স্থানঃ– আজিমগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ!
সময়:—অক্টোবর,৮৮
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:–ববিনবাবু, পঙ্কজ বাবু, সেনগুপ্ত বাবু,মানিক ব্রহ্ম প্রভৃতি ভক্তগণ।

জিজ্ঞাসু:—-বাংলার প্রাচীনকালের ইতিহাস ঘাঁটলে _ এক শশাঙ্ক ছাড়া অন্য কোনো উল্লেখযোগ্য চরিত্র বা বীরের কথা পাওয়া যায় না! কিন্তু আধুনিক কালে আমরা দেখতে পাচ্ছি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু থেকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামীজী এবং পরে ঋষি অরবিন্দ, নেতাজিসহ প্রচুর মনীষীরা শরীর নিয়েছেন! এর কারণ কি হোতে পারে?

গুরুজী:—শশাঙ্ক বীর ছিলেন_ কিন্তু ওটা মধ্যযুগের ইতিহাস। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস তুমি পাবে কোথায়? এখনো ঠিক সেভাবে বাংলার প্রাচীন ইতিহাস লেখা হয়নি। তবুও আধুনিক ঐতিহাসিকরা যেটুকু লিখেছে, তাতে তুমি শশাঙ্ক ছাড়া আর কোন বীরকে পেলে না? বাংলার বারো ভূঁইয়ারা কি কম বীর ছিল ? ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদার হওয়া সত্ত্বেও বিশাল মুঘল বাহিনীর সাথে যেভাবে লড়ে, তাদেরকে বারবার পর্যুদস্ত করেছিল_ তা জেনে অবাক হতে হয়! গুপ্ত বংশের যে রাজারা ভারতবর্ষে “সোনার সময়”(যদিও গুরুজী অন্যসময় বলেছিলেন_গুপ্তযুগ কে সুবর্নযুগ বলা যায় না) এনে দিয়েছিল তারাও তো বাঙ্গালীই ছিল! এছাড়া মধ্যযুগেরশিক্ষা শিল্প-সংস্কৃতিতে বাংলার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছিল_ বহু দিকপাল মনীষী ওই সময় বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যেমন ধরো_ মহাকবি কালিদাস, উনি যে বাঙালি ছিলেন তার বহু প্রমাণ আছে! এর মধ্যে অন্যতম প্রমাণ এই যে, ভারতবর্ষের উত্তরে হিমালয় এবং দক্ষিনে সাগরের এবং প্রকৃতির ছটা ঋতুর উনি যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন_ ঠিক ঠিক ঠিক সেগুলির অবস্থান বা অবস্থা একমাত্র বাংলা থেকেই অনুভব করা যায়।

সে যাইহোক, আধুনিককালে শ্রীচৈতন্য, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বা স্বামীজীর জন্ম গ্রহণের বহুকাল আগে থেকেই, ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের দরবারে_ আচার্যের ভূমিকায় বহু বাঙালির নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে। এর মধ্যে বৌদ্ধযুগে জিন ভিক্ষু, শীলভদ্র, অতীশ দীপঙ্কর এদের নাম উল্লেখযোগ্য। সহজিয়া সাধনার প্রাণপুরুষ কবি জয়দেব, চন্ডীদাস এরা সকলেই প্রবাদপুরুষ।

তবে অবতারপুরুষ আর মহান পুরুষদের এক করে ফেলোনা। অবতার পুরুষেরা কখন কোথায় জন্মগ্রহণ করবেন, তা নির্ধারণের অন্য তত্ত্ব আছে। সাধারণ মানুষের যুক্তি বা বুদ্ধির ওপর তা নির্ভর করে না। কিন্তু অধিক সংখ্যায় মহাপুরুষ যে জাতির মধ্যে জন্মাচ্ছে_ সে জাতির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে বৈকি! ব্যাপারটা হলো_ বাংলার একটা নিজস্বতা রয়েছে। অতি প্রাচীনকাল থেকেই যেটা ভারতের অন্য প্রদেশের লোকের সাথে মেলেনা। তাই বহুকাল বাংলাকে ‘ব্রাত্য’ করে রাখা হয়েছিল! কিন্তু বাংলা এগিয়ে গেছে তার নিজস্ব ধারায়। শুধু আচার্য বা মহাপুরুষের জন্ম দেওয়া ছাড়াও, উল্লেখযোগ্য সমাজ সংস্কারকদের জন্ম এখানেই। এদের মধ্যে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, হাজী মুহাম্মদ মহসিন ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং সৈনিকরা ছিল বেশিরভাগই বাঙালি। বাংলা ভারতবর্ষকে অনেক নতুন চিন্তা ভাবনা দিয়েছে।

