সময়;-নভেম্বর,88.
উপস্থিত ব্যক্তিগণ;–পূর্নানন্দ মহারাজ ও রায়নার ভক্তবৃন্দ।
জিজ্ঞাসু:— আপনি আধ্যাত্মিক সুখ-দুঃখের কথা বলছিলেন কিন্তু মানুষের আধিদৈবিক ক্লেশ বা আধিভৌতিক রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি তো আগের তুলনায় এখন অনেক বেড়ে গেছে। তাই নয় কি?
গুরু মহারাজ:– এর কারণ মানুষ artificial হচ্ছে সহজতা বা naturality ছেড়ে মানুষ যতই কৃত্রিম হবে বা কৃত্রিমতা অবলম্বন করবে ততই তার ক্লেশ বাড়বে। এখন কথা হচ্ছে, আধিদৈবিক অর্থাৎ মনের ব্যাধি এবং আধিভৌতিক অর্থাৎ দেহের ব্যাধি কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বাংলায় একটা কথা আছে_ ‘আগে মনের কুষ্ঠ, তারপর দেহের কুষ্ঠ’! কথাটা ঠিক! মনোকুন্ডয়ন থেকেই দেহের কুষ্ঠ হয়। মানুষের মন যত লোভ-মোহ আদি রিপূগনের বশীভূত হবে ততই মন অসুস্থ হবে আর অসুস্থ মন-ই দেহের ব্যাধি সমূহের একমাত্র কারণ! তবে অবশ্য অ্যাকিউট প্রবলেমের(acute problem) কথা আলাদা! সেগুলো ‘ব্যাধি’ হিসেবে গণ্য নয়!
যাইহোক, বর্তমানে তুমি যে ব্যাধির প্রকোপ বেশি দেখছো_ এর কারণ এক কথায় বলতে গেলে বলা যায়, এটি কামনা-বাসনার প্রতি মানুষের অত্যন্ত আকর্ষণ বাড়ার ফল! কিন্তু কথা হচ্ছে এই যে, ত্রিবিধ ক্লেশ, এটা সবকালে-সবযুগেই মানুষের সমাজে ছিল! আর তা এখনো আছে, পরেও থাকবে! তবে কোনো কোনো সময়,কোন কোন মানুষের জীবনে_ এদের কোনটার হয়তো বেশি প্রকাশ ঘটতে পারে। মনের ব্যাপারটা বর্তমান দেহবাদীরা মানতে চায় না, অবশ্য জানে না বলেই মানতে চায় না! আমি এই ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দিচ্ছি_ ব্যাখ্যাটা হয়তো তোমরা সবাই মানবে।দ্যাখো, মনকে বলা হয় ইন্দ্রিয় গণের রাজা, আর রিপুসমুহ ইন্দ্রিয়দের অবলম্বন করেই তাদের ক্রিয়া করে থাকে। এবার যে ব্যক্তি যত উচ্ছৃংখল, যত অসংযমী_ তার দেহের অন্তক্ষরা গ্রন্থি থেকে তত বেশি থাইরক্সিন জাতীয় হরমোন নিঃসৃত হয়_ কারণ তাদের ইন্দ্রিয়সকল সহজতা হারিয়ে অকারণ বেশিমাত্রায় ক্রিয়াশীল হয়! আবার বেশি মাত্রায় অন্তক্ষরা গ্রন্থি থেকে ঐ জাতীয় হরমোনগুলি নিঃসরণ হলে মানুষের ইমিউনিটি পাওয়ার(immunity power) কমে যায়_ ফলে শরীর ব্যাধিগ্রস্থ হয়!
তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে মানুষের শরীর ব্যাধিমুক্ত করতে গেলে তাকে অযথা অন্তক্ষরা গ্রন্থি থেকে থাইরক্সিন জাতীয় হরমোন নিঃসরণ কমাতে হবে, অর্থাৎ তাকে সংযমী ও সুশৃংখল হতে হবে। এটা আবার তখনই সম্ভব হবে_যখন সেই ব্যক্তির মন সুস্থ ও শান্ত হবে! এখন তোমরা পুনরায় জিজ্ঞাসা করতে পারো_ ‘মন কি কৌশলে শান্ত হয়?’ তার উত্তরে বলা যায়, ‘মন শান্ত হবে_ প্রাণ স্থির হলে!’ বেদান্তে তাই প্রাণিবিদ্যা-কে অত্যন্ত মর্যাদা দেওয়া হয়েছে! প্রাণায়াম এর সাহায্যে প্রাণকে স্থির করার কৌশল গুরুর কাছে শিখে নিতে হয়_ এরপর এইসব শিক্ষা জীবনে আচরণ করতে শুরু করলেই ধীরে ধীরে সুফল পাওয়া যায়।
জিজ্ঞাসু:– এই ব্যাপারটি যদি আরেকটু detail-এ বলেন তো ভালো হয়?
