সময়:– 22 /11/ 88.
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:– পূর্ণানন্দ মহারাজ, জগাদা, গঙ্গা বাবু ও কয়েকজন ছাত্র।
জিজ্ঞাসু:–মহারাজ! আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে বহুদিনের, যদি উত্তর দেন তো বড়ই আনন্দিত হই! জিজ্ঞাসাটা হচ্ছে,_ আমি কে, কোথা থেকে এসেছি এবং কেনই বা এসেছি?
গুরুজী:–( ভদ্রলোকের জিজ্ঞাসা করার ধরণ দেখে গুরুজী একটু হাসলেন তারপর উত্তর দিতে শুরু করলেন)! গুরুজী:— “তত্ত্বমসি”, তৎ-তমসি__ অর্থাৎ ‘তুমিই সেই’! ব্রহ্মবিলাসের অবতরণ-উত্তরণ লীলায় এখন মায়াচ্ছন্ন হয়ে, স্বরূপ ভুলে_ তুমি নিজেকে একজন ‘মানুষ’ ভাবতে শুরু করেছ! ছাগলের পালে কোন বাঘের বাচ্চা বড় হলে যেমন সেই বাঘ নিজেকে ছাগল মনে করে_ সেইরূপ আত্মবিস্মৃত তুমি স্বয়ং ব্রহ্মস্বরূপ হয়েও নিজেকে ক্ষুদ্র জীব ভাবছো, একটি বিশেষ নাম বা রূপের আবরণ চাপিয়ে নিজেকে প্রকাশ করছো এবং এর সাথে ‘ব্যক্তি অহং’- যুক্ত করে ‘তুমি অমুক’_ এইরূপ সিদ্ধান্ত করছো! এটাই রহস্য! ব্রহ্মই লীলাবিলাসের জন্য বা রস আসাদের আস্বাদনের জন্য ‘বহু’- হয়েছেন। সুতরাং বিবর্তন সংবর্তনের মধ্যে দিয়ে জড় থেকে চেতন, আবার চেতনা থেকে চৈতন্য লাভ করে স্বরূপের বোধে উপনীত হওয়াই_ জীবের উদ্দেশ্য!Need of Life এবং Necessity of Life_ এই দুটো নিয়েই মানুষের যত চিন্তা।Need of Life অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান আর Necessity of Life অর্থাৎ স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং নিরাপত্তা। কিন্তু মানুষ প্রকৃত নিরাপদ কখন হয় এর উত্তর খুঁজে পেলেন একমাত্র ভারতীয় ঋষিরা_ তাঁরা জীবনের গভীরে ডুব দিয়ে জানতে পারলেন জীবের Purpose of Life-কি? তাঁরা তাঁদের এই উপলব্ধ সত্য বিশ্ববাসীকে জানালেন,_ “শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ”… ইত্যাদি,যার অর্থ_ “আমি সেই মহান পুরুষকে জানিয়াছি, যাঁহাকে জানিলে মৃত্যুকে অতিক্রম করিয়া সেই অমৃতলোকে উত্তরণ করা যায়”! তাঁরা জানালেন__ মহাবিশ্বের জড়-চেতন সবকিছুই, সেই ব্রহ্ম হোতে জাত হয়, তাতেই স্থিত হয় এবং তাতেই লয় প্রাপ্ত হয়!
নিরবচ্ছিন্নভাবে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় হয়ে চলেছে মহাবিশ্বের সর্বত্র! তোমার দেহেও একইসঙ্গে এই তিনটি ক্রিয়া হচ্ছে যার সামগ্রিক ফল হিসেবে তুমি অনুভব করছ _ঐ টি ‘তোমার দেহ’! সৃষ্টি ও স্থিতির হার, যতদিন ধ্বংসের হার অপেক্ষা বেশি হচ্ছে_ততদিন শরীরের বৃদ্ধি হচ্ছে বা শরীর পুষ্টিলাভ করছে! যখনই শরীরে ধ্বংসের হার বেশি হচ্ছে, তখনই দেহ জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে _জীবশরীর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে!
