সময়_ জুন-জুলাই,৮৮
উপস্থিত ব্যক্তিগণ__ রমেশ বাবু, নরেশ বাবু, গঙ্গা বাবু প্রমূখ আরো অনেক ভক্তবৃন্দ।
জিজ্ঞাসু:– গুরুজী! সংসারী লোকের ছেলেমেয়েদের জন্য দুশ্চিন্তা তো থাকবেই! তাছাড়া তাদের ভালো-মন্দ দেখার কর্তব্যটাও তো থেকে যাচ্ছে?
গুরুজী:—আবার আমিত্ব আরোপ করছো! এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এতই বিশাল যে সেখানে এই সৌরমণ্ডলটাই অতিক্ষুদ্র!এই সৌরমণ্ডলের অন্তর্গত পৃথিবী একটি গ্রহ! পৃথিবীর অন্তর্গত এশিয়া একটি মহাদেশ ! তার অন্তর্গত ভারতবর্ষ একটি দেশ এবং সেই দেশের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গ একটি রাজ্য! সেই রাজ্যের অন্তর্গত হাওড়া একটি জেলা, সেখানে আবার কত মহুকুমা- কত ব্লক- কত মিউনিসিপালিটি ! এসবের তুলনামূলক বিচারে একজন মানুষ কতটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র_সেটা বুঝতে পারছো? তাহলে বলো তো __বিশ্ব-বিরাটের সাপেক্ষে একটা ক্ষুদ্র ব্যক্তির কতটুকু ভূমিকা থাকতে পারে! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন _”ঈশ্বরের ইচ্ছে ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়ে না”! তাই মহাবিশ্ব বা মহাজাগতিক নিয়মের কোন ব্যতিক্রম ঘটানো, কি কোন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব? আর অতি ক্ষুদ্র কর্তব্যবোধ কি না দেখালেই নয়?
সবকিছু ঈশ্বরে অর্পণ করো_ শরণাগত হও! ছেলেমেয়ের ভালো-মন্দের ভার ঈশ্বরকে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে আনন্দে দিন কাটাও__ তাহলেই সমস্যামুক্ত হবে! অন্যথায় দুশ্চিন্তা, সমস্যা দিনকে দিন বেড়েই যাবে__ কমবে না কোনদিন!
দ্যাখো গঙ্গাবাবু!ধরো, তোমার মেয়ের অনেক দূরে কোথাও বিয়ে হয়েছে। তুমি অনেকদিন খবর পাওনি_ একমাত্র মেয়ে, তাই চিন্তা করছ_ ছটফট করছ! এমতাবস্থায় তুমি কি করতে পারো বলো_বড়জোর টাকা পয়সা খরচ করে সেখানে খবর নিতে যেতে পারো! কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলে _তোমার মেয়ে এমন কোন সমস্যায় পড়েছে যে, তার হাত থেকে তাকে মুক্ত করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়! তখন তুমি কি করবে_ মানসিক দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি করা ছাড়া তোমার ‘কর্তব্যবোধ’ দিয়ে তুমি কিভাবে তাকে সাহায্য করতে পারো- বলো?
কিন্তু প্রথম অবস্খাতেই তুমি যদি তোমার মেয়ের ভার_ ঈশ্বরের উপর ছেড়ে দিতে, তাহলে দেখতে পেতে অচিরেই তুমি তোমার মেয়ের সুসংবাদ পেয়ে গেছো! সেক্ষেত্রে তোমার মানসিক উদ্বিগ্নতাই সৃষ্টি হতো না, ফলে তা বেড়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই উঠতো না।
আমি সত্যি বলছি_যে সব পিতামাতারা পুত্র-কন্যার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করতে চান __তাদের এর চেয়ে প্রকৃষ্ট পন্থা আর নাই! বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখে নিও_নিশ্চয়ই ফল পাবে । তবে একটা ব্যাপারে perfect থাকতে হবে__মন মুখ যেন এক থাকে, যেন প্রার্থনায় নিষ্ঠার কোন ঘাটতি না হয়_ তাহলেই হবে।
ঋষিবাক্য মিথ্যা হবার নয়!
জিজ্ঞাসু:—-পাপ ও পুণ্যের সংজ্ঞা এবং তার ব্যাখ্যাটা যদি একটু বলেন ?
