স্থান:– বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন !
সময়:–১৩/৪/৮৯
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:– পূর্ণানন্দ মহারাজ, সিঙ্গুরের কয়েকজন ভক্ত, বনগ্রাম আশ্রমস্থ কয়েকজন মহারাজ ও অন্যান্যরা।।

জিজ্ঞাসু:—এখানে এসে আপনার কথা শুনতে শুনতে বেশ সুন্দর সময় কেটে যায়। অথচ বাড়িতে সময়‌ই কাটতে চায় না, তাই আজেবাজে লোকের সঙ্গে মিশতে হয়! আর এইজন্যেই বোধহয় ধ্যান জপের সময় মন বসে না?

গুরু মহারাজ:–যে সময়টায় তুমি বাড়িতে থাকছ_তখন অবসর সময় পেলে ভগবৎ চিন্তা করবে অথবা বাড়ির সদস্যদেরকে নিয়ে ‘ভগবৎ প্রসঙ্গ’- আলোচনা করবে! তাও যদি না পারো_ তাহলে নির্জনে প্রকৃতির দিকে চেয়ে চুপচাপ বসে থাকবে! এইভাবে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে_ চুপচাপ বসে থাকার অভ্যাস একবার হয়ে গেলে, জড়জগৎ ও মনুষ্যেতর জগতের অনেক রহস্য তোমার কাছে উদ্ঘাটিত হবে! প্রথম প্রথম পশুপাখির চলাফেরা, তাদের ডাকের তারতম্যে_ ভাব বিনিময়ের প্রকাশের তারতম্য এসব ধরতে পারবে। প্রকৃতির সঙ্গে যদি তুমি সহজভাবে মিশে যেতে পারো_তাহলে প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, প্রকৃতির অনুকূলে থাকা পশুপাখিদের জীবনধারণের পরিবর্তনের যোগসাজশ ইত্যাদি লক্ষ্য করেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতে পারবে।

জানো,এসব করে কত সাধারন মানুষ অসাধারণ হয়েছে ! অনেকে প্রকৃতি, পশুপাখি ইত্যাদি নিয়ে কত বই লিখেছে, অনেকে ডক্টরেট করেছে, অনেকে আবার প্রকৃতিপ্রেমিক সাধক হয়ে গেছে !

যাইহোক, এইরকমভাবে যদি তুমি শুধুমাত্র উদ্ভিদজগতের দিকে মনোনিবেশ কর_ তাহলে কিছুদিন পর তুমি উদ্ভিদজগতের অনেক রহস্য জানতে পারবে! যেমন ধরো_একটি গাছ কিভাবে নিচের দিকে তার মূল চালিয়ে, কোথা থেকে জল শোষণ করছে_ সেখানে জল জোগান পাওয়ার জন্য পাশাপাশি অন্যান্য গাছগুলির মূলের সঙ্গে যে কি ভীষন লড়াই চলছে, এসব জানতে পারলে সত্যিই অবাক হয়ে যাবে ! জলাশয়ের ধারে মাটি কাটা হলে অনেক সময় গাছেদের মূলের মারামারির ঘটনা ভালোভাবে বোঝা যায়! একটা বড় গাছের মূলগুলি, কি দারুন প্রচেষ্টায় অন্য কোন গাছের মূল কে ব্যারিকেভ করে সেগুলিকে জল সংগ্রহে বাধা দিচ্ছে __তা দেখতে পাওয়া যায়!

এছাড়া গাছের উপরের অংশেও এই রেষারেষি চলে, যেটা সহজেই চোখ মেলে দেখা যায়_সেটা হলো সূর্যালোক পাওয়ার জন্য ছোট গাছগুলির আকুল প্রয়াস, অপরপক্ষে বড় গাছগুলির সে ব্যাপারে প্রচন্ড বাধা দানের চেষ্টা! এইভাবে যদি অভ্যাস করো_তাহলে উদ্ভিদজগতের struggle for existence দেখতে দেখতেই তোমার অবসর সময়‌ও কাটবে, আবার মনেরও exercise হবে!

