স্থান:– শিবপুর হাওড়া।
সময়:— জুন, 1980
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:– গঙ্গা বাবু, এনাঙ্কবাবু, জনৈক ডাক্তার, টুকুদি ও চিনু(কদমতলা), রত্না প্রমুখেরা।

জিজ্ঞাসু:– রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে_ “যে জাতি জীবন হারা অচল অসার, পদে পদে বাঁধে তারেজীর্ণ লোকাচার”! আমাদের শাস্ত্রেও তো বিভিন্ন বিধি নিষেধ বা লোকাচার রয়েছে, এগুলি কি জাতির অবক্ষয়ের কারণ নয়? আমরা আমাদের শাস্ত্রের প্রাচীনত্ব এবং মহত্ব নিয়ে গর্ব করি অথচ এগুলি কি?

গুরু মহারাজ:– “আমাদের শাস্ত্র”_ বলতে তুমি কোন শাস্ত্র বোঝাতে চাইছো? ভারতবর্ষে বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিভিন্ন শাস্ত্র রয়েছে, কিন্তু সেগুলি যে সবই ঋষিদের সৃষ্টি বা তাঁদেরই বক্তব্য সেগুলিতে রয়েছে_ তা তো নয়! ভারতীয় শাশ্ত্র থেকে যদি শিক্ষা নিতে চাও তাহলে শ্রীমদ্ভগবদগীতার শিক্ষা গ্রহণ করো, কারণ গীতায় স্বয়ং ভগবানের বাণী রয়েছে। এছাড়া তুমি আধুনিককালের শ্রীরামকৃষ্ণ বা স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারো।

তবে, তুমি সমাজের বিধান সর্বস্ব যেসব শাস্ত্রের কথা বলছো_ সেগুলিকে বলা হয় ‘স্মৃতিশাস্ত্র’! পশ্চিমবঙ্গে যেমন রঘুনন্দনের স্মৃতিশাস্ত্রের প্রচলন আছে_ তেমনি ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রান্তে অন্যান্য স্মার্তকারদের স্মৃতিশাস্ত্র বা সামাজিক বিধান চলে। দ্যাখো না_ বাংলায় শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের যে বিধান বা নিয়ম চালু রয়েছে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের গেলে দেখবে সেখানকার নিয়ম ভিন্ন। এগুলি সামাজিক বিধি নিষেধ ! এক একটা সমাজের জন্য সেখানকার পন্ডিতবর্গ এবং সমাজপতিরা মিলে সেগুলি সমকালীন দৃষ্টি দিয়ে রচনা করেছিলেন। এখনকার দিনে যেমন সংবিধান সৃষ্টি হয়েছে_ঠিক তেমনি! এক এক দেশের এক একরকম সংবিধান_বুঝতে পেরেছ? সে যুগে অর্থাৎ যখন স্মৃতিশাস্ত্র গুলি রচিত হয়েছিল তখন মানুষকে কিছু সামাজিক অনুশাসন বা নিয়ম কানুন মেনে চলার জন্য এইগুলি লেখা হয়েছিল। পরে হয়তো পুরোহিততন্ত্রের যুগে সেগুলির মধ্যে ধর্মের কিছু আচার সংযোজন করে দেওয়া হয়েছে! রাজতন্ত্রের যুগে এগুলোকে আবার সংস্কার করা হয়েছে_ এইভাবে এই স্মৃতিশাস্ত্র গুলি গড়ে উঠেছে।

কিন্তু এগুলির সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোন সম্পর্ক নেই তো! কোন অবতারপুরুষ বা মহাপুরুষ কবে বলেছেন বিধানসর্বস্ব শাস্ত্র গুলিকে মেনে চলতে? ওইগুলি মেনে চলার কথা পুরোহিতরা বলে থাকে_ কিন্তু তোমরা মহাপুরুষদের কথা ছেড়ে পুরোহিতদের কথা নাও কেন ? ঈশ্বর বা শাস্ত্রের চেয়ে পুরোহিত বড় আল্লাহ বা কুরআনের চেয়ে মোল্লা বড়_ এই করতে গিয়েই আধুনিক মানব সমাজে যত সমস্যা এসে দাঁড়িয়েছে! শাস্ত্র বলেছে_ “মহাজন যেন গতঃ স পন্থাঃ।” এই কথাগুলি ভুললে হবে কেন?