গুরুজী:—-দেখো বৈদান্তিক দৃষ্টিতে জগৎটাই তো মিথ্যা_ সেখানে পাপ-পুণ্য নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না!কিন্তু সাধারণ মানুষ যখন সবের মধ্যেই আছে তখন তার পাপ-পুণ্যও আছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন_”দুর্বলতা, অজ্ঞানতা এবং স্বার্থপরতাই পাপ”! আমিও তাই বলি__ যে আচরণ তোমাকে দুর্বল করবে, যার ফলে তোমাকে অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতে হবে_ তাই পাপ ! যে অজ্ঞানতার ফলে তোমারভেদজ্ঞান, তোমার অন্যায়আচরণ, তোমার আত্মাভিমান_ বেড়ে যায়, সেই অজ্ঞানতাই পাপ! আর সর্বোপরি ‘স্বার্থপরতা’! নিজের নিয়েই পরে রয়েছো__অপরের কথা ভাবছো না, এটাই স্বার্থপরতা! আর এগুলিই পাপ! অতএব,এটাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ_ দুর্বলতা অজ্ঞানতা এবং স্বার্থপরতার বিপরীত আচরণগুলিই_ পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হবে। উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলছি__ স্বার্থপরতার বিপরীত আচরণ হবে “পরোপকার”! তাই পরোপকার-ই “পুণ্য”। মানুষের মধ্যেই সুর এবং অসুর রয়েছে । অসুর প্রকৃতির মানুষেরা পাপ কর্মগুলি আচরণ করে এবং সুর প্রকৃতির মানুষেরা পুণ্যকর্ম আচরণ করে থাকে। একটা উপনিষদের গল্প বলি শোন !একবার দনুর পুত্র দানব ,দিতির পুত্র দৈত্য এবং অদিতির পুত্র দেবতারা_ ভগবান বিষ্ণুর নিকট হাজির হয়েছিলেন তাদের নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য! মধ্যাহ্ন হয়ে গেছে দেখে_ভগবান তাদেরকে স্নানাদি সেরে কিছু অন্নগ্রহণ করার অনুরোধ জানালেন এবং তারপর তাদের বক্তব্য শুনবেন বলে আশ্বাস দিলেন। নামমাত্র স্নান সেরে দানবের দল প্রথমে খাদ্য গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়ে চলে এলো, দৈত্যরাও তাড়াতাড়িই ফিরে এল কিন্তু সবার শেষে স্নান-আন্হিক ইত্যাদি সেরে সবার শেষে এল দেবতারা! খাদ্য পরিবেশন হয়ে গেছে_ সবাই এবার গণ্ডূষ করে খাদ্য গ্রহণ করতে যাবে, এমনসময় ভগবান তাদের সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন_ “শোনো, তোমরা সবাই অন্ন গ্রহণ করতে পারো! কিন্তু সাবধান! তোমরা স্বহস্তে অন্ন গ্রহণ করে মুখে তুললেই_ তোমাদের মস্তক স্কন্ধচ্যুত হবে!” দানবেরা প্রথমে বিস্মিত ও ভীত হলো পরে লোলুপ দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকাতে তাকাতে ও খাদ্যের ঘ্রাণ আস্বাদন করতে করতে বিরক্ত হয়ে স্থান ত্যাগ করল। দৈত্যরাও দানবদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করল! একে তো তারা ক্ষুধার্ত ছিল, তার উপর হাতের কাছে অমন সুন্দর ঘ্রাণযুক্ত খাবার খেতে পাবে না শুনে, তারাও খুব বিরক্ত হোল। ফলে তারা খাদ্যগুলোকে খানিক নাড়াচাড়া করে উঠে চলে যেতে বাধ্য হোল। কারণ ভগবানের