স্থান:—-শিবপুর,হাওড়া।
সময়:—-জুন,1989.
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:—গঙ্গাবাবু,এনাঙ্কবাবু,পূর্ণানন্দ মহারাজ,রত্না এবং সিঙ্গুরের ভক্তগন।।

জিজ্ঞাসু:— পৃথিবীতে অজস্র মতবাদ রয়েছে_ এমন দিন কি কখনো আসবে যখন সকল মতাবলম্বী রা একমত হবে? কারণ তা না হলে তো মানুষে মানুষে বিভেদ কখনোই কাটবেনা?

গুরুমহারাজ:— তাই কখনো হয় নাকি? বৈচিত্র থাকবে! বহুর মধ্যে এক কে বোধ করাই মানব জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। যিনি সেই লক্ষ্যে উপনীত হতে পারেন, তাঁর আর কোন আলাদা মত বা আলাদা মতবাদ থাকেনা। তিনি তখন সব মতেই আছেন, আবার তিনি সকল মতের ঊর্ধ্বে! কিন্তু সাধারণ মানুষের তো সেই অবস্থা নয়_তাই তাদের মধ্যে তো মতভেদ থাকবেই। সেইজন্য সাধারণ মানুষকে_ বোধি ব্যক্তিদের প্রদর্শিত পথকে অনুসরণ করতে হয়। জগতে বোধি ব্যক্তিরা কখনোই কোন মত সৃষ্টি করেন না_ শুধু পথ বাতলে দেন। মত সৃষ্টিকারী লোক বা তাদের অনুগামীদেরকে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন “মতুয়া”! তাঁর কথা_ “মতুয়ার বুদ্ধি ভালো নয়”! দেখা যায়, বোধি ব্যক্তি বা মহাপুরুষগণের শিক্ষা জীবনে ঠিক ঠিক ভাবে গ্রহণ করলে_ মানুষ অসৎ হয় না! তাই যে কোন মহাপুরুষের শিক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্ন ‘মতাবলম্বীরা’_সৎ(সত্যাশ্রয়ী)হয়ে উঠুক না কেন_ তাহলেই তো সুস্থ সমাজ গড়ে উঠবে! কিন্তু বাস্তবে তা হয় না_ কারণ কোন মহাপুরুষের দেহত্যাগের মাত্র তিন জেনারেশন পর থেকে, তাঁর উত্তরসূরিরা ঐ মহাপুরুষের কথাগুলিকে তাদের মনোমত ব্যাখা করতে শুরু করে দেয় ফলে ভিন্ন ভিন্ন মতের সৃষ্টি হয়ে যায়। এরপর, একমতের সাথে অন্য মতের শুরু হয়ে যায় বিরোধ! এখন ধর্ম জগতে যত বিরোধ দেখছো_ তা এমনি ভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। দেখবে, সবাই যেন শিক্ষক_ শুধু অপরকে শেখাতে চায়, কেউ ছাত্র হতে চায় না!কিন্তু এটা কেউ মনে রাখে না যে, ভালো ছাত্র না হলে তার নিজেরও সঠিকভাবে শেখা হয়ে উঠবে না এবং সে কাউকে ভালো করে শেখাতেও পারবে না। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে, সেইটা বলছি শোনো!

সংখ্যা বিজ্ঞান জানে এমন 10 জন ব্যক্তি কোন এক জায়গায় যাচ্ছিল। পথে পড়ল একটা ভরা নদী, নদীতে কোন নৌকা ও ছিল না‌। ফলে তাদের সকলকে ওপারে যেতে হলে সাঁতরে পার হতে হবে। সৌভাগ্যবশত তারা সকলেই সাঁতার জানত_তাই অসুবিধা কিছু হলো না। কিন্তু ওপারে পৌঁছে সবাই ঠিকমতো পৌঁছাতে পেরেছে কিনা তা দেখার জন্য যখন তারা নিজেদেরকে গুনতে লাগল তখনই হলো সমস্যা_ কারণ সবাই গুনে আর দেখে তারা সংখ্যায় হচ্ছে 9 জন! কিন্তু তারা তো ছিলো 10 জন_ তাহলে আর একজন কোথায় গেল! প্রত্যেকেই সংখ্যা গুনতে জানে, ফলে সকলেই বারবার গুনছে_ কিন্তু সবার সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে সেই 9 জন। ফলে ওরা ধরেই নিলো যে ওদের একজন জলে ভেসে গেছে_এই মনে করে ওরা সকলে কান্নাকাটি করতে লাগলো!