এইসব কথা যখন হল‌ই__ তখন উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের কিছু মজার কথা বলি শোনো! আফ্রিকায় এক রকম গাছ আছে যে গাছে এক বিশেষ প্রজাতির পাখিরা দল বেঁধে এসে বাসা বেঁধে বসবাস করে। একসাথে প্রায় 10-12 হাজার পাখি এসে বাসা বাঁধে এবং ওই গাছের পাতা গুলোকে এক বিশেষ পদ্ধতিতে গুটিয়ে নিয়ে খুপড়ির মত করে নেয়। এরকম হাজার হাজার খুপড়ি বিশিষ্ট গাছটি সালোকসংশ্লেষ করতে না পেরে কিছুদিন পর মারা যায়। কিন্তু আশ্চর্য এই যে ওই গাছটির আকৃতিটা এবং খুপড়ি গুলো নষ্ট হতে চায়না_ বহুদিন থেকেই যায়। ফলে পাখিরা নিজেদের বাসস্থান হিসেবে দীর্ঘদিন সেই গাছটিকে দখল করে বসে থাকে। এইভাবে বৃক্ষটি নিজে মারা গিয়েও দীর্ঘকাল পাখিদের আবাসস্থল হয়ে জঙ্গলে থেকে যায়!

জীব জগতের অন্যতম ধর্ম “বাঁচা এবং বাড়া”!সুতরাং যে কোন জীব (উদ্ভিদ বা প্রানী) বাঁচতে চায় আর তার সন্তানদের বাঁচাতে চায়! এর জন্যই জীবের যত কৌশল, যত সংগ্রাম! সাধারণত পাখি ও সরীসৃপদের ডিম থেকে বাচ্চা হয়। পাখিরা ডিম গুলিকে একটি নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেল(angle)-এ রেখে_ ডিমে “তা” দেয়! পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড(magnetic field)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ! ঐ নির্দিষ্ট direction নষ্ট হলেই_ সেই ডিমে আর বাচ্চা হয় না! সেইজন্য_ এই অসাধারন ব্যবস্থা! ডাহুক পাখি ডিমে “তা” দেওয়ার সময় সারারাত ধরে ডাকতে থাকে_ যতক্ষণ পর্যন্ত তার গলা চিঁরে রক্ত না বেরোয়, ততক্ষণ সে চিৎকার করে! মা-ডাহুকির গলার রক্ত ডিমে পড়লেই, ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়!

নিজেদের ডিম রক্ষায় উট পাখিরা দারুন মজার ভূমিকা পালন করে! উটপাখির ডিম আকারে বেশ বড়, আর স্থানীয় অধিবাসীদের খাদ্য হিসাবে এই ডিম খুবই প্রিয়! উটপাখিরা সাধারণত দুজন এক জায়গায়থাকে। স্ত্রী-পাখি যখনই দূর থেকে কোন মানুষ বা কোন ডিম-সংগ্রহকারীকে দেখে, তখনই সে বাসা ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে ডিমে “তা” দেবার ভঙ্গিতে বসে থাকে! আর পুরুষ পাখিটা আরো খানিকটা দূরে গিয়ে এক‌ইভাবে বসে ডাকতে থাকে। মানুষ উটপাখির ডাক শুনে সেখানে গিয়ে বসে থাকা পাখি টাকে দেখতে পায়, আর ভাবে ওখানেই ডিম আছে! কিন্তু সেখানে গিয়ে ডিম পায় না! ততক্ষণে পুরুষ পাখিটি একটু দূরে সরে গিয়ে আরেক জায়গায় বসে পড়ে এবং স্ত্রী-পাখিটি আরো কিছুটা দূরে গিয়ে ডাকতে থাকে। মানুষ আবার ভূল বোঝে এবং বসে থাকা উটপাখির কাছে ডিম খুঁজতে যায়! এইভাবে বিভ্রান্ত করতে করতে প্রকৃত ডিমের জায়গাটি থেকে ডিম সংগ্রহকারীকে পাখিগুলি অনেক দূরে নিয়ে চলে যায় ! গ্রামেগঞ্জে নদীতীরবর্তী অঞ্চলে হট্রিটি বা হাট্টিমাটিম্ পাখিরাও মানুষকে বিভ্রান্ত করতে খানিকটা এরকমই আচরণ করে থাকে!

