স্থান:-পরমানন্দ মিশন, বনগ্রাম।
সময় :-অক্টোবর, ১৯৮৮ সাল ।
উপস্থিত ব্যক্তিগণ : সব্যসাচী মান্না, স্বরূপানন্দ মহারাজ, জয়রাম ইত্যাদি।

জনৈক ব্যক্তি :– মহাপুরুষদের কথা সমাজের যুক্তিবাদী মানুষ কখনই গ্রহণ করতে পারে না, কারণ সমাজে অর্থনীতির যে একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে, সাধু-মহাপুরুষরা সেদিকটাকে উপেক্ষা করে সকলকে সাধু হতে বলেছে। এই জন্যই মহাপুরুষদের এত সমালােচনা হয় এবং কার্লমার্কস-এর মত মনীষীদের এত কদর! আমার মনে হয়__ এটাই হওয়াও উচিত!

গুরুজী :– তাই নাকি? তা_ কথা হচ্ছে যে, মহাপুরুষ বলতে তুমি যদি কার্লমার্কস-কে বােঝ – তাহলে আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু যদি বুদ্ধ, যীশু, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামীজীদের মতো অবতার পুরুষদের মহাপুরুষ বল – তাহলে বলতে হয় যে, জীবকোটি হয়ে কোন ঈশ্বর-কোটি মহাপুরুষ _কে, বা তিনি কি, অথবা কি তাঁর দোষ-গুণ তা কি করে বিচার করবে বল দেখি ? ঈশ্বর-কোটি মহাপুরুষদের অবতরণ হয়, তাই তাঁরা “অবতার” অর্থাৎ Descending, কিন্তু জীবকোটি Ascending, অর্থাৎ এই পৃথিবী গ্রহের-মধ্যেই এদের জন্ম-মৃত্যুর আবর্তনে ঘোরাফেরা। এদের ক্ষেত্রে একমাত্র সাধনার দ্বারাই চেতনার উত্তরণ বা অভিবিকাশ ঘটে থাকে। সুতরাং বামন হয়ে চাঁদ ধরতে চাওয়ার মতো জীবকোটি হয়ে_ ঈশ্বরকোটি মহাপুরুষগণের সমালােচনা করা হাস্যকর ও নিছক বােকামি। তবুও ভারতবর্ষের কিছু মানুষ(তারা নিজেদেরকে বুদ্ধিজীবী বলে পরিচয় দেয়, কিন্তু আদতে তারা ভ্রান্ত বা আহাম্মক) হিন্দু দেব-দেবী বা মহাপুরুষগণের সমালােচনা করে, কারণ বােধহয় একমাত্র এই দেশেই ওইসব সমালোচনামূলক গ্রন্থ পুরস্কার পায় বা লেখকেরা বাহবা পায়। জেনে রাখবে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন তহবিল থেকে ভারতীয় পরম্পরাকে maline করার জন্য টাকা পাঠানো হয়, এবং ঐ বুদ্ধিজীবীরা_তার থেকে কিছু না কিছু মুনাফা লোটে, খুব সততার ভাণ করে যারা তারাও অন্ততঃ কিছু সুযোগ সুবিধাও ভোগ করে থাকে।কিন্তু খেয়াল করে দেখবে যে, এরা ভুলেও অন্যান্য গোঁড়া ধর্মমতগুলির বিরুদ্ধে বা সেই ধর্মের ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে কোন মন্তব্য করেন। কারণ সেখানে শুধু সম্মানহানি-ই নয়, প্রাণহানির-ও আশংকা আছে।