কোন “একটা” নিয়ম কখনোই চিরস্থায়ী হতে পারে না, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বদলে যায়_ এটাই বিবর্তনের ধারা। সুতরাং সময়ের সঙ্গে সামাজিক পুরোনো নিয়মকেও বদলে নিতে হয়_ সংস্কার করে নিতে হয়! তবে এখানে দেখতে হবে যেন সেই সংস্কার টি কোন উন্নত মহাপুরুষের দ্বারা করা হয়, নাহলে কিন্তু সমাজ সেই সংস্কারের সুফল তো পাবেই না বরং পরবর্তী কালের মানুষেরা নানান ভোগান্তির শিকার হবে। তাছাড়া_কি হয়েছে জানো_ ভারতবর্ষের বেশিরভাগ শাস্ত্র‌ই, পরবর্তীকালে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে অর্থাৎ মূল ভাব বা ভাবনার কথা কেটে দিয়ে_তাতে বিদেশিদের বা কিছু আধুনিক পণ্ডিতের মতামত ঢুকে গেছে! এর ফলেই আরো সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে! সেজন্যই আজকের ছেলেমেয়েরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন শাস্ত্র পাঠ করে বিভ্রান্তির শিকার হয়! অনেক সময় দেখা যায় একই শাস্ত্র-গ্রন্থে নানারকম স্ববিরোধী উক্তি লেখা আছে, এইসবের জন্য আমাদের প্রাচীন রীতি ছিল সদ্গুরুর পদপ্রান্তে বসে তাঁর কাছ থেকে শাস্ত্রের পাঠ নেওয়া! গুরু যদি realised person বা আত্মজ্ঞানী হন_ তাহলে তো কথাই নেই, আর তা না হলেও যদি তিনি কোন উন্নত পরম্পরার উত্তরসূরীও হন_ তাহলেও তিনি শিষ্যের সমস্ত বিভ্রান্তি দূর করতে সমর্থ হবেন। দ্যাখো, সমাজের সাধারন যেসব আচার বা বিধানের কথা তুমি বলছো_ সেসব বেশিরভাগই কোন না কোন পাঁচালীর কথা অথবা কোন পুরোহিত দর্পণের কথা_ যা কিছু স্বার্থসর্বস্ব টোলের পন্ডিতদের লেখা‌। আবার কিছু কিছু কথা আছে যেগুলি ‘খনার বচন’ নামে গ্রন্থ থেকে নেওয়া। রঘুনন্দনের স্মৃতিশাস্ত্রে যা লেখা আছে তা কজনই বা পড়ে?

ওই যে এখনি বললাম ‘খনার বচন’_ এটা বাংলায় খুবই প্রচলিত! কিন্তু ঐতিহাসিকদের মতে আনা বালীলাবতী ছিলেন বর্তমান শ্রীলংকার মেয়ে,অর্থাৎ দক্ষিণ ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তাই সুললিত বাংলায় তাঁর লেখা শ্লোক ‘খনার বচন’_কি করে হোতে পারে? এগুলি স্থানীয় পন্ডিতের লেখা_ ওনার লেখাই নয়! হয়তো তিনি দক্ষিণ ভারতীয় ভাষায় কিছু কথা সূত্রের আকারে বলে গিয়েছিলেন, সেগুলো থেকেই কোন পন্ডিত হয়তো কিছুটা অনুবাদ করেছে।

এই ভাবেই বর্তমানে লিখিত শাস্ত্র গ্রন্থাদির বিষয়বস্তু কত পাল্টে গেছে তার ইয়ত্তা করতে পারবেনা। সেইজন্য বিচারবোধ কে জাগ্রত রেখে সব কিছুকে গ্রহণ করবে, তখন দেখবে আর তোমার মনে কোন ক্লেশ আসবে না বা বিরোধ সৃষ্টি হবে না। যথার্থ অনুসন্ধানের ইচ্ছাই আধ্যাত্মিকতার সোপান। অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন বা বিরোধ করা আধ্যাত্মিকতার পরিপন্থী। কথাগুলি মনে রাখলে জীবনে সুফল পাবে।

জিজ্ঞাসু:—শিব তো বৈদিক দেবতা নন, তবু তাকে “দেবাদিদেব” বলা হয়েছে কেন?