একজন জ্ঞানী ব্যক্তি দূর থেকে দাঁড়িয়ে ওদের এইসব মজা দেখছিলেন_ তিনি এবার এগিয়ে এলেন এবং তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “ভাই সব! তোমাদের সমস্যাটা কি?” তারা উত্তর দিল, “দেখুন না মশাই! আমরা 10 জন বেরিয়েছিলাম অমুক জায়গা যাব বলে_ কিন্তু নদী পার হবার সময় আমাদের মধ্যে একজন জলে ভেসে গেছে, এখন আমরা ন’জন পড়ে আছি!”সব শুনে জ্ঞানী ব্যক্তি তাদেরকে বললেন _”দ্যাখো, তোমরা সংখ্যা বিজ্ঞানের theory-টা জানো কিন্তু practical-টা জানো না, অর্থাৎ তোমরা ‘গুণতে’ জানো কিন্তু ‘কি করে গুনতে হয়’- তা জানো না! এসো, আমি তোমাদের শিখিয়ে দিচ্ছি!” এই বলে, সেই ব্যক্তি নিজের বুকে হাত দিয়ে বলতে শুরু করলেন, বললেন _”রাম(এক)-দুই-তিন………..দশ”!লোক গুলি ওইভাবে গুনে দেখল যে তারা দশজনই আছে! এরপর তারা ওই জ্ঞানী ব্যক্তিকে ধন্যবাদ দিয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে হাঁটা লাগালো ।

এখানে গল্পের তাৎপর্য টা হচ্ছে যে, সমস্ত ধর্মমতের লোকেরাই ধর্মবিজ্ঞানের তত্ত্বটা জানে কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তা যোজনা করে না । এর ফলে কি হচ্ছে_ সবাই নিজের দোষ না দেখে, নিজেকে বাদ দিয়ে অপরের কি দোষ হচ্ছে, তাই দেখছে! ফলে আর তার হিসাব মিলছে না_ শুধু বিরোধ করতে করতেই জীবন কেটে যাচ্ছে! কিন্তু যথার্থ জ্ঞানী যখন কোথাও আবির্ভূত হন, তিনি প্রথমে নিজের জীবন দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে প্রকৃত ধর্ম বিজ্ঞানী হয়ে ওঠেন, তারপর তিনি সমাজের সকলকে ডেকে ডেকে শিক্ষা দেন,_ “বাবারা! ওভাবে হবে না, নিজেকে দিয়ে আগে শুরু করো_ তবে সংখ্যাটা সবার সাথে মিলবে! আমাকে দেখে শেখো_ আমি ষোল টাং করেছি তোমরা অন্তত এক টাং করো!” এনারাই পরবর্তী মানুষের কাছে জগৎগুরু হিসেবে পূজিত হয়ে থাকেন।

যাইহোক, দেখা যায় মানুষের চেতনা যত নিচের level-থাকে ততই সে বৈচিত্র্য না দেখে_ভেদ দেখে এবং মত ও পথ নিয়ে বিরোধ করে। আর যেসব ব্যক্তিরা চেতনায় সমুন্নত, তাদের সংকীর্ণতা কেটে গিয়ে তারা বৈচিত্রের মধ্যে সেই “এক”-কেই দেখতে পায়। এইজন্যই তো ঋষিরা বলতে পেরেছিলেন,_”এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু রয়েছে, তা সেই “এক” থেকে সৃষ্টি হয়েছে এবং কিছুকাল স্থিতি লাভ করার পর আবার সবকিছু সেই ‘একে’-তেই লয়প্রাপ্ত হয়ে থাকে!”