এবার তােমাকে একটা কথা বলছি–যেটা তুমি বাস্তবে মিলিয়ে নিতে পারো, তা হোল—কোন বিশেষ কালজয়ী ব্যক্তিকে নিয়ে যখন সমালােচনা হয় তখন দেখা যায় যে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমালােচক বিভিন্ন আঙ্গিকে তার সমালােচনা করে গেছেন–কিন্তু মানুষ, সমালোচনার মূলে যে ব্যক্তিটি তাকেই মনে রেখেছে—সমালোচকের দলকে ভুলে গেছে, এটাই রহস্য! মহাপুরুষই পারেন অন্য একজন মহাপুরুষকে বুঝতে, সাধারণ মানুষ তাঁদের কতটুকু বুঝবে ? স্বামীজী শেষ সময় একবার বলেছিলে যে “বিবেকানন্দ কি করে গেল, তা আর একটা বিবেকানন্দ থাকলে বুঝতে পারতাে।” আশাকরি কি বলতে চাইছি তা বুঝতে পারলে। যদি না বুঝতে পারাে_তাহলে আর একটা উদাহরণ দিচ্ছি শোন! ধরো, দেওয়ালে একটা দাগ টানা আছে; এবার তােমাকে বলা হল–না মুছে দাগটাকে ছােট করে দাও। এবার তুমি কিভাবে তা করবে? তুমি—সেই দাগটার উপরে অপেক্ষাকৃত আর একটা বড় দাগ টেনে দেবে—তা হলেই তুলনামূলক বিচারে পূর্বের দাগটা ছােট হয়ে যাবে তাই না? অতএব বােঝা গেল criticize নয়, কাউকে ছােট করতে হলে নিজেকে তার চেয়েও বড় হতে হবে। একতলা থেকে উঁচুতলার খবর দেওয়া যায়না, কিন্তু উঁচুতলা থেকে নীচুতলার সমস্তকিছু দেখা যায় বলে,সব উঁচু এবং নিচু উভয় স্থানের খবর‌ও দেওয়া যায়।

এবার তােমার কথায় আসছি, তুমি বলছিলে না–’মহাপুরুষদের কথা মতো চলতে হলে সবাইকে সাধু হতে হবে’,–তা খারাপ কি? তুমি কি চাওনা _তােমার ছেলেমেয়েরা সৎ হােক, বিবেকবান হােক এটাই তো সাধুতা! বর্তমান সমাজে অশান্তির অন্যতম কারণ হচ্ছে অসাধুতা। ব্যাবসাদার অসাধু, ডাক্তার অসাধু, প্রতিবেশী অসাধু–সবাই সাধু হলে তো কোন ঝামেলাই থাকতো না! হচ্ছে না বলেই তো সমস্যা! তাছাড়া নিজে সাধু(সৎ) না হয়ে সকলেই অপরের কাছে সাধুতা আশা করছে_ এটাও এক ধরনেরপাগলামি। ভারতীয় শাস্ত্র এই জগৎ-কে বলেছে_ ত্রিগুণ প্রপঞ্চ, ফলে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনগুণ সম্পন্ন ব্যক্তিরা সবসময়ই রয়েছে সমাজে! আর শুধু ব্যক্তি কেন, প্রাণী জগৎ, উদ্ভিদ জগৎ, জড় জগতেও এই তিন গুণের প্রকাশদেখা যায়! তার ফলেই এত বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্য থাকবেই–সকলেই একরকম কখনই হতে পারে না। তাই যদি কেউ কখনও বলে যে ‘সবাই সাধু হবে’ তবে সেটা হয় মূর্খের মতো কথা এবং সেটা ভ্রান্তধারণাও বটে! এখন কথা হচ্ছে বৈচিত্র্য আছে বলে কি বিরোধ করতে হবে? অথবা এই সমস্যা বা অশান্তি কি চলতেই থাকবে? না, তাও নয়। বৈচিত্রের মধ্যেও প্রকৃতিতে রয়েছে ঐক্যতান বা Harmony ! এটাকে যদি কেউ খুঁজে পেয়ে নিজেকেও Harmonise করে নিতে পারে, তাহলেই সে সমস্যা মুক্ত হয় এবং শান্তির সন্ধান পায়। আর এই শান্তি বর্হিমুখী অন্বেষণে অথবা কোন ‘বাদ’ বা -ism দিয়ে লাভ করা যায় না, শান্তি পেতে হলে অন্তর্মুখী হতে হয়। মানুষের স্বভাবে রয়েছে শান্তি আর স্বরূপে আনন্দ! ফলে শান্তি কোথায় খুঁজবে ? তোমার স্ব-ভাবটি কিতাই খুঁজে বের করতে হবে।Quest of self বা আত্মানুসন্ধানেই ক্রমে আত্মজ্ঞান লাভ হয়।আর আত্মজ্ঞান লাভ হোলে শান্তি এবং আনন্দের আস্বাদন ঘটে।