আদেশ অমান্য করলেই মৃত্যু ! এবার দেবতাদের পালা! এমনিতেই স্নানাহ্নিক সেরে তাদের আসতে একটু দেরিই হয়েছিল! দেবতারা গণ্ডূষ করে যেইমাত্র খাদ্য গ্রহণ করতে যাবেন, এমন সময় ওদের কানে এলো_ ভগবানের সতর্কবাণী! কিন্তু সেই সতর্কবাণী শুনে দেবতারা পরস্পরের দিকে চেয়ে একটু হাসলেন, তারপর পরস্পর পরস্পরকে খাওয়াতে লাগলেন! ইন্দ্র চন্দ্রকে,চন্দ্র বরুনকে, বলুন পবনকে_ এইভাবে প্রত্যেকের খাওয়া সম্পন্ন হলো, কিন্তু কারো নিজের হাত মুখে ঠেকলো না! ফলে ভগবানের নির্দেশ মেনে চলাও হোল, তাদের পেটপুরে খাওয়াও হোল।
এইবার গল্পের শিক্ষাটা বুঝতে পারছো__ পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করার যে প্রবৃত্তি সেটাই দেবস্বভাব। এখানে দৈত্য এবং দানবেরা হোল ইন্দ্রিয়পরায়ণ! আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিরা_দৈত্য-দানব, আর বিবেকপরায়ণ ব্যক্তিরাই দেবতা! কিন্তু এখানেও কথা আছে,পাপকর্ম বা পুণ্যকর্ম__ যাই করা হোক না কেন, কর্মফলের ভোগটা থেকেই যাচ্ছে ! পাপ কর্ম করলে না হয় নরকভোগ, আর পুণ্যকর্ম করলে স্বর্গবাস । কিন্তু এ দুটোই তো অনিত্য! স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্রের ও পতন ঘটে! তেমনি আবার ভোগান্তিতে নরকবাসেরও অবসান ঘটে! তাহলে এখন জিজ্ঞাসা__তাহলে নিত্য কি_ চিরন্তন কোনটি ? কি করলে নিত্যে স্থিতিলাভ হয়? এর উত্তরে বলা যায়__ এর একমাত্র উপায় ‘নিষ্কাম কর্ম’! পাপকর্ম-পুন্যকর্ম কি, তার বিচার না করে ‘পরহিতায়’ কর্ম করে যাও_ নিস্কাম কর্মযোগী হও। তখন দেখবে_মানব জীবনের উদ্দেশ্য সফল হবে এবং অচিরেই পরমেশ্বরের করুণা লাভ করে জীবন ধন্য হবে।
জিজ্ঞাসু:– 84 লক্ষ যোনি অতিক্রম করে মানুষ__ এরকম বলা হয় ।এ কথার কি কোন বাস্তব ভিত্তি আছে?
গুরুজি:–আছে বৈকি! ভারতীয় শাস্ত্রাদিতে ঋষিদের উপলব্ধির কথাই লেখা আছে! যে সত্য তাঁরা উপলব্ধি করেছেন, সেগুলোই সবার মঙ্গলের জন্য বলে গেছেন। বিশ্ববাসীকে_ “অমৃতস্য পুত্রাঃ”_হিসাবে।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে_ ব্রহ্মের লীলাবিলাসের কথা! এক কলায় জড়জগৎরূপে প্রকাশমান ব্রহ্ম বিবর্তন ও সংবর্তনের অর্থাৎ evolution এবং involution-এর মধ্যে দিয়ে ষোড়শকলায় পূর্ণ হয়ে নিজেকে সম্পূর্ণভাবেআস্বাদন করেন | “একোহহম্ বহুস্যাম্ প্রজায়েয়েতি “|_ এই ভাবেই এক ব্রহ্ম বহু হবার ইচ্ছায় অর্থাৎ নিজেকে আস্বাদনের নিমিত্ত প্রথমে এক কলায় জড়জগৎ এবং তারপর দ্বিতীয় কলায় নিজেকে উদ্ভিদজ রূপে প্রকাশ করলেন । জড় ভেদ করে জীবনের প্রকাশ হয়_তাই নাম দেওয়া হয়েছে ‘উদ্ভিদ’! এরা সম্পূর্ণরূপে শুধু জড়ের উপরই নির্ভরশীল! এইভাবে এককোষী থেকে বহুকোষী উদ্ভিদজ__লতা,গুল্ম, ঔষধী, বনস্পতি রূপে প্রকাশিত হল। নিরাপত্তার অভাব বোধ থেকেই এভলিউশন ঘটে চলল ২০-লক্ষ প্রজন্ম ধরে! তবু secured হওয়া গেল না_ তাই ব্রহ্ম তৃতীয় কলায় নিজেকে প্রকাশ করলেন স্বেদজরূপে! সেখানেও বিবর্তনের পথে কীটানু, জীবাণু ও বীজানুরূপে আরও ২০- লক্ষ প্রজন্ম অতিক্রান্ত হল, কিন্তু তাতেও security এল না।