স্থান:– বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন !
সময়:– এপ্রিল, 1989.
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:– সিঙ্গুরের ভক্তবৃন্দ, মিশনের মহারাজগণ ও আরো অনেকে।

জিজ্ঞাসু:– সভ্যতার সংজ্ঞা কি হবে?

গুরু মহারাজ:– সভ্যতার পরিভাষা হল সংযম। যে মানুষ যত সংযমী, সেই মানুষ ততটা সভ্য।যে জাতিতে যত বেশি সংযমী মানুষেরা থাকে, সেই জাতি ততটাই উন্নত! ভারতবর্ষে এই সংযমের বাঁধটুকু অনেকাংশে আছে বলেই দেশটা এখনো পুরোনো গৌরব নিয়ে টিকে আছে_ ভারতবাসী হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব এখনও বজায় আছে! নাহলে তোমাদের(ভারতবাসীর) বুজরুকি কেউ শুনত না! এদেশের অবতার পুরুষ আর সাধু-মহাত্মাদের বাদ দিলে, এদেশে আর কি পড়ে থাকে? কতকগুলো দ্বিপদ জীব ছাড়া আর কি! অনুকরণপ্রিয়তা আর পরস্ত্রীকাতরতায় জাতিটা শেষ হয়ে যেতে বসেছে। সুতরাং আমি তোমাদের বলবো_ তোমরা আকাশবৎ হ‌ও! সমস্ত কিছুতে আকাশের ছায়া পড়ে, কিন্তু কোন কিছুর ছায়া আকাশে পড়ে না! এইজন্যেই আত্মাকে ভারতীয় শাস্ত্র ব্যাখ্যা করেছে _’গগনসদৃশম্’ বা ‘ত্রিগুনরহিতম্’ বলে!

দ্যাখো সব্য, তুমি যে অর্থে সভ্যতার সংজ্ঞা দাও, সেটা সভ্যতা নয়_ ওটা অসংযমের ফল। ভারতীয় নারীদের সতীত্ব, পবিত্রতা আছে বলেই ভারত এখনো বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ এইসব সংযমী “মা” থেকেই সৎ সন্তানেরা (পুরুষ এবং নারী) জন্মগ্রহণ করে। সারদা মাতার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আমার এই কথাগুলো ভেবে দেখো, বুঝতে পারবে কি বলতে চাইছি! মনকে কলুষমুক্ত করো_তাহলেই যতসব আজে বাজে ভাবনা আসবেনা। বিদেশীদের অনুকরণ করতে গেলে ভারতবর্ষের মানুষের আরও বেশি সর্বনাশ হবে।

জিজ্ঞাসু:– ভগবানের যখন অবতারণ হয়, তখন সেই বিশেষ শরীরকে কেন্দ্র করে কি সর্বদাই ভগবৎ সত্তার প্রকাশ থাকে; না বিশেষ বিশেষ সময়ে তার প্রকাশ ঘটে ?

