গুরুজী :— হয় বই কি! পৃথিবীকে বলা হয় ‘ত্রিগুণ প্রপঞ্চ’, ফলে জড়-চেতন সর্বত্র-ই তুমি ত্রিগুণের প্রকাশ দেখতে পাবে। তবে যার মধ্যে এই তিনগুণের যে কোন একটি প্রধান হয় — তখন তাকে ‘সেই গুণ’-বিশিষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়। যেমন সত্ত্ব-প্রধান ব্যক্তিকে বলা হয় সাত্ত্বিক, রজ-প্রধান ব্যক্তিকে বলা হয় রাজসিক — এইরূপ সর্বক্ষেত্রেই।
উদ্ভিদ জগতে বেল সাত্ত্বিক_ তুলসীও সাত্ত্বিক, আম ইত্যাদি ফলের গাছ রাজসিক, তেঁতুল-বাঁশ-ছাতিম ইত্যাদি তামসিক প্রকৃতির গাছ। সাত্ত্বিক প্রকৃতির গাছেরা পরিবেশকে প্রচুর পরিমাণে উদযান বায়ু (oxygen) সরবরাহ করে, তাছাড়া এদের মূল থেকে পাতা পর্যন্ত সমস্ত অংশই মানুষের বা অন্যান্য জীবের বিভিন্ন ব্যাধি-নিরাময়ে সাহায্য করে। রাজসিক প্রকৃতির গাছের ফল_ জীবের পুষ্টি যোগায় ও শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তামসিক প্রকৃতির গাছেরা প্রকৃতিতে প্রচুর পরিমাণে অম্ল জাতীয় উপাদান ছড়িয়ে পরিবেশকে দূষিত করে।
সেইজন্য দেখবে কোন বাড়ির ঈশান কোণে যদি বেল, তুলসী ইত্যাদি গাছ থাকে এবং সেই বাড়ির দক্ষিণ দিকে নিমগাছ থাকে, তাহলে সেই বাড়িতে কঠিন রোগ-ব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এই জন্যেই গ্রামাঞ্চলে তুলসী,বেল এই জাতীয় গাছ বাড়িতে থাকলে সেই সব গাছকে দেবতার ন্যায় ভাবা হয়! স্থানটি পরিষ্কার রাখা হয় — ধূপ-ধূনা, প্রদীপ দেওয়া হয় অর্থাৎ এইসবের মাধ্যমে মানুষকে শেখানো হয় যে, ঐ গাছগুলির গৃহে থাকার একান্ত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আবার যেখানে তেঁতুল-বাঁশ জাতীয় গাছ রয়েছে — দেখবে তার তলায় ঘাস পর্যন্ত জন্মায় না!ঐ স্থানের মাটিও অম্লপ্রধান হয়ে ওঠে। এইসব গাছে কোনো ভালো পাখিও বাসা করতে চায় না, কারণ পাখিদেরও তো গুণের তারতম্য রয়েছে। ফলে বক্ ইত্যাদি যারা প্রচুর আমিষ জাতীয় খাবার খায় তারাই তামসিক ধরনের গাছে বাসা বেঁধে থাকে, অন্যেরা থাকতে সক্ষম হয় না।
জিজ্ঞাসু:— তবে, আজকাল লোকে বাড়ির উঠোনে ওইসব গাছ না লাগিয়ে শাক,বেগুন,টমেটো ইত্যাদি বেশি লাগাতে চায়!
গুরুজী:— লাগাক্ না! ওটা তো অর্থনৈতিক দিক! উঠোনে বেশি জায়গা থাকলে_কেউ শাক,বেগুন লাগাতেই পারে! এর জন্য তো তুলসী গাছ কোন বাধা সৃষ্টি করে না! দ্যাখো, বাঙালিরা শাক খেতে ভালবাসে_ তাই শাক লাগায়। পৃথিবীর মধ্যে বাঙালিরাই সবচাইতে বেশি শাক খায়, সেইজন্যই আগে এর নাম ছিলো “শাকদ্বীপ”! এখানে নানা ধরনের শাক জন্মায়ও আর লোকে খায়ও খুব! তবে টমেটো, কপি এগুলো বিদেশি! ভারতবর্ষে আগে এগুলো ছিল না।ধান,গম_ ভারতের নিজস্ব! আবার ধানের আদিভূমি বাংলা। এখনও ধানউৎপাদন বাংলাতেই বেশি হয়, তার মধ্যে আবার বর্ধমান জেলা শ্রেষ্ঠ! প্রবাদ আছে_ “তাল-তেঁতুল-ধান, তিনে বর্ধমান”! গমের আদি ভূমি পশ্চিম ভারতে। এখনও দেখা যায় _বাংলায় যেমন বিভিন্ন জলা জায়গায় আপনা-আপনি এক ধরনের ছোট ছোট ধান জন্মায়, ঠিক তেমনি সিন্ধু প্রদেশের বনে-জঙ্গলে পতিত জমিতে বুনো গম আগাছার মত আপনাআপনি হয়।
জিজ্ঞাসু:– এখন তো উচ্চ ফলনশীল ধান ও গমের চাষ?