গুরু মহারাজ:– শিব বা সদাশিব_ তন্ত্রের স্রষ্টা। তবে তিনি শুধু আগম নয় নিগমের‌ও প্রবক্তা বলে_ ভারতীয় শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে। আমি যখন হিমালয়ের গভীরতম প্রদেশগুলোতে ঘুরছিলাম, তখন সন্ন্যাসী পরম্পরায় সদাশিব সম্বন্ধে যে কথাগুলি চালু রয়েছে তা শুনেছিলাম। ওখানে ওনারা বলেছিলেন_ সদাশিব একসময়(হয়তো 12-14 হাজার বছর আগে) পৃথিবীতে শরীর ধারণ করে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। খুব সম্ভবত তাঁর তিব্বতীয় শরীর ছিল, তাই তিনি চমরি গরুর পিঠে চেপে হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন এবং মানুষকে শিক্ষা দিতেন‌। মহাজ্ঞানী, মহাযোগী ও মহা ত্যাগী ছিলেন এই সদাশিব। তৎকালে এমন কোন বিজ্ঞানের শাখা ছিল না_ যে শাখায় তিনি পারদর্শী ছিলেন না!

শিব পূর্ববর্তী সভ্যতাকে ‘বৈদিক সভ্যতা’ না বলে ‘আর্য সভ্যতা’ বললেই ঠিক বলা হয়। হিমালয়কে কেন্দ্র করে এই ‘আর্য সভ্যতা’ বা আর্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। ফলে এর বাইরের অঞ্চলের মানুষ-জনকে ‘অনার্য’ বলে আখ্যায়িত করা হতো! সদাশিব এই ব্যাপারটাতে আঘাত হানেন! তিনি তথাকথিত অনার্য সংস্কৃতি গুলির যে ভালো দিক আছে সেগুলিকে গ্রহণ করে সমস্ত সংস্কৃতি কে মিলন ঘটিয়ে এক বৃহত্তর আর্য সংস্কৃতির রূপ দান করেন। তৎকালীন জ্ঞানীরা অর্থাৎ দেবতা,ঋষি,মুনি ইত্যাদিরা এবং উত্তর ভারতের রাজা প্রজাপিতা(প্রজাপতি নয়)দক্,ষ তাঁকে প্রথমে মানতে রাজি হননি। সদাশিবের কাজে সহায়তা করার জন্য স্বয়ং জগন্মাতা দক্ষকন্যা রুপে জন্মগ্রহন করেছিলেন। তারপর মহাকালের নিয়মে তাঁদের মধ্যে বিবাহ হয় এবং তার ফলস্বরূপ “দক্ষযজ্ঞ”_যে ঘটনা তোমাদের সকলের জানা!