তবে মানুষকে কি পাখি ধোঁকা দিতে পারে? উটপাখির ডিম যারা সংগ্রহ করে তারা ঠিক তক্কে-তক্কে থাকে, এক আধ বার মিসগাইডেড(misguided) হলেও_ তারা ডিমের সঠিক অবস্থান খুঁজে বের করে নেয়।তবে একজন মানুষ উটপাখির কাছে সরাসরি যেতে পারে না_ ওদের ঠোঁটে অসম্ভব জোর এবং গায়ের জোর‌ও খুব! একটা উটপাখি একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষকে পিঠে চাপিয়ে ছুটতে পারে_ওদের দৌড়ের স্পীড-ও নেহাৎ কম নয়! সেইজন্য ডিম সংগ্রহকারীরা বুদ্ধি খাটিয়ে ভালুকের চামড়া গায়ে লাগিয়ে নিশ্চিন্তে ডিমের কাছে চলে যায়_ ভালুক ভেবে পাখিরা ভয়ে আর কিছু বলে না! সেই সুযোগে মানুষগুলো ডিম তুলে নিয়ে চলে আসে।।

যাইহোক, আমরা যেটা আগে আলোচনা করছিলাম, সেই মূল আলোচনায় ফিরে আসি! পৃথিবীতে এমন বহু মানুষ আছে যারা সারা জীবনটা বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে-অরণ্যে কাটিয়ে দিয়েছে__ শুধুমাত্র পাখি বা প্রাণী জগতের জীবনযাত্রার অজানা রহস্য জানার জন্য! সুতরাং এটা কখনোই ভেবোনা যে, আর একজন মানুষ ছাড়া তুমি নিঃসঙ্গ! প্রকৃতির নানান বিষয়, মনুষ্যেতর প্রানীকূল,পশুপাখি, উদ্ভিদ এমনকি জড়-ও তোমার সঙ্গী হতে পারে! আমি নিজের ক্ষেত্রে দেখেছি_ ইঁট-কাঠ-পাথরের সঙ্গেও আমার সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে! এদের সাথে যোগাযোগ করতে বা এদের সাথে সময় অতিবাহিত করতে গিয়ে আমার কখনোই আনন্দের অভাব হয়নি তো! মানুষের আসল উদ্দেশ্য‌ই তো হোল_ “আনন্দ লাভ”! তাহলে, অহেতুক কোন বাজে লোকের সাথে বকবক্ করে বকে, পরে ক্লেশ পাওয়ার থেকে_ প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে _আনন্দে থাকো! মে সঙ্গ তোমার মনকে পীড়া দেয়_সেইসব সঙ্গ এড়িয়ে থাকাই তো ভালো!!

জিজ্ঞাসু:– সব পশু-পাখির‌ই শত্রু হোল মানুষ ! অথচ দেখা যায় পশুপাখিরা মানুষের কাছাকাছি থাকতেই ভালোবাসে_ এটা কেন?

গুরু মহারাজ:– সব পশুপাখিরা তো এটা চায় না! বাঘ-ভাল্লুক-সিংহ মানুষের কাছে এলে বিপদ হয়ে যাবে তো! যে সমস্ত পশু-পাখি মানুষের কাছাকাছি থাকতে চায়_ সেগুলো জঙ্গলের জীবন অপেক্ষা তোমাদের সমাজ জীবনকে অনেক বেশি নিরাপদ বলে মনে করে অর্থাৎ তারা মানুষের কাছে কাছে থেকে বাঁচা এবং বাড়ার বেশি সুযোগ পায়_ তাই এটাকে গ্রহণ করেছে! মানুষ যেমন সেই পশু বা পাখি গুলিকে লালন পালন করে তেমনি আবার তাদেরকে মেরে_তাদের মাংস খায়। তাছাড়া-ও এদেরকে গৃহপালিত বানিয়ে, এদের কাছ থেকে নানারকম সুযোগ সুবিধা আদায় করে।