গুরু মহারাজ:– যাঁরা সব সময়ই স্বরূপের বোধে অবস্থান করেন, তাদের আবার সময়-অসময় কি? ইচ্ছামাত্রই তাঁরা ভগবৎ-সত্তার প্রকাশ ঘটাতে পারেন_ এমনকি ইচ্ছামাত্র এই শক্তি তাঁরা অন্য আধারে সঞ্চারিত‌ও করতে পারেন! মহাপ্রভুর স্পর্শ পেলেই মানুষের মধ্যে দিব্য ভাবের প্রকাশ ঘটতো_ সাধারণ মানুষ, তাঁর স্পর্শে আনন্দে-উন্মাদনায় নৃত্য করতো! শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি বাজলে গোপীদের‌ও ওই একই অবস্থা হতো! গম্ভীরালীলার সময় মহাপ্রভু একবার রাত্রে ঘর থেকে উন্মাদের ন্যায় ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিলেন পুরীর সমুদ্রের দিকে! সঙ্গীরাও(সাড়ে তিনজন_স্বরূপ দামোদর,রায় রামানন্দ,শিখী মাহাতি এবং মাধবী দাসী) ছুটলেন পিছু পিছু! কিন্তু তাঁকে ধরার সাধ্য কার আছে_ সঙ্গীরা অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে পরলো, উনি গেলেন কোন দিকে_এই ভেবে! হঠাৎ তাঁরা দেখলেন_ একজন জেলে দুহাত তুলে নৃত্য করতে করতে আসছে! তখন তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, মহাপ্রভু ঐদিকেই গেছেন! ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় যেভাবেই হোক এই ধরনের মহাপুরুষের সংস্পর্শে এলে মানুষ তৎক্ষণাৎ পরমানন্দের স্বাদ পায়! তবে এখানে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের একটা কথা মনে রাখতে হবে, উনি বলতেন যে, “নরলীলায় ভগবানকেও, মানুষের মতোই আচরণ করতে হয়। মানুষ হয়েছেন তো একদম ঠিক ঠিক মানুষ!”

আমি তোমাদের একটা গল্প বলছি শোনো_কোন এক স্থানে একটা দ্বীপ ছিল, সেখানকার সকল মানুষই কুষ্ঠরোগী! হয়তো সেখানকার জলে এমন কোন সমস্যা ছিল_ যার জন্য এই অবস্থা!সকলেই কুষ্ঠরোগী হ‌ওয়ায়, সেখানকার সব মানুষের‌ই হাতে পায়ে ফেট্রি বাঁধা! এদিকে এক নাবিক জাহাজডুবি হওয়ায় সে মাস্তুল ধরে ভাসতে ভাসতে ওই দ্বীপে এসে উঠলো। মানুষ আছে দেখে নাবিকের মনে খুব আনন্দ হল_ সে সকলের সাথে পরিচয় করতে চাইল! কিন্তু কি আশ্চর্য_ কেউ তার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলতে চাইছিল না বরং কেমন যেন অবজ্ঞার দৃষ্টিতে ওর দিকে সবাই তাকাতে লাগল! এ আবার কি ব্যাপার _কেউ তার দিকে ভালো করে তাকাচ্ছেই না! ব্যাপারটা কি! হঠাৎ তার মাথায় এই চিন্তা এলো যে, এখানকার সকলেরই হাতে-পায়ে কুষ্ঠ, তাই সকলেরই সেই সব স্থানে ফেট্রি বাঁধা আছে _আর যেহেতু তার শরীরে কোনখানে ফেট্রি বাঁধা নেই, তাই হয়তো এরা তাকে মেনে নিচ্ছে না! এই ভেবে ওই নাবিক একটু আড়ালে গিয়ে নিজের কাপড় ছিঁড়ে হাতে-পায়ে ভালো করে ফেট্রি বেঁধে নিল। এবার যেই সে গিয়ে দ্বীপের লোকেদের মাঝখানে দাঁড়ালো _অমনি তারা সবাই একে একে তার সঙ্গে ভাব জমাতে এলো। শুধু তাই নয় _বিদেশি নাবিকের কাছে নানান দেশের গল্প‌ও শুনতে চাইলো_অর্থাৎ দ্বীপবাসীদের সাথে তার ভাব হয়ে গেল।