এখানে এই গল্পের মধ্যে থেকে সার-অংশ খুঁজে বের করলে দেখা যাবে_ওই সভায় বিভিন্ন পন্ডিত ও জ্ঞানী লোকদেরকে (অর্থাৎ দেবতা ঋষি মুনি দেরকে) আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল কিন্তু সদাশিবকে আমন্ত্রণ করা হয়নি। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সদাশিব তার এক অনুচর বীরভদ্রকে সভাস্থলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন! তিনি তাঁর সুচিন্তিত মতামত দিয়ে রাজা দক্ষ এবং তাঁর পন্ডিতদের মতগুলিকে এমন ভাবে খন্ডন করেছিলেন যে, দক্ষের কথার আর কোনো মূল্যই থাকল না! সেই মহাজ্ঞানী শিবানুচরের যুক্তির কাছে_ দক্ষের যুক্তি ছাগলের মত ব্যা-ব্যা শোনাচ্ছিল! সেই জন্যই বলা হয়েছে দক্ষের ছাগ-মুন্ড হয়েছিল! রূপকাকারে থাকা পুরাণাদি শাস্ত্রের ব্যাখ্যা ভালো করে বুঝতে না পারলে এগুলিকে নিছক ছেলেভুলানো গল্প বলে মনে হবে! ওই জন্যেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন_ “শাস্ত্রে দুধে-জলে মেশানো আছে, জলটা ফেলে দুধ খেতে পারলে তবেই শাস্ত্রের স্বাদ পাওয়া যাবে।

যাইহোক, এর পরেই দেখা যায় শিবকে সকলের শ্রেষ্ঠ যোগ্য সম্মানের আসনে বসানো হয়েছিল। এই ভাবেই প্রাচীন আর্যচিন্তা শিবচিন্তার সঙ্গে মিশে আরো বলিষ্ঠ এবং স্থায়ীরূপে ভারতবর্ষে আত্মপ্রকাশকরেছিল। এরপরেই বৈদিক পঞ্চাশাখায় “শৈব” এবং “তন্ত্র” উভয়ই অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল! কিন্তু আরো পরবর্তীকালে বেদে উল্লেখিত রুদ্র এবং তন্ত্রের শিবের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলায় সাধারণের কাছে শিবচরিত্র একটা জটিল আকার ধারণ করেছে!

তবে তোমাদের যে কথাটা এখনি বললাম যে, সদাশিব কোন এক সময় পৃথিবীতে শরীর গ্রহণ করেছিলেন _এর অনেক নিদর্শন এখনো রয়েছে! তার মধ্যে কিছু হয়তো লোকচক্ষুর গোচর,কেন না তিব্বতের বিভিন্ন গুহায় শদাশিবের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্রের নিদর্শন এখনও পাওয়া যায়। কিন্তু শিবের শরীর গ্রহণের প্রকৃত প্রমাণ রয়েছে উন্নত যোগীদের কাছে ! বাহ্যিকভাবে আরও প্রমাণ রয়েছে _যেমন হরিদ্বারের কাছে কন্খলে এখনো দক্ষযজ্ঞের স্থানটি চিহ্নিত করা আছে‌। সদাশিব সম্বন্ধে আরো কিছু কথা বলা যায়_মানস-সরোবর এবং কৈলাসের যাত্রাপথে এখনো এমন কিছু দুর্গম জায়গা আছে যেখানে সাধারণ মানুষের পদার্পণ এখনো হয়নি। একমাত্র যোগীরা যোগবলের সাহায্যে সেখানে যেতে পারেন! পরম্পরাগত ভাবে আজও বিভিন্ন সাধু-সন্ন্যাসীরা জানেন _সদাশিবের সঠিক আস্তানা কোথায় ছিল এবং এখনো সেখানে কি আছে! এছাড়াও _শিবের মহিমা বর্ননা করে যে প্রাচীন স্তবটি আছে, সেটি পাঠ করলে শিবের শরীরের ও গুনের পরিচয় পাওয়া যায় _সেগুলি থেকে পরিস্কার বোঝা যায় যে উনি একজন তিব্বতীয় যোগী ছিলেন।