জিজ্ঞাসু:—রাজা দাহিরসেন কি বাংলার রাজা ছিলেন?

গুরুজী:—না, অবিভক্ত ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে সিন্ধু প্রদেশের ব্রাহ্মন রাজা ছিলেন দাহির। দাহির সেন নামকরণ কেন হয়েছে জানি না, তবে উনি কোন সেনবংশীয় বাংলার রাজা ছিলেন না।

দাহিরের ঘটনা তোমরা অনেকেই জানো, কিন্তু দাহিরের কন্যাদের বীরত্বের কথা তোমরা হয়তো জানো না__ আজকে আমি সেই কথা তোমাদের বলছি শোনো!

দাহিরের রাজ্য ছিল ছোট, সৈন্যসংখ্যাও কম। একদিন হঠাৎ তৎকালীন আরবের রাজার এক বিশাল সৈন্যবাহিনী দাহিরের রাজধানী আক্রমন করে বসল। সেই অসম যুদ্ধে দাহির পরাজিত ও নিহত হল। সেনাপতি কাসিম রাজ্যের ধন সম্পদ লুট করে ফিরে গেল তাদের রাজার কাছে_ আর রাজাকে উপঢৌকন দেবার জন্য বন্দী করে নিয়ে গেল দাহিরের দুই অনূঢ়া কন্যাকে। রাজকন্যাদ্বয় যেমন সুন্দরী ছিলেন তেমনি ছিলেন অসাধারণ তেজস্বিনী, শিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী। সাধারণতঃ তখনকার দিনে রাজা পরাজিত এবং নিহত হলে হিন্দু রমনীরা স্বেচ্ছায় প্রাণত্যাগ করতো_ বিধর্মীর হাতে ধরা দিত না। কিন্তু এই দুই কন্যারা অন্যরকম কৌশল অবলম্বন করেছিল । রাজকন্যারা চেয়েছিল_ তাদের প্রাণের বিনিময়ে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবে তারা! তাই আরব সেনাপতি যখন রাজকন্যাদেরকে রাজার দরবারে হাজির করল_ রাজা তো এই ধরনের উপহার পেয়ে খুবই খুশি! সেনাপতিকে পুরস্কার দিতে যায় আর কি! এমন সময় কন্যাদ্বয় বলে উঠল_ “মহরাজ! মহারাজ! এই বিশ্বাসঘাতক কে পুরস্কার দেবেন না”! এই কথা বলার কারণ জিজ্ঞাসা করায় ওরা দুইজনে জানালো যে রাজাকে খুশি করার আগেই পথের মধ্যে ওই সেনাপতি তাদের ইজ্জত লুট করেছে! হিন্দু মতে রয়েছে যে, দেবতার উদ্দেশ্যে একবার কোন অর্ঘ্য নিবেদিত হলে_ তা আর অন্য দেবতার পূজায়লাগে না। সুতরাং জেনে শুনে তারা রাজাকে গ্রহণ করে, তাকে ঠকাতে তারা পারবে না। তার থেকে তাদের যদি মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়_তাও ভালো!