হিমালয়ের একজন সাধু আমাকে গল্পটা বলেছিলেন। গল্পের শেষে উনি বললেন, “বাবা! মানুষের মনে কুষ্ঠ_ তাই কুষ্ঠহীন মানুষকে তারা গ্রহণ করতে পারে না! এই জন্যই সাধু-মহাত্মারা সমাজ থেকে দূরে থাকতে ভালোবাসেন বা বলা যায় তারা থাকতে বাধ্য হন! কিন্তু ভগবান যখন অবতীর্ণ হন, তখন তিনি আসেন সমাজের কল্যানের জন্য। তাই তিনি আর কোথায় যাবেন_ তাঁকে সমাজেই থাকতে হয় অর্থাৎ ঐরূপ নানা ফেট্রি বাঁধতে হয় বা বলা যায় মানুষের নানান সংস্কারকে আশ্রয় করে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের ন্যায় আচরণ করতে হয়! কিন্তু তা করলে কী হবে _সর্বক্ষণ‌ই তিনি স্বরূপের বোধে-ই থাকেন, ফলে তাঁর কর্মের কোন বিচ্যুতি ঘটে না। কিন্তু যারা কাছ থেকে তাঁকে দেখে, তাদেরই হয় মুস্কিল! তাদের‌ই মতো দেখতে _তাদের‌ই মতো চালচলন, কথাবার্তা! তাদের‌ই মতো খাদ্যগ্রহন করছেন, শৌচকর্ম করছেন _এইভাবে এক এক রকম অবস্থায় তাঁকে দেখে সাধারণ মানুষেরা, তাঁর উদ্দেশ্যে নানা রকম মন্তব্য করেবসে, অনেকে আবার মনে মনে অনেকিছু সিদ্ধান্ত‌ও করে বসে। যাইহোক, ভগবৎ-সত্তা বিশিষ্ট পুরুষগণ মানুষের মতো শরীরধারণ করে, মানুষের মাঝে থেকে _মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করেন, যুগধর্মের প্রবর্তন করেন, কিন্তু সব কিছু করেও তিনি নিজে থেকে যান সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে! কয়েকজন মাত্র তাঁর পার্ষদ এবং তাঁর অনুগৃহীত ব্যক্তিরা ছাড়া, বাকি সাধারণ মানুষেরা বুঝতেই পারে না _কে এসেছিল,কি সাংঘাতিক একটা তত্ত্ব শরীর ধারণ করে লীলা করে গেল! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন _”বাউলের দল এলো, নাচলো-গাইলো, আবার চলে গেল, কেউ চিনলো _কেউ চিনলো না!”

তাই বলছিলাম ভগবানের শরীরে থাকা অবস্থায় তাঁকে ধরা খুবই মুস্কিল হয়! তবে যে বা যারা ধরতে পারে _তার অত জিজ্ঞাসার প্রয়োজন হয়না! সে সবসময় জানে যে, ভগবান এখন এই শরীরে লীলা করছেন! কারণ সে তো তখন অসংশয়! গীতায় রয়েছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, “অসংশয়ো মহাবাহো”! এবার ব্যাপারটা বুঝেছ নিশ্চয়! আর দ্যাখো, ভগবানের আবার সময়-অসময় কি, ইচ্ছামতো যা কিছু করতে পারেন, দরকার হলে মহিষের মুখ দিয়ে বেদ মন্ত্র পাঠ করাতে পারেন!

জিজ্ঞাসু:–মহিষের মুখ দিয়ে বেদ মন্ত্রোচ্চারণের কোন ঘটনা কি সত্যি আছে, না এমনি কথার কথা বললেন?

গুরু মহারাজ:– এমন ঘটনা ঘটেছিল মহারাষ্ট্রের একটি মন্দিরে! জ্ঞানদেব বা জ্ঞানেশ্বর নামে একজন মহাপুরুষ মহিষের মুখ দিয়েই বেদ মন্ত্র উচ্চারণ করিয়েছিলেন।

জিজ্ঞাসু:– জ্ঞানদেবের ঘটনাটা যদি একটু বিস্তারিত বলেন?