তাহলে, বোঝা গেল তো যে, জগতে ‘আসা’ এবং ‘যাওয়া’-র জায়গা সেই এক! কিন্তু মাঝখানে ক্ষুদ্র অহং-আশ্রিত তুমি “আমি-আমার”,এই ভাবনায় ভাবিত হয়ে কিছুকাল কাটিয়ে যাচ্ছ_ জন্মাচ্ছো- বড় হচ্ছো- মরছো! আবার জন্ম- আবার বড় হওয়া, আবারও মৃত্যু __ এই রকম চলছে!
তারপর জন্ম-জন্মান্তরের অভিজ্ঞতায়, যখনই মানুষের চেতনা জাগছে, সে সাধনার জগতে প্রবেশ করছে_তখন ধীরে ধীরে তার অজ্ঞানতা যাচ্ছে কেটে! মায়ার আবরণ সরে যাচ্ছে তখন তুমি দেখছো_ তুমি কিছুই হারাও নি! স্বরূপতঃ তুমি যা ছিলে, তা-ই আছো! “পদিপিসির বর্মীবাক্স”_ বলে একটি গল্প আছে_ সেখানে দেখা যায় পদিপিসি তার বর্মা থেকে আনা সেগুন কাঠের বাক্স থেকে নানা সাজ বের করে পরলো, কতরকমের খেলা দেখালো_ তখন কেউ তাকে চিনতে পারল না! কিন্তু শেষকালে যখন সে সব সাজ খুলে ফেলল_ তখন সবাই দেখল_”আরে! এ যে আমাদের সেই ‘পদি’!” মাঝের থেকে শুধু কিছু রঙ্গ হয়ে গেল_ পদি কিন্তু যে পদি সেই ! তাই বলা হয়_ “কত রঙ্গ দেখালি পদি”!
জিজ্ঞাসু:– কিন্তু আত্ন সাক্ষাৎকারই যে Purpose of Life বা জীবনের উদ্দেশ্য_ তা মানবো কেন ?
গুরুজী:– তোমাকে মানতে কে বলেছে? ভারতীয় আর্য চিন্তাধারা তো কখনো কাউকে কোন কিছু মানতে বলেনি! বেদ বলেছে_ “জানো”! আর জানার জন্য চাই ঐকান্তিক আগ্রহ_ একাগ্র মন, বিবেক-যুক্ত বুদ্ধিই, সিদ্ধান্ত করতে পারে_ কোনটা ঠিক অথবা কোনটা নয়। যে কোনো মানুষের দিকে তাকিয়ে দেখো_ মানুষ কি তৃপ্ত? না, তা নয়! কি করে তৃপ্ত হবে ? একটার পর একটা চাহিদার পিছনে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে মানুষ! শুধুই ‘এষনা’ ! পুত্রৈষনা,বিত্তৈষনা,দারৈষনা,লোকৈষনা__জীবনে চাওয়ার আর শেষ নাই! কখনো কখনো যখন চাওয়া কিছুটা মেলে_ মনের মত হয়, মানুষ তখন সুখ অনুভব করে! অন্যথায় শুধুই ক্লেশভোগ করে। হয়তো ছেলেবেলা থেকে চাহিদা ছিল ভালো লেখাপড়া করবে_ তা পূরণ হলো, এরপর চাকরির চাহিদা_ হয়তো তাও মিটলো, তারপর স্ত্রীর চাহিদা, তারপর পুত্র-কন্যার জন্য চাহিদা, আরো পরে পুত্রকন্যাদের লেখাপড়া করানোর চাহিদা__ ইত্যাদি পরপর চলতেই থাকছে! কিন্তু জাগতিক সমস্ত চাহিদাই তো সবসময় মেটে না_ তখনই আসে ক্লেশ! চাহিদা থাকতে ক্লেশমুক্ত হওয়া যায় নাকি?
