সময়:– অক্টোবর ,৮৮
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:– সব্যসাচী মান্না, গোপাল,নগেন প্রমূখরা।
জিজ্ঞাসু:—– আমাদের ওদিকে একজন ম্যাজিশিয়ান এসেছিল। শুনেছি, সে মননশক্তি দ্বারা দূরবর্তী একটা হারমোনিয়ামকে টেনে কাছে নিয়ে এসেছিল। এভাবে মনকে control করতে তো ম্যাজিসিয়ানটিকে অনেক সাধনা করতে হয়েছে?
গুরুজী:— কোন ম্যাজিশিয়ান রে! যে মননশক্তির সাহায্যে একটা আস্ত হারমোনিয়াম টেনে আনতে পারে! ব্যাপারটা কি জানিস_ ও সব ভাঁওতাবাজি! একটা fine chord লাগানো থাকে যার সাহায্যে হারমোনিয়াম বা এই ধরনের কিছু টেনে আনে ম্যাজিশিয়ানরা এবং স্টেজে এটাকে show করে দেখায়, আর পয়সা রোজগার করে! এদের পুরোটাই হাতের কারসাজি, আর কিছু বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়! ঐরূপ ব্যক্তিরা মনকে concentrate করে একটা হারমোনিয়াম কেন, এক টুকরো তুলোও টেনে আনতে পারবে না!
তবে হ্যাঁ, সাধকেরা পারে! নিষ্ঠার সঙ্গে সাধনা ও অভ্যাসের দ্বারা শরীর ও মনকে বশে আনা যায়! সাধু সমাজে ঘোরার সময় আমি একজন পালোয়ানের কথা শুনেছিলাম, যে এক হাতে আস্ত একটা পূর্ণবয়স্ক মোষকে তুলতে পারতো! রহস্যটা হচ্ছে_ যখন মোষটা খুব ছোট বাচ্চা ছিল, তখন থেকেই ওই পালোয়ান তাকে নিয়মিত এক হাতে করে তুলত। এইভাবে ধীরে ধীরে মোষটি বড় হলেও কিন্তু প্রতিদিনের অভ্যাস থাকায় ওই ব্যক্তির মোষটিকে একহাতে তুলতে কোন অসুবিধা হতো না। আরো একটা ব্যক্তির কথা বলছি_ কুম্ভ মেলায় ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ঐ ব্যক্তি (সাধু) তার লিঙ্গের সঙ্গে শেকল বেঁধে এক কুইন্টাল ওজনের একটা হন্দর তুলতে পারতো। সেটা দেখার জন্য খুব ভালো ভিড় হতো, আর টাকা-পয়সাও পড়তো অনেক! এক্ষেত্রে দেখা যাবে,ঐ ব্যক্তি অন্তত দশ-বারো বছর ধরে একটু একটু করে লিঙ্গের সাহায্যে ওজন তোলা অভ্যাস কোরতো এবং সেই ওজনকে বাড়াতে বাড়াতে এখন এক কুইন্টালে পৌঁছেছে। এই কম্মো করার জন্য যদি এত সাধনা ও সময়ের দরকার হয়_ তাহলে মনকে concentrate করে মননশক্তিকে কাজে লাগাতে_ কত সময় বা কত নিষ্ঠা সহকারে সাধনার প্রয়োজন, তা সহজেই বোঝা যায়! যারা show করে বেড়ায়_ এমন ম্যাজিশিয়ানদের, এত সময়ই বা কোথায় আর এসব করার প্রয়োজনটাই বা কি!