তবে, তুমি যে পৃথিবীর অজস্র মতবাদের কথা বলছিলে_ সেগুলি সবই যে মানুষের কল্যাণকর_তা কিন্তু নয়। মানব কল্যানকামী মতবাদ গুলিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, এগুলি হল যথাক্রমে__ রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ, অর্থনৈতিক সাম্যবাদ এবং ধর্মীয় মৌলবাদ! বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি বা রাষ্ট্রগুলি তাদের রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে অন্যান্য দেশকে নিজের আয়ত্তে এনে, বিশ্বে একটা শান্তির বাতাবরণ আনতে চাইছে_এইটা প্রথম দল টির উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য!দ্বিতীয়-পন্থীরা অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে এবং সবার মধ্যে সমবন্টন ব্যবস্থা চালু করে পৃথিবীতে শান্তি আনতে চাইছে। তৃতীয় দলের সমর্থকরা চায়, নিজেরনিজের ধর্মমতের ছত্রছায়ায় বিশ্বের সবাইকে এনে_বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে! মজাটা দেখো, এরা সবাই মানুষের ভালো করতেই চায় কিন্তু ফল কি হচ্ছে? বর্তমান পৃথিবীতে যত অশান্তি, রক্তপাত ও হাহাকার সৃষ্টি করেছে_ এই তিন প্রকারের আন্দোলন! এবার বিচার করো_ এদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবার কারণ কি! তাহলেই দেখতে পাবে যে, এদের গোড়ায় গলদ হয়ে গেছে_কারণ এরা নিজেরাই জানেনা শান্তি কি, শান্তি লাভের উপায় কি! এরা নিজেরা শান্তি লাভ না করে অপরকে শান্তি দিতে চায়! বর্তমান বিশ্বে এই প্রহসন‌ই হয়ে চলেছে!

তবে আমি তোমাদের বলছি_এমনটা বেশিদিন চলবে না, দিন বদলে যাবে! যথার্থ শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ভালো-মন্দ,সত্যাসত্য অনেকখানি বুঝতে পারবে।ফলে আগামীতে জীবনে এগিয়ে চলার “সঠিক পথ” কি_ তা জানার জন্য অনেক মানুষ এগিয়ে আসবে! আর এরূপ বৃহৎ field তৈরি হলেই সমাজে অনেক “আচার্য” তৈরি হবে, যাঁরা সঠিক শিক্ষা দিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রকৃত শান্তির সন্ধান দেবেন এবং তা প্রাপ্ত করার উপায়ও বলে দেবেন। মানুষ জানতে পারবে,আনন্দ বলতে pleasure নয়, joy বা happiness-ও নয়, eternal peace-ই প্রকৃত আনন্দ বা শান্তি।

জিজ্ঞাসু:– ব্রহ্ম, পরমাত্মা, ঈশ্বর_ এসব মানবো কেন_ এদের তো বাস্তবে কোন অস্তিত্বই নেই?