ভারতীয় ঋষিরা অন্তর্জগতের গভীরতায় প্রবেশ করে এটাই উপলব্ধি করলেন যে, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি এবং অপার্থিব আনন্দ লাভের একমাত্র উপায় “আত্মজ্ঞান লাভ”। নিজেকে জেনেই জগতের রহস্য জানা যায়। ভারতীয় বেদ-বেদান্ত শাস্ত্রাদি হল সেই ঋষিদের “উপলব্ধ-সত্যে”র জ্ঞান। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মনীষীগণ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, সামাজিক তত্ত্ব প্রকাশ করে সমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধন করছেন বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু গবেষণা চালালে দেখা যাবে, ঐসব প্রাশ্চাত্তের বিজ্ঞানী বা দার্শনিকগণও কোন না কোন ভাবে ভারতীয় ঋষি বা মহাপুরুষের চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত। অনেক গবেষক এসব গবেষণা করে অনেক বইও লিখেছেন, তাতে বলা হয়েছে পর্তুগীজ, স্প্যানিয়র্ড, ডাচ্, ওলন্দাজ প্রভৃতি ইউরোপীয় বণিকগণ বহু পূর্ব-পূর্ব কাল থেকেই ভারতের বিভিন্ন বন্দরে বাণিজ্য করতাে, কেউ কেউ দস্যুবৃত্তিও করতো, এরাই ভারতবর্ষের বহু প্রাচীন পুঁথি-পত্ৰ-শাস্ত্রাদি ইউরােপের বাজারে চালান দিতো। নবজাগরণোত্তর ইউরােপে ভারতীয় প্রাচীন পুঁথিগুলির, ওখানকার পণ্ডিত সমাজে খুব কদর ছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় _এরপর থেকেই ইউরােপের দেশগুলির বিজ্ঞানে বা দর্শনে নতুন নতুন দিগন্ত খুলে যেতে লাগল। ভারতীয়রা যতই প্রাচীন শাস্ত্রাদির প্রতি অবহেলা দেখিয়ে দূরে ঠেলে রাখল, ওরা ততই সেগুলিকেই গবেষণা করে, বিভিন্ন তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটিয়ে নিজেদের উন্নত করে ফেলল। ভারতের ঋষিগণ এদেশের সাধারণ জনগণকে বোঝানোর জন্য বিজ্ঞানকে রসমিশ্রিত করে পুরাণে গল্পের আকারে পরিবেশন করেছিলেন। কারণ শুধুই বিজ্ঞানের তত্ত্ব সাধারণ মানুষের কাছে নীরস এবং দুর্বোধ্য মনে হতো! কিন্তু বর্তমানের ভারত প্রাচীন শাস্ত্রগুলি থেকে নিল শুধু “গল্প” আর প্রাশ্চাত্তের পন্ডিতেরা নিল “তত্ত্ব”। ফলে সূর্যের রথের সাতটা বাহন ঘোড়া কাহিনী এখানকার ছেলে-ভূলানো গল্প হিসাবে থেকে গেল আর প্রাশ্চাত্তের কোন বিজ্ঞানী ওইটা থেকেই বর্ণালী আবিস্কার করল। এইভাবে “দশাবতার”-এর কল্প-কাহিনী _’অভিব্যক্তিবাদে’ রূপ নিল, ভারতের “সামুদ্রিক বিদ্যা” হয়ে গেল Cosmology। এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়।

বিজ্ঞানের মতই ইউরোপের সমাজ-দর্শনের বিভিন্ন তত্ত্বও ভারতের ন্যায়-দর্শন এবং বৌদ্ধ-দর্শন থেকে নেওয়া । ন্যায়দর্শনের বিভিন্ন সূত্র এবং বৌদ্ধশাস্ত্রগুলির বিভিন্ন ব্যাখ্যার সাহায্য নিয়েই তৎকালীন জার্মানের দুই বিখ্যাত দার্শনিক হেগেল্ এবং ফুয়ারব্যাখ্ দুখানি বিখ্যাত গ্রন্থ লেখেন, যাদের নাম যথাক্রমে Materialistic Idealism এবং Dilectic । পরবর্ত্তীকালে কালমার্কস ঐ দুটি বই থেকেই তথ্যাদি গ্রহণ করেন এবং কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব যোগ করে তার বিখ্যাত গ্রন্থ Dilectic Materialism প্রকাশ করেন। গবেষকেরা এটাও বলেছেন যে, আইনষ্টাইনের ভর এবং শক্তি সংক্রান্ত গাণিতিক সূত্র E = Mc² প্রকাশিত হবার পর যদি মার্কস তাঁর বই লিখতেন তাহলে বস্তুর ধর্ম নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করতেন কিনা বলা যায় না! কারণ বস্তু যখন শক্তির-ই একটা বিশেষ রূপ তখন সমাজে বস্তুবাদের ভূমিকা নিত্য তো নয়ই! এমন কি তাই বেশিদিন স্থায়ীও হতে পারে না!