গুরু মহারাজ:–জ্ঞানদেবরা তিন ভাই ও এক বোন ছিলেন।এদের সবাই খুব উন্নত অবস্থার সাধক-সাধিকা ছিলেন, তাই সাধারণ মানুষ তাঁদেরকে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের অবতার ও বোনকে ভগবতীর অংশ হিসেবে মান্যতা দিতো। নিবৃত্তিনাথ, জ্ঞানদেব ও সোপানদেব এই তিন ভাই এবং মুক্তাবাই ছিলেন তাঁদের বোন। এঁরা খুব গরীবের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ছোট বয়সেই এঁদের পিতা-মাতা উভয়েরই মৃত্যু হয়। তাই ছোট থেকেই এঁরা সকলেই ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল হয়ে সাধন-ভজন করে দিন কাটাতেন_এবং ধীরে ধীরে আধ্যাত্মিকভাবে উন্নত হয়ে উঠতে থাকেন! কিন্তু গ্রামবাসিরা এঁদেরকে ভালো চোখে দেখতো না! একদিন জ্ঞানদেব সহ অন্যরা যখন কোনো এক মন্দিরে ঢুকছিলেন ঠাকুর দর্শনের নিমিত্ত _তখন মন্দিরের পুরোহিত বা অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা ওঁদেরকে মন্দিরের মধ্যে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না! জ্ঞানদেব ছোট বয়স থেকেই অসাধারণ পন্ডিত ছিলেন _ শোনা যায় মাত্র 12 বছর বয়সে তিনি গীতার ভাষ্য রচনা করতে শুরু করেছিলেন যেটি “জ্ঞানেশ্বরী গীতা” নামে আজও পন্ডিত মহলে খুবই সমাদৃত! জ্ঞানদেব প্রচার করতেন, “ইশ্বর সবার এবং জ্ঞানে সকলের অধিকার আছে এইসব কথা তৎকালীন ব্রাহ্মণদের খুব একটা ভালো লাগতো না তাই তাদের উপর উচ্চবর্ণের লোকেদের একটু রাগ ছিল। জ্ঞানদেব সেই মন্দিরের পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তাকে বা তার ভাই বোনদের মন্দিরে ঢুকতে না দেওয়ার কারণ কি? মন্দিরের পুরোহিত তাকে উত্তর দিয়েছিল যে, ‘বেদে ব্রাহ্মন ছাড়া বাকিদের অধিকার নাই! আর জ্ঞানদেব ঐ টুকু ছেলে, সে বেদের জানেটাই বা কি যে, সে সকলকে বেদে অধিকারের কথা বলে! এসব অন্যায় কাজ করার জন্যই জ্ঞানদেবকে মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হবেনা! জ্ঞানদেব প্রধান পুরোহিতের এই কথা শুনে শান্তকণ্ঠে উত্তর দিলেন _ “দেখুন! ভগবানের কৃপা হলে শুধু মানুষ কেন, ওই যে মহিষটি মন্দির প্রাঙ্গণে বাঁধা রয়েছে _সে-ইবেদের মন্ত্র উচ্চারণ করবে! কিন্তু যার উপর ঈশ্বরের কৃপা নাই সে ব্রাহ্মণ হলেও বেদ পাঠ করতে পারবেনা, আর করলেও তা নিষ্ফল হবে!” একথা শুনে প্রধান পুরোহিত খুব রেগে গেল এবং বলল, _”ছোকরা তো খুব বড় বড় কথা বলছ, বলাও তো মহিষের মুখ দিয়ে বেদমন্ত্র!” প্রধান-পুরোহিতের এতো রাগ দেখে জ্ঞানদেব হাসলেন এবং ধীরে ধীরে মহিষটির কাছে গিয়ে বললেন, “হে মহিষ! তুমি এই ব্রাহ্মণদের একটু বেদ পাঠ করে শোনাও, কারণ তোমার মুখ থেকে বেদপাঠ শুনতে এরা খুবই আগ্রহী!” জ্ঞানদেবের কথা শেষ হতে না হতেই _ সবাইকে অবাক করে দিয়ে, ওই মহিষটির মুখ দিয়ে বেদমন্ত্র উচ্চারিত হতে শুরু করল! এই ঘটনা বহু লোকের সামনে ঘটেছিল, ফলে ঘটনাটা রেকর্ডেড সত্য! কিন্তু এই ঘটনার পর জ্ঞানদেবদেরকে গ্রাম ত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছিল।

জিজ্ঞাসু:– জ্ঞানদেবের পরবর্তী জীবনকালের আরো কিছু ঘটনা যদি বলেন মহারাজ, তাহলে খুব ভালো হয়?

