স্থান_পরমানন্দ মিশন, বনগ্রাম।
সময়_ অক্টোবর,88
উপস্থিত ব্যক্তিগণ __মিশনের মহারাজগন ও বহিরাগত ভক্তরা।

জিজ্ঞাসু:— রামপ্রসাদের গান জাগতিক দুঃখ মোচনের জন্য মায়ের কাছে প্রার্থনার কথা আছে, তাহলে ঈশ্বরকোটি মহাপুরুষরাও তো সুখ দুঃখের অতীত নন! কারণ কোন কোন মহাপুরুষ রোগে শোকে কাতর হচ্ছেন_ এমন ঘটনাও ঘটেছে !ব্যাপারটা কি একটু বুঝিয়ে বলবেন?

গুরুজী:– হ্যাঁ-বলছি! জগতে জন্মগ্রহণ করলে জাগতিক সবকিছুকেই মেনে চলতে হয় মহাপুরুষদের। পৃথিবী গ্রহে মানুষের শরীর যখন তারা নিয়েছেন, তখন মানুষের মতো রোগ-ব্যাধি-আহার-শৌচ ইত্যাদি সবকিছুই তাঁদের থাকে_ এটাই সহজতা! তাঁরা অসহজ হবেন কেন? তবে হ্যাঁ, জীব কোটির সাথে ওঁদের পার্থক্যটা হলো এই যে, জীবকোটি _সুখে বা দুঃখে মোহগ্রস্ত হয়ে যায়, লিপ্ত হয়ে পড়ে _আর ঈশ্বরকোটিরা থাকেন উদাসীন! তাই জাগতিক কোন কিছুই তাঁদের আচ্ছন্ন করতে পারে না!মূল বাদী সূরটি থেকে কখনোই তাঁরা বিচ্যুত হন না! আর হবেন-ই বা কেন, নিত্য এবং অনিত্যের বোধ তাদের রয়েছে না!! তাই অনিত্য,নশ্বর বস্তুর অভাবে বা বিয়োগে তাঁরা শোক বা দুঃখ করবেন কেন? দু একটা ঘটনার কথা তুমি যা বলছ _সেগুলো লোকশিক্ষার্থে ঘটানো হয়েছে, অথবা এগুলোকে বলা যায় ভগবানের দুঃখবিলাস!যা লীলার‌ই অঙ্গ! বালগোপাল কাঁদছে ,মা মেরেছেন বলে _ আবার তখনই মুখটি ‘হাঁ’ করে মা কে বিশ্বরূপ দেখাচ্ছে! এটাকে লীলা ছাড়া আর কি বলবে ? আমার নিজের ক্ষেত্রেও এইরকমটাই হতে দেখেছি! যতক্ষণ এখানে বসে আছি , নানা কথা হচ্ছে _ জিজ্ঞাসা উত্তর চলছে _এই মুহূর্তে আমার মন তোমাদের মধ্যেই রয়েছে! আমি তোমাদের কথা ভাবছি, আশ্রমের কথা ভাবছি, আবার কেউ এসে কোন সমস্যার কথা বলল_তখন তার দুঃখে দুঃখিত হয়ে সেই সমস্যার সমাধানের কথা ভাবছি! কিন্তু ব্যস, যতক্ষণ তোমরা আছো ততক্ষণ‌ই! যখন আমি একা, তখন এসব কিছুই আর থাকেনা! এ ‘মন’ যাঁর, তাতেই সম্পূর্ণভাবে নিবদ্ধ থাকে। ওস্তাদ সংগীতশিল্পী অর্থাৎ যারা সংগীতে সিদ্ধ_তাঁরা যখন কোন ‘রাগ’ আলাপন করেন, তখন খেয়াল করে দেখবে যে, তাঁরা মূল রাগটির বাদী সূর থেকে কখনোই বিচ্যুত হন না! হয়তো মাঝে মাঝে একটু সরে এসে নানারকম সূরের কেরামতি করেন কিন্তু ঠিক আবার নিখুঁতভাবে ফিরে যান মূল রাগটিতে।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন_”বুড়ি ছুঁয়ে থাকা”! যাঁরা বুড়ি ছুঁয়ে আছেন__ তাঁরা কেন রোগে-শোকে হাহাকার করবেন বল দেখি? রোগব্যাধি তাদের নিশ্চয়ই হতে পারে, কারণ শরীরের ধর্ম তো শরীর পালন করবেই! কিন্তু দুঃখবোধের কথা যদি বলো _তাহলে উদাহরণ দিয়ে বলতে হয় যীশুর ক্রুশিফিকশনের সময় তাঁর শাস্তি দাতাদের প্রতি তাঁর মনোভাব দেখো _করূনার যীশু কেমন উদার কন্ঠে ঐ নিষ্ঠুর মানুষগুলোর জন্য প্রার্থনা করছেন!! এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ-বুদ্ধ- শ্রীচৈতন্য সকলের জীবনে ওই একই চিত্র দেখতে পাবে! আঘাতের বদলে তাঁরা দিয়েছেন অপার করুণা, আর অকপট ভালোবাসা! রোগযন্ত্রণাক্লিষ্ট ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ হাসিমুখে ভক্ত সঙ্গ করছেন, আর তাদেরকে অনাবিল আনন্দ দিচ্ছেন _ এটাতো মাত্র 100 বছর আগেকার কথা!