যাইহােক, এসব হচ্ছে বিভিন্ন গবেষকদের মতামত, কিন্তু তার মধ্যে সত্য থাকলে_ তা মানতে হবে বইকি! এখনও যেসব তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখে মানুষ চমৎকৃত হচ্ছে, বহুপূর্বেই সেগুলি ঋষিদের প্রণীত গ্রন্থে সূত্র আকারে প্রকাশ পেয়েছিল। ঋষিদের উপলদ্ধ-জ্ঞান বা সেই পরম সত্যকেই পরবর্তী মহাপুরুষগণ সহজ ভাষায়, সহজ আঙ্গিকে সাধারণের গ্রহণযোগ্য ভাবে প্রকাশ করে যান। তাঁদের সমালোচনা—তাঁদের বিরোধ করে তুমি নিজেই নিজেকে বঞ্চনা করছ—তােমার অশান্তিময় জীবনের সূচনা করছ। এছাড়া আর কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে জানবে প্রকৃত সমাজকল্যাণ মহাপুরুষগণই করে থাকেন, কারণ তাঁরা জগতের কল্যাণ করার জন্যই শরীর ধারণ করছেন! সাধারণে জগতকল্যাণ করতে পারে_করতে চাইলেও কতটুকু করবে? কোন মহাপুরুষ যখন পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন (তা তিনি যেখানেই করুন) তখন সারা পৃথিবীব্যাপী এক-একটি বিশেষ ভাব ছড়িয়ে পড়ে, যা সর্বতােভাবে জনকল্যাণমূলক! ঠাকুর রামকৃষ্ণের জন্মের পরই পৃথিবীতে সমাজতান্ত্রিকতার ভাবনা আসে–বিশ্বাস করো বা না করো, এটা “সত্য”_ তাই বললাম ৷

এবার তােমাকে বলি যে, আমি মার্কস-বিরােধী নই, যদি সত্যি-ই তার দ্বারা মানবকল্যাণ হয়ে থাকে তো Welcome। মার্কস-কে ভগবান ভাবতেও আমার আপত্তি নাই। বাউল গানে আছে -“যেথা আল্লা-হরি-রাম-কালী-গড একথালাতে খায় খানা।” তা এখনকার আধুনিক কোন বাউল গান রচনা হোক না—“যেথা আল্লা-হরি-রাম-কালী-গড-মার্কস এক থালাতে খায় খানা।” আমার কোন sentiment নাই, কেউ সত্য বললে আমি তাকে support করি কিন্তু অসত্য বললেই আমার আপত্তি! তখনই বিরােধ করি এবং তার ভুল সংশোধন করে দিই।

জিজ্ঞাসু :~ মার্কস-দর্শনে যদি কিছু অসত্য থাকে, সেটা যেমন আমাদেরকে গ্রহণ করতে বলছেন, তেমনি মহাপুরুষদের নিয়ে যে সত্য সমালোচনা তাও তো আপনাকে মানতে হবে ?

গুরুজী :~ কি সেই সত্য সেটাই বল্ না !

জিজ্ঞাসু(ঐ ব্যক্তিটি) :~ আমাকে একজন বলেছিল যে, স্বামীজী(বিবেকানন্দ) দীর্ঘদিন একা একা মহিলাদের সঙ্গে কাটিয়েছেন, পজেটিভ-নেগেটিভের আকর্ষণ তো স্বীকার করতেই হবে, ফলে স্বামীজীও নারীর আকর্ষণ কাটাতে পারেন নি ? এটা কি সত্য নয়?

গুরুজী :~ না, কখনই নয়! কিন্তু কথা হচ্ছে–সেই লােকটা তোকে এইসব কথা বলল আর তুই শুনে চলে এলি ? প্রতিবাদ করতে পারলি না ? জেনে রাখবি_ যতসব বাজে লোক, যারা নোংরামি করে বেড়ায় _তারাই স্বামীজী সম্বন্ধে এইরকম মন্তব্য করে । অামার পাল্লায় এসব লােক একবার পড়লে আমি ছাড়ি না, একেবারে তুলােধােনা করে দিই_ যাতে কখনও সে আর এই ধরনের মন্তব্য করতে সাহস না পায়!