এই কথা শুনে ক্রোধে অগ্নিশর্মা রাজা তখনই সেনাপতি কে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করল। সেনাপতির মৃত্যু হওয়ার পর রাজকন্যারা হাসতে লাগল আর রাজাকে “মূর্খ”_ বলে সম্বোধন করল! এইরূপ ধৃষ্টতাপূর্ণ কথা বলার কারণ জানতে চাওয়ায় রাজকন্যারা উত্তর দিল যে, _’ওই সেনাপতি হচ্ছে তাদের পিতৃ হন্তা! তাই মিথ্যাকথা বলে, তার মৃত্যু ঘটিয়ে _তারা তাদের পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে! আর রাজাকে “মূর্খ” বলার কারণ এই __যে রাজা তার প্রিয়, বিশ্বাসী সেনাপতির কথা বিশ্বাস না করে, শত্রু কন্যাদের কথা বিশ্বাস করল এবং সেনাপতির মৃত্যুদণ্ড দিল _এর থেকে মূর্খতা আর কি হতে পারে!’ এই কথা শুনে সম্রাট তাদেরও মৃত্যুদন্ড দিলে কন্যাদ্বয় হাসিমুখে সেই যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু মেনে নিয়েছিল। এই ভাবেই এই ভারতবর্ষে বহু বীর যেমন জন্মগ্রহণ করেছে, তেমনি অনেক বীরাঙ্গনারাও জন্মগ্রহণ করেছে। ইতিহাসে যাদের কথা লেখা আছে, মানুষ শুধুমাত্র সেই নাম কটাই জানে , যাদের কথা লিপিবদ্ধ হয় নি তাদের অবদানের কথা কি করে জানবে? তাই ইতিহাস পড়ে কখনোই একটা জাতির উত্থান-পতনের সমস্ত কথা অথবা সমকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া শতশত ঘটনার কথা জানা যায় না!

জিজ্ঞাসু:—–আচ্ছা গুরুদেব! স্ত্রী-পুত্র বা আত্মীয় স্বজন এরাও তো আপন জন! এদেরকে না ভালোবেসে এড়িয়ে চলা কি অন্যায় নয়?

গুরুজী:—আত্মজ্ঞান হলে আপন পর বোধ থাকে না, তখন _”আত্মবৎ সর্বভূতেষু”!অজ্ঞানতা থেকেই আপন পর বোধ আসে। মানুষ সাধারণত স্বার্থমগ্ন, আসলে সে নিজেকেই ভালবাসে। ফলে তার নিজের স্বার্থের অনুকূলে যারা আছে, তাদেরকে সে ভালোবাসে _ এরকম মনে করে! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। তোমার শিশুপুত্রটি তোমার খুব প্রিয় তো! নিশ্চয়ই তাকে তুমি খুব ভালোবাসো! এবার মনে করো _ একদিন তাকে কোলে নিয়ে তুমি বাগানে বেড়াচ্ছো, হঠাৎ একটা বিষাক্ত পোকা তোমার চোখে আচমকা ঢুকে পড়ল! তখন তুমি কি করবে বলোতো _ তখনই ছেলেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তোমার নিজের চোখের সুস্থতার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে! একটু সুস্থ হলে, তারপর ছেলের কি হলো _ তা মনে আসবে! আর ঐ অবস্থায় যদি তোমাকে বিষাক্ত সাপে কামড়ায় _ তাহলে তো কথাই নাই, ছেলের কথা মনেই আসবেনা! এইভাবে দেখা যায়, মানুষের স্বার্থের অনুকূল হলে তবেই অন্য একজনের সাথে তার ভালোবাসা-প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আবার স্বার্থের প্রতিকূলতা আসলেই ঘৃণা-অবজ্ঞা-প্রতিশোধস্পৃহা জেগে ওঠে! এই নিয়মে _ আত্মীয়-বন্ধু-স্ত্রী-বাবা-মা নাই বাবা_এ কথাগুলি সার্বজনীন সত্য এবং সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য!