তাই সাধারণ মানুষের, যে অর্থে দুঃখ-সুখের ভোগান্তি হয়__ ঈশ্বরকোটি মহাপুরুষদের তা কখনোই হয় না। তাদের নিজস্ব জাগতিক দুঃখ মোচনের জন্য প্রার্থনা থাকে না তো! তাঁদের প্রার্থনা জগতের মঙ্গলেরজন্য! তাঁদের জীবনের যা কিছু ক্রিয়াকর্ম, তার হোল_ “আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শেখায়”!

রামপ্রসাদের গানের কথা তুমি বলছিলে_তোমাকে প্রথমেই বলে রাখি_ হালিশহরের রামপ্রসাদ সেন কিন্তু ঈশ্বরকোটি ছিলেন না! এখানে তোমার জানার ভুল আছে। দ্যাখো, এইজন্যই তাকে “সাধক রামপ্রসাদ”- বলা হয়, ‘ভগবান রামপ্রসাদ’ বলা হয় নি! কিন্তু ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ’, ‘ভগবান রামচন্দ্র’, ‘ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ’_বলা হয়, ব্যাপারটা বুঝতে পারছো! রামপ্রসাদ অবশ্য পরবর্তীতে সংগীত সাধনায় সিদ্ধ হয়েছিলেন! তাই তাঁর রচিত প্রথম দিকের গানে_ কিছু জায়গায় জাগতিক দুঃখমোচনের কথা আছে কিন্তু পরের দিকে পরমার্থিক দুঃখ মোচনের কথাই তার গানে পাবে। যাইহোক, তবু তার রচিত গানগুলি পরবর্তীকালে সাধকদের কত প্রেরণা যুগিয়েছে, এটাও একটা বিরাট দিক! তবে, কথা হচ্ছে _কোন একজনের কিছু একটা ঘটনাবিশেষ দেখে, সমস্ত মহাপুরুষদের একই মাপকাঠিতে মাপতে যেওনা! কারণ, তাঁদের মাপা অত সহজ নয়! তাই মহাপুরুষদের সমালোচনা করে তাঁদের অনুসরণ কর _ এতেই তোমার কল্যাণ হবে। নাহলে ‘আসলে’-ই ফাঁকে পড়বে, ‘কাজের কাজ’ কিছুই হবে না। সেই জন্যই শাস্ত্র বলেছে _ “মহাজন যেন গতঃ স পন্থাঃ শ্রেয়”।

জিজ্ঞাসু:—- বেশিরভাগ মহাপুরুষ, এমনকি ঈশ্বরের অবতারগন বারবার ভারতবর্ষেই শরীর নিচ্ছেন_ এর কারণ কি?