গুরুজী:— হ্যাঁ, সংকরায়ন করে উচ্চফলনশীল খাদ্য শস্যের বীজ সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে চাষীদের। তাছাড়া বিভিন্ন কোম্পানি ও এখন উচ্চফলনশীল বীজ তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে। তার ফলে এখন আর আগেকার দিনের বিভিন্ন পুরোনো জাতের ধান চাষ প্রায় উঠেই গেছে। কিন্তু জানো তো_ 3-4 সিজন যদি একই ধান একই জমিতে লাগানো যায়, তাহলে দেখা যায় যে_ সেই জমিতে প্রচুর ‘ঝোরা’ ধান জন্মাচ্ছে। ‘ঝোরা’ ধান অর্থাৎ যে ধান ঝরে যায় এবং যে ধানের মাথায় লম্বা লম্বা শুঁড় থাকে। প্রকৃতির অদ্ভুত রহস্য এটাই যে, আদি ধানের প্রকৃতিও ছিল এইরকমই! অর্থাৎ সংকরায়ন ঘটিয়ে বীজের quality-র পরিবর্তন করা গেলেও তার মধ্যে একটা tendency রয়েছে_ সেই আদি অবস্থানে ফিরে যাবার! তাছাড়া শুধু ধান বা গম কেন, যে কোন শস্য বা সবজি_ সবই তো এখন hybrid ! এদিকে poultry foods, dairy foods _এ সব ও hybrid! মাছের মধ্যে _ যেমন সিলভার কার্প,গ্রাসকার্প,আমেরিকান রুই ইত্যাদিরা hybrid ! প্রচুর লোকসংখ্যা বৃদ্ধি হয়ে যাওয়ার জন্য, খাদ্যের যোগান দেওয়া অসম্ভব হচ্ছিল বলেই _কৃষিতে বিজ্ঞানীদের এই(সংকরায়ন) প্রযুক্তি বর্তমান পৃথিবীতে খানিকটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার _ এই যে কৃত্রিম পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা hybrid products, এগুলোতো natural নয় _ ফলে জীবের শরীরের যে গ্রন্থি সমূহের কাজ বা জিনের কাজ _ এগুলি কিন্তু এইসব খাদ্যগ্রহণের ফলে ব্যাহত হচ্ছে! দ্যাখো না, এইজন্যেই তো বর্তমানে _ পৃথিবীতে নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে! লোকের immunity power কমে যাচ্ছে _এগুলির অন্যতম কারণ কিন্তু এই জাতীয় খাদ্যগ্রহণ !সুতরাং বর্তমান কৃষি বিজ্ঞানীদের শুধু quantity নয় quality-র দিকেও নজর দেওয়ার সময় এসে গেছে _ নাহলে অদূর ভবিষ্যতে শুধু উৎপাদনের পরিসংখ্যান নিয়ে গর্বিত হতে গিয়ে, সমাজ চরম সমস্যার এবং অবক্ষয়তার সম্মুখীন হতে পারে।
জিজ্ঞাসু:— ধান যদি বাংলার আদি শস্য হয়, তাহলে তো প্রাচীন সাহিত্যে_ বাঙালির খাদ্য যে ভাত_ তার উল্লেখ থাকা উচিত ?
গুরুজী:— হ্যাঁ, আছে তো! মঙ্গলকাব্যগুলোয় পাবে। এমনকি কালিদাসের বিভিন্ন কাব্যের নায়কেরা ভাত খেতো। কালিদাস যে আসলে বাঙালি ছিলেন, এটাও তো তার একটা অন্যতম প্রমাণ।
জিজ্ঞাসু:– কথাতে অবশ্য আছে “ভেতো বাঙালি”!!