আর পশুপাখির প্রতি মানুষের প্রেম বা ভালোবাসার কথা যদি বলো_ সেটা অন্য ব্যাপার! যে ভালবাসতে পারে, তার কাছে সবাই বশ! হিংস্র পশুরাও বশ, আবার দুর্দান্ত মানুষও বশ! আবার জানো, প্রাকৃতিকভাবে কোন কোন পশু-পাখিকে দেখা যায় মানুষকে কোন কারণ ছাড়াই ভালোবাসে! যেমন সামুদ্রিক প্রাণী শুশুকবা ডলফিন, এরা মানুষকে খুবই ভালবাসে! মাঝ-সমুদ্রে বিপন্ন মানুষের একমাত্র বন্ধু এরাই! পরিসংখ্যান বলছে_জাহাজ ডুবিতে এখনো পর্যন্ত পৃথিবীতে অধিক সংখ্যক মানুষকে বাঁচিয়েছে এই ডলফিনেরা! জাহাজডুবি হয়ে গেলে, এরা দূর থেকে বুঝতে পারে এবং অতিদ্রুত সেখানে পৌঁছে_ জলে ভেসে থাকা মানুষজনদেরকে পিঠে চাপিয়ে একেবারে ডাঙায় পৌঁছে দিয়ে যায়! হাঙ্গরের মাঝখানে পড়ে যাওয়া মানুষকেও রক্ষা করেছে শুশুক _এমন ঘটনাও ঘটেছে! আবার এমনটাও দেখা গেছে _ হয়তো সমুদ্রে কোনো ডেডবডি ভাসছে, শুশুক সেটা বুঝতে না পেরে _ তাকেও ডাঙায় পৌঁছে দিয়ে গেছে!

যাইহোক, দীর্ঘকাল ধরেই বিভিন্ন পশু ও পাখি মানুষের কাছাকাছি বাস করছে,ফলে যেন সুখে-দুখে এরা একে অপরের সাথী হয়ে গেছে! বহু মানুষ বিশেষত যারা একা একা জীবন যাপন করে_তাদের অনেকেই কোন না কোন পশুপাখিকে পোষ্য করেই জীবন কাটিয়ে দেয়। অনেকক্ষেত্রে সেখানেও অসম্ভব ভালবাসার বন্ধন গড়ে ওঠে! বিভিন্ন গল্প-কাহিনী, উপকথায় দেখা যায়_ পশু বা পাখি হয়ে উঠেছে অন্যতম চরিত্র! জাতকের গল্প, ঈশপের গল্প ইত্যাদি গ্রন্থে বেশিরভাগ চরিত্রই পশু বা পাখি! ঐসব গল্পগুলি যখন পড়া হয়, তখন এগুলি কখনোই মানুষের কাছে শুধুই পশুপাখি হয়ে থাকে না, যেন মানুষের মতোই একটা চরিত্র হয়ে উঠেছে!

পৌরাণিক গল্পে নরসিংহ, মহিষাসুর_এরাও পশু মানবের এক একটা মিশ্ররূপ! এদের সম্বন্ধে আধুনিক ব্যাখ্যাকারেরা যাই বলুক না কেন_ শুধুমাত্র ‘চরিত্র’ হিসেবে যদি দ্যাখো, তাহলে এগুলো তো নগণ্য নয়‌ই বরং মহান চরিত্রের মর্যাদা পেয়েছে । এখনকার কার্টুন চরিত্রের মধ্যেও পশু-পাখিকে মানুষের সাথে মিশিয়ে বাচ্চাদের মনোরঞ্জনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।।

জিজ্ঞাসু:– আচ্ছা মহারাজ! মহিষাসুর কি সত্যিই কোন ব্যক্তি ছিল?