গুরুজী:— শরীরের মধ্যে মাথা যেমন সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে উঁচুতে থাকে এবং মাথাকে রক্ষা করার জন্য যেমন অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতিকে উপেক্ষা করা যায়, তেমনি ভারতবর্ষ যেন পৃথিবী গ্রহের মাথা_ তাই একে ঠিক রাখার জন্যই অবতারগণের বা বিভিন্ন মহাপুরুষগণের ভারতে বারবার আগমন ঘটে থাকে। ভারতবর্ষের ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যে, এই দেশের ঈশাণ কোণে হিমালয় পর্বতমালা এবং দক্ষিনে মহাসাগর, যা ভারতভূমিকে দেবভূমিতে পরিণত করেছে। ভারতের জনগণ তাই স্বভাবতই ধর্মপ্রাণ! পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ-ই এই বিশেষ ভৌগলিক অবস্থান পায় নি,যার ঈশাণে পর্বত এবং দক্ষিণে সমুদ্র। সেইজন্য অন্যান্য দেশের মানুষের মধ্যে এই বিশেষ ভৌগলিক প্রভাবও(অধিবাসীরা ধর্মপ্রাণ হবে) পড়েনি! যাইহোক, এই বিশেষ সুবিধার জন্য ভারতে উন্নত মহাপুরুষ, বেদের ন্যায় শ্রেষ্ঠ সাহিত্য, রামায়ণ-মহাভারতের ন্যায় মহাকাব্য তৈরি হয়েছে। বহু ঋষিরা তাঁদের উপলব্ধ সত্য এইগুলির মাধ্যমে রেখে গেছেন । এই সমস্ত শিক্ষা থেকে এই দেশের নর-নারীরা আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত হয়েছে। বিশেষতঃ সীতা-সাবিত্রীর আদর্শে গড়ে ওঠা উন্নত “মা” পাওয়া সম্ভব হয়েছে l মহাপুরুষদেরকে গর্ভে ধারণ করার জন্য উন্নত ‘মা’য়ের খুবই প্রয়োজন হয়! সেজন্যই মহাপুরুষগণের জন্ম ভারতবর্ষেই বেশি হয়। এবার কথা হচ্ছে যে, জন্ম তাঁদের ভারতের কোন এক প্রত্যন্ত স্থানে হলেও, তাঁদের কর্মের পরিধি কখনোই ক্ষুদ্র স্থানে বা স্বদেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তো! গোটা বিশ্ববাসী তার স্বাদ পেয়েছে। ভারতবর্ষের ঋষিরা এইজন্যেই বলেছিল_”শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ”!

প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর প্রথম সভ্যতা বিকাশের কেন্দ্র ছিল হিমালয়। আজ যে-কোনো দেশে যত সভ্যতা বা উন্নতি দেখছ, অথবা বহু বৎসর আগে যেগুলি(সিন্ধু সভ্যতা,সুমেরিয়,গ্রিক,মায়া, অ্যাজটেক ইত্যাদি) ছিল_ সেগুলির‌ও উৎস_ ‘হিমালায়ান সভ্যতা’! আজ হয়তো এই কথাগুলি শুনতে আশ্চর্য লাগছে, কিন্তু ভবিষ্যতে যখন আরো আধুনিক ও নিরপেক্ষভাবে প্রত্নতত্ত্ব-পুরাতত্ত্বের গবেষণা হবে, তখন এই কথার সত্যতা জানা যাবে।

আমি অবশ্য মনে করি না, পৃথিবীগ্রহ এখনো সেই অর্থে ‘সভ্য’ হয়েছে! তাই “গ্রিক সভ্যতা”, “সিন্ধু সভ্যতা”, “আধুনিক সভ্যতা”_ এই শব্দগুলি অনেকেই ব্যবহার করে বটে কিন্তু আমি করতে পারিনা!তোমাদের বোঝার সুবিধার জন্য ‘সভ্যতা’ বা civilization কথাটা বলছি_ যেহেতু তোমাদের মনোজগতে এই শব্দগুলি রয়েছে! civilization না বলে dynasty বললেই ঠিক বলা হয়! যাইহোক, এগুলির মধ্যে ব্যতিক্রম হোল “হিমালয়ান সভ্যতা”! যা ছিল প্রকৃতঅর্থেই সভ্যতা! যা সাম্রাজ্যবাদ, নগরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রার সৃষ্টি, অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে আসেনি! এসেছিল হাজার হাজার বছর ধরে শত শত মনীষীদের(ঋষি) আত্মত্যাগ, নিরলস সাধনা ও গবেষণার মধ্যে দিয়ে! আজকের পৃথিবীও সভ্য হতে পারে শুধুমাত্র সেই পথ অনুসরণ করে_ যে পথ হাজার হাজার বছর আগে ভারতীয় ঋষিরা দেখিয়ে গিয়েছিলেন! যার কিছুটা লিপিবদ্ধ রয়েছে বেদ-উপনিষদে, আর বাকিটা বাহিত হচ্ছে গুরু পরম্পরায়!এই একটাই পথ_”নান্যং পন্থা বিদ্যতেহয়নায়”।