ঋষিরা তো এটাই জানতে পারলেন যে, বাসনা-ই সকল দুঃখের কারণ !সুতরাং শান্তি পেতে গেলে নির্বাসনা হতে হবে! বাসনা থাকতে তুমি নিরাপদ নও এবং ক্লেশমুক্ত নও! “নাল্পে সুখমস্তি”_অল্পে(অনিত্য) সুখ নাই, “ভূমৈব সুখম্”_অর্থাৎ একমাত্র ‘ভূমা’-তেই সুখ! অমৃতের পুত্রগণ, জাগতিক চাহিদা পূরণে কি তৃপ্ত হতে পারে? একমাত্র অমৃততত্ব-ই তাকে তৃপ্ত করতে পারে! তবুও “এটা-ওটা” চাওয়া কেন __না,এ যেন অন্বেষণ, খুঁজে বেড়ানো! “খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশ পাথর” _ জন্ম থেকে জন্মান্তরে,কল্প-কল্পান্তরে এই খোঁজ চলছে _ পূর্ণতার খোঁজ! কিন্তু লক্ষ্য স্থির না হওয়ায় চলাটা হচ্ছে Horizontal! পৃথিবগ্রহে আর্য ঋষিরাই প্রথম এটা বুঝলেন যে আগে নিজেকে উপরে উঠতে হবে (চেতনায় উন্নীত হতে হবে)!তাই তাঁরা প্রথমেই লক্ষ্য স্থির করলেন, তাঁরা বুঝলেন _আত্মতত্ত্বের উপলব্ধি করেই সেই “তৎ”-কে জানা যায়! তাই বললেন _ “উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত” _ ‘ওঠো’_ ‘জাগো’! দ্যাখো_ এখানে “জাগো _ওঠো” নয়! প্রথমে “ওঠো” অর্থাৎ শুরু করতে হবে Vertical Movement _ এটাই চরৈবেতি!এ চলা কতক্ষণ _ না, “প্রাপ্য বরান নিবোধত”! অর্থাৎ যতক্ষণ না লক্ষ্যে উপনীত হচ্ছো, ততক্ষণ থেমো না, এগিয়ে চলো! চরৈবেতি _চরৈবেতি!!
ঋষিদের উপরোক্ত সত্য তোমাদেরকে বললাম_ এর বাইরে অন্য কোন চিন্তা দিয়ে মনুষ্য সহ যে কোন জীবের সমস্যার সমাধান করা যায় না। যখনই মানুষ মুক্ত হবার, নিরাপদ হবার বা অভয় হবার জন্য সচেষ্ট হয় _তখনই সে বুঝতে পারে এ ছাড়া অন্য কোন পথ নাই(নান্যংপন্থাবিদ্যতেহয়নায়!) । তবে যুগ প্রয়োজনে ভগবান স্বয়ং অবতীর্ণ হয়ে মাঝে মাঝেই মানুষকে সহজ উপায়ে এই সকল তত্ত্বলাভের সহায়তা করেন। তখন সেই উপায়গুলির আচরণই হয় সেই যুগের যুগধর্ম । ফলে সমাজে নতুন-পুরোনো ইত্যাদি মিলে, ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে _নানান বৈচিত্র্য দেখা যায় । কিন্তু একটা কথা মনে রাখবে _ধর্ম আচরণের ভিন্নতা হলেও এটাকে বৈচিত্র বলে দেখবে, কখনো কোন বিরোধ করবে না।
জিজ্ঞাসু:— আচ্ছা মহারাজ! নরসিংহ অবতার রূপে ভগবানের অবতরণ হয়েছিল_ এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
