। এর ফলে তাঁরা কোনরূপ কর্ম বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন না এবং কোনরুপ কর্মফলও তাদের স্পর্শ করতে পারে না! এই অবস্থাতেই সাধক ‘অভয়’ হয়! এটা যেন নিশ্চিন্তে শিশুর মায়ের কোলে বসে খেলা করার মত।

তাহলে এখন নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছো_ কর্ম রহস্যটি কি ! দ্যাখো, ‘নিষ্কর্মা’- বলে কেউ নেই, কারণ যে কোনরকম কাজ বা ক্রিয়া ই _কর্ম। এমনকি, তুমি হয়তো চুপটি করে বসে আছো _ ভাবছো কোন কর্ম হচ্ছে না কিন্তু তুমি যে নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছ, এটাও তো কর্ম! তবে জেনে রাখবে_ সমস্ত কর্মের‌ই কর্মফল রয়েছে, যা ভোগ করতে হয়, শুধুমাত্র নিষ্কাম কর্ম‌ই কর্মযোগ।।