মনের উপর প্রভুত্ব করেন বা মনকে বশে আনতে পারেন প্রকৃতপক্ষে সন্ন্যাসীরা!তাঁরা মনের রাজা তাইতো তাঁদের “মহারাজ”বলে সম্বোধন করা হয়। তোমাদেরকে একজন এরকম সন্ন্যাসীর গল্প বলি শোন __প্রথম জীবনে তার নাম ছিল শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্ধমান শহরের কাছাকাছি একটা গ্রামে তার বাড়ি ছিল । ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত প্রকৃতির ছেলে ছিলেন তিনি। তাঁর চেহারাও খুব শক্তসমর্থ ছিল এবং তাঁর অন্তরে ভয় বলে কিছু ছিল না! একদিন গ্রামের বাইরে ফুটবল মাঠে খেলা চলছে _ শ্যামাকান্তও খেলছে। হঠাৎই পাশের জঙ্গল থেকে এক ব্যক্তি ছুটতে ছুটতে এসে চিৎকার করে ছেলেদের জানালো যে, ‘বনে বাঘ বেরিয়েছে’! তাই সে পালাচ্ছে এবং ছেলেরাও যেন পালিয়ে যায়। তখন বর্ধমান জেলার বিভিন্ন জায়গায় বাঘ দেখা যেতো। এই বাঘগুলো রয়েল বেঙ্গল ফ্যামিলির ছিলনা _ অপেক্ষাকৃত ছোট “কেঁদো বাঘ”। যাইহোক, ছেলেরা সব গ্রামের দিকে ছুটে পালিয়ে গেল কিন্তু শ্যামাকান্ত ছুটল সামনের দিকে। সে কখনও বাঘ দেখেনি, তাই সে ভাবল বাঘ যদি বনের বাইরে না আসে, তাহলে এবারও তাকে দেখতে পাবে না _ তাই বাঘ দেখতে সে বনের দিকে ছুটলো। ছেলেরা অনেকটা দূর থেকে ওই ঘটনা দেখে গ্রামে এসে ব্যাপারটা জানালো। গ্রামবাসীরা সকলে তখন একজোট হয়ে লাঠি,সরকি,মশাল ইত্যাদি নিয়ে বনের ধারে যখন পৌঁছালো _ তখন দেখা গেল শ্যামাকান্ত ঐ বাঘটিকে মেরে ঘাড়ে করে নিয়ে গ্রামের দিকে আসছে। বর্ধমানের মহারাজের কাছে এই খবর পৌঁছাতে বেশি সময় লাগল না! এরকম ভাবে একটা বাঘ-মারা পালোয়ানকে রাজসভায় রাখতে পারা _ তখনকার দিনে যে কোন রাজার কাছে গৌরবের ব্যাপার বলে পরিগণিত হতো! তাই শ্যামাকান্ত বর্ধমানের মহারাজের দরবারে চাকরি পেল। তার কাজ হলো রাজার বিশেষ অতিথিদের সামনে বাঘের খাঁচায় থাকা(তখনকার দিনে সব রাজাদেরই নিজস্ব ছোটখাটো চিড়িয়াখানা থাকতো) বাঘকে না মেরে তাকে খাঁচাতেই আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বেঁধে আবার খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসতে হোত। অসীম শক্তিশালী শ্যামাকান্ত এই কাজ তো করতোই, তাছাড়াও বাঘটির চোয়াল দুটো ফাঁক করে তার মধ্যে নিজের মাথাটা কিছুটা ঢোকাতো হাততালি পাওয়ার জন্য। এভাবে বর্ধমানের রাজার আদেশে এবং অন্যান্য রাজাদের আমন্ত্রণে বহু জায়গায় শ্যামাকান্ত এই দুঃসাহসিক কাজ করে বেরিয়েছে! সেই সময় একজন সন্ন্যাসী হঠাৎ একদিন ওনার সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন _”ব্যাটা! বনের বাঘ জব্দ করা সহজ কাজ, কিন্তু মনের বাঘকে জব্দ করে দেখা দেখি! তবেই বুঝব তুই বীর!” তখন এই কথাগুলোকে শ্যামাকান্ত খুব একটা গুরুত্ব দেননি, কারণ এরপরই কুচবিহার মহারাজার আমন্ত্রণে সেখানকারচিড়িয়াখানায় তাকে খেলা দেখাতে যেতে হবে! তাই তিনি ওই নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। কুচবিহারে