গুরুজী:– হঠাৎ নরসিংহকে ধরলে কেন_ তার আগেরগুলো অর্থাৎ মৎস্য, কুর্,বরাহ-রূপেও তো ঈশ্বরের অবতার রয়েছে। তবে ‘নরসিংহ অবতারে’র মূর্তি কল্পনাটা একটু অদ্ভুত বলেই কি তোমার জিজ্ঞাসা? যাইহোক, ব্যাপারটা বলছি_ বোঝার চেষ্টা করো! বিষ্ণুর দশ অবতারের কথা শাস্ত্র বলেছে_মৎস্য,কুর্ম,বরাহ, নরসিংহ ইত্যাদি। এখানে বিষ্ণু অর্থে _বিস্তার! যিনি বা যে তত্ত্ব, এই জগত সংসার পরিব্যপ্ত হয়ে আছে__ তাই বিষ্ণু! বিষ্ণু-কে বলা হয়েছে পালনকর্তা! আবার শাস্ত্র এও বলেছে যে, বিশেষ ক্ষেত্রে তিনি অবতার-রূপ পরিগ্রহ করে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করে থাকেন। এইগুলি সবই পুরাণাদি শাশ্ত্রের কথা। পৌরাণিক আখ্যান এবং তার তত্ত্বের ব্যাখ্যা এখন থাক_ জীবনবিজ্ঞান দিয়ে এই দশাবতার তত্ত্বকে বোঝানোর চেষ্টা করছি_শোন! চার্লস ডারউইনের অভিব্যক্তিবাদ ভারতীয় শাশ্ত্রাদিতে ঋষিদের বর্ণিত বিভিন্ন তত্ত্ব থেকে সংগৃহীত। কারণ, ভারতীয় শাস্ত্রে রূপকাকারে বর্ণিত ঘটনাগুলির সাথে অভিব্যক্তিবাদ এর প্রচুর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। তাই হাজার হাজার বছর আগেকার তত্ত্ব যখন বিজ্ঞানী ডারউইন মাত্র কয়েক বছর আগে লিপিবদ্ধ করলেন_ তখন সহজেই এটা মানতে হয় যে, তিনি আর্য ঋষিদের কাছে এ ব্যাপারে ঋণী! দশাবতার স্তোত্রের শুরুতেই বলা হয়েছে_ “প্রলয় পয়োধি জলে….” অর্থাৎ যখন পৃথিবী জলমগ্ন ছিল, তখন “মীন” শরীর ধারণ করে বিষ্ণু_আদিপিতা মনু এবং সমস্ত সৃষ্টির বীজ কে রক্ষা করেন। এবার কথা হচ্ছে, বর্তমান বিজ্ঞানীরাও বলছেন_ সৃষ্টির প্রারম্ভে পৃথিবী জলমগ্ন ছিল, কোথাও ভূমি ছিলনা, ধীরে ধীরে ভূমির সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে জলেই যে প্রথম প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল এবং পরে ভূচর-দের সৃষ্টি হয়__একথা ভারতীয় শাস্ত্রাদিতেও উল্লেখ রয়েছে আবার আধুনিক বিজ্ঞান ও সেই কথাই বলছে। পৌরাণিক আখ্যানটিতে রয়েছে_ প্রথম অবতার “মীন” অর্থাৎ মৎস্য! সেইসময় যে সকল জলজ জীব সৃষ্টি হয়েছিল_ তাদের মধ্যে Survival of the fittest_ ছিল ‘মীন’! তাই এই প্রজাতির totem-কে “অবতার”-হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। ডারউইন বলেছে_struggle for existence, survival of the fittest এবং natural selection-এর কথা! এর মধ্যে important হচ্ছে survival of the fittest। জীবন-সংগ্রামে যে টিকতে পারে, সেই তো survive করতে পারবে। একে বাংলায় বলা হচ্ছে “যোগ্যতমের উদবর্তন”। ঋষিরা জেনেছিলেন যে, সৃষ্টির প্রথমদিকে_ জলচর প্রাণীদের মধ্যে “যোগ্যতম” ছিল মীন,_ তাই জীব-বিবর্তন বোঝাতে ঋষিরা রূপকাকারে অবতারতত্ত্বের অবতারণা করলেন এবং প্রথম অবতাররূপে নির্ধারণ করলেন _মীনাবতার বা মৎস্যাবতারকে!