গুরু মহারাজ:– এই ঘটনার পর, ওরা চার ভাই বোন বিভিন্ন তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াতে লাগল! এইভাবে বেড়াতে বেড়াতে তারা এসে পৌঁছালো মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত বিটঠল মন্দিরে! ঐ মন্দিরে ঠাকুরের বিগ্রহকে আরতির আগে মন্দিরের পোষা হাতি মালা পরাতো_আর এইটা ছিল তখনকার দিনে খুব দর্শনীয় বিষয়, তাই আরতির আগে মালা পরানো দেখার জন্য অনেক মানুষের ভিড় হতো এ মন্দিরে। জ্ঞানদেবরা যেদিন ঐ মন্দিরে গিয়েছিলেন, সেদিন হাতিটি শুঁড়ে করে মালা নিয়ে সরাসরি এসে জ্ঞানদেবের গলায় পরিয়ে দিয়েছিল! এই ঘটনায় সেদিন মন্দির প্রাঙ্গণে হৈ হৈ পড়ে গিয়েছিল! উল্লেখযোগ্য এই ঘটনা ঘটার পর, সেইসময় চারিদিকে বিভিন্ন সাধুমহল বা পন্ডিত মহলেও জ্ঞানদেবকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল।

সেই সময় নামদেব নামে আরেকজন মহাত্মা ওই অঞ্চলেই থাকতেন_ মন্দিরের হাতি তাঁকে কোনদিন গলায় মালা পড়িয়ে বরণ করেনি, অথচ বালক জ্ঞানদেবকে হাতি মালা পরালো_ এই ঘটনায় নামদেব খুব ভেঙে পড়েছিলেন! তার দীর্ঘদিনের কঠিন সাধনা সত্ত্বেও তিনি কেন ঈশ্বরের কৃপা থেকে বঞ্চিত হলেন_ এই জিজ্ঞাসা নিয়ে বিটঠলজীর মন্দিরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে প্রার্থনা জানাতে লাগলেন _উত্তরের প্রত্যাশায়! বহুক্ষণ পর দৈববাণী হয়েছিল যে, ‘নামদেবের সাধন-ভজন থাকলেও _ এখনো তাঁর সদগুরু লাভ হয়নি! তাই তাঁর মধ্যে এখনো পূর্ণতা আসেনি! নগরের প্রান্তে যে জীর্ণ শিবমন্দির আছে, সেখানে গেলেই নামদেব তার প্রত্যাশিত গুরুর দেখা পাবে!’ সেই রাত্রিটি ছিল প্রচন্ড ঝড়ঝঞ্ঝা পূর্ণ _কিন্তু নামদেব পাগলের মত সমস্ত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সেই রাতেই চলে গেলেন সেই জীর্ণ শিব মন্দিরে! কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখলেন এক অদ্ভুত দৃশ্য _এক বৃদ্ধ ব্যক্তি মন্দিরে শিব লিঙ্গের মাথায় পা চাপিয়ে শুয়ে আছে! রাগে জ্ঞানহারা হয়ে নামদেব বৃদ্ধটিকে গালাগালি দিতে দিতে জোর করে তার পা দুটো ধরে নামিয়ে দিলো! কিন্তু দিলে কি হবে যেখানে ওই বৃদ্ধের পা পড়লো _ সেখানেও দেখা গেল আর একটা শিবলিঙ্গ রয়েছে! নামদেব ভাবলেন আরেকটা শিবলিঙ্গ বোধহয় ওই মন্দিরে ছিল _ তাই তিনি আবার ওই বৃদ্ধের পা-দুটো ধরে দিলেন এক টান! ফলে এবার পা অন্যদিকে পড়ল বটে কিন্তু সেখানেও দেখা গেল ঐ বৃদ্ধের পা রয়েছে একটি শিব লিঙ্গের মাথায়! এবার ঘাবড়ে গেলেন নামদেব _বুঝতে পারলেন এই বৃদ্ধ ব্যক্তি নিশ্চয়ই সাধারণ কেউ নয়! তিনি সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধের পা দুটো জড়িয়ে ধরে তাঁর পরিচয় জানতে চাইলেন। সঙ্গে সঙ্গেই সেই বৃদ্ধ অদৃশ্য হলো এবং ভেসে এলো দৈববাণী, _ “নামদেব! আমাকে চিনতে পারলি না _আমি দেবাদিদেব মহাদেব! এই পৃথিবী, বিশ্ব-চরাচর সবই শিবময়! তোর অহংকার এবং অভিমান এখনো বর্তমান থাকায়, তুই এটা বুঝতে পারছিস না। এই দুটি থেকে মুক্ত হলেই তোর জীবনে পূর্ণতা আসবে!”