গুরুমহারাজ:– তুমি ‘বাস্তব’ কথাটা ব্যবহার করলে, তা_ তুমি বাস্তবের সংজ্ঞা কি তা জানো? জানো না_ ঠিক আছে, আমি বলে দিচ্ছি! “বস্তুত যা আছে”_ তাই বাস্তব! তাহলে দেখা যাক_ কি আছে! আচ্ছা, ধরে নাও ঈশ্বর নাই, কিন্তু তুমি তো আছো! তোমার শরীর-মন-বুদ্ধি ইত্যাদি রয়েছে! দেখা যায় যে_ কোন শরীর গড়ে ওঠে প্রধানত দুটি উপাদানকে নিয়ে_ একটা ‘দশা’ যা পরিবর্তনশীল আর অপরটি ‘সত্তা’ অপরিবর্তনীয়! দশা কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ‘রূপ’ আর সত্তা যেন ‘অরূপ’! তবে তোমরা যদি চোখে দেখা যায় না বলে, অরূপকে মানতে না চাও এবং শুধু দেহযন্ত্র কেই প্রাধান্য দাও_ তাহলে একটা উদাহরণ দিয়ে,দেহ যে শুধুমাত্র একটা যন্ত্র নয়_ সেটা বোঝানোর চেষ্টা করছি! ঘড়ির‌ও‌ লিভার রয়েছে, মানুষের‌ও লিভার রয়েছে_ কিন্তু ঘড়ির লিভার খারাপ হয়ে গেলে সে বলতে পারে না বা কোনকিছু অনুভব করতে পারে না, আবার খারাপ হওয়া লিভারকে সারিয়ে তোলার কোনো তাগিদ‌ও অনুভব করে না! কিন্তু ওই একই জিনিস অর্থাৎ মানুষের লিভার খারাপ হলে সে নিজেই বুঝতে পারে এবং সে নিজেই ওটা সারাবার তাগিদ অনুভব করে_ তাই না! আবার দ্যাখো, যন্ত্রে সুতো দিলে কাপড় তৈরি হয় কিন্তু এতে ঐ যন্ত্রটির কোন পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয় না! অপরপক্ষে, মানব দেহে খাদ্য দিলে তা থেকে শরীরের পরিপুষ্টি বা পরিবর্ধন হয়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, শরীর শুধুমাত্র যন্ত্র নয়_ এটা যেন এক ধরনের বিশেষ যন্ত্র! তাহলে এবার দেখা যাক_ এই যন্ত্রের বিশেষত্ব টি কোথায়! আমি যদি তোমাকে বলি_ “তুমি আছো”, এটা বললে তুমি তোমার শরীরটাকেই “তুমি” ভেবে বসছো! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শরীরটা তো ‘তুমি’ ন‌ও! তাহলে এই যে ‘থাকা’ অর্থাৎ তুমি “আছো”_ এটাকেই বেদান্ত শাস্ত্র বলেছেন_ “সৎ”! কিন্তু শরীরের এই ‘থাকা’ বা বাঁচাই যদি জীবের শরীরধারনের মূল লক্ষ্য হয়, তাহলে মানুষের তো উচিত পূর্ণবয়স প্রাপ্ত হবার পর তার দেহকে “মমি” বানিয়ে রাখা! কারণ দেহ বিনাশশীল জেনেও সত্তর আশি বছর বেঁচে, শরীরকে জীর্ণ করে অবশেষে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরে যাওয়ার থেকে হাজার হাজার বছর ধরে ‘মমি’ হিসাবে থেকে যেতে পারতো! কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ তা কি করে_ করে না! কেন করে না_ কারন সে বাঁচতে চায় এবং শরীরে চেতনা নিয়েই বাঁচতে চায়! শরীর জীর্ণ হলেও সে বাঁচতে চায়! সুতরাং এখানে শরীর প্রধান নয়।এখন ঐ যে চেতনার জগতের কথা বলা হলো,অর্থাৎ চেতনা নিয়ে বাঁচার কথা বলা হলো এই ‘চেতনা’-কেই শাস্ত্র বলেছে “চিৎ”বা ‘ভাতি’ ! এবার ধরো, কাউকে বাঁচতে দেওয়া হলো_ চেতনা নিয়েই বাঁচতে দেওয়া হলো, তার শরীর ধারণের জন্য খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করা হলো_ তার মনোরঞ্জনের জন্য কিছু বই রেডিও-টিভি ইত্যাদি দেওয়া হলো _কিন্তু এই অবস্থায় ওইব্যক্তিকে এক নির্জন দ্বীপে ফেলে রেখে তার চারিদিকে নিরাপদ দূরত্বে আগুনের ব্যারিকেড করে দেওয়া হল _যাতে করে ঐ লোকটি ভিতরে দীর্ঘকাল বাঁচতে পারে, কিন্তু বাইরের জগতের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ না থাকে! এবার কি হবে বলোতো _ কিছুদিন পরেই এ লোকটি হাঁফিয়ে উঠবে, সে বেঁচে থাকার কোনো আনন্দ পাবে না _ফলে সে ওই অবস্থা থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে চাইবে! হয়তো আগে ওই ব্যক্তির অর্থাভাব ছিল, সংসারে অশান্তি ছিল _এখানে তার খাদ্য আছে, তার থাকার বিলাসবহুল ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তবুও সে তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে চাইবে! এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে মানুষ বাঁচতে চায় কিন্তু তা যেন হয় আনন্দের সঙ্গে বাঁচা! জীবন তো সংগ্রামময় কিন্তু তার মধ্যেও মানুষ এক প্রকারের রস পায় _ এটাই আনন্দের স্পর্শ বা touch! সাধন-ভজনহীন সাধারণ মানুষের ‘পরিপূর্ণ আনন্দে’-র আস্বাদন কখনোই হয় না! কিন্তু মাঝে মাঝে touch বা স্পর্শ পাওয়া যায় _আর তাতেই মানুষ এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা পায়, প্রকৃত আনন্দ অন্বেষণের প্রেরনা পায়।