বেদে যে পঞ্চকোশের কথা বলা হয়েছে ,তাতে জড়জগতে শুধু প্রাণময় কোশের ক্রিয়া হয়! উদ্ভিদজ ও স্বেদজ প্রাণীদের মধ্যে অন্নময় এবং প্রানময় কোশের ক্রিয়া দেখা যায়।এরপরেই ব্রহ্ম যখন নিজেকে চতুর্থ কলায় অন্ডজরূপে প্রকাশ করলেন, তখন থেকে মনোময় কোষের ক্রিয়া শুরু হয়। জলচর,ভূচর এবং খেচর রূপে অন্ডজ প্রাণীরা আরো ২০-লক্ষ প্রজন্ম অতিক্রম করে_ নিরাপদ হবার তাগিদে। এরা মেরুদন্ডী, তাই এদের central sensory system ক্রিয়াশীল । এইজন্য এদের মন ক্রিয়াশীল। কিন্তু এখানেও জীব নিরাপদ নয়, তাই আবার ‘চরৈবেতি’_ অভিব্যক্তির পথে আবার এগিয়ে চলা!এরপর ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশিত করলেন ষষ্ঠকলায়_ জরায়ুজরূপে!ভূমির সঙ্গে horizental- এই পশুকুল একসাথে পা,নখ এবং দাঁতের ব্যবহার করতে পারল_এদের মস্তিষ্কের গঠন ও অন্যান্যদের তুলনায় অনেকটা উন্নত হল।থ্যালামাস ক্রিয়াশীল থাকার জন্য এরা যথেষ্ট বুদ্ধিমানও হোল। কিন্তু এখানেও তারা নিরাপদ হোতে পারল না! আরও ২০-লক্ষ প্রজন্ম কেটে গেল উন্নত এবং উপযুক্ত শরীর গ্রহণের তাগিদে! এবার ব্রহ্ম প্রকাশিত হলেন হোমো ইরেকটাস রূপে। ‘ইরেক্ট’_মানে খাড়া,সোজা!এই প্রথম সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল জীব। এইভাবে হোমো ইরেক্টাস থেকে হোমো হাবিলিস এবং হোমো স্যাপিয়েন্স অর্থাৎ মানুষরূপে আসতে __আরও ৪-লক্ষ প্রজন্ম কেটে গেল! এইভাবেই 84 লক্ষ যোনি অতিক্রম করে দুর্লভ মানব জীবন লাভ করা যায়। এটা বর্তমানে জীব-বিজ্ঞানীরাও জানতে পেরেছেন। তাই পৌরাণিক আখ্যানগুলি অবাস্তব হবে কেন? এগুলি পড়তে গেলে একটু গোলমেলে লাগে বটে_কিন্তু গোলের ভিতরেই ‘মাল’ রয়েছে।
এবার কথা হচ্ছে, মানবজীবন লাভ করেও কি মানুষ secured হয়েছে? না__ তা হয়নি ! অষ্টম কলা বা অর্ধ কলায় ব্রহ্ম নিজেকে এই রূপে প্রকাশ করেছেন মাত্র! তারপর আর evolution দিয়ে এগিয়ে যাওয়া নয়, এবার involution এর মাধ্যমে এগিয়ে চলা! মানব শরীরে পঞ্চকোশই ক্রিয়াশীল,কিন্তু বিবেকের জাগরণ ঘটিয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্নময়, মনোময় ও আনন্দময় কোশ-কে ভেদ করা যাচ্ছে ততক্ষণ মানব অপূর্ণই রয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ এখনও– insecured! বেদে বলা হয়েছে_”পঞ্চকোশ বিবেক ভেদাঃ”! বিবেকের দ্বারা পঞ্চকোশ ভেদ হোলেই মানুষ অভয় হয়, secured হয়। আর এই security-র সন্ধানেই তো জীবের যাত্রা শুরু হয়েছিল অনাদিকাল থেকে __অনন্তের দিকে!!_”life through journey to attain perfection!”