সময়:—-জুন-জুলাই,1989.
উপস্থিত ব্যক্তিগণ:–এনাঙ্কবাবু, গঙ্গাবাবু,রত্না,পূর্ণানন্দ মহারাজ, সিঙ্গুরের ভক্তবৃন্দ ও অন্যান্যরা।।
জিজ্ঞাসু:—আপনি স্ক্যান্ডিনেভিয়া(Scandinavia) না কোথায় যেন বাইরে বেড়াতে যাচ্ছেন_ এটা কি ঠিক?
গুরুমহারাজ:— হ্যাঁ,ঠিক_ তবে বেড়াতে যাওয়া ঠিক নয়, আমার অন্য কাজ আছে_ সেই কাজের জন্য যাচ্ছি! তুমি বললে Scandinavia কিন্তু Scandinavia বলে কোন দেশ হয়না_নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, সুইডেন ইত্যাদি দেশগুলিকে একত্রে Scandinavia বোঝায়। সেই অর্থে ওখানকার প্রত্যেকটি দেশকে Scandinavian country বলা হয়। আমি ইউরোপের অনেকগুলি দেশেই যাবো_ তবে প্রথমেই আমিনরওয়েতে যাবো। ওখান থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে যাবার কথা রয়েছে! বহু প্রাচীনকাল থেকেই ওই সমস্ত দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিভিন্ন রকমভাবে যোগাযোগ ছিল। আমাদের পুরাণাদি শাস্ত্রে পৃথিবীর উত্তরের ওই অঞ্চল গুলির নাম পাওয়া যায় “উত্তরকুরুবর্ষ” হিসাবে। তোমাদের হয়তো এসব কথা শুনে অবাক লাগছে, কিন্তু ওদের দেশের শিক্ষিত লোকেরা এটা জানে। ওদের দেশে যে প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস রয়েছে, তাছাড়া বিভিন্ন লোকগাথাতেও পাওয়া যায় যে, পূর্বদেশ থেকে ওক গাছের কাঠে চেপে কোন জ্ঞানী ব্যক্তি প্রথম সভ্যতার আলো ওইসব দেশে নিয়ে যায়! তার মানেটা বুঝতে পারছ_ ওক্ কাঠের নৌকায় চেপে কোন ভারতীয় মনীষী প্রথম ওদের দেশে গিয়েছিলেন এবং তৎকালীন ওই অঞ্চলের মানুষদের মধ্যে সামাজিক ও সংস্কৃতি বিষয়ক শিক্ষা দান করেছিলেন। ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তের কিছু জনগোষ্ঠী এখনো খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী নয় এবং ওই অঞ্চলের অন্য কোন ধর্ম আচরণও ওরা করে না, এদেরকে বলা হয়_ pagan! এদের সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতবর্ষের হিন্দু সংস্কৃতি অনেকটাই মেলে! তাই মনে করা হয়_খ্রিস্টপূর্ব সময়কালে হয়তো এদের জনজীবনে অন্যরকম জীবন-চর্যা ছিল। খ্রিষ্টধর্মের প্লাবন, মূল স্রোত থেকে ওদের অনেকটা দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে এবং সেখান থেকে ওরা ওদের পূর্ব সংস্কৃতির লিঙ্ক রাখতে পারেনি তাই পিছিয়ে গেছে!
জিজ্ঞাসু:– সে যুগেও সুদূর ভারতবর্ষের সাথে ওদের যোগাযোগ ছিল? আমরা তো শুনেছি_ প্রাচীনকালে এখানকার লোকেরা ভারতবর্ষকেই পৃথিবী বলে মনে করত এবং সেইজন্য এদেশের কোন রাজাকে “পৃথিবীর অধীশ্বর” বলে সম্বোধন করা হতো?