যাইহোক, এইভাবেই_ সৎ-চিৎ ও আনন্দের প্রকাশ থাকে সকল জীবনে! এজন্যই বলা হয় প্রতিটি জীবেই সেই সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম বা আত্মা প্রকাশমান। ব্যাপারটা বুঝতে পারছো! কিন্তু এই কথাগুলো শুধু বুঝলে তো আর হয়না _এগুলোকে বোধে আনতে হবে! যে সমস্ত মার্গ অবলম্বন করে এই বোধে উপনীত হওয়া যায় _সেগুলোকে বলা হয় _ “যোগ”! যেমন জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ‌। এই মার্গগুলি বা পথগুলি জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার যোগাযোগ সাধন করে। আর যারা এই যোগমার্গ অবলম্বন করে এগিয়ে চলেছেন _তাদেরকেই লোকে ধার্মিক বলে থাকে‌। স্বামী বিবেকানন্দও এইজন্যেই ধর্মবিশ্বাসী সকলকেই ধার্মিক বলেন নি। উনি বলেছিলেন _”ধর্ম জগতে চলা বেশিরভাগ লোকই হয় ধর্মোন্মাদ নয় ধর্মান্ধ, কতিপয় সাধক হয় যথার্থ ধার্মিক!” ধর্মজগতে জীবন যাপনকারী সবার এজন্যই সিদ্ধিলাভ ঘটে না, কেবলমাত্র যারা প্রকৃত ধার্মিক_তাদের‌ই ঘটে। কিন্তু একটু আগে যে কথাটা বলছিলাম, সেইটা মনে রাখবে _যে কোন পথ বা মতকে লক্ষ্য করে এগিয়ে চললেই অন্তিম লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়! আর সেখানে একবার পৌঁছে গেলে _আর কোনো বিরোধ থাকেনা! তখন ঠিক বোঝা যায় যে জ্ঞানীর ব্রহ্ম, যোগীর পরমাত্মা আর ভক্তের পরমেশ্বর _এক‌ই তত্ত্ব! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন _ “সেই একই মিছরী কেউ চেটে খাচ্ছে, কেউ চিবিয়ে খাচ্ছে, কেউ চুষে খাচ্ছে _ কিন্তু স্বাদ এক‌ই! তবে সেই অরূপ তত্ত্ব যখন ভোগ আয়তন শরীর ধারণ করে ভক্তের ইচ্ছা পূরণ করতে নরশরীর গ্রহন করে ধরনীর ধুলায় অবতীর্ণ হন, তখন সেই বিশেষ শরীরধারী-কে বলা হয় “ভগবান”! যেমন _”ভগবান রাম”, “ভগবান কৃষ্ণ”, “ভগবান শ্রী চৈতন্য”, “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ”!

জিজ্ঞাসু:– এইভাবে কখনো চিন্তা করিনি, আজ আপনার কাছ থেকে যেন নতুন তথ্য পেলাম। কিন্তু কথা হচ্ছে যে, সাধারণভাবে দেহ-কেই তো প্রাধান্য দিতে হয় তারপর তো আত্মা_অর্থাৎ বোধ-টোধের ব্যাপার_ তাই না?

গুরু মহারাজ:– তাই নাকি? দ্যাখো, রূপের মধ্যে দিয়েই অরূপকে পাওয়া যায়! কিন্তু সাধারণভাবে রূপেই আটকে যাচ্ছে না মানুষ!ফলে horizontal movement-ই হচ্ছে, “পুনরপি জননম্ পুনরপি মরনম্ পুনরপি জননীজঠরে শয়নম্”_ জন্ম-মৃত্যুর‌ এই যে চক্র চলছে তার বাইরে কি মানুষ আসতে পারছে? এই চক্রের বাইরে থেকে জীবনকে না দেখলে ঠিক ঠিক রসটা কখনোই পাওয়া যাবে না! ধর্ম জীবনে প্রবেশ করার পর‌ও সাধকেরা নানা রকম ফাঁদে পা দিয়ে প্রকৃত লক্ষ্য থেকে সরে আসেন। অনেকে শরীরটা নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে তার কাছে যেন লক্ষ্যের থেকে উপলক্ষ-ই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়! আবার অনেকে বিভিন্ন সিদ্ধাই-এ আটকে পড়ে ঘুরপাক খেতে থাকেন! আবার এমনও দেখা গেছে যারা হয়তো দেহ-মন বুদ্ধিকে অতিক্রম করে গেছেন, তারাও নাম-যশ হেতু বা অহংকার প্রতিষ্ঠার জন্য আটকে পড়েছেন।