গুরু মহারাজ:– দ্যাখো, শাস্ত্রে আছে ঔষধি-রসায়ন ও প্রাণায়াম এই ত্রিবিধ প্রয়োগ বিধির কথা যা মানব শরীরের যাবতীয় রোগ-ব্যাধির নিদান! এখানে ‘ঔষধি’ বলতে_ ভেষজ ও জান্তব অর্থাৎ গাছ-গাছড়া থেকে প্রাপ্ত এবং জীবজন্তুর শরীর থেকে প্রাপ্ত ঔষধ সমুহ! ‘রসায়ন’ হোল_বিভিন্ন মৌলিক বা যৌগিক পদার্থ থেকে উৎপন্ন লবনাদি,যা বর্তমানে হোমিওপ্যাথিক এবং বায়োকেমিক ঔষধ হিসাবে পাওয়া যায়। বাকি থাকল ‘প্রাণায়াম’_ যার কথা একটু আগে বলছিলাম, উপযুক্ত গুরুর কাছ থেকে প্রানায়াম শিখে নিয়ে অভ্যাস করতে হয়। এইসব গুলির যথাযথ প্রয়োগ হলে তবেই ত্রিবিধ ক্লেশ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ।
জিজ্ঞাসু:– ঔষধি সম্বন্ধে কি বলছিলেন_যদি একটু বিস্তারিত বলেন?
গুরু মহারাজ:– ‘ঔষধি’, দেহে প্রকটিত বাহ্য রোগসমূহের নিরাময়ে সাহায্য করে। কিন্তু এটা মনে রাখবে, ঔষধ সেবনে চিরস্থায়ী রোগমুক্তি কখনোই ঘটতে পারে না_ তা সে যে ভাবেই প্রস্তুত করা ঔষধ হোকনা কেন! দ্যাখোনা, বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞান উন্নত হয়েছে বলে দাবি করা হয়, কিন্তু এমন কোন ঔষধ কি আবিষ্কার হয়েছে_ যা ব্যবহার করলে, মানুষের জীবনে আর কখনোই কোনো রোগ-ব্যাধি হবে না! অবশ্য এটাও ঠিক যে, এই ধরনের কোন আবিস্কার হওয়াটা সম্ভবও নয়! তাই ঔষধ প্রয়োগে রোগ-নিরাময়ের চেষ্টা নিশ্চয়ই করতে হবে কিন্তু সেই সঙ্গে রোগ ব্যাধি হওয়ার পিছনে আসল কারণটি কি অর্থাৎ root-টাকে খুঁজে বের করতে হবে। আর সেটি খুঁজে পেলেই অর্থাৎ রোগব্যাধি সৃষ্টির কারণ গুলি শরীরে ও মনে প্রবেশ করতে না দিলেই_ শরীর ব্যাধিমুক্ত হবে! একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি_ বর্তমানে গঙ্গা দূষণ রোধে কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন প্রজেক্ট হয়েছে, কিন্তু এসব সত্ত্বেও গঙ্গা কি একেবারে দূষণমুক্ত হয়েছে? এবার দ্যাখো_ যদি এমন কোন ব্যবস্থা করা যায় যাতে কোনরকম দূষিত পদার্থ গঙ্গাতে ফেলা হবে না_ তাহলে আপনা-আপনি গঙ্গা শুদ্ধ হয়ে যাবে,সবসময় পরিশ্রুত থাকবে। যেখানে দূষণের সঙ্গে গঙ্গার কোন সম্বন্ধ-ই নাই, সেখানে দূষণ মুক্তির কোন চেষ্টার প্রয়োজনও নাই_তাই না! এখানেও ব্যাপারটা সেইরকমই হয়। সে যাইহোক, ভারতীয় ঋষিরাও প্রাচীনকালে ঔষধ নিয়ে গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন,যা “আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা” নামে পরিচিত! এখানে জেনে রাখা ভালো যে, বর্তমান এলোপ্যাথিক ওষুধ কিন্তু প্রাচীন আয়ুর্বেদিক ওষুধের অনুকরণে তৈরি করা হয়। কিন্তু ওষুধের প্রসেসিং(processing)-এ আয়ুর্বেদিক এর নিয়ম মানতে না পারার জন্যই এলোপ্যাথিক ঔষধের গুণগতমান অতটা উচ্চ মানের হয় না। তাছাড়া এলোপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগের ফলে বিভিন্ন সাইডএফেক্ট(side-effect) দেখা