খেলা দেখাতে গিয়েই ঘটলো বিপত্তি! বাঘটাকে শ্যামাকান্ত বেঁধেছিলেন ঠিকই কিন্তু সদ্য বন থেকে ধরে আনা বাঘ _ তারও তেজ ছিল খুব! শ্যামাকান্ত বাঘটাকে বেঁধে, খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসছিল _ এমন সময় বাঁধা অবস্থাতেই লাফিয়ে উঠে বাঘটা বাঁধন একটু আলগা করে _ পিছন থেকে এক লাফে তার ঘাড় কামড়ে ধরেছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় শ্যামাকান্ত প্রথমে পড়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তারপর ওই অবস্থাতেই বাঘের মাথায় এমন এক থাপ্পড় মেরেছিলেন যে, বাঘের মাথা ভেঙে ঘিলু ছিটকে পড়েছিল চারিদিকে!আহত শ্যামাকান্তকে কুচবিহার থেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু বাঘের কামড়ে যে বিষক্রিয়া হয়, তার চিকিৎসা হয় মানুষের বিষ্ঠা দিয়ে।
যাইহোক, শ্যামাকান্ত যখন অনেকটা সুস্থ তখন একদিন সেই পূর্বের সন্ন্যাসী আবার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে হাজির হয়েছিল।সেখান থেকেই শ্যামাকান্ত মিসিং হয়ে যান। প্রকৃতপক্ষে এরপর তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন এবং তার নাম হয় সোহম স্বামী। অনেক পরে পরমহংস যোগানন্দের সাথে একবার তাঁর দেখা হয়েছিল হরিদ্বার_হৃষীকেশ অঞ্চলের কোন স্থানে। কৌতূহলবশত যোগানন্দ জানতে চেয়েছিলেন_ একজন মানুষের হাতের জোর এতটা কিভাবে হতে পারে, যাতে করে এক চড়ে একটা বাঘের মাথা ভেঙে যেতে পারে! তখন ঐ যোগী সামনের দেওয়ালে একটা হালকা ঘুঁষি মেরে কয়েকটি ইঁট ছাড়িয়ে দিয়ে তার প্রমাণ দেখিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে,_ “মানুষের মনের শক্তি অপরিসীম! সেই শক্তিকে বশে এনে যদি শরীরের কোন অঙ্গে লাগানো যায়_ তাহলে তা সাধারণ পেশি শক্তি অপেক্ষা কত গুণ বেশি শক্তিতে রূপান্তরিত হতে পারে_ তা ভাবা যায় না! আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন যোগানন্দ, _”কি করে তিনি অত বড় এবং শক্তিশালী বাঘের সম্মুখীন হতেন?” শ্যামাকান্ত উত্তর দিয়েছিলেন যে, তিনি বাঘকে বিড়াল ভাবতেন! তারপর তার মোকাবিলা করা তাঁর পক্ষে খুবই সহজ হোত! এটা একটা অসাধারণ কথা! কর্মকৌশলের রহস্য _এক কথায় বলে দিয়েছিলেন স্বামীজী! যে কোন কাজকে কঠিন না ভেবে সহজ ভেবে নিলেই কাজটা আর দুরহ থাকেনা! সাধকের সংকল্প সিদ্ধির এটাই হল রহস্য!
যাইহোক, যে কথা হচ্ছিল! মননশক্তির সাহায্যে মনকে বশে এনে তাকে কাজে লাগানোর জন্য একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সাধনার প্রয়োজন হয়! স্বপ্রকৃতিকে জয় না করে তা করা যায় না, আর স্বপ্রকৃতিকে জয় করলে বহিঃপ্রকৃতিকেও জয় করা যায়। তখন শুধু কোন স্থুলবস্তু বা কোন প্রাণীর উপর ক্রিয়ারই নয়, nature-এর উপরেও কর্তৃত্ব করা যায়। প্রাকৃতিক যে কোন বিপর্যয় রুখে দেওয়া যায়, আবার সংকল্পমাত্রই যে কোন বিপর্যয় ঘটানোও যায়!