এরপর ঋষিরা দ্বিতীয় স্থানে বর্ণনা করলেন কূর্মাবতারের রূপ।কূর্ম কেন_ কারণ যখন প্রথম ভূমি সৃষ্টি হল তা দেখতে ছিল অনেকটা কূর্মপৃষ্ঠের ন্যায়। আর উভচর প্রাণীদের মধ্যে কচ্ছপ-ই অল্প সময়ের জন্য স্থলভাগ এবং অধিকাংশ সময় জলভাগ_এই দুই জায়গাতেই survive করতে পারে ! সেই সময় সৃষ্ট অনেক প্রাণীই হয়তো স্থল এবং জলে বসবাস করতে পারতো কিন্তু তাদের সকলের মধ্যে কূর্মই fittest!_ তাই ঋষিরা বললেন_ “কূর্মাবতার”!
এরপরের অবতার “বরাহ”! তখন বেশ কিছু ভূভাগ সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু সেই অংশ ছিল কর্দমাক্ত। এইঅবস্থায় স্থলচর প্রাণীদের মধ্যে survive করার মধ্যে একমাত্র প্রাণী এরাই! পৃথিবীর স্থলভাগকে দাঁত দিয়ে বিদীর্ণ করে(প্রথম কর্ষন) মাটিকে প্লান্টেশন এর উপযোগী করে তুলেছিল বরাহরাই! পরবর্তীকালের সমস্ত ধরনের প্রাণীদের জীবনধারণে এদের ভূমিকা অপরিসীম__ এইজন্যই ঋষিরা বললেন_ “বরাহ অবতার”!
এরপর হচ্ছে তোমার জিজ্ঞাসিত “নরসিংহ অবতার”_ অর্থাৎ যার অর্ধেক অংশ সিংহ, অর্ধেক মানুষ! ঋষিদের এক একটা অবতার-কল্পনা, যেন বিবর্তনের এক-একটা turning point! এইজন্যেই Horizontal_ভাবে অবস্থানকারী মধ্যবর্তী অন্যান্য পশুদের কাউকেই “অবতারে”-র মর্যাদা দেওয়া হলো না! বিবর্তনের ধারায় জীব যখন প্রথম vertical বা উলম্ব হোল অর্থাৎ Homo-Habilis(পশু মানব) অবস্থাকেই ঋষিরা “নরসিংহ অবতার” আখ্যা দিলেন। Homo-Erectus মিশরের পিরামিডের সঙ্গে যে স্ফিংস-এর মূর্তি আছে তাতেও এই ধরনের ভাবনার ছাপ পাওয়া যায়। যাইহোক, নরসিংহ অবতার অর্থাৎ পশু মানব, বিবর্তনের ধারায় এরাই প্রথম জীব, যারা খাড়া হয়ে দাঁড়ালো! আর প্রকৃতপক্ষে, তখন থেকেই মস্তিষ্ককোষের দ্রুত বিকাশ শুরু হয়েছিলো। এটাই নরসিংহ অবতারের মূর্তির রহস্য!
এইভাবে এর পরবর্তী অবতারের কল্পনাগুলিও জীব-বিবর্তনের ক্রমবিকাশের টোটেম!
যেখানে ‘পরশুরাম’_অস্ত্রব্যবহারকারী মানবগোষ্ঠীর, ‘রাম’_আরো উন্নত সমাজব্যবস্থার, ‘বলরাম’_কৃষিজীবি মানবগোষ্ঠীর টটেম্ হিসাবে দেখানো হয়েছে। সম্পূর্ণ-মানবকে বুদ্ধ বা জ্ঞানী বলা হয়_ তাই সভ্য-মানবের চূড়ান্ত রূপ বোঝাতে_ বুদ্ধাবতার!
যাইহোক, আশা করি তোমার জিজ্ঞাসার উত্তর পেয়েছ! এবার বিশ্বাসের কথা যদি বলো_ তবে বলতে হয়, কোন কিছু না জানলে অর্থাৎ বোধ না করলে__ ঠিক ঠিক বিশ্বাস হয়না! আর সাধারণত লোকে যে বলে আমার “ওটায় বিশ্বাস”- “সেটায় বিশ্বাস”, এগুলো ঠিক ঠিক বিশ্বাস নয়! কারণ, একটু আঘাত লাগলেই সে বিশ্বাস টেকে না_আসে অবিশ্বাস! তাই বলছিলাম_ একমাত্র উপলব্ধি হলে বা বোধ হলে__ হয় বিশ্বাস! অন্যথায় “বিশ্বাস”_ একটা কথার কথা!!