গুরুমহারাজ:– এইসব কথা ভাবা নিছক বোকামি! দ্যাখো, বেশ কয়েকশ বছর ধরে ভারতবর্ষ বিদেশিদের পদানত থাকার সময়, কিছু অসভ্য ও অসংস্কৃতিবান জাতি এদেশে জোরপূর্বক ঢুকে_উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে ভারতীয়দের এবং ভারতের সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন করেছে! আর এগুলো করেছে তাদের নিজেদের শাসন ব্যবস্থা স্থায়ী করার জন্য। এটাতো স্বাভাবিক_ কাউকে যদি শ্রদ্ধা বা সম্মান করতে হয়, তাহলে তাকে শাসন করা যাবে কি করে? সেজন্যই মুসলমান-শাসক এবং ইউরোপীয় বণিকেরা ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে যতটা সম্ভব নষ্ট করেছে বা অবমূল্যায়িত করেছে!
যাই হোক যেটা বলছিলাম ওই সব দেশের কথা শুধু মহাভারতেই উল্লেখ রয়েছে তাই নয়_ আরো অনেক দেশের কথা, যাদের সাথে ভারতবর্ষের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল_ তাদেরও নাম রয়েছে! কিন্তু তখনকার নামগুলির সাথে হয়তো এখনকার নামের এখন আর কোন মিল পাওয়া যায় না, এইজন্যেই তোমরা এ গ্রন্থগুলি পড়ে হয়তো বুঝতেও পারবে না। আর যেটা বলছো পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের দেশের কথা_ খ্রিস্টপূর্ব ইউরোপের ইতিহাস খুঁজে দেখলে,কটা উন্নত দেশের কথা পাবে? স্বামী বিবেকানন্দ এইজন্যই একবার বলেছিলেন_ “ভারতবর্ষের তপোবন গুলিতে যখন যজ্ঞাগ্নি উঠছে, তখন ইউরোপের বিভিন্ন জাতি বুনো ঘোড়ার পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে_ তাদেরকে বশ করার জন্য!” অর্থাৎ স্বামীজি তাদেরকে বলতে চেয়েছিলেন যে, সভ্যতার প্রাচীনত্বের নিরিখে ইউরোপের থেকে ভারতবর্ষ শত শত বছর এগিয়ে!
মহাভারতের যুদ্ধের বর্ণনায় পাওয়া যায়_বিভিন্ন বিদেশী জাতি কৌরবদের পক্ষে ঘোড়া সরবরাহ করেছিল_ তাদের মধ্যে স্ক্যান্ডিনেভিয়ানরাও রয়েছে। প্রাচীনকালে ইউরোপের নিজস্ব সংস্কৃতি কোথায় ছিল_ যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ থাকবে? যেটুকু ছিল,তা এদেশ থেকেই আচার্যরা বিভিন্ন সময়ে ওই সব দেশে নিয়ে গিয়ে এক একটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এই ভাবে ভারতবর্ষের আর্যসংস্কৃতিই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছিল। বিদেশী শাসকেরা (গ্রীক, তুর্কি, ব্রিটিশ_ইত্যাদিরা)জোর করে এদেশ দখল করে বসার পর, রাজশক্তির অনুগৃহীত পণ্ডিতেরা শাসকের নির্দেশে উল্টোপাল্টা ইতিহাস রচনা করল, এমনকি ইংরেজরা “আর্যদের বাইরে থেকে আসার গল্প”ও_ফেঁদে বসল, যেগুলি এদেশের ছেলেমেয়েদেরকে আজওপাঠ্যপুস্তকে মুখস্ত করতে হচ্ছে। কিন্তু সত্য ঘটনা যেটা, সেটা আমি বলছি শোনো! আর্যরা কোন জাতি নয়,আর্য কথার অর্থ “সু-সংস্কৃতি” তথা “সভ্যতা”! আর যারা ওই সুসংস্কৃতি বা সভ্যতার ছত্রছায়ায় আসতো তারা সবাই “আর্য” পদবাচ্য হোত । এইভাবে ভারতবর্ষ থেকেই আর্যসংস্কৃতি দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল! পৃথিবীর সমগ্র প্রান্তের মানুষকে অসভ্য অবস্থা থেকে সভ্য করার মন্ত্র ভারতের আচার্যেরা গ্রহণ করেছিল_”কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্”!