গুরুজী:—- কিন্তু বাঙালীদের প্রতি ঐ কথাটা ব্যবহার হয় একটু অন্য অর্থে_ যেন অবজ্ঞা ভাব প্রকাশ পায়! আমিও এই নিয়ে চিন্তা করেছি_ জানো! ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের লোকই ভাত খায়, সাউথের লোকেরা তোখুবই ভাত খায়, তাছাড়া নর্থের লোকেরাও খায়, পূর্ব ভারতের সমস্ত এলাকাতেই_ লোকে ভাত খায়, এমনকি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষেরা ভাত খায়_ যেমন ধরো, চীন-জাপান-কোরিয়া-সিরিয়া-রাশিয়া প্রভৃতি দেশের লোকের অধিকাংশেরই প্রধান খাদ্য ভাত। তাহলে “ভেতো বাঙালি”– কথাটা ব্যাঙ্গার্থে কেন ব্যবহার করা হয়_ ভাত খেলে যে শরীরের পুষ্টি ঠিকমতো হয়না_ তাও নয়, তাহলে? আমি চিন্তা করে দেখলাম__ না, ওটা কারণ নয়_ কারণ অন্য! সমস্ত জাতি অপেক্ষা বাঙ্গালীদের ভাত খাবার সময় এবং ধরনটা ভিন্ন। একমাত্র বাঙালিরাই সমস্ত কাজ সেরে শেষকালে ভাত খায়, আর ভাত খেয়েই শুয়ে পড়ে_সেটা কি দিনে_কি রাত্রে! যারা খেয়ে অল্প রেস্ট নিয়ে আবার কাজ করে তাদের শরীর যথেষ্ট মজবুত।সাউথের লোকেরা সন্ধ্যেবেলা খেয়ে নেয়, তারপর কাজ করে। ওখানকার অনেক শহরে তুমি রাত্রি আটটা_নটার পরে আর খাবারই পাবে না, হয়তো কফি পাবে! বাঙ্গালীদের এই বদঅভ্যাসটা চালু হবার পর থেকেই স্বাস্থ্যের হানি হতে শুরু করেছে!
প্রকৃতপক্ষে, যে সময়ে ঠাকুরকে শীতল দেওয়া হয় অর্থাৎ সন্ধ্যার অব্যবহিত পরেই,_ সেই সময়ে রাত্রির খাবার খেয়ে নেওয়া উচিত। যারা দৈহিক পরিশ্রম খুব একটা করে না তাদের অল্প আহার, আর যারা তারপরেও কাজ করবে তাদের অপেক্ষাকৃত বেশি! এই নিয়মে আহার করলে কখনোই স্বাস্থ্যের হানি হয়না।
মানব শরীরে সূর্যগ্রন্থি বা পিঙ্গলা নাড়ি _খাদ্য পরিপাক ঘটাতে সাহায্য করে, ফলে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়েই সাধারণত খাদ্য পরিপাক সব চাইতে ভালো হয়। এরপর(সূর্যাস্তের পর)কাজকর্ম বা পরিশ্রম করলে, তার জন্য খানিকটা পরিপাক হতে পারে। যাইহোক, তাহলে দেখা যাচ্ছে যে এই সময়ের মধ্যে খাদ্য গ্রহণ করাই বিধেয়! অধিক রাত্রিতে _ গুরুপাক খাদ্য ভোজন করা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আমাদের দেশে এই জন্য রাত্রে কোন ভোজ-কাজের অনুষ্ঠান বা লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর রেওয়াজ পূর্বে ছিলনা _ ইংরেজরা এদেশে এসে এই ব্যাপারটা চালু করে দিল। এখন তো রাত্রে অনুষ্ঠান করে খাওয়ানোটাই ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে! কিন্তু এটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। বিশেষতঃ অধিক রাত্রে গুরুপাক ভোজন করা, কোন স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিরই উচিত নয়।
জিজ্ঞাসু:— আপনি শুধু বাইরে বাইরেই ঘুরে বেড়ান! কিছুদিন এখানে থেকে যান না?
গুরুজী:— সেকি রে!! আসলে তোরা আমার এই শরীরটাকে ভালোবাসিস বলেই হয়তো এমন ধরনের কথা বলছিস! কিন্তু আমি নস্টালজিক্ হব নাকি? ঘরকুনোরা ঘরে থাকতেই ভালোবাসে। অল্প পরিসরের জগত-ই তাদের কাম্য! এর মধ্যেই তারা তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে চায়_ কিন্তু সঠিক art-টি জানা না থাকায় তাও খুঁজে পায়না!ফলে নানারকম জ্বালা-যন্ত্রণা-অশান্তিতে ভোগে!
দ্যাখ্, প্রয়োজনে মনকে নিজের মধ্যে গুটিয়েও আনতে হবে_ আবার প্রয়োজনে মনকে অনন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে! তবেই তো অনন্তের সন্ধান পাওয়া যাবে!