জিজ্ঞাসু:– আচ্ছা Homo-Habilis-এর সময় তো কোন মানুষ ছিল না! তবু, আর্য বিজ্ঞানীরা পরবর্তীকালে এই সব মূর্তির কল্পনা বা আবিষ্কার করলেন কি করে?
গুরুজী:– যে কোনো আবিষ্কার তা বৈজ্ঞানিক হোক আর ভৌগোলিক বা সামাজিক ই হোক তা তো প্রকৃতিতেই ছিল! নিউটন মহাকর্ষ ,অভিকর্ষ _এইসব নানা তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন। তাই বলে কি অভিকর্ষ বল, মহাকর্ষ বল_ আগে ছিল না? এরকমটাই সব ক্ষেত্রে হয় জানবে! যে কোন রহস্যের সমাধানসমূহ মানুষের অন্তঃকরণেই থাকে, শুধু গভীর চিন্তা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তা আবিষ্কারের রূপ নেয়! কোন জিনিসের অস্তিত্ব যদি প্রকৃতিতে একেবারেই না থেকে থাকে_ তাহলে তার তো কল্পনাই করা যাবেনা! তাহলে আবিষ্কার টা হবে কি করে? পূর্ব পূর্ব ঘটনাসমুহের একটা impression মানুষের অন্তঃকরণের মধ্যে থেকে যায়, যা জন্ম-জন্মান্তরের মধ্যে দিয়ে পরিবাহিত হয় পরবর্তী প্রজন্মগুলিতে! দ্যাখো না, “হাঁসজারু”- “বকচ্ছপ”_ এগুলোকে বলা হয়, সুকুমার রায়ের আজগুবি সৃষ্টি শব্দমালা! কিন্তু এখানেও_ হাঁস এবং সজারু অথবা বক এবং কচ্ছপ ইত্যাদি পৃথক পৃথক দুটি প্রাণীর সমন্বয় করা হয়েছে।যে প্রানীগুলি বাস্তবে রয়েছে! আজগুবি কল্পনা একটাও হয়না, যদি কোথাও হয়ে থাকে_ তাহলেও জানবে সত্যি-সত্যিই প্রকৃতিতে সেই ধরনের কোন প্রাণী পূর্বে কোনসময় ছিল অথবা পরে হবে! অন্যথায় ‘কল্পনা’_ হবে কি করে? ‘কল্পনা’র উপর ভিত্তি করে কখনও ‘কল্পনা’ করা যায় না_ সত্যের ওপর ভিত্তি করেই ‘কল্পনা’ করতে হয়! এখনকার বিজ্ঞানীরা জীবাশ্ম থেকে বিভিন্ন “মিসিং লিঙ্ক”– প্রাণীদের সন্ধান পেয়েছেন, যারা ভিন্ন দুটি প্রজাতিরপ্রাণীদের মধ্যবর্তী এবং এদের অনেকেই প্রকৃতি থেকে বহু আগে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। সুতরাং আর্য ঋষিদের উপলব্ধি সমূহকে কল্পনা মনে করোনা_ সেগুলি সব সত্য! বর্তমান বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন আবিষ্কার সেই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করছে মাত্র!
জিজ্ঞাসু:— এখনো কি ‘সত্য’ উপলব্ধি করা যায়? আর যদি যায় সেই সত্যকে জানার উপায় কি?