যায়! আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুজন প্রাচীন গবেষক ছিলেন চরক ও শুশ্রুত। তাঁদের প্রণীত গ্রন্থে বিভিন্ন গাছ-গাছড়া থেকে প্রাপ্ত ঔষধ প্রস্তুতির যে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির উল্লেখ রয়েছে তা জানতে পারলে আজও মানুষকে অবাক হতে হয়! এছাড়া সার্জারির ব্যাপারেও তাদের গবেষণা ছিল নিখুঁত! জীবক, ধন্বন্তরি এঁরাও ছিলেন এই পরম্পরার সুযোগ্য উত্তরসূরি। কিন্তু পরবর্তীকালে সমাজব্যবস্থার ধাঁচ পাল্টানোর সাথে সাথে চিকিৎসকদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়ে গেছে ফলে যোগ্য আয়ুর্বেদাচার্যের অভাবে এই বিজ্ঞান চর্চা অবহেলিত হয়ে পড়ে, তাছাড়া বারবার বিদেশীদের আক্রমণের ফলে এই শিক্ষার পরম্পরাও চালু রাখা যায়নি। কিন্তু বর্তমানে আবার নতুন করে মানুষের চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার প্রতি পৃথিবীর মানুষের শ্রদ্ধা বাড়ছে_ ফলে অচিরেই দেখবে এই চিকিৎসাবিদ্যার যোগ্য আচার্য এসে যাবেন সমাজে । যাঁরা মানবকল্যাণের নিমিত্তেই এই বিদ্যাকে কাজে লাগাবেন _অর্থোপার্জনের জন্য নয়! কারণ পৃথিবীতে কখনোই কোন বিদ্যা একেবারে অবলুপ্ত হয় না, হয়তো উপযুক্ত ক্ষেত্রের অভাবে সেটি ক্রিয়াশীল হতে পারেনা _ এইমাত্র!Field প্রস্তুত হয়ে গেলেই _ সেখান থেকে আবার কাজ শুরু হয়ে যাবে!
ব্যাপারটা কি রকম হয় জানো তো, প্রকৃতিতে যেমন রোগ বা রোগজীবাণু সকল আছে_ তেমনি এর প্রতিবিধানও প্রকৃতিতেই আছে। শুধু খুঁজে পাওয়ার জন্যই গবেষণা! আমি দু-একটি এমন উদাহরণের উল্লেখ করছি_ জাম পাতার রস খেলে আমাশয় ভাল হয়ে যায়_ এমনকি রক্ত আমাশয়ও ওতেই ভালো হয়ে যাবে। ব্রাহ্মী পাতার রস নাকে কয়েক ফোঁটা ড্রপ(drop) নিলে বহুদিনের পুরনো মৃগী রোগও সেরে যায়! খইদই নামে একটা ছোট গাছ গ্রামেগঞ্জে প্রাকৃতিকডভাবেই হয়, গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলার সময় যার পাতা তুলে,একটু ছেঁচে নিয়ে ঐ পাতার রস দিয়ে দই পাতে! কারণ কিছুক্ষণ রাখলেই ঐ পাতার রস,দই-এর মতো জমে যায়! এই রস কয়েকদিন খেলে মেয়েদের লিউকোরিয়া(leucorrhoea) রোগ ভালো হয়ে যায়। এরকম সাধারণ গাছ,যেগুলি হাতের কাছেই রয়েছে,অথচ দুরারোগ্য ব্যাধি সমূহের একেবারে অব্যর্থ ঔষধ! শুধুমাত্র জানা না থাকায় আমরা অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ খেতে বাধ্য হই এবং কষ্ট পাই। আয়ুর্বেদিক ওষুধের সাথে কিছু আনুসঙ্গিক উপাদান যুক্ত হওয়ায় এই ঔষধ,পথ্যের স্থান নিয়েছে । সেই অর্থে_ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় রোগমুক্তির সাথে সাথে শরীরের পুষ্টিও অক্ষুন্ন থাকে।।
জিজ্ঞাসু:– মহাভারত পড়ে দেখেছি_ ওখানে অনেকক্ষেত্রেই ‘ক্ষেত্রজ সন্তান’– উৎপাদনের কাহিনী রয়েছে। এই ধরনের ভ্রষ্টাচারকে সে যুগে কেন স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল?