সমাজের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো_ স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, ভাই-ভাইয়ের ঝগড়া,মারামারি লেগেই আছে! এসব সম্পর্ক যদি ভালোবাসারই হয়_ তাহলে এত বিরোধ কেন? খোঁজ নিয়ে দ্যাখো, স্বার্থের প্রতিকূলতাই এর মূল কারণ।

সুতরাং অজ্ঞানেই আপন-পর, আত্মীয়তা-অনাত্মিয়তা! জ্ঞান হলে এসব ভ্রম দূর হয়ে যায়। আচার্য শঙ্কর বললেন_ “ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা”! একমাত্র জ্ঞানীরাই পারেন সত্যের স্বরূপ উপলব্ধি করতে। আমার গুরুদেব রামানন্দ অবধূত বলতেন _”জগ ঝুট হ্যায়– কুত্তা কা পুছ হ্যায়”! তারা জানেন জগত‌ই যখন মিথ্যা অর্থাৎ অনিত্য, তো তখন সেখানে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আর ‘আপন’ খুঁজতে যাওয়া কেন? আপন যদি কাউকে ভাবতেই হয় _ তাহলে যা ‘নিত্য'(অর্থাৎ ব্রহ্ম) তাকেই ভাবো। প্রকৃত ‘আপন’-কে তখনই তো ঠিক ঠিক পাওয়া যাবে। অন্যথায় মরুদেশে মরীচিকার পিছনে ছুটে বেড়ানোর ন্যায় বৃথা অন্বেষণ হবে __তাই নয় কি?

সংসারে স্ত্রী-পুত্রের সম্পর্কের রহস্যটা কি জানো__ মনে করো সীমাহীন সাগরে এক টুকরো কাঠ ভাসছে। এরূপ অনেক কাঠ ভাসছে, তার মধ্যে আমরা যে কোন একটাকে ধরে পুরো বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করছি! তাহলে ধরো_সেই ‘কাঠ’-টা ভাসতে ভাসতে একাই চলেছে হঠাৎ একদিন অন্য আর একটা কাঠ ভাসতে-ভাসতে এসে তার সাথে জোড়া লেগে গেল। এবার ওই জোড় বাঁধা কাঠ দুটি একত্রে আবার ভাসতে-ভাসতে চলল! কোন একসময় হয়তো ছোট টুকরো টুকরো দু-একটা কাঠ আবার তাদের সাথে যুক্ত হলো। এভাবে কিছু দিন সবাই একসাথে ভাসতে থাকল_সেই সীমাহীন সাগরে! তারপর একদিন সাগরের একটি ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রথমকার বড় কাঠটা বিচ্ছিন্ন হয়ে ডুবে গেল। বহুদূরে বা অনেকদিন পরে আবার হয়তো সেই কাঠটি কোথাও ভেসে উঠল_ শুরু হলো আবার ভাসতে থাকা!!

এবার এই কথাগুলির তাৎপর্য বলছি_শোন। এখানে প্রথম কাঠটি মনে করো একজন ব্যক্তি! এই ভবসাগরে, সে যেন ভাসছে! দ্বিতীয় কাটটি যেন ঐ ব্যাক্তির স্ত্রী, যে একসময় তার সাথে যুক্ত হয়ে ভাসতে শুরু করেছিল । ছোট ছোট টুকরো গুলো যেন তাদের পুত্র-কন্যা ইত্যাদি । এরা সবাই মহাসাগরের বুকে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল_ শুধু উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতি লাভ করে একত্রে জোড় বেঁধেছিল মাত্র! কিন্তু এই জোড় চিরস্থায়ী নয়_ মৃত্যু এসে আবার এদেরকে বিচ্ছিন্ন করবে! আবার এরা অন্য কোথাও চলে যাবে_ অন্য কারো সাথে জোড় বাঁধবে। এইরকমই চলছে_horizental movement!