সুতরাং বিচার করো যে,দেহ না আত্মা_ কে প্রধান,তা না করে আগেই কাউকে প্রাধান্য দিলে প্রকৃত রহস্য কি করে আস্বাদন করা যাবে? দেহকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অর্থাৎ দেহসর্বস্ব হয়েই তো বেশি ফেঁসেছে মানুষ! দেহের সাধ মেটাতে মেটাতেই কত জীবন কেটে যাচ্ছে, আর আত্মবিস্মৃত হয়েই থেকে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ!

তাই দ্যাখো, দেহ তো চাই -ই, কিন্তু লক্ষ্যবস্তু অর্জনের জন্য যতটুকু দরকার এটাকে ততটুকুই ব্যবহার করা উচিত। দেহ তো ‘আধার’, যাকে কেন্দ্র করে ‘আধেয়’ কাজ করিয়ে নেয়! মানুষ-শরীর পেয়েছো_ ঠিক আছে, এবার মনুষ্যত্ব অর্জন করো! কারণ ধর্মজগতে প্রবেশের প্রথম শর্তই হোল_ ‘মনুষ্যত্বম্’। এরপর যখন তোমার মধ্যে জীবনের, জগতের তথা ঈশ্বরের প্রকৃত রহস্য কি_ তা জানা বা বোঝার ব্যাকুলতা আসবে, তখন তাকে বলা হয়_ ‘মুমুক্ষুত্বং’! এরপর যে শর্ত তা হোল_ ‘মহাপুরুষ সংশ্রয়ঃ’! মানব শরীরে মনুষ্যত্ব লাভের পর যদি মুমুক্ষুতা জাগে এবং কৃপা করে যদি কোন মহাপুরুষ তাকে সঙ্গী করে নেন_ তাহলেই আর চিন্তা নেই! যেমন শিশিরকণা কোনদিনই সমুদ্রে মিশতে পারে না_ যদি না সে কোন স্রোতস্বিনীতে পড়ে! সেখানে পড়ে সে তার নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে কিন্তু সে এটা নিশ্চিত জানে যে _অবশেষে একদিন সে সাগরে মিশতে পারবে। এক্ষেত্রেও তাই হয় _মহাপুরুষ‌ই সেই সাধককে হাত ধরে পরমপুরুষের সঙ্গে মিলিত হবার রাস্তা বাতলে দেন।

তাই দেহসর্বস্বতা ভালো নয়, দেহ না দেখে প্রতিটি রূপেই তাঁকে দেখার প্রযত্ন করো! রূপ- রস- শব্দ -গন্ধ- স্পর্শ এই পঞ্চ তন্মাত্রায় সেই ব্রহ্ম-ই লীলায়িত হয়ে রয়েছেন_ এটাকে বোধ করার চেষ্টা করো। প্রত্যেক ‘রূপে’-র পিছনে রয়েছে একটা তত্ত্ব_যেটি ‘অরূপ’! সেইটা ধরতে পারলেই তা ‘অপরূপ’ হয়ে তোমার সন্মুখে প্রকাশিত হয়ে যাবে। এইজন্য আমি তোমাদের সকলকে বলি_ “ঈশ্বর” বলতে কোন ব্যক্তি বা বস্তুকে বোঝায় না_ ঈশ্বর একটা তত্ত্ব_একটা খোঁজ! বাউলের যেমন খোঁজা _”আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে”! তোমরাও তেমনি করে পথে নামো, তোমরাও খোঁজো _খুঁজতে খুঁজতেই একদিন সেই মনের মানুষের সন্ধান নিশ্চয়ই পাবে।।