গুরুমহারাজ:– আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তোমার ‘ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন’_ব্যাপারটাকে ভ্রষ্টাচার মনে হচ্ছে কিন্তু সে যুগে যে সমাজব্যবস্থা ছিল-সমাজের যে নীতি ছিল, তাতে এই ঘটনা ভ্রষ্টাচার বলে গণ্য ছিল না! আর ছিলনা বলেই তো সেগুলিকে শুধু স্বীকৃতিই নয়_ গৌরবময় ঘটনার পর্যায়ে স্থান দেওয়া হয়েছে! স্থান-কাল-পাত্র তিনটি ফ্যাক্টর(factor) আছে_ এটা মনে রেখো! বর্তমানকালের কিছু ঘটনাই দ্যাখো না_ ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত রাষ্ট্রগুলিতে স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্কের স্বাধীনতা দেখে তোমার ‘চরম উচ্ছৃংখলতা’_ মনে হতে পারে, যেহেতু এখানকার সমাজে ওই ধরনের আচরণ অবৈধ। কিন্তু ওই দেশগুলিতে সেগুলি স্বাভাবিক আচরণ বলেই গণ্য হয়!
আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগেকার কোন ঘটনা বা সামাজিক নিয়ম মহাভারতে লিপিবদ্ধ আছে_ তুমি কি করে আজকের সমাজের সঙ্গে সেইযুগের সমাজনীতির হুবহু মিল পাবে ? তোমার এই ধরনের ভাবনাটা ভুল হচ্ছে না কি? তবে,সমাজ-বিশেষজ্ঞদের ধারণা_ সে যুগের মানুষেরা, মানসিকতার দিক থেকে আজকের মানুষের থেকেও উদার ছিল ! নারীদের সতীত্ব রক্ষার দোহাই দিয়ে তাদের শুধু হেঁসেল ঘরে এবং আঁতুড়ঘরে আবদ্ধ না রেখে_ তারা সমাজের স্বার্থে বিভিন্ন মনীষীদের দ্বারা তাদের নিজের স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করাতেন! কতটা উদার এবং সমাজ সচেতন ছিলেন তারা_সেটা কি বুঝতে পারছো! এসব থেকে উদাহরণ নিয়ে,বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই_ প্রথম বিশ্বের দেশগুলি Sperm-Bank তৈরি করেছে অর্থাৎ সমাজের ক্রিম(cream) বা বিখ্যাত ব্যক্তিরা যেমন_ বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ, দৈহিক বা মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষ ইত্যাদিদের Sperm নিয়ে, শিক্ষায়-দীক্ষায় উন্নত মহিলাদের গর্ভে সেগুলি প্রবেশ করিয়ে__ গর্ভ উৎপাদনের চেষ্টা চলছে! যাতে করে উন্নত মেধার সন্তান সৃষ্টি হয়! আমেরিকার(USA) এই গবেষণার প্রথম ব্যাচের ছেলেমেয়েদের বর্তমান বয়স প্রায় 8/9 বছর হবে(1994 সাল)। এবার এরা যদি পরবর্তীকালে এক একটা দিকপাল হয়ে ওঠে_ তখন কি মানুষ এই পদ্ধতিকে ‘ভ্রষ্টাচার’ বলে ঘৃণা করবে, না welcome জানাবে?