এবার কথা হচ্ছে শিবকে দেবাদিদেব বলা হয় কেন_ তার কারণটা বলছি। শাস্ত্রে বলেছে_ “যে দেয়, সেই দেবতা”! শিব মহাত্যাগী, আর ত্যাগ-ই মানবের আদর্শ! অষ্টসিদ্ধি যার করায়ত্ত_তিনিই আবার ভিখারী, গোটা স্বর্গরাজ্য_ইন্দ্রত্ব ইত্যাদি সবকিছু যাঁর চরণে লোটায়, কিন্তু সমস্তরকম ভোগের ব্যাপারে তিনি এতটাই নির্লিপ্ত যে_তাঁর কোন আকাঙ্ক্ষা তো দূর-অস্ত, তাঁর নিজের বসনের‌ই ঠিক থাকেনা। তাঁর এই অসাধারণ ত্যাগের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে, সাক্ষাৎ জগন্মাতা রাজরাজেশ্বরী হয়েও তাঁর অনুগমন করেন! চিকিৎসাবিদ্যা, সমাজবিদ্যা, অধ্যাত্মবিদ্যা, কৃষিবিদ্যা ইত্যাদি অসংখ্য বিদ্যা তিনি সকল শ্রেণীর মানুষের উপযোগী করে সমাজকে উপহার দিয়েছিলেন! এইজন্যে শিবের মহিমা ব্যাখ্যা করা সত্যিই বড় কঠিন কাজ! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ শিবের পূজা করতে গিয়ে_তাঁর মহিমা বর্ননা করতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন_ “শিব গো, তোমার গুনের কথা এক মুখে বলতে পারব না!” শিব_ পশুপাখিদের দেবতা, তাই তাঁর নাম পশুপতি! ভূত-প্রেতের তিনি উদ্ধারকারী_তাই তিনি ভূতনাথ, ভুতেশ। সকল লোকের তিনিই ত্রাতা_ তাই তিনি লোকনাথ! ত্রিকালের অতীত, তাই তিনি মহাকাল! এই ভাবেই সর্বদেবতার‌ও তিনি দেবতা_ তাই তিনি দেবাদিদেব! ত্রিলোকের তিনি দেবতা_ তাই তিনি ত্রিদেব! কিন্তু এতো কিছু সত্বেও_ বাঘছাল তাঁর বসন, শ্মশানে অথবা দূর কৈলাসের কোন গুহায় তাঁর বাস_ সবার প্রাণনাশকারী অভক্ষ তীব্র হলাহল “কালকূট”_ তাঁর খাদ্য হয় লোক কল্যাণের জন্য! তাঁর দ্বারা সকলের শুধু কল্যাণ‌ই হয় তাই তিনি শিব। সেইজন্যই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন,_”হে ভারত! ভুলিও না_ সর্বত্যাগী শংকর তোমার আদর্শ!”

জিজ্ঞাসু:– আপনার কথা শুনে মনে বড় শান্তি হচ্ছে_ কিন্তু বর্তমান পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখুন_ সারা বিশ্ব জুড়ে শুধুই যেন যুদ্ধের আর ধ্বংসের প্রস্তুতি চলছে! এই যে অশান্তির আগুন পৃথিবীব্যাপী জ্বলছে_ এটার কারণ‌ই বা কি, আর এর থেকে নিবৃত্তির উপায়‌ই বা কি?

গুরু মহারাজ:–দ্যাখো, মানুষ তাঁর মনোজগতেই গড়ে তোলে ধ্বংসের প্রস্তুতি_ আবার মানুষই পারে নিজেই নিজেকে এই ধ্বংসের হাত থেকে মুক্ত করতে! জীব বিবর্তনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় জীবের ক্রমোন্নতির কারণ_ নিরাপত্তার অভাব বোধ! insecurity-ই, জীবকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী! জড় থেকে চেতন এবং চেতন থেকে চৈতন্যের দিকে যে অগ্রগতি_ এর একমাত্র কারণ ঐ insecurity । বর্তমানে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যে অস্ত্র-প্রতিযোগিতা আর যুদ্ধ বা ধ্বংসের ভয়াবহতার ছায়াদেখছো_তার‌ও কারণ সেই নিরাপত্তার অভাববোধ! এর হাত থেকে সঠিকভাবে বাঁচার উপায় কি, তা না জেনে বিভিন্ন বাহ্য উপায় অবলম্বন করতে চাইছে বর্তমানের সভ্য মানুষ_ আর তাতেই ঘটে চলেছে বিপত্তি! তথাকথিত উন্নত দেশগুলির অস্ত্রের ঝনঝনানি, যুদ্ধ এবং রক্তপাত দিয়ে নিজেরা দেখাতে চাইছে_ তারা কত উন্নত জাতি।হায় উন্নতি_ হায় বীরত্ব! আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভগবান বুদ্ধদেব তাঁর শিষ্য অশ্বলকে বলেছিলেন, “যুদ্ধবাজ বীর নয়, অহিংসক-ই বীর!” তিনি আরো বলেছিলেন,_”প্রাণ নিতে পারাটা কোন কৃতিত্ব নয়,প্রাণ দেওয়াটাই কৃতিত্বের পরিচয়!”