মন যাদের সংকীর্ণ,তারাই সংকীর্ণ-গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায়। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন,_ “মানুষ মনেতেই বদ্ধ, আবার মনেতেই মুক্ত”! সত্যিই দেখবি_ মানুষের ‘মন’- নিয়ে যত গন্ডগোল! ছোটবেলায় আমার অন্তর্জগতে এসব কথা নিয়ে খুব বিচার চলতো! “মন”_ “মন”- করে মানুষ পাগল হচ্ছে দেখে, আমিও আমার মনকে নিয়ে গবেষণা করতে লাগলাম! রাত্রিবেলায়_ নির্জন স্থানে উন্মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতাম চাঁদকে! ছোটবেলা থেকেই চাঁদকে আমার ভগ্নি বলে মনে হতো_ স্নেহশীলা ভগ্নি! সে যাইহোক, চাঁদকে দেখতে দেখতে আমি আমার মনকে বলতাম,_” হে আমার মন! তুমি ওই চাঁদে প্রতিফলিত হয়ে, স্নিগ্ধ চন্দ্রকিরনের সাথে বিশ্বের আলোকিত অংশে ছড়িয়ে যাও”! অথবা ভাবতাম,_”এইমুহূর্তে যতজন ওই চাঁদকে দেখছে, তাদের সকলের মনের সাথে আমার মন যুক্ত হয়ে যাক্”!
এইভাবে ছোটবেলা থেকে আমি মনকে নিয়ে খুব ই গবেষণা করেছি! বলতে পারিস মনকে তুলোধোনা করে ছেড়েছি! তারপর একদিন মনকে বললাম,_”হে মন!যাও তুমি মুক্ত”! এইভাবে যাঁর(মা জগদম্বা) মন তাঁকে ফিরিয়ে দিলাম! ভেবে দেখলাম _আমি মন নিয়ে কি করবো, তার থেকে যার মন তার কাছে থাকাই ভালো! যাক্, কথায় কথায় অন্য কথা এসে গেল _ দ্যাখো, ঘরকুনো হওয়া ভালো নয়_ বাউল হতে হবে! এটাই শিব-ভাব! ভগবান শিব যখন যেখানে থাকেন, তখন সেটাই যেন তারা নিজের বাড়ি! আপন বলতেও কিছু নাই_ আবার পরও কেউ নয়! স্বামী বিবেকানন্দের জীবনও এমনটাই ছিল! যে মানুষকে ভালোবাসে_ সে কি ক্ষুদ্র জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে? তাই তো ছুটে ছুটে যেতে হয় মানুষের কাছে! আমি যেতে না চাইলেও আমার স্বভাব আমাকে টেনে নিয়ে যাবে! মা জগদম্বা জানেন, আরো কত নতুন নতুন জায়গায় যেতে হবে! আমি তো শুকনো পাতা, হাওয়া যখন যেদিকে দেয়_ আমি সেদিকেই যাই! যেখানে যেমন- সেখানে তেমন, যার যেমন- তার তেমন, যখন যেমন- তখন তেমন_ এই আমার স্বভাব!
জিজ্ঞাসু:– অনেকে বলে ঈশ্বর-ই শক্তি, কিন্তু আমরা তো জানি ‘সকল শক্তির উৎস সূর্য’_ তাহলে তো বলা যায় সূর্যই ঈশ্বর?