সেইজন্য বাবা__ প্রাচীন শাস্ত্রসমূহকে বিচার করতে গেলে, কখনই সমকালীন দৃষ্টিতে এবং একপেশে দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখলে_ সঠিক বিচার হয়না! সামগ্রিকভাবে এবং নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে হয়! কিন্তু এখন দেখছি_ কিছু শিক্ষিত মানুষের মনে ভারতীয় শাস্ত্রগুলিকে_ “যেন তেন প্রকারেন” হেয় করার একটা মানসিকতা জন্মে গিয়েছে। কিন্তু তাতে কি লাভ? কালের বুকে যে সব দৃষ্টান্ত দীর্ঘস্থায়ী আঁচড় কেটে রেখেদিয়েছে, তাকে সমালোচনা করে কি ছোট করা যায় ? তার চেয়ে বরং তোমরাই দৃষ্টান্ত হও ! এইটাই তো সঠিক পথ! তাই নয় কি! তোমরা সৎ হও, সুন্দর হও এবং সুন্দরভাবে জীবনকে গড়ে তুলে তোমরাই এক একটা দৃষ্টান্ত হও_স্বামী পরমানন্দ এটাই চায়!
জিজ্ঞাসু:– আপনি ঠিক অংকের সমাধান করার মত সুন্দর ভাবে উত্তর সাজিয়ে সাজিয়ে বলেন!
গুরু মহারাজ:– তাই নাকি! তবে জানো, আমি কিন্তু আমি অংক জানিনা_ ছোটবেলায় শেখার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু শেখা হয়নি! তোমরা আমার কথা শুনে হাসছো_ আমি কিন্তু সত্যি কথা বলছি! প্রথম থেকেই দেখেছি আমার বিয়োগ বা ভাগ হয় না_ আর যোগ করে গুন করতে গিয়ে দেখলাম ইনফিনিটি(infinity) হয়ে গেল ! কেমন মজার ব্যাপার বলতো! তারপর ঠিক করলাম অংক বিষয়টা যখন এতই গোলমেলে_ তখন অঙ্ক শিখে আর কাজ নেই!
****** ********** ********** *******
স্থান:– শিবপুর রাধাকান্ত মন্দির
সময়:– 1988,
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:– গঙ্গাবাবু, রমেশ দত্ত, সব্যসাচী মান্না প্রমুখেরা!
জিজ্ঞাসু (একজন প্রবীন ব্যক্তি):—এখনকার ছেলেমেয়েরা বড়ই দুর্বিনীত, তাই আমার মনে হয় আমাদের সময়টাই, এখনকার চাইতে অনেক ভাল ছিল!
গুরু মহারাজ:–তাই নাকি! কিন্তু আমি এই বর্তমান কালের খারাপ কিছু দেখিনা! ভালো-মন্দ থাকবেই, এটা সব যুগেই থাকে। আপনি যে যুগের কথা বলছেন অর্থাৎ আপনার কৈশোর বা যৌবনের সময়__ সে যুগেও ভালো-মন্দ সবই ছিল, এখনও আছে! কিন্তু আপনি যেমন নাক উঁচু করে একতরফা আপনাদের সময়ের(ভদ্রলোকের বয়স যদি 70-হয়, তাহলে আরও 50-60 বছর আগে, অর্থাৎ 1920-25 খ্রীষ্টাব্দ হতে পারে) প্রশংসা করছেন_ তার পিছনে আপনার কোন স্ট্রং(strong) যুক্তি আছে বলে আমার মনে হয় না! আপনাদের সময় বলতে_ আপনি যখন যুবক ছিলেন সেই সময়কার কথা বলছেন তো ! আচ্ছা_ আমি ওই সময়কার একটা ঘটনার কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি ইংরেজ শাসনাধীন সেই সময়ে একবার এই বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়েছিল এবং তাতে বহু মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিল! এটা ছিল ইংরেজদের সৃষ্টি করা দুর্ভিক্ষ! ইংরেজরা হাজার হাজার মন খাদ্যশস্য বিভিন্ন স্থানে মজুদ করে রেখেছিল_বাজারে আসতেই দেয় নি! তাদের দু-একটা গোডাউন আপনাদের এই শিবপুর অঞ্চলেই গঙ্গার