এবার দেখা হলে এই কথার উত্তর দিবি, বলবি পজেটিভ এবং নেগেটিভের মধ্যে আকর্ষণের কথা আমরাও জানি, কিন্তু আমরা এটাও জানি যে, ‘ওটা জড়ের ধর্ম_ জীবনের নয়’! জড়ের ধর্ম_ জীবনে খাটে না, কোন প্রকৃত “জীবন” দিয়ে জীবনের একটা ঐরকম দৃষ্টান্ত ওরা দেখাক তাে দেখি_ পারবে না! কারণ এতটা সূক্ষ্ম চিন্তা করার মত সবল মস্তিষ্ক ওদের নেই। ওরা প্রকৃত ‘জীবন’ দেখেনি—তাই এসব কথা বলে। নিজেরা যা করে সকলকে তাই ভাবে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, “মুলো খেয়ে মুলাের ঢেকুর তােলা”। জৈবিক চেতনা সর্বস্ব, স্থূলবুদ্ধি সম্পন্ন আত্মবিস্মৃত মানব তো মৃত তুল্য—তাই জড়ের অনেক ধর্মই ওদের জীবনে খাটে, কিন্তু যিনি ‘জীবিত’ অর্থাৎ যিনি সাধনার দ্বারা সাধারণ জীবন থেকে উন্নত জীবনের পথে এগিয়ে চলেছেন , তাঁর ক্ষেত্রে এসব তত্ত্ব খাটবে কেন? স্বামী বিবেকানন্দের কথা ওরা কি বলবে_স্বামীজী হোসেন ‘মহাজীবন’, ‘জীবিতরা’ই তাঁকে বুঝতে পারেনি—তাে জড়েরা(সাধারণ চেতনা সম্পন্ন মানুষ) কি বুঝবে ? মানুষ নিজের নিজের দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার কোরে সমস্ত রহস্যই জেনে ফেলতে চায় কিন্তু তা কি কখনও সম্ভব হয় ? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সুন্দর উদাহরণ দিয়ে এসব বােঝাতেন, উনি বলতেন, “যার ন্যাবা হয় সে সবকিছুই পীত দেখে।” সুতরাং আধ্যাত্মিক মানুষ যেমন সবকিছুই ঈশ্বরময় দেখে, তেমনি নোংরা- দুর্নীতিপরায়ণ লােকেরাও জগৎ সংসারের সকলকে তারই মতো মনে করে। স্বামীজীর মত মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেন শুধুমাত্র “বহুজন হিতায় চ বহুজন সুখায়।” সম্পূর্ণরূপে আত্মস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ধূপের মতাে পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে এঁরা শুধুই সুগন্ধ ছড়িয়ে যান সমাজে। যার সুফল শুধু তৎকালীন সমাজই নয় পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম ধরে মানুষ ভোগ করে । গীতায় বর্ণিত নিষ্কাম কর্মযোগীর সাক্ষাৎ উদাহরণ স্বামী বিবেকানন্দ। যেন শাস্ত্রবাক্যের সত্য প্রমাণের জন্যই তাঁর অবতরণ। জীব কল্যাণের সংকল্প গ্রহণ করে শরীর ধরেন এঁরা, আর কাজ শেষ হলেই চলে যান—কৃতকর্মরাশির দিকে ফিরেও তাকান না। দেহসর্বস্ব নিম্ন চেতনার মানুষ এসব রহস্য কি করে বুঝবে ?

সাধারণ মানুষের অজ্ঞানতা প্রসূত বৌদ্ধিক এই দুর্গতির কথা ভেবে স্বামীজীই প্রথম উদ্যোগ নেন__গিরি-গুহা-অরণ্যে রক্ষিত বেদান্তের জ্ঞান সমাজে ছড়িয়ে দিতে। পরে আরও কয়েকজন উন্নত মহামানব এই কাজে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন, তাই এখনও কাজ চলছে। ধীরে ধীরে অজ্ঞান-অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে আসছে মানব সমাজ। তবু আজও মনুষ্যসমাজ স্বামীজীকে কৃতজ্ঞতা না জানিয়েদোষারােপ করছে_এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আর কি হতে পারে ! আগামীতে মানুষের যদি এই দোষ-দৃষ্টি দূর হয় তবেই সমাজের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সাধিত হবে, অন্যথায় নয়।