বেশ কিছুদিন আগে তিব্বতের এক সাধক_ এমন একটা ঘটনা প্রায় ঘটিয়েই ফেলেছিলেন! সাধকের মা গ্রামে থাকতেন _যে কোন কারনে (গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্য) অন্য গোষ্ঠীর লোকেরা তাদের গ্রাম চড়াও হয়ে ঝামেলা বাধায়, আর সেই ঝামেলায় ওই সাধকের মা মারা যান! খবর পেয়ে ওই সাধক ফিরে এসে মায়ের মৃতদেহ দেখে খুবই কষ্ট পায়! তিনি মৃত মায়ের মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে মায়ের মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন এবং মনন শক্তিকে একাগ্র করে ঈশ্বরের কাছে অভিযোগ জানাতে থাকেন! একটানা সাত দিন তিনি ওই একই ভাবে বসে ছিলেন। তাঁর অন্তঃপ্রকৃতির বিক্ষুব্ধতায় বহিঃপ্রকৃতিও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে _ ফলে বায়ুমন্ডলে দেখা দেয় প্রবল ঘূর্ণিঝড়! তিব্বতের ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যে, সেখানে ঘূর্ণিঝড় হওয়াটা খুবই আশ্চর্যজনক! এটা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে সেইসময় খুবই লেখালেখি হয়েছিল। কিন্তু আসল রহস্যটা জেনে ছিলেন হিমালয়ের সাধুসমাজ! তাঁরা দেখলেন প্রকৃতি অশান্ত হয়ে উঠেছে ছেলেটির মনের সংকল্পের জন্য। তাই তাঁরা তাঁদের মননশক্তির সাহায্যে ঐ সাধকটির সংকল্পশক্তি কেটে দিয়েছিলেন, ফলে তৎক্ষণাৎ ওই অঞ্চলের প্রকৃতি শান্ত হয়ে গিয়েছিল।
এবার বুঝতে পারছিস তো _ মননশক্তি করায়ত্ত হলে কি অসম্ভব শক্তির অধিকারী হওয়া যায়! আর এটা বলাই বাহুল্য যে, অসাধারণ সাধনা ছাড়াও শক্তি লাভ হয় না! সুতরাং সাধারন ম্যাজিশিয়ানরা এই শক্তি পাবে কোথায়? যারা দুটো পয়সা রোজগারের জন্য খেলা দেখায়__ তাদের এসব করার সময়ই নেই ! আর যদিওকেউ এই শক্তি অর্জন করে থাকেন বা এই শক্তির অধিকারী হন _তখন কি তাঁরা আর show করে বেড়াবেন? পরমেশ্বরের মহিমা অপার জেনে তখন সেই সাধক নিত্য আনন্দে বিরাজ করবেন এবং বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় কাজ করে যাবেন।আত্মসুখের তিলমাত্র বাসনা সেখানে স্থান পাবে না।
জিজ্ঞাসু:— আমরা জানি ‘জিন’_ বংশপরম্পরায় বৈশিষ্ট্য বহন করে নিয়ে যায়! তাহলে,যে কোন মহাপুরুষের জন্মগ্রহণ _এই নিয়ম মেনে হয় না কেন?
গুরুজী:— জীবন বিজ্ঞানে জিনকে বংশগতির ধারক এবং বাহক বলা হয়েছে । কোষের প্রোটোপ্লাজমের মধ্যে থাকা ক্রোমোজমের মধ্যে অবস্থিত এবং এদের সংখ্যাও বেশ কয়েক কোটি বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। তবে আধুনিক বিজ্ঞান এখনো জিনের রহস্য ঠিকমতো উন্মোচিত করতে পারেনি, এর গবেষণা সবে শুরু হয়েছে মাত্র। জিনবিজ্ঞান আরেকটু উন্নত হলে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতির মানুষ originally কোন মানবজাতির শ্রেনীভুক্ত(ককেশিয়,অষ্ট্রালয়েড ইত্যাদি) তা জানা যাবে এবং এখান থেকে জাতি গর্বে গর্বিত অনেক দেশের মানুষের যে superiority complex রয়েছে, তা ম্লান হয়ে যাবে। সে যাইহোক, বর্তমান বিজ্ঞান জিন সম্বন্ধে যাই বলুক না কেন, বাস্তবে দেখা যায়_ সন্তান-সন্ততিরা পিতা-মাতার দৈহিক গঠনের সাদৃশ্য লাভ করতে পারে কিন্তু মানসিক গঠন পায় না, অর্থাৎ আকৃতিগত সাদৃশ্য থাকলেও প্রকৃতিগত সাদৃশ্য থাকে না। তা যদি হতো তাহলে তো বিদ্যাসাগরের ছেলে বিদ্যাসাগরের চেয়েও বড় পন্ডিত হতো অথবা বিশ্বকবির পুত্র হত মহাবিশ্বকবি! ক্রমবিকাশের সিঁড়ি বেয়ে তাদের আরো উন্নতি হওয়াই উচিত ছিল কিন্তু তা তো হয়নি! তাহলে এরকম রহস্য টা কি? ঋষিরা সাধনার গভীরে গিয়ে এর উত্তর পেলেন_ তাঁরা দেখলেন যে, মানবশরীর পৃথিবী গ্রহের সবচাইতে উন্নত শরীর, আর এই শরীরেই পরিপূর্ণ বিকাশলাভ সম্ভব! যে কোন মানবশরীরে যে কোটি কোটি জিন রয়েছে, তার সবগুলো এই জন্মেই ক্রিয়াশীলহয় না। পূর্ব পূর্ব, এমনকি আগামী প্রজন্মের মানুষের জিনও ওই শরীরেই রয়েছে কিন্তু এদের বেশিরভাগই রয়েছে সুপ্ত অবস্থায়! এদের মধ্যে যেগুলো ক্রিয়াশীল_ সেগুলোর ক্যারেক্টার অনুযায়ী জাতক বিশেষ দৈহিক অথবা মানসিক গঠন সম্পন্ন হয়ে থাকে। জাতকের শরীরে আরও সম্ভাবনাময় জিন ছিল, এমনকি মহাপুরুষসমূহের character বহনকারী জিনও ছিল কিন্তু তাদের প্রকাশ ঘটেনি। এইজন্যেই ব্যক্তিবিশেষে শরীর ও মনের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ দেখা যায়_এ নগেন, ও সব্য, তুমি অমুক হয়েছ_এইজন্যেই ,তুমি বুঝতে পারছো ব্যপারটা ! সুতরাং দেখা যাচ্ছে, শুধু দৈহিক নয় মানসিক বৈশিষ্ট্যও জিন বহন করে, যা তার পূর্ব পূর্ব জন্মের সংস্কার রূপে থাকে এবং এই জীবনে তার বহিঃপ্রকাশও ঘটে থাকে। মানব শরীর লাভ করেও মানুষের পশুসুলভ আচরণ, অথবা সাধনার দ্বারা মানুষের চরিত্রের অভিবিকাশ বা উত্তরণ_ প্রমাণ করে যে সব ধরনের সংস্কারই ঐ ব্যক্তির মধ্যে আগে থেকেই ছিল। আবার দ্যাখো, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধদেবের মধ্যে পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল _ এটাই প্রমাণ করে যে, মনুষ্য শরীরেই পূর্ণত্বের সমস্ত সম্ভাবনা বিদ্যমান।