materialistic উন্নতি দিয়ে আমার কথাগুলির বিচার করোনা_তাহলে ধরতে পারবে না। কারণ_ “সভ্যতার পরিভাষা সংযম”! বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন সময়ে শক্তিতে, অর্থে, প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হয়েছে_ আর পৃথিবীকে তারা কি উপহার দিয়েছে__ অসভ্যতা, অত্যাচার, পরাধীনতা_এসব‌ই তো!! অপরপক্ষে বহির্বিশ্বে বারবার করুণা,প্রেম, প্রজ্ঞা, শান্তির বাণী বহন করে নিয়ে গেছেন ভারতীয় আচার্যেরা, মহাপুরুষেরা! আজকের পৃথিবী “যুদ্ধ নয়_ শান্তি চাই”বলে ধ্বনি তুলছে, কিন্তু ভাবলে অবাক হতে হয়_ এই কথাই আড়াই হাজার বছর আগে থেকে বিশ্বকে শুনিয়ে এসেছে বৌদ্ধ শ্রমনেরা! “চিনি’-‘চিনি’ বললে যেমন মুখ মিষ্টি হয় না, তেমনি ‘শান্তি চাই’ ‘শান্তি চাই’- বললেই শান্তি আসে না। তার জন্য করনীয় কি__ তার শিক্ষাও বহির্বিশ্বে দিয়ে এসেছেন ভারতীয় আচার্যেরা। এসব শিক্ষা গ্রহণ না করার ফল‌ই তো আজকের ‘অশান্তিময় পৃথিবী’। তাই আজকে এই অশান্তিময়তা থেকে শান্তির সন্ধান যে ব্যক্তি পেতে চাইছে, তাকেই অবশেষে বুঝতে হচ্ছে ভারতীয় আর্য ঋষিদের নির্ধারিত পথ-ই একমাত্র সঠিক!শ্রোত্রিয়,ব্রহ্মজ্ঞ গুরুর পদপ্রান্তে সমিতপাণি হয়ে বসে শিক্ষাগ্রহণ করে এবং তা জীবনে অনুশীলন করেই শান্তি লাভ করা যায়! অন্যথায় জীবনটা যেন মরুভূমি_ হতাশাগ্রস্ত, অশান্তিময় এক বিড়ম্বনা!

জিজ্ঞাসু:— আচ্ছা, ভারতের যদি এতকিছু ভালোই আছে__ তাহলে এদেশে আজও কেন অভাব-অনটন, অনাচার? আর ভারত বারবার বিদেশীদের পদানত‌ই বা হোল কেন? মহাপুরুষরা তাহলে কি করলেন?

গুরুজী:— ভারতবর্ষে মহাপুরুষগণ বারবার জন্মগ্রহণ করেছেন বলেই, ভারতবর্ষের সমস্ত মানুষ সৎ এবং সুন্দর হয়ে যাবে_ এটা ভাবছো কেন! জগতকে বলা হয়েছে ‘ত্রিগুন প্রপঞ্চ’! ফলে ভালো-মন্দ সব প্রকৃতির মানুষ-ই সব জায়গায় থাকবে! হয়তো কোথাও কম_কোথাও বেশি। তাছাড়া অন্য দেশের মানুষ ভালো হবার আশায় এ দেশে জন্মগ্রহণ করতে পারে, আবার এদেশের ভালো মানুষেরা অন্য দেশে গিয়ে শরীর ধারণ করতে পারে_ সেখানকার মানুষদের উন্নত করার জন্য! সুতরাং ভালো-মন্দ, অত্যাচার সদাচার, অভাব-প্রাচুর্য_ সবদেশেই সবসময় থাকবে।