তাহলে এই insecurity-র হাত থেকে মুক্তি পাবার উপায় কি? একমাত্র উপায় নিজেকে উন্নত করে আত্মজ্ঞান লাভ করে “অভয়” হওয়া! দ্যাখো, দেশের কথা, রাষ্ট্রের কথা ভেবে তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না_ তুমি তোমার নিজের কথা ভাবো! কেন একথা বলছি, তার কারণটা বলছি_ দ্যাখো, তোমার দুশ্চিন্তা দিয়ে তো তুমি উন্নত দেশগুলির রাষ্ট্রনায়কদের চিন্তার পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না_ তাহলে কেন বৃথা দুশ্চিন্তায় দিনযাপন করবে? তার চেয়ে আনন্দে থাকো, আর আনন্দে থাকার art-টা শিখে নাও! ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল হ‌ও, সাধ্যমতো দুঃস্থ-আর্তদের সেবা করো, পরিবেশের সকলকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসো, কপটতা ত্যাগ কোরে_নিস্কপট হ‌ও। স্বার্থপরতা ও অসহজতা মুক্ত হয়ে_ সৎ ও সহজ হ‌ও! তাহলেই দেখবে_ তোমার অন্তর্জগতে আনন্দের আস্বাদন হতে শুরু করবে!

আর এই জগত সংসারের কথা যদি ধরো_সে যেমনটি চলবার, তেমনটাই চলবে! আমার গুরুদেব বলতেন_ “জগ ঝুট্ হ্যায়, কুত্তা কা পুছ্ হ্যায়।” জগৎ যেন কুকুরের লেজের মতো_ যতই সোজা করার চেষ্টা করো, ছেড়ে দিলেই আবার বেঁকে যাবে। কাজেই_ দেশের কি হবে, জগতের কি হবে_ এসব না ভেবে নিজের কি হবে, তার খোঁজ নাও! খুঁজতে খুঁজতে অন্তর্জগতের গভীরে ডুব দাও_দেখবে ঠিক মানিক-রতন উঠে আসবে !যদি ডুবতে না জানো, তাহলে কোন ডুবুরির কাছে গিয়ে_ কিভাবে ডুবতে হয়,তার শিক্ষা করো_ কি বললাম বুঝতে পারলে ?

তুমি যুদ্ধের কথা বলছিলে না_যুদ্ধ ব্যাপারটা মানুষের চরম অজ্ঞানতার ফল। আমার এসব দেখে মনে হয় পৃথিবী গ্রহ এবং এর সর্বোন্নত জীব মানুষেরা_ চেতনার বিকাশের নিরিখে এখনো শিশু অবস্থায় রয়েছে! দেখবে_ শিশুরা সামান্য কারণে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, পৃথিবীর মানুষের যুদ্ধ‌ও যেন ঠিক তাই।