নামদেব বুঝলেন যে,জ্ঞানদেব অহংমুক্ত, তাই বয়সে ছোট হওয়া সত্ত্বেও তার উপর ঈশ্বরের কৃপাহয়েছে! যেটা অনেক সাধনার পরেও তাঁর এখনো কাটেনি! তাই নামদেব ফিরে গেলেন মন্দিরে এবং সেখানে গিয়ে বালক জ্ঞানদেবকে জড়িয়ে ধরে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এরপর থেকেই নামদেব ধীরে ধীরে অন্তর্মুখী হয়ে পূর্ণতালাভ করেছিলেন।

জ্ঞানদেবের রচিত গীতা “জ্ঞানেশ্বরী গীতা” নামে পরিচিত, যা সাধু-সমাজে খুবই আদৃত! বাংলাতেও এর অনুবাদ রয়েছে, পড়ে দেখো _খুবই ভাল লাগবে!

মহারাষ্ট্র এইরকম বেশ কয়েকজন মহাপুরুষের লীলাভূমি! এদের মধ্যে সিরিডি সাইবাবা, গোরাকাকা, পুণ্ডরীক প্রমূখের নাম উল্লেখযোগ্য! জিজ্ঞাসু:—- আচ্ছা বাবা! বলা হয় পিতা-মাতাই ঈশ্বর, তাহলে অন্য দেবদেবীকে মানার প্রয়োজন কি?

গুরু মহারাজ:— বেদে আছে_ “পিতৃদেবো ভব”, “মাতৃদেবো ভব”! কিন্তু তোমাদের মধ্যে কজন পিতা বা মাতাকে ঈশ্বর জ্ঞানে ভক্তি করে! আবেগপ্রবণতা দিয়ে কোন কাজ হয়না_ সর্বক্ষণ, সর্ব অবস্থায় পিতা-মাতাকে ঈশ্বর-ঈশ্বরী জ্ঞান করা সহজ কথা নয়! তাদের কর্তব্যের ত্রুটি দেখিয়ে ছেলেমেয়েরা বাবা-মার কত সমালোচনা করে, তাদের দোষ ধরে, বৃদ্ধ বয়সে অমর্যাদা করে_ সুতরাং তাদের মুখে এসব কথা মানায় না! জীবন্ত বিগ্রহকে সর্ব অবস্থায় নিঃসন্দেহে এবং নিঃসংশয়ে মেনে নেওয়া খুবই কঠিন কাজ! সেজন্যই তো দরকার হয় কোন কাঠের বা মাটির অথবা পাথরের বিগ্রহের!কোন বিগ্রহকে অদৃশ্য, অলৌকিক শক্তির অধিকারী রূপে কল্পনা করে নিলে, তাতে দেবত্ব আরোপ করতে আর অসুবিধা হয় না! এই জন্যই দেখবে, বেঁচে থাকতে পিতামাতার জন্য বিশেষ কিছু না করলেও মৃত্যুর পর তাদের ফটোতে ফুল মালা দেবার ঘটা করে অনেকে !