ফলে এই “নিজের স্ত্রী’ বা “নিজের স্বামী’_বলে যাকে ‘আপন’ ভাবছো, তারা না হয় ‘আপন’-ই হোল, কিন্তু সেও তো শুধুমাত্র এই জন্মের বিচারে! পূর্ব-পূর্ব জন্মে কে জানে_ সে কার স্ত্রী বা কার স্বামী ছিল? এ জন্মে কার স্ত্রীকে ‘নিজের স্ত্রী’ বলছ_ তা কি তুমি জানো? একজন্মের স্ত্রী_ অন্য জন্মে অন্য কোন নিকটাত্মীয় হয়েও জন্ম নিতে পারে_ এ এক রহস্য! এইজন্য, হঠাৎ কোন সাধকের জীবনে যদি পূর্ব পূর্ব জন্মের স্মৃতি জাগরুক হয়ে যায়_ তখন অনেকে পাগল হয়ে যায়! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন না,_ “যার যেমন ভাব, তার তেমন লাভ”! ভাবের পরিবর্তন হলে এরকমটা হয়। এইজন্য জ্ঞান হয়ে গেলে সাধকেরা সমস্ত নারীজাতিকে মাতৃবৎ এবং সাধিকারা সমস্ত পুরুষকে সন্তানবৎ দেখেন। আর অধ্যাত্মবিজ্ঞানীরা সর্বভূতে ‘নিজে’কেই দেখেন! কিন্তু যত গন্ডগোল __অজ্ঞান অবস্থায়! এখানে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার মধ্যে লোকে ‘আপনজন’ খোঁজে! ‘পুত্রের পিতা’ _ বলে কত গর্ব করে! আরে _ ‘পিতা’ কে?? আমি তো ‘পিতা’ কাউকেই দেখিনা! সবাই তো পুত্র! বাবার‌ও তো বাবা রয়েছে! ফলে সবাই ব্যাটা! বাবা __সেই একজন! কি গো _ তোমরাই বলো না, এই জগতে সেই ‘জগৎপিতা’ ছাড়া আর পিতা কেউ আছে নাকি? যীশু সেই তাঁর কথাই বলতেন! তিনি বলতেন__ “আমি তাঁর পুত্র!” এটা ঠিক ঠিক জানার নাম-ই জ্ঞান, আর বাকি সব অজ্ঞান! শুধু অভিমানাত্মক _উপাধি আরোপ করে বসে আছে। আর সেই কারণেই তো মানবজীবনে নানা রকম ক্লেশ এসে উপস্থিত হচ্ছে। যা নয়, তাই আরোপ করলে ক্লেশ হবে না? সুতরাং উপায় একটাই _ জ্ঞানী হও! জো-সো করে অজ্ঞানতা কাটিয়ে ওঠো!তাহলেই অভিমান অপসারিত হবে,আর সংশয়‌ও কেটে যাবে! অনিত্যকে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা থাকবে না তখন আর! অনাবিল আনন্দের সন্ধান পেয়ে পূর্ণ হবে মানবজীবনের উদ্দেশ্য!

জিজ্ঞাসু:—–তবে গুরুদেব! শাস্ত্রে বেহুলার পতিভক্তির কথা পাওয়া যায়, যার জোরে তিনি সশরীরে স্বর্গলাভ তো করলেন‌ই, এমনকি ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের সাক্ষাৎ-ও পেলেন! তাহলে এটাই বা কম কিসে?

গুরুজী:—–তুমি পদ্মপুরাণের কাহিনী যা বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল কাব্য’ পরিস্ফুট হয়েছে_সেখান থেকে ‘বেহুলা’র কথা বলছো তো? দ্যাখো,পিতৃভক্তি,ভ্রাতৃভক্তি, পতিভক্তি ইত্যাদি ভালো তো! সামাজিক ও পারিবারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য, গার্হস্থ্য জীবন সুখে কাটানোর জন্য_ এসব সমাজশিক্ষা ভালো! আর তাছাড়া ঋষিরা চতুরাশ্রম এর মধ্যে গার্হস্থ্য আশ্রম কেও তো ‘আশ্রম’-ই বলেছে! এখানে থেকেও যেআধ্যাত্মিক হওয়া যায় না__ এমন তো নয়! তবে জীবনের উদ্দেশ্য ও চলার পথটাকে প্রথমেই সঠিক করে নিতে হয়।