বুদ্ধদেবের জীবনের আর একটা ঘটনা দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করছি_ শোনো! উত্তর ভারতের দুই রাজার মধ্যে একবার প্রবল যুদ্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল! এমনকি উভয় রাজাই তাদের সৈন্যদের নিয়ে একেবারে রণক্ষেত্রে হাজির‌ও হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যবশত ভগবান বুদ্ধদেব যুদ্ধক্ষেত্রের কাছাকাছি কোন স্থানে বিহার করছিলেন। যুদ্ধের খবর তাঁর কানে পৌঁছাতে দেরি হয় নি, তাছাড়া উভয় রাজাই ছিলেন বুদ্ধের শিষ্য_ তাই খবর পাওয়া মাত্রই বুদ্ধদেব অতিসত্বর যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছালেন! যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে উনি দেখলেন যুদ্ধ প্রায় শুরুর মুখে! উভয় পক্ষের সৈন্যরাই যুযুধান অবস্থায় শুধুমাত্র রাজার নির্দেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। যুদ্ধের ঘোষণা শুরু হয় হয়_ এমনসময় ভগবান বুদ্ধ দুইপক্ষের মাঝখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন! যেহেতু উভয় পক্ষের রাজাই তাঁর শিষ্য_তাই ভগবান বুদ্ধকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখে দুটি রাজাই তাদের নিজ নিজ রথ থেকে নেমে এসে বুদ্ধকে অভিবাদন জানাতে এবং আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে সেখানে এসে উপস্থিত হলো! ভগবান বুদ্ধ উভয় রাজাকেই জিজ্ঞাসা করলেন_”এই যুদ্ধের কারণ কি”? কিন্তু কোন রাজাই সঠিক উত্তর দিতে পারল না! তারা বলল, “মন্ত্রীরা জানে”! বুদ্ধদেব বললেন, “ডাকো মন্ত্রীদের!” মন্ত্রী দুইজন এসে মাথা চুলকে বলল, “প্রকৃত কারণটা সেনাপতিরা জানে!” সেনাপতিদেরকেও ডাকা হোল_ তারাও সঠিক কারণ বলতে পারলো না!এইভাবে “সঠিক কারণ কে জানে”_ খুঁজতে খুঁজতে শেষকালে দেখা গেল যে, আসল ঘটনাটা জানে উভয় রাজ্যের নগরপালরা! নগরপালদের মুখ থেকে যে ঘটনাটা শোনা গেল_ তা হলো যে, পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এই দুটি রাজ্যের সীমান্ত দিয়ে, প্রয়োজনে এদিকের মানুষ ওইদিকে যেতো এবং ওই দিকের মানুষ এদিকে আসতো! এইরকম একদল’ঘেসুরে’ (অর্থাৎ যারা ঘোড়ার জন্য ঘাস কাটে) ভিন্ রাজ্যের সীমানায় ঢুকে ঘাস কাটার সময় _সেই দেশের লোকের সঙ্গে কিছু অশান্তি করে বসে! এইটার জবাবে ওই দিকের লোকজন তাদের মারধর করে! এই ঘটনাটাই বাড়তে বাড়তে দুটো দেশের মধ্যে যুদ্ধের রূপ নেয়। বুদ্ধদেবের উপস্থিতিতে উভয় রাজাই প্রকৃত ঘটনার কারণ শুনে খুবই লজ্জিত হলেন এবং পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে যে যার ঘরে ফিরে গেলেন।

এই ঘটনাটা শুনে তোমরা কি বুঝতে পারলে যে, পৃথিবীর যে কোন যুদ্ধের প্রকৃত কারণ অতি সামান্যই হয়ে থাকে। শুধু কর্তৃত্বের অহংকার আর অভিমান বজায় রাখার জন্য যুদ্ধ করে মানুষ! যে কোন যুদ্ধের প্রকৃত কারণ খুঁজতে গেলে_ এটাই দেখবে যে, কোন একজন ব্যক্তি বা কোন রাষ্ট্র_ তার স্বার্থ বজায় রাখার জন্য এবং নিজেকে অপরের থেকে শক্তিশালী প্রমাণ করার জন্য_ যুদ্ধ বাধায়! তাতে হয়তো অসংখ্য লোক মরে, হাজার হাজার একর জমির ফসল নষ্ট হয়, কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়_ তবুও যুদ্ধ চাই! এসব দেখে কি মনে হয় জানো তো_ যে মানুষ নিজেকে যতই সভ্য বা উন্নত মনে করুক না কেন_ চেতনার বিকাশে তারা এখনও অবোধ শিশু!