আগেই তো বললাম, ভারতবর্ষে অনেক মহাপুরুষ জন্মেছেন, কিন্তু তাঁদের কর্মের পরিধি সমগ্র পৃথিবী ব্যপ্ত। বেদান্ত ভারতীয়দের সৃষ্ট_ একথা ঠিক, কিন্তু উপনিষদের জ্ঞান কি শুধু ভারতীয়দের জন্য না মহাপুরুষগণের শিক্ষা শুধু ভারতীয়দের জন্য? তা তো নয়__যারাই জ্ঞান কে অনুশীলন করে জীবনে প্রতিষ্ঠা করেছে, যারা মহাপুরুষদের শিক্ষা জীবনে যোজনা করেছে, বেদান্ত বা মহাপুরুষগণ একান্ত ভাবে তাদের‌ই। ভারতের কয়জন ব্যক্তি বেদান্তের শিক্ষা গ্রহণ করে? কয়জন ব্যক্তি মহাপুরুষদের আদর্শকে জীবনে বাস্তবায়িত করে_ যে তাদের চেতনার উন্নতি হবে! এইজন্যেই মহাত্মারা বলে থাকে__ ‘ভারতের মহাপুরুষগণকে বাদ দিলে শুধু গোটাকয়েক মনুষ্যেতর প্রানী এখানে পড়ে থাকে’! কথাটা অস্বীকার করতে পারবে?_ পারবে না! ভগবান বুদ্ধের মৃত্যুর কয়েক generation পরই বৌদ্ধরা তাদের মূল আদর্শ থেকে সরে এলো! জৈনদের ক্ষেত্রেও সেই একই চিত্র! অহেতুক “অহিংসা” দেখাতে গিয়ে ভারতের ক্ষাত্রশক্তি হীনবীর্যহয়ে পড়ল। ফলে বিদেশি আক্রমণ শুরু হয়ে গেল। মানুষের বাহুরশক্তি দুর্বল হলে, মাথা বাঁচাতে যেমন সে পিঠটা উপরে রেখে_ মাথাকে পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে দেয় কাছিমের মতো___ তেমনি ভারতমাতার শরীরের বাহুরূপ ক্ষাত্রশক্তি দুর্বল হ‌ওয়ায় মাথারূপ ব্রাহ্মণেরা(ঋষি, মুনি, আচার্য্যেরা বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকারীরা)- তাদের আধ্যাত্মিক জ্ঞান নিয়ে গিরি-গুহা-জঙ্গলে প্রবেশ করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। সেইজন্যেই আজ‌ও ঋষিদের শিক্ষা টিকে রয়েছে।

কিন্তু যে আঘাত মস্তকে পড়ার কথা ছিল তার পিঠে পড়েছে (কাছিমের ন্যায় অবস্থানের ফলে)_অর্থাৎ সাধারণ মানুষ নিদারুণ অত্যাচার সহ্য করেছে। যাইহোক, এটাই বিদেশীদের আক্রমণের এবং ভারতের পরাধীনতার মূল কারণ বলে জানবে।।

তবে দ্যাখো, মহাকালের(কোটি কোটি বছরের জীব-বিবর্তন) হিসাবে ১০০০ বছর(প্রায় ১০০০-বছর ভারতবর্ষ পরাধীন ছিল) এমন কিছুই নয়_তবু এটা ঘটেছিল ভারতীয়দের নিজেদের দোষে। অতি তামসিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে আলস্যে-প্রমাদে দেশটা ভরে গিয়েছিল, তাই ভারতবর্ষের উপর মহাপ্রকৃতির এই আঘাত নেমে এসেছিল!!