গুরুজী:— না, তা নয়! কারণ ঈশ্বর কোন বস্তু বা শক্তি নন_ ঈশ্বর একটি তত্ত্ব। তুমি বোধহয় বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র, তাই “শক্তি”, “সূর্য”- এইসব শব্দ ব্যবহার করছো! যাইহোক, তোমার যে ধারনা ‘সূর্য সকল শক্তির উৎস’_ এটা পৃথিবী গ্রহ বা এই সৌরমণ্ডলের অন্যান্য গ্রহের ক্ষেত্রে সত্য হতে পারে কিন্তু এই সৌরমণ্ডলের বাইরে তোমার এই সূর্যটির ভূমিকা কি? এইরূপ অনেকগুলি সৌরমণ্ডল নিয়ে একটি ছায়াপথ, কতকগুলি ছায়াপথ নিয়ে হয় গ্যালাক্সি। এইরকম ভাবে পরপর পাওয়া যায় নোভা-সুপারনোভা! তাহলে তাদের কাছে এই সূর্য তো একটি বিন্দু মাত্র! তাহলে সেগুলির কার্য চলছে কোন শক্তিতে? সুতরাং “শক্তি”- এই শব্দটির যে বিশালতা তার ধারনাও তোমার নাই। এই বিশাল বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রণকারী যে শক্তি_ তাকেও “ঈশ্বর” বলা হচ্ছে না। কারণ তিনি শক্তি নন, তিনি শক্তিমান_ সর্ব-শক্তিমান! যতকিছু শক্তির ভিন্নতা ও জড়ের বৈচিত্র্য_সে সবকিছু তাঁকে-ই প্রকাশের চেষ্টা মাত্র! “ঈশ্বর” হচ্ছে একটি তত্ত্ব_ একটি চরম ও সম্পূর্ণ তত্ত্ব! ঈশ্বরতত্ত্বের কথায় আমরা পরে আসছি _প্রথমে কোন জড় বা চেতন বস্তু যেগুলি দৃশ্যমান এমন কিছুকে ধরে বোঝার চেষ্টা কর।সেই বস্তুটির রূপ, তার গঠন-বৈশিষ্ট্য তুমি অনুভব করছো _ তোমার বিভিন্ন ইন্দ্রিয় ও মস্তিষ্কস্থিত বিশেষ কোষসমূহের দ্বারা! কিন্তু যদি বস্তুটির বিশ্লেষণের গভীরে যাও তাহলে প্রকৃতপক্ষে বস্তুটি কে কিভাবে দেখবে? দেখবে_ _ কতকগুলি ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদির সমষ্টি। তারাও কিন্তু কেউ স্থির নয়_ সকলেই গতিশীল!সকলেই সদাসর্বদা স্পন্দিত হয়ে চলেছে।
তাহলে বোঝা গেল যে, একটা নির্দিষ্ট চাপ বা তাপে, নির্দিষ্ট কালের সীমায়, নির্দিষ্ট স্পন্দনের একটা ঘনীভূত রূপ ও বস্তুটি। তাপ বা চাপ প্রয়োগে স্পন্দনের পরিবর্তন ঘটালে, বস্তুটির রুপেরও পরিবর্তন ঘটবে_ তাই না! সাধারণভাবেই তো দেখা যায় যে, জলকে ফোটালে বাষ্প হচ্ছে_ আবার জলকে জমালে বরফ হচ্ছে ! স্পন্দনের তারতম্যে যে কোন বস্তুকে _অন্য বস্তুতে পরিণত করা সম্ভব।
এবার আসছি শক্তির কথায়_ শক্তি বলতে পদার্থবিজ্ঞানে শব্দশক্তি, তাপশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি_ ইত্যাদিকে বোঝায়। কিন্তু সেগুলোও নির্দিষ্ট মাত্রার স্পন্দন ছাড়া আর কিছুই নয়! স্পন্দনের তারতম্য ঘটিয়ে এক শক্তিকে অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়। এমনকি শক্তিকে বস্তুতে, অথবা বস্তুকে শক্তিতেও রূপান্তরিত করা যায় _ শুধুমাত্র স্পন্দনের তারতম্য ঘটিয়ে!
আবার দ্যাখো, এই যে তুমি যা কিছু দেখছ_ এটাও তো আলোকতরঙ্গের অভিক্ষেপ_যা প্রকৃতপক্ষে স্পন্দন ছাড়া আর কিছুই নয়! তোমার চিন্তা, তোমার অনুভব_ এসব-ও কি স্পন্দনেরই ফল নয়? এইভাবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যা কিছু জড়,চেতন,শক্তি সবকিছুই এক নিরবিচ্ছিন্ন স্পন্দনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বেদে একে বলা হয়েছে_ “স্পন্দতত্ত্ব”! এই স্পন্দতত্ত্ব-ই প্রাণ! আর প্রাণকে_ প্রকাশ করে যে তত্ত্ব_ তাই ঈশ্বর! এবার বুঝতে পারলে নিশ্চয়ই_ ঈশ্বরকে “তত্ত্ব” কেন বলা হয়েছে! এই তত্ত্বের মধ্যেই সকল “তত্ত্ব” নিহিত আছে। এইজন্যই বলা হয়_ ‘ঈশ্বর’-কে জানলেই সব জানা যায়!
কিন্তু এখানেও একটা কথা আছে। বিজ্ঞানের বই পড়ে বা শুনে যেমন বিজ্ঞানী হওয়া যায়না _তার জন্য নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা ইত্যাদি অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়, তেমনি এই চরমতত্ত্ব বা পরমত্ত্বের সন্ধান পেতেও _ দীর্ঘ গবেষণা অর্থাৎ সাধনার প্রয়োজন হয়, অন্যথায় শুধুই বাদানুবাদ বা কথার কচকচানি হয়, তত্ত্বলাভ বা তত্ত্ব সাক্ষাৎকার হয় না।