গুরু মহারাজ:– দ্যাখো, আধুনিক বিজ্ঞানীরা এখন জেনেছে যে, জন্মের ব্যাপারে মাতৃকোষের ভূমিকা তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয়! তবে ফার্টিলাইজেশন(fertilisation) অর্থাৎ শুক্রাণু ও ডিম্বানুর মিলনের সময় থেকে পূর্ণাঙ্গ শিশুর রূপ নেবার ব্যাপারে, সবচাইতে উপযুক্ত ক্ষেত্র বা আধার হচ্ছে “মাতৃজঠর” বা “গর্ভ” ! পূর্ণাঙ্গ সন্তানের রূপদানের জন্য‌ এটির বিশেষ প্রয়োজন! কিন্তু গর্ভ বা মাতৃজঠর ছাড়াও শরীরের বাইরে উপযুক্ত আধার বা container সৃষ্টি করতে পারলে সেখানেও সন্তান উৎপাদন সম্ভব হবে। পুরুষের শুক্রাণুতে XY ক্রোমোজম থাকে, আর নারীর ডিম্বানুতে থাকে XX ক্রোমোজম। পুরুষের শুক্রাণু থেকে শুধুমাত্র এক্স(X) ক্রোমোজমগুলি বের করে, তাদের মধ্যে বি-সম গুন বিশিষ্ঠ দের মিলন ঘটালেই fertilisation হয়ে যাবে। এবার মাতৃগর্ভের বাইরে কোন উপযুক্ত কন্টেইনার(container) বা আধারে রাখতে পারলে(যেখানকার তাপমাত্রা,চাপ ইত্যাদি একেবারে মাতৃগর্ভের ন্যায়! তাছাড়া সেখানে ভ্রুনের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান রাখতে হবে) সেখানেও অপত্য উৎপাদন করা সম্ভব হয়। রামায়ণে বর্ণিত_মহাবিজ্ঞানী ঋষি বাল্মীকির দ্বারা কুশের জন্ম এই ভাবেই হয়েছিল। মহাভারতের যুগে দ্রোন এবং দুর্যোধন-আদি 100 ভাই-বোনেরা মাতৃজঠরের বাইরে উৎপাদিত সন্তান (যা আজকের টেস্টটিউব বেবি ছাড়া আর কিছুই নয়)!

এইবার কথা হচ্ছে_ ধরো, যদি মহিষ জাতীয় কোন স্ত্রী-পশুর গর্ভ-কে উপযুক্ত “আধার” হিসাবে তৈরি করা যায়, আর সেখানে যদি মানুষের fertilised sperm স্থাপন করা যায়_ তাহলে মহিষীর গর্ভে মনুষ্যশরীর যুক্ত অপত্য _পাওয়া গেলেও যেতে পারে ! তবে জানো তো _ পৌরাণিক এই সমস্ত চরিত্রগুলিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায় কিনা, তা নিয়ে বহুদিন ধরেই বিভিন্ন উন্নত দেশে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে! Human sperm থেকে এক্স(X) ক্রোমোজোম পৃথক করাটা খুবই জটিল ব্যাপার ! অত্যন্ত আধুনিক ও উন্নত যন্ত্রপাতি ছাড়া এসব পরীক্ষা করা সম্ভবই নয়! তাই ভারতে না হলেও প্রাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে এসব গবেষণাহচ্ছে! এই পরীক্ষাগুলি সাকসেসফুল(successful) হলে, তখন তোমরা এই ধরনের creation হয়তো কোনদিন বাস্তবে দেখতেও পেতে পারো!

জিজ্ঞাসু:– ভোজবাড়িতে পদ্মপাতা এবং শালপাতায় খেতে দেবার ব্যাপারটা_ কি শুধুই hygienic বলেই ব্যবহার করা হয়? এইটা জিজ্ঞাসা করছি এইজন্য কারণ হাজার হাজার গাছের পাতা থাকতে শুধু এই দুটিই ব্যবহার করা হয় কেন ?

গুরু মহারাজ:– কেন! কলাপাতায় খাবার রেওয়াজও খুব‌ই ছিল আগে, এখনো রয়েছে! হাইজেনিক ব্যাপারটাতো আছেই_ তাছাড়া পদ্মপাতা, শালপাতা, কলাপাতায় খাদ্য পরিবেশনের সুবিধাও অনেক বেশি। এরকম অন্য আর কোন গাছের পাতা তুমি হাতের কাছে পাবে কি? পদ্মপাতা, কলাপাতা আকারে বড় হয়_ আর শালপাতা ছোট হলেও তাকে কাঠির সাহায্যে জুড়ে জুড়ে বড় করা হয়_ কিন্তু এর বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, এগুলো শুকিয়ে গেলেও নরম থাকে, অথচ চট করে ছিঁড়েও যায় না! অন্য ওই ধরনের পাতা তুমি জুড়ে শুকনো করে দেখ_ নরম থাকবে না, ছিঁড়েও যাবে।