জিজ্ঞাসু:– তাহলে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও তো আমাদের বৈদিক ধর্মেরই অন্তর্ভুক্ত? কারণ যেহেতু এটাই আদি এবং সব জ্ঞান-ই বেদে নিহিত আছে?
গুরুমহারাজ:– “বেদ” শব্দটি ‘বিদ্’ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ “জানা”! আর এই জ্ঞান বেদে লিপিবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। বেদের জ্ঞান ঋষিদের উপলব্ধ সত্য, এগুলি শাশ্বত- চিরন্তন অর্থাৎ যা ছিল যা আছে এবং যা থাকবে! সুতরাং এটা ঠিকই যে, পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান, যাবতীয় তত্ত্ব বা সংস্কৃতি রয়েছে বেদের বাইরে কিছু নাই! কিন্তু তাই বলে, ‘আমাদের বৈদিক ধর্ম’ কথাটি ব্যবহার করে_ তুমি নিজেকেও একটা কেউকেটা ভাবছো_ এটা ঠিক নয়! বহু মানুষই, তোমার মতো এরকমই ভাবে, “আমাদের বেদ” “আমাদের শাস্ত্র”_ এইসব কথা ব্যবহার করে একটা অহেতুক আত্মতুষ্টি অনুভব করে! কিন্তু “বেদ”অর্থে যদি ‘জ্ঞান’ হয় তাহলে তো বেদ স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সবার! কারণ জ্ঞানে সকলেরই অধিকার আছে! কোন ব্যক্তি ভারতীয় হলেও “বেদ কি_বেদে কি আছে”, তা জানেই না, সে কি করে গর্ব করে যে ‘বেদ’ তার? ‘বেদ’ কার_ না, যে ‘জানে’ তার! তাই আগে জানো_ বেদ কি, সত্য কি_তা জানো! এই যে “জানা”_এতেই বেদের মহত্ব! অন্যান্য ধর্মমতের যে সমস্ত প্রধান ধর্মগ্রন্থ গুলি রয়েছে, সেখানে দেখবে_ শুধু বলা হয়েছে “মানো”! সেখানে লেখা আছে, ‘অমুক ধর্মগুরু ইহা বলিয়াছেন, ইহা করিলে ইহা হয়, তিনি মহান ছিলেন_ অতএব তার সকল কথা “মানো”! যুক্তি চেয়োনা, প্রশ্ন কোরোনা_ শুধু “মানো”!’
কিন্তু “বেদ” বলেছে মানো কি না মানো_ তাতে কিছুই যায় আসে না, তুমি “জানো”! ঋষিরা এটাও বললেন_’বাইরের জগতে অনেক কিছু খুঁজে বেরিয়ে জানতে হবে না, তোমার অন্তঃকরণ তোমার সবচাইতে কাছে আছে তাই সেখানে অনুসন্ধান করো,আর তোমাকেই জানো_ নিজেকে জানো_”know thyself”! নিজের আত্মাকে জানো “আত্মানাং বিদ্ধি”! নিজেকে জেনে তবে অপরকে জানার চেষ্টা করো _সেই জানাটাই সঠিক হবে, অন্যথায় যা জানবে সেগুলি সবই ভ্রান্তি!’
এই জন্যই বলছিলাম, কোন কিছু না জেনে অহেতুক “আমার বেদ”_ “আমার শাস্ত্র” বলে আত্মতুষ্টি লাভ করাটা_ নিছক বোকামি ছাড়া আর কি?
জিজ্ঞাসু:– অনেকে তো ভগবান- ঈশ্বর এসবই মানে না, তবে বেদ মানবে কেন?
গুরু মহারাজ:–আবার ‘মানা’-র কথা বলছো? আমি তো মানতে বলিনি_ জানতে বলছি! দ্যাখো বাবা_জানতে তো তোমাকে হবেই, কারণ জানা থেকেই তো ‘জ্ঞান’ কথাটা এসেছে, আর “বেদ”-এর অর্থই হোল জ্ঞান! এবার হয় জগত-জ্ঞান বা