তবে, ঈশ্বরের অবতরণের ব্যাপারটা অবশ্য অন্যরকম! সেখানে অবতারগণকেও কোনো পিতা-মাতাকে আশ্রয় করে শরীর নিতে হয় কিন্তু জন্মগ্রহণের পর নিজের ইচ্ছামত জিনকে কাজে লাগাতে পারেন তাঁরা। সমস্ত বিজ্ঞানকেই ভোগ করতে পারেন তাঁরা! ভোগ করতে পারেন, তাই তো তাই তিনি ভগবান! অবতার ইচ্ছামত নেমে এসে (পিতার প্রয়োজন ব্যতিরেকেই)যে কোন শরীর গ্রহণ করে, সেই শরীরের যে কোনো জিন-বৈশিষ্ট্য কে কাজে লাগিয়ে জীবন থেকে মহাজীবনে উন্নীত হয়ে যেতে পারেন। সাধারণ মানুষ এই কৌশলকে কাজে লাগাতে পারে না বলেই গতানুগতিক জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। জন্মসূত্রে যে দিনগুলি ক্রিয়াশীল, সেগুলো নিয়েই তাকে সারা জীবন কাটাতে হয়। আবার ঐ ব্যক্তি কোন সদগুরুর সংস্পর্শে এলে তিনি বিশেষ কিছু art বা কৌশলের সন্ধান দেন। তখনই শুরু হয় মানব জীবনের উত্তরণ! এইভাবে বোঝা যায়_জন্ম-জন্মান্তর যেন অভিজ্ঞতার সিঁড়ি_যে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে মানুষের উত্তরণ হয়। জন্ম-জন্মান্তরেরঅভিজ্ঞতাপুষ্ট হয়ে_ যে জিনগুলির প্রকাশ ঘটে মানবজীবনে__ তা এক জীবনেই ঘটে যেতে পারে_ সদগুরুর সান্নিধ্যলাভে, তাঁর কৃপায়,তাঁর নির্দেশিত আচরণ পালনে । এজন্যই বলা হয় _”এই জনমে ঘটালে কত জন্ম-জন্মান্তর”! তবে দেহবুদ্ধি নাশ না হলে, এই কৌশল রপ্ত হয়না। আমি দেহ নয় _ “আমি আত্মা”- এই শুদ্ধ বুদ্ধিতেই জিনবিজ্ঞানের রহস্য ভেদ হয়।
জিজ্ঞাসু:—- জগতে দুঃখ কষ্টই তো বেশি, তাহলে এত কষ্ট সহ্য করে ভগবান অবতরণ করেন কেন?
গুরুজী:– প্রথম কথা হচ্ছে_এই যে “দুঃখ-কষ্ট” কথাটা বললি,এটা তোর ধারনা থেকে বলছিস তো ? দ্যাখ্_ একজনের কাছে যা দুঃখ, অপরের কাছে হয়তো সেইটাই সুখের কারণ। যেমন ধর_ একজন পেশাদার খুনি খুন করে সুখ পায়(টাকা-পয়সা পায়), অপরপক্ষে নিহত ব্যক্তির পরিবারের কাছে তা অত্যন্ত দুঃখের কারণ ! এভাবে জগতের সমস্ত সুখ বা দুঃখই আপেক্ষিক। সংসারীর কাছে যা দুঃখ_ সন্ন্যাসীর কাছে তাই হয়তো সুখের, আবার কোন সংসারীর কাছে যা সুখের, সন্ন্যাসীর কাছে সেটাই হয়তো দুঃখের–বলে পরিত্যাজ্য! এই পৃথিবীকে বলা হয় ‘ত্রিগুণ প্রপঞ্চ’! জীবের বৈশিষ্ট্য এবং গুণের তারতম্যে মানুষের স্বভাবও ভিন্ন ভিন্ন হয় !
এবার ভগবানের অবতরণের ব্যাপারটা বলছি_ শোন! এটি সম্পূর্ণ অন্য নিয়মে হয়__ nature দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হয় না__ universal nature বা মা জগদম্বার ইচ্ছায় হয় ঈশ্বরের অবতরণ! কাজেই, সাধারন মানুষ চিন্তার দ্বারা, যুক্তি বা বুদ্ধির দ্বারা_এর কোন কারন কখনোই খুঁজে পাবেনা। সহস্র সহস্র মানুষ প্রতিনিয়ত নানারকম জ্বালায় জ্বলে,কষ্টে বিচলিত হয়__ ভগবান করুণা করে শরীর ধারণ করে এসে এইসব ব্যক্তির কষ্ট দূর করেন। এটাই লীলা! মানুষ দৈহিক কষ্টে কাতর হয়, আর অবতারগণ মানব কল্যাণের নিমিত্ত স্বেচ্ছায় ক্রুশ বিদ্ধ হন_ এও লীলা! একমাত্র ভক্তের কাছেই ভগবান ধরা দেন_তাই ভক্তেরা বোঝে ভগবানের লীলা! সেজন্যই মহাজনগণ বলেছেন_ ভগবৎ রহস্য বুঝতে গেলে ‘ভক্ত হও’! তবেই ভগবৎ-রহস্য বুঝতে পারবে।