গুরুজী:– সত্যকে উপলব্ধি করাই মানবজীবনের উদ্দেশ্য। প্রত্যেককেই ঐ ‘সত্য’-কে বোধে বোধ করতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি তা করা যায় ততই জীবের পক্ষে মঙ্গল। তোমাদেরকে সেই “পান ওয়ালার গল্প”_ বলেছিলাম, মনে আছে তো?_ এক পানওয়ালা দুপুরবেলায় দোকান খোলা রেখেই ঘুমাচ্ছিল! একজন ব্যক্তি দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল যে, অনেক খরিদ্দার এসে দোকানদারকে ঘুমন্ত দেখে ফিরে যাচ্ছে । এটা দেখে সেই উৎসাহী ব্যক্তি চেঁচামেচি করে দোকানদারের ঘুম ভাঙিয়ে বলল,_ “আপনার তো আচ্ছা আক্কেল মশাই! কত খরিদ্দার এসে ফিরে যাচ্ছে, আর আপনি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন?” জানেন না খরিদ্দার লক্ষী!”
দোকানদারের তখন সদ্য ঘুমভাঙ্গা অবস্থা_ তাই সে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বললো, “তাইতো_ তাহলে মশাই! আমার এখন কি করা উচিত?”
লোকটি বলল,_ “আপনার মন দিয়ে ব্যবসা করা উচিত! খরিদ্দার ফিরিয়ে না দিয়ে আরো বিক্রি বাড়াতে হবে, তবে তো ব্যবসায় লাভ হবে!”
দোকানদার আবার জিজ্ঞাসা করল, “তা তো হবে, কিন্তু তখন কি করব?”
লোকটি উত্তর দিল, ” তখন আর কি করবেন_ লোকের টাকা হলে যা করে আপনিও তাই করবেন! বাড়ি কিনবেন, গাড়ি কিনবেন, ভালো ভালো ফার্নিচার অর্থাৎ দামি খাট-বিছানা, আলমারি,ফ্রীজ_এইসব কিনবেন।”
দোকানদার তখন আবার জিজ্ঞাসা করল, “তা সবই না হয় হল, কিন্তু এরপর কি করব?”
সহৃদয় অতি উৎসাহী ব্যক্তিটি এবার বিরক্তির সঙ্গে উত্তর দিল, “এরপর কি করবেন, তাও আমাকে বলে দিতে হবে? একবার ধনী হয়ে গেলে তখন কি আপনাকে খাটতে হবে_ তখন নাকে তেল দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন!”
দোকানদার টি তখন মৃদু হেসে উত্তর দিল,_ “দূর মশাই! আমি তো ঐ কম্মো-ই করছিলাম!”_ এই বলে সে আবার পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমাতে লাগল। উৎসাহী ব্যক্তিটি ওই পানওয়ালা কে বোকা-হাঁদা ভেবে সরে পড়ল।
এবার গল্পের তাৎপর্যটা বলছি শোন__ মানবজীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্যটি যদি জানা হয়ে থাকে তাহলে আর নানা ঝামেলা পোহানোর প্রয়োজন টা কি?তখন সে তো যেন-তেন প্রকারেণ ওই উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই কাজে লেগে যাবে! এর আবার এখন তখন কি আছে? সব যুগে বা সবকালেই এটা সম্ভব! আমি এই জন্যই সবাইকে বলি_যে যখন থেকে এই “সত্য” বুঝতে পারবে, সে তখন থেকেই কাজে লেগে যাও! বয়স কম-বেশি ইত্যাদি কোন ফ্যাক্টর নয়_ জাগতিক বয়স দিয়ে ‘আধ্যাত্মিক বয়স’- বিচার হয় না !অনেকেরই দেখা যায় পাকা চুল দাড়ি, কিন্তু আধ্যাত্মিক জগতে সে হয়তো শিশু, আবার এমনও আছে জাগতিক দৃষ্টিতে কম বয়সী বা শিশু, কিন্তু আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে সে অনেক senior! এগুলি পূর্ব-পূর্বজীবনের সংস্কারের ওপর নির্ভর করে ! যাদের সংস্কার ভালো, তারা ছোট থেকেই অধ্যাত্মজীবনে প্রবেশ করে, আর যাদের সংস্কারে বিষয়ভোগের তীব্র বাসনা, তারা বৃদ্ধ বয়সেও সংসারের মায়া ত্যাগ করতে পারে না। মৃত্যুকালেও ওই চিন্তানিয়েই মরে! “যাদৃশী যস্য ভাবনা, সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী”_ গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই কথা বলেছেন! ফলে আবার নতুন করে জন্ম নিয়ে তাদেরকে নানান ভোগ ও ভোগান্তির শিকার হোতে হয়।
তাই, আগে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য স্থির করে নিয়ে অবিচলভাবে_ নিষ্ঠা সহকারে সেই পথে চললে মানবের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়।চলার পথে, দৃশ্য অথবা অদৃশ্যভাবে নানা সাহায্যও লাভ হয়! আর তখনই জানতে পারা যায়_ পরমেশ্বরের কি অপার মহিমা!!