কিন্তু প্রকৃত‌ই যদি কেউ পিতা-মাতাকে দেবদেবী জ্ঞান করতে পারে, তাহলে তার অন্য দেবদেবীর মূর্তির_ সত্যি সত্যিই কোন প্রয়োজন হয় না! এরকম উদাহরণ রয়েছে শাস্ত্রে! এইরকমই একটা ঘটনার কথা বলছি শোনো! একটু আগেই বলছিলাম_ মহারাষ্ট্রের পুণ্ডরীকের কথা!তার‌ই ছোটবেলাকার ঘটনা এটা! অধিক বয়সে সন্তান হওয়ায় পুণ্ডরীক কিশোর বয়স্ক হতে না হতেই তার বাবা-মা খুবই বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিল! কিন্তু পুণ্ডরীক সাক্ষাৎ ঈশ্বর এবং ঈশ্বরী জ্ঞানে পিতা-মাতার সেবা করতো! সারাদিন তার অতিবাহিত হয়ে যেত পিতামাতার সেবায়_এর ফলে পুণ্ডরীক বন্ধুদের সাথে খেলা করতেও যেত না,এমনকি কোন অনুষ্ঠান বা উৎসবে যোগ দিতেও যেতো না! ওদের গ্রামে জন্মাষ্টমী উৎসব উপলক্ষে খুবই ধুমধাম হত! গ্রামের সকল মানুষ সুসজ্জিত হয়ে একটা নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হয়ে কৃষ্ণের জন্ম-উৎসব পালন করতো। সেবার জন্মাষ্টমীর সন্ধ্যায় প্রচণ্ড গরম পড়েছে, একটুও হাওয়া নাই বাইরে। ঘরের মধ্যে পুন্ডরীকের বৃদ্ধ বাবা-মা খুবই কষ্ট পাচ্ছেন দেখে পুন্ডরীক তার কোলের একদিকে বাবাকে ও অপরদিকে মাকে শুইয়ে_দুই হাতে দুটো পাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগলো! কিছুক্ষণ পরে পরেই তার হাত ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিল, ফলে সে পাখা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছিল। কিন্তু বাবা-মা আবার ঘেমে যাচ্ছে বা কষ্ট পাচ্ছে দেখে পুন্ডরীক আবার হাত চালাচ্ছিল।