ঐ পাতাগুলোর hygienic দিক যেটা বলছিলে, সেটা হচ্ছে যে_ কোন্ পাত্রে কোন্ খাবার রাখলে বা কোন পাত্রে খাবার খেলে _খাদ্যের খাদ্যগুণ, দীর্ঘক্ষণ অক্ষুন্ন থাকে_সেই অনুযায়ী বিচার হয়। যেমন _ কলাপাতায় খিচুড়ি খাওয়ার কথা বলা হয়েছে! ভাত খেতে হয় ধাতব পাত্রে অর্থাৎ কাঁসা,রুপা,সোনা ইত্যাদি পাত্রে(লোহা,অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি নয়),ফলার(দ‌ই,ছিঁড়ে,কলা বা অন্য ফল, মিষ্টান্নাদি) খেতে হয় পদ্মপাতায় বা পাথরের পাত্রে।শালপাতায় লুচি খেলে অথবা রাখলে _লুচির খাদ্যগুণ নষ্ট হয় না।

কাটা ফল রাখতে হয় কাঠের “বারকোসে”(কাঠের তৈরি বড় রেকাবির মতো দেখতে!) বারকোসে দীর্ঘক্ষন কাটা ফল রাখলেও সেগুলি টাটকা থাকে_ জীবাণু আক্রমণ হতে দেরি হয়, কিন্তু অন্য কোন ধাতব পাত্রে ফল কেটে রেখে দেখো_খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে। জলকে বিশুদ্ধ রাখার জন্য,ভরে রাখতে হবে হয় তাম্র পাত্রে অথবা মাটির পাত্রে। অন্যান্য পাত্রে রাখলে জলের গুনমান অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। দ্যাখো, এগুলি কিন্তু প্রাচীনকালের খাদ্য বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান! বর্তমানে হয়তো অনেকে এগুলিকে backdated বা কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেবার একটা চেষ্টা করছে! কিন্তু ভালো করে চিন্তা করে দেখলে বোঝা যাবে যে, প্রাচীন ভারতের ঋষিদের গবেষণা ছিল একদম সঠিক ! এখন তো অ্যালুমিনিয়াম আর stainless-steel সবকিছুর জায়গা দখল করে নিয়েছে। কিন্তু যে কোন খাদ্য, অনেকক্ষন সংরক্ষন করে রাখার ক্ষেত্রে, অ্যালুমিনিয়াম পাত্র খুবই অস্বাস্থ্যকর! বর্তমান বিজ্ঞানিরা এইসব দিকে নজর দিলে মানুষের কল্যাণ হবে। ন্যাচারাল পাত্রে খাদ্য গ্রহণ ও খাদ্য সংরক্ষণের ভূমিকা কি তা সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে তবেই সবার স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।

জিজ্ঞাসু:– অধিক জনসংখ্যার জন্যই বোধহয় এখন আর পূর্বের বিভিন্ন নিয়ম কানুন মেনে চলা মানুষের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না ?

গুরু মহারাজ:– এটাতো একটা আন্যতম কারণ বটেই! সামাজিক নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে জনসংখ্যার একটা বিরাট ভূমিকা থাকে! স্বাধীনতার আগে এদেশের জনসংখ্যা যা ছিল স্বাধীনত্তোর কালে এই কয়েক বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিনগুণ! স্বাধীনতার আনন্দে ভারতবর্ষের মানুষ যেন ওই একটাব্যাপারই উঠে পড়ে লেগেছিল এবং এই একটা ব্যাপারেই তারা successful হয়েছে! তবে বর্তমানে শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে বলে_এখন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেকটাই কমে গেছে! যদিও সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এখনও এই সচেতনতা আসেনি, তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যে কমেছে, সেটা একটা পরিসংখ্যান দিলে তোমরা বুঝতে পারবে। মনে করো, তোমরা চার ভাই অর্থাৎ তোমার বাবার চার ছেলে_ কিন্তু এখন তোমাদের চার ভাইয়ের সব মিলিয়ে দেখবে ওই চারটি কিংবা পাঁচটি-ই ছেলে-মেয়ে! দেখা যাচ্ছে, শিক্ষিত মহল ব্যাপারটাকে খুবই গুরুত্ব দিয়েছে_ এবং আশার কথা এই যে, বর্তমানে অশিক্ষিতরাও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী হচ্ছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের হার কমার আরেকটা প্রমাণ দিচ্ছি_ প্রাইমারি স্কুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, এক একটা স্কুলে পনেরো কুড়ি টি ছাত্র! কোন কোন স্কুল ছাত্রাভাবে উঠে গেছে! অথচ পনেরো কুড়ি বছর আগে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে _ব্যাঙের ছাতার মত প্রাইমারি স্কুল তৈরি করতে হয়েছিল! এখন(1994) সেই ঢেউটা চলছে কলেজ, ইউনিভার্সিটি-তে! নামকরা স্কুল বা কলেজে হয়তো খালি 20টা সিট _400 টা application পড়ছে! চাকরির ক্ষেত্রে চিত্রটা আরও মারাত্মক! কিন্তু আজ থেকে আরো কুড়ি বছর পরে দেখা যাবে অন্য চিত্র! কলেজ ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন শাখায় সে তুলনায় ছাত্র সংখ্যা কমে যাবে, আরও পরবর্তীতে চাকরির ক্ষেত্রেও যোগ্যতা অনুযায়ী এমপ্লয়মেন্ট হবে। এই ধরনের ভয়ঙ্কর competition থাকবে না!