জিজ্ঞাসু:–কিন্ত পূর্বজীবনের সংস্কার কেমন_তা এই জন্মে জানবো কি করে ?
গুরুজী:– জন্ম, জীবনকাল এবং মৃত্যু_ এই তিনটি নিয়েই তো একটা জীবন! এখানে জীবিত অবস্থাটা মনে করো স্মৃতি,আর মৃত্যুটা বিস্মৃতি,এইভাবে জন্ম-জন্মান্তর ধরে স্মৃতি এবং বিস্মৃতির _পরপর ধারা চলে আসছে! তাই একটা জীবনের স্মৃতি পরবর্তী জীবনে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! কিন্তু যাদুকরের দড়ির ফাঁস লাগানো খেলায় _যেমন একটা টানেই অনেক গিঁট খুলে দড়িটা সরল হয়ে যায়, তেমনি এক্ষেত্রেও গুরুর কাছে রহস্যটি শিখে নিতে পারলে একদিন দেখা যায় সমস্ত বিস্মৃতির গিঁট খুলে বেরিয়ে গেছে__ পড়ে আছে শুধু স্মৃতি, স্মৃতি, আর স্মৃতি! তখন শুধু পূর্বজন্ম কেন_ পূর্বাপূর্ব সমস্ত জীবনের স্মৃতি চোখের সামনে জাজ্জ্বল্যমান হয়ে ওঠে।ঋষিরা সাধনার গভীরে ডুব দিয়ে এইসব কৌশল রপ্ত করেছিলেন এবং সেই সব বিদ্যা উত্তরসূরীদের জন্য রেখে গেছেন যা গুরু পরম্পরায় মানব কল্যাণের জন্য আজও বাহিত হয়ে আসছে! এর পিছনে তাঁদের কত আত্মত্যাগ লুকিয়ে আছে_ সাধারণ মানুষ কি তার হিসাব রাখে? এক একটা রহস্য উদঘাটন করার জন্য কত সাধকের শরীর ‘পাত’ হয়ে গেছে, তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আবার উত্তরসূরীরা শুরু করেছেন সাধনা! এই ভাবে কয়েক পুরুষের প্রাণপাত সাধনায় হয়তো কোন একটি রহস্যের উদঘাটন হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা তা মানব কল্যাণের নিমিত্তে তাদের শিষ্যদের কাছে সেগুলি বলে গেছেন! বৈদিক যুগে এইভাবে শ্রুতি পরম্পরাতে শিক্ষা দেওয়া হতো, যা অনেক পরে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন বেদব্যাস। কোন বিশেষ পুরুষ বেদ সৃষ্টি করেননি বলেই বেদকে বলা হয় “অপৌরুষেয়”! কোন বিশেষ একজনের বক্তব্য বা সৃষ্টি নয় এজন্যই “ঋষিরা বেদের প্রবক্তা”_ এই কথা বলা হয়, কোন একজন বিশেষ ব্যক্তি সৃষ্টি করেছেন তা বলা হয় না!
সে যাইহোক, তোরা তো এসব কথা শুনছিস _এবার তোরা ঋষিদের নির্দেশিত পথ গ্রহণ করে, এগিয়ে চল্ পূর্ণতার দিকে! চলা শুরু করলেই দেখবি ভালো-মন্দ সংস্কারের পাহাড় যেন _’তুলোর পাহাড়’- হয়ে কোথায় উড়ে যাবে!!