তবে, বেহুলার পতিভক্তির যে উদাহরণ তুমি দিলে_ তার দ্বারা সামাজিক কল্যাণ নিশ্চয়ই হবে। বেহুলা নারীসমাজের আদর্শ হলে অনেক সামাজিক বিকৃতির অবসান হবে। কিন্তু বেহুলা তো আধ্যাত্মিক জগতের নারীদের আদর্শ হতে পারে না! কারণটা বলছি, ধরে নেয়া যাক ঘটনাটি সত্য_ মৃত স্বামীকে নিয়ে কলার ভেলায় চড়ে বহু কষ্ট সহ্য করে, বহু পথ অতিক্রম করে সতী বেহুলা এসে পৌছালো স্বর্গধামে! এরপর তার বিভিন্ন গুণের জন্য অর্থাৎ নাচ-গান এসব দেখে দেবতারা সন্তুষ্ট হয়ে_ তাকে ‘বর’ দিতে চাইলো! কিন্তু তখন বেহুলা তাদের কাছে চাইল টা কি?? স্বামীর জীবন, ধন, ঐশ্বর্য এইসব _অর্থাৎ এ যেন ‘রাজার কাছে লাউ কুমড়ো চাওয়া’! এবার বল _ এটা কি পারফেকশন বা পূর্ণজ্ঞান এর লক্ষণ? নিশ্চয়ই নয় ।জ্ঞান হলে আর নশ্বর বস্তুসমূহের উপর মোহ থাকে না। সুতরাং জানবে, যে সাধনা সাধককে জ্ঞানের চরম অবস্থায় পৌঁছে না দিয়ে যশ,আয়ু,ধন ইত্যাদিতে আটকে রাখে _ তা আধ্যাত্মিক জগতের পথ নয়! সামাজিকভাবে এর ভূমিকা নিশ্চয়ই আছে __যাদের উদ্দেশ্য ‘স্বর্গলাভ’, তাদের জন্য এই আদর্শ ঠিক আছে কিন্তু ‘আনন্দলাভ’ যাদের উদ্দেশ্য _ তাদের আদর্শ এটা কি করে হতে পারে?

আধ্যাত্নিক ব্যক্তিরা তাদের লক্ষ্য আগে থেকেই স্থির করে নেন্ মহীয়সী নারী মৈত্রেয়ী, এ ব্যাপারে যা বলেছিলেন তাই ঠিক জানবে _”যেনাহং নামৃতাস্যাম্ _কিমাহং যেন কুর্যাম!”

[গুরুজীর কথা চলাকালীন সময়ে, দুজনের মধ্যে তর্ক বিতর্ক শুরু হয়ে যাওয়য়_গুরুজী আলোচনা বন্ধ করে দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন]••• তর্ক বিতর্ক করা একদমই ভালো নয়! কারণ এই বিশাল বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সকল রহস্য তো তুমি জানো না__ জানো কি? আর তা যখন জানো না, তখন তোমার জানার মধ্যে অসম্পূর্ণতা আছে! আর তা যখন আছে তখন সেই অসম্পূর্ণ জ্ঞান নিয়ে কারো সাথে তর্ক করে তোমার নিজের মত প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা মূর্খতা নয় কি? মা জগদম্বা যখন যাকে চাপরাস দেন, তখন লোকে তার কথা শোনে! তার বাইরে অন্য কেউ হাজার চেঁচালেও তার কথা লোকে মানবে না! তবে হ্যাঁ, তোমাকে যদি কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে_ তোমার যেটুকু জানা আছে সেটা বলবে,_ এতে দোষ নেই! তবে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য তর্ক শুরু করা ভালো নয়! তাছাড়া, ‘তর্ক’ তো দুঃখের কারণ! যে দুজন তর্ক করছে_ তাদের একজন হারবে ই, ফলে সে দুঃখিত হবে । তাহলে তুমি তার দুঃখের কারণ হলে! আবার দ্যাখো, তর্কে হেরে গেলেও যে, সে ঐ জয়ী-ব্যক্তির মত গ্রহণ করবে__ এমনও কিন্তু নয়! ফলে, আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য তর্ক করে অযথা জীবনী শক্তির অপচয় করা, আর হারলে দু্ঃখবরণ করা এবং জিতলে আত্মগর্বে গৌরবান্বিত হ‌ওয়া ছাড়া__ এতে আর কি হয়? ধরো, তুমি তর্কে জিতলে__ তাতেও তোমার ক্ষতি! কেননা_ অপরের মনে দুঃখ দিলে সেটিও আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতিবন্ধক হয় সেই জন্যই তো আমি তোমাদের সবাইকে বলি কোন action-এর reaction-নয়, proper action-ই সঠিক পন্থা!!