শুধুমাত্র পূর্বসূরীদের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে _হোল কি,পরপর দুটো প্রজন্ম মার খেল ! নানান সমস্যা ও অসুবিধার মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাতে হল তাদের! সব ক্ষেত্রেই শুধু প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা! আর এখন এসে গিয়েছে ডোনেশন্(donation)! সেখানেও প্রতিযোগিতা _ একটা ভালো স্কুলে ছেলেকে ক্লাস ফাইভে ভর্তি করতে গেলে দিতে হয় মোটা টাকার ডোনেশন, না হয় এমএলএ বা এমপি-র recomendation চাই _ তাছাড়া ছেলে ভর্তি হবে না। তাই বলছিলাম স্বাধীনতার পর দুই প্রজন্ম suffer করছে কিন্তু যারা নতুন প্রজন্ম অর্থাৎ এখন যারা শিশু-কিশোর, তারা যখন বড় হবে _ তখন অন্যরকম ব্যবস্থা শুরু হবে! তাদেরকে আর এতটা ভুগতে হবে না,রুজি-রোজগারের নানা সুবিধা পাবে।

জিজ্ঞাসু:–বর্তমানে একশ্রেণীর লেখকের বই এ মহাপুরুষদের সমালোচনা বেশি বেরোচ্ছে। তারা বলতে চাইছে, মহাপুরুষরা হিপনোসিস(hypnosis) করে লোককে বোকা বানায় এটা কি ঠিক?

গুরু মহারাজ:—-বাজারে কত বই প্রকাশিত হচ্ছে!যে কোন ব‌ইয়ের বিষয়বস্তু_সেই লেখকের মত অনুযায়ী লেখা হচ্ছে। এবার যে পাঠক, যে মানসিকতার_ তার সেই ধরনের বই পড়তে ভালো লাগবে! তবে কোন একটা বই পড়ে সেই লেখকের মতকেই “সিদ্ধান্ত” করতে যাওয়াটা নেহাত বোকামি!ঐ লেখক, কোন level-এর ব্যক্তি, তার চেতনা কতটা উন্নত স্তরে রয়েছে_ সেটা তো দেখতে হবে! কোন মহাপুরুষ সম্বন্ধে যখন কেউ কোন মত প্রকাশ করছে_ সেই মত প্রকাশের কতটা যোগ্যতা ও লেখকের আছে_ সেটা বিচার করবে না?