তারপর ভারতের চরম সংকটকালে এলেন স্বামী বিবেকানন্দ! তিনি ভারতবাসীকে ডাক দিয়ে বললেন_”ওঠো_ জাগো”! দেশটা যেন ঘুমন্ত ছিল_ এক ডাকেই ঘুম ভেঙে উঠে নড়েচড়ে বসল! স্বামীজী ভারতবর্ষকে একধাক্কায় কয়েক শতাব্দী এগিয়ে দিয়ে গেলেন। স্বামীজীর পর থেকেই ভারত দ্রুত উন্নতি করে চলেছে। এখনই ভারতের যা অবস্থা__সুস্থ বন্টন নীতির ব্যবস্থা হলে, সাধারণ মানুষ আরো অনেক স্বাচ্ছন্দ্য পাবে। বর্তমানে ভারতবর্ষের যেটা প্রধান সমস্যা_ সেটা হলো জনসংখ্যা! যেখানে ২০-টি ইঁদুর থাকার কথা, সেখানে ৪০৯-টা রাখলে যে অবস্থা হয়_ এখানেও এখন সেই অবস্থা! পরাধীন ভারতে যখন জনসংখ্যা ছিল মাত্র 30 কোটি, তখনই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন_ আগামীতে ভারতে জনসংখ্যা একটা সমস্যা হবে। তাই তিনি ভক্তদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন_ “একটা দুটো সন্তান হওয়ার পর, স্বামী-স্ত্রীতে ভাই বোনের মত থাকবে”! আজকের সমাজ বিজ্ঞানীরাও এই কথাটাই বলছেন ‘জন্মনিয়ন্ত্রণের প্যাকেটে মুড়ে’! তা সে যাই হোক, সেদিন কে শুনেছিল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা? স্বাধীনতার পর যেন মানুষ_ স্বাধীনতার সমস্ত ‘আনন্দ’ আর ‘কর্তব্য’কে নিয়োগ করলো সন্তান উৎপাদন করার কাজে!!এই একটা প্রজেক্ট‌ই স্বাধীনত্তোর ভারতে সফল_ ৪০ বছরে জনসংখ্যা তিনগুণ !!

প্রথম বিশ্বের দেশগুলির সঙ্গে ভারতের তুলনা materialistic বা scientific development দিয়ে কোরো না। কারণ প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের এটা ‘উন্নতি’ নয় ‘অবনতি’! বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে কত কম সময়ে কত বেশি সংখ্যক লোককে মেরে ফেলা যায় তার জন্য প্রাশ্চাত্য যতটা গবেষণা করেছে_ সে তুলনায় কম সময়ে বেশি সংখ্যক লোক বাঁচানোর ব্যবস্থা কি করা গেছে?? এইজন্যেই বলছিলাম_ “পৃথিবী এখনো সভ্য হয়নি, কারণ সভ্যতার পরিভাষা সংযম”! প্রাচীনকালেও atomic বা nuclear weapons-এর ব্যবহার ছিল_ কিন্তু সে বিজ্ঞান শুধুই ঋষিরা জানতেন, সাধারনকে সেই সব বিদ্যা জানানোই হয়নি। শুধুমাত্র বিশেষ প্রয়োজনে_ সমাজের সবচাইতে শিক্ষিত, স্থিতধী, সংযমী অর্থাৎ সর্বতোভাবে উপযুক্ত ব্যক্তিদের এই বিদ্যা দান করা হোত(ঋষিদের দ্বারা।যেমন ভরদ্বাজ ঋষি রাবন বধের নিমিত্তেরামচন্দ্রকে এই বিদ্যা দিয়েছিলেন) যাতে কোরে_ এর দ্বারা সমাজের সুমঙ্গল‌ই হয়, অমঙ্গল নয়!দেখেছো_ কতখানি সম্পূর্ণ ছিল ঋষিদের চিন্তা! আজকের যারা বিজ্ঞানী _তারাও তো মানুষ! সুযোগ-সুবিধা-স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে তাদের আবিস্কার অসৎ লোকের হাতে, ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে _এর ফলে সমগ্র মানবজাতিই আজ বিপন্ন!

তাই এখন প্রথমেই যেটা প্রয়োজন, সেটা হোল__ আধুনিক বিজ্ঞানীদের মানবিক চেতনার উন্নতি ঘটানো! না হলে অমানবিক বৈজ্ঞানিক চিন্তা মানবজাতির পক্ষে ধ্বংসাত্মক‌ই হবে_ সৃষ্টিধর্মী হবেনা!