এদিকে পাড়ার ছেলেরা সকলেই পুন্ডরীককে উৎসব-স্থলে যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়ে একে একে সবাই মন্দিরে চলে গেল! গ্রামবাসীরা সকলেই চলে গেলেও শুধুমাত্র পুন্ডরিক একা তার বাবা-মায়ের সেবা করার জন্য গ্রামের মধ্যে থেকে গেল! বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর রাত্রি যখন একটু গভীর হল_পুন্ডরীকের ক্লান্ত হাত বারবার শিথিল হয়ে উঠছে, সারাদিনের পরিশ্রমের পর_ ক্লান্তি তার সর্বশক্তি হরন করতে চাইছে, ঠিক তখনই সারা ঘর আলো করে একটি কালো রঙের ছেলে ঘরে এসে উপস্থিত হোল! ছেলেটি জিজ্ঞাসা করলো_” জন্মাষ্টমী উৎসবে তুমি যাওনি কেন?” ছেলেটি যাতে কথাবার্তা বাড়াতে না পারে তার জন্য মুখে আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় তাকে চুপ করতে বললো পুন্ডরীক, আর ফিসফিস করে বললো যে, অনেক কষ্টে সে তার পিতা-মাতাকে ঘুম পারিয়েছে_ তাই অযথা কথা বলে ওই ছেলেটি যেন তাদের ঘুম না ভাঙায়! কালো ছেলেটি সে কথা না শুনে আবার বলল,_ “তোমাদের বাড়িতে আমি প্রথমএসেছি_ তুমি আমাকে বসতেও বলবে না!” পুণ্ডরীক সে কথা শুনে একটা ইঁট নিয়ে ডান হাতে করে তার দিকে ছুড়ে দিয়ে বললো_”ওটাতে বস!” কিশোরটি একটু আগিয়ে এসে ঘরে ঢুকে যেই না ওই ইঁটের উপর দাঁড়িয়েছে_ অমনি একটা উজ্জ্বল আলোর জ্যোতিতে ঘরটা ঝলমল করে উঠল। চমকে উঠে সে দেখলো_ ছেলেটি আর নাই, তার বদলে ইঁটের উপর দণ্ডায়মান অপূর্ব কৃষ্ণমূর্তি! এটিই মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত কৃষ্ণমূর্তি বিটঠলজী! মারাঠি ভাষায় ‘বিট’- মানে ইঁট এবং ‘ঠল’ মানে দাঁড়ানো! ইঁটের উপর দণ্ডায়মান_তাই বিটঠলজী! পরবর্তীকালে ঐ স্থানকে কেন্দ্র করে_ কত সাধক যে সিদ্ধ হয়েছেন তার ঠিক নেই! একটু আগে নামদেব বা জ্ঞানদেবের যে কথা বলা হয়েছিল সেটাও এই বিখ্যাত মন্দিরের‌ই ঘটনা!

যাইহোক, এসব কথা থাক, যা বলছিলাম সেখানেই ফিরে আসি! তাহলে দেখা গেল_গভীর আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠা সহকারে পিতা-মাতার সেবা করলেও ভগবৎ কৃপালাভ হয়। ঘটনাটি থেকে দেখা যায় যে,পুন্ডরীকের পিতা-মাতার কৃষ্ণদর্শন হলো না কিন্তু পিতা-মাতার সেবা করে তার ছোট বয়সেই কৃষ্ণদরশন হয়ে গেল! এই ঘটনার পর থেকেই পুণ্ডরীকের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীকালে তিনি একজন মহাত্মা রূপে পরিগণিত হন। এবার বুঝলে তো রহস্যটা কি! মুখে চিনি- চিনি বললে কি মুখ মিষ্টি হবে? হবে না! তেমনি মুখে ফটর-ফটর করলে কোন লাভ হয়না_ কাজে প্র্যাকটিকাল করে দেখাতে হয়! “মহাজন গতাঃ স পন্থা শ্রেয়ঃ” মহাজনের পথই প্রকৃষ্ট পথ! বিভিন্ন ধরনের শাশ্ত্রে বিভিন্ন কথা লেখা আছে! সেসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করা যেতে পারে_ কিন্তু কাজের কাজ যে করতে চায় সে গ্রন্থে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে না!সে তার স্বভাব অনুযায়ী কোন মহাপুরুষকে আদর্শ করে এবং তাঁকে অনুসরণ করে সাধন-ভজন করতে শুরু করে দেয়! এভাবে করতে থাকলে অচিরেই ঈশ্বরের কৃপা লাভ হয়, আর ঈশ্বরের কৃপা লাভ হলে ঐ সাধকের জীবনে কোন না কোন মহাপুরুষের সংস্পর্শ ঘটে! মহাপুরুষের সঙ্গলাভ হয়ে গেলে, অবশিষ্ট সাধনের কাজটা তিনিই করিয়ে নেন। এটাই আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে চলার ক্রম। তোমরাও এই পথেই এগিয়ে চলো_ চরৈবেতি- চরৈবেতি !