কিছু magazine আমার হাতেও আসে, যাতে এইধরনের কিছু লেখা দেখতে পাই_ আমিও খেয়াল করেছি বর্তমানের কিছু লেখক, ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে অথবা পূর্ববর্তী কোন স্বদেশী ও বিদেশী লেখকদের লেখা follow কোরে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে article লিখছে, অথবা দু-একটা চটি বইও লিখেছে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি _কিছু বিদেশী লেখক,যেমন _ ডাঃ কাভূর,দানিকেন ইত্যাদি লেখকদের follow করে এরা! এদের ব‌ই-এ নিজস্ব উপলব্ধির কোন কথা নেই, কিছু বিকৃত তথ্য পরিবেশিত হয় আর কিছু উদ্ভট শব্দ _ যেগুলি সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের ধারণা কম, সেগুলো ব্যবহার করা হয় পাঠকদেরকে আকর্ষণ করার জন্য !আর পাঁচজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের মতো_সহজ কথা সহজভাবে লিখে টাকা রোজগার করার ক্ষমতা এদের নাই, ফলে এরা এই চালাকিটা অবলম্বন করে! একটু অন্যরকম (থোরা হট্ কে)হ‌ওয়ায় এদের বই বিক্রি হয় এবং দু_পয়সা আমদানি হয়! কিন্তু এইসব বই বাজারে আসায়_ ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ শিক্ষিত কিশোর-কিশোরী, বা যুবক-যুবতীদের! কোন বিষয় না-জানাটা তবু ভালো, কিন্তু সেই বিষয় সম্বন্ধে ভুল জানা অথবা তথ্য-বিকৃতি করে জানাটা খুব‌ই ক্ষতিকর। এরা সমাজের এই ক্ষতিটাই করে চলেছে!

তুমি যে কথাটা বললে হিপনোসিস্(hypnosis)_দ্যাখো, প্রকৃত hypnotism শিখতে গেলে যে কোনো ব্যক্তির অন্তত 8-10 বছর লেগে যাবে_ তবে ওই বিদ্যা আয়ত্ত হবে। এতো কষ্ট করে,এতো সময় ব্যয় করে ঐ ধরনের বিদ্যা লাভ করে, যদি কেউ লোক ঠকানো শুরু করে, তাহলে জানবে_ কিছুদিনের মধ্যেই তার ওই বিদ্যা নষ্ট হয়ে যাবে এবং ঐ ব্যক্তি যে ঠক_ তা প্রমাণিত হয়ে যাবে!

যে লেখকদের কথা তুমি বলছিলে_ ওরা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এবং স্বামী বিবেকানন্দের সমালোচনা করতেও ছাড়েনি! কি স্পর্ধা! একটা মাঝি গঙ্গার ঘাটে তার ছেলেকে মেরেছিল_ সেইটা দেখে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শরীরে যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন, এই ঘটনাকে এরা self-hypnosis হিসাবে ব্যাখ্যা করে করেছে ! বেশ_ তাই না হয় হোল, কিন্তু এতে কি লোক ঠকানো হলো? আরে শোন_ ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ এবং স্বামী বিবেকানন্দ শরীর ধারণ করে ভারতবর্ষকে কয়েক সেঞ্চুরি এগিয়ে দিয়ে গেলেন! এরা এসব রহস্য কি করে বুঝবে ? যারা প্রকৃত জ্ঞানী বা ঋষি স্থিতিতে রয়েছেন_ তারা এইসব রহস্য অবগত আছেন!

শোনা যায় বামপন্থীদের একটা শাখা, যারা নিজেদেরকে রেশনালিস্ট(rationalist) বলে পরিচয় দেয়_ এই ধরনের লেখকেরা,ওই দলের সঙ্গে যুক্ত! গোটা ভারত বর্ষ জুড়ে বিভিন্ন ভাষায় ওদের প্রকাশিত পত্রিকা রয়েছে! ওদের কাজই হলো সেই সব পত্রিকার মাধ্যমে ভারতীয় শাশ্ত্রাদি, প্রাচীন পরম্পরা, বিভিন্ন মহাপুরুষ ইত্যাদির বিরুদ্ধে নানা কথা বলে, মানুষকে বিভ্রান্ত করা! কিন্তু এখন আমি দেখছি ওদের এই মিশন(mission)-টা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফলে আধুনিক শিক্ষিত যুবকরা হয়তো আর বিভ্রান্ত হবে না! তারা বর্তমানকে বোঝার চেষ্টা করবে এবং অতীতের ভালো দিকগুলোকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে।

সে যাইহোক, এই যে self-hypnosis-এর কথা ওরা বলছে_ এটাই ওদেরকে একবার করে দেখাতে বলতো? পারবে কি _কেউ পারবে না! তাই যে জিনিস সম্বন্ধে নিজের সম্যক ধারণা নাই, সেই সম্বন্ধে অপরকে ধারণা দিতে যাওয়াটা নিছক বুজরুকি ও আহাম্মকি ছাড়া আর কি বলা যাবে!!