ভারতবর্ষ প্রাচীনকাল থেকে এই শিক্ষাই দিয়েছে বিশ্বকে__”be and make”! প্রাচীন ঋষিদের উপলব্ধ সেই সত্যের ধারা যেন অব্যাহত থাকে, তাই বিভিন্ন পরম্পরায় বারবার মহাপুরুষদের আগমন হয়! materialisticdevelopment মানুষকে আনন্দ আর শান্তি এনে দিতে পারে কি? একমাত্র স্বভাবের অনুকূল হয়ে শান্তি আর স্বরূপের বোধ লাভ করলে,তবেই আনন্দের স্বাদ পায় মানুষ!

ঋষিরা ভারতের materialistic উন্নতি কখনোই চাননি _চেয়েছিলেন সব মানুষ আধ্যাত্মিকতায় পুষ্ট হয়ে উঠুক! “সোনার প্লেটে চানাচুর” _ খেতে তাঁরা শেখান নি,তাঁরা শিখিয়েছিলেন _ “শালপাতার ঠোঙায় রসগোল্লা খেতে”! এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারলে ভারতবর্ষের _ ‘ভালো’টা কি!!

তবে, ভারতবর্ষের বর্তমান যে খারাপ অবস্থা দেখছ _এর আগের অবস্থা আরও খারাপ ছিল, ধীরে ধীরে ভালোর দিকে চলেছে! আর বর্তমানের এই দুরবস্থার অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণ তো এতক্ষন বললাম __এবার রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটা অন্যতম কারণ বলছি_শোন! ভারতবর্ষের রাজধানী যখন যখনই ‘দিল্লি’_কে করা হয়েছে, তখন তখনই শুরু হয়েছে নানা ধরনের রাজনৈতিক বিভ্রাট! পৃথিবীর সমস্ত জায়গাই কিন্তু সবকিছুর জন্য উপযুক্ত নয়!এটা একটা বিশেষ বিজ্ঞান। বিশেষ বিশেষ জায়গা _ বিশেষ বিশেষ কারণে যে ব্যবহার করতে হয় __এই বিজ্ঞানটা আজকের মানুষ ভুলে গেছে । প্রাচীনকালে এটা ‘ভূমি বিজ্ঞান’ বা “দিক্ বিজ্ঞান'(বাস্তুবিজ্ঞান ও এর মধ্যেই পড়ে) নামে প্রচলিত ছিল! মহাভারতের যুগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ _ এই বিজ্ঞানের শেষ প্রয়োগ দেখিয়েছেন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধক্ষেত্রে অথবা খান্ডববনকে ইন্দ্রপ্রস্থ নগরী হিসেবে চিহ্নিত করে! সে যাইহোক, ভূমি বিজ্ঞান অনুযায়ী ভারতের রাজধানী সঠিকভাবে করতে গেলে মধ্যপ্রদেশের ভূপালের কাছে “উজ্জয়নী” বা এর কাছাকাছি কোন স্থানে করতে হবে । এমনটা হলে দেখবে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সমস্যা এমনিতেই অনেকটা মিটে যাবে। প্রমাণ হিসেবে ভারতবর্ষের কয়েকশ বছর আগের ইতিহাস দ্যাখো, গুপ্তযুগে ‘উজ্জয়িনী’ ভারতের রাজধানী ছিল__ তখন ভারতবর্ষের অবস্থা কত ভালো ছিল_বলা হয় সুবর্ন যুগ ছিল ! মুঘলদের সময় দেখা গেল, যেইমাত্র ওরা রাজধানী আগ্রা থেকে দিল্লিতে নিয়ে এলো__ সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক গন্ডগোল শুরু হয়ে গেল ,মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে গেল! এরপর এল ইংরেজ! যতদিন ওদের রাজধানী কলকাতায় ছিল, ততদিন ওরা ভালোমতো কাটিয়েছিল। কিন্তু যেই মুহুর্তে ইংরেজরা রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করল_ব্যস, ওদেরকেও ভারত ছেড়ে চলে যেতে হোল। এখন‌ও_ ভারতের রাজধানী দিল্লি থাকার জন্য‌ই নানা ধরনের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চলছে! রাজধানীর স্থান পরিবর্তন ঘটালেই এটাও ঠিক হয়ে যাবে।।