ধারের দিকে ছিল! এখন বলুন তো_ অসহায় দেশবাসীর কথা ভেবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘তরুন বা যুবক আপনি’_ তখন কি কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন? আপনার নিজের বাড়িতে নিশ্চয়ই তখন কোন অন্নকষ্ট ছিল না_ আপনার পূর্বসূরিরা হয়তো ইংরেজদের অনুগতও ছিল, তাই তাদের অনুগ্রহে আপনাদের পরিবারে দুর্ভিক্ষের কোন আঁচ-ই লাগে নি। ফলে দেশের জন্য বা দেশবাসীর জন্য ভাবার প্রয়োজন আপনি বা আপনার পরিবারের লোকেরা সে সময় অনুভব করেন নি! পরবর্তীতেও পরাধীন মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য আপনার কি ভূমিকা ছিল_ বলুন? সম্ভবত, একটুও না! দেখুন_নিজেই নিজেকে ভালো ভেবে বসে থাকলে_ কি ভালো হওয়া যায়? সেই সময়সত্যিকারের যারা ভালো ছিল, তারা দেশের জন্য-দেশবাসীর জন্য প্রাণ দিয়েছে, লড়াই করেছে, জেল খেটেছে, কতরকমের নির্যাতন সহ্য করেছে! আর আপনি তখন ভালো করে পড়াশোনা করেছেন, নিজের ক্যারিয়ার তৈরি করেছেন এবং ইংরেজদের দেওয়া চাকরিও করেছেন! সুতরাং নির্ঝঞ্ঝাটে আপনার জীবন কাটানোটাই প্রমাণ করে যে, আপনি নিজেই “ভালো”- ছিলেন না! তবু আপনি বলছেন_ “সেই সময় ভালো ছিল”! আরে_ কিসের ভালো ছিল? মাত্র কয়েক হাজার ইংরেজ হাজার হাজার মাইল সমুদ্র পেরিয়ে এসে কয়েক কোটি মানুষকে শতাব্দীকাল ধরে অত্যাচার করে গেল_আর এটা দেখেও যাদের হৃদয় কাঁদল না, তারা কি করে দাবী করে যে, সেই কাল ভালো ছিল? ‘ইংরেজদের গোলামী করা যেত’_ বলে কি ভালো ছিল?
আমি তো দেখি_ আগের থেকে এখনকার যুবকেরা অনেক ভালো! তারা যতই উদ্ধত, দুর্বিনীত_ হোক না কেন, ওরা আপনাদের মত গোলামী খাটাকে প্রশ্রয় দেবে না! এরপর যদি কখনো বিদেশী আক্রমণ হয়, তো_ আজকের যুবকেরা বীরের মতো লড়বে, স্বদেশের সম্মান রক্ষার জন্য আগামীদিনে উন্নত ভারত ওরাই গড়বে! তাই দোষ-দৃষ্টি দিয়ে দেখে_ আজকের যুবকদের ছোট করবেন না, উৎসাহিত করুন_ তাতেই আপনার মঙ্গল হবে ।।
জিজ্ঞাসু:– আমার শ্বশুর বাড়ির সকলে “রাধাস্বামী”-র ভক্ত, কিন্তু আমি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে ভক্তি করি, ভালোবাসি।এই অবস্থায় আমি কি তাকে ডাকতে পারি?
গুরু মহারাজ:– তা পারেন বই কি! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সবার_ তাই তাঁকে ডাকার অধিকার সবার আছে। তবে যে কোনো ঠাকুরকে ডাকার পৃথক পৃথক মন্ত্র বা বিশেষ বিশেষ পদ্ধতি আছে! সেইটা জেনে বা সেই পদ্ধতি অবলম্বন করলেই ভালো হয় । যেমন ধরুন_ রাস্তা দিয়ে অনেক লোক যাচ্ছে, আপনি তাদের যে কোনো একজনকে উদ্দেশ্য করে যদি, “এই”- “এই”, বলে ডাকেন_ তাহলে সে সাড়া নাও দিতে পারে! কিন্তু আপনি যদি তাকে নির্দিষ্ট নাম ধরে ডাকেন_ তাহলে সে সাড়া দেবেই, তাই না! তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে আরাধনা করার সময় আপনি _”ওঁ নমো শ্রী ভগবতে রামকৃষ্ণায় নমো নমঃ” _ এই মন্ত্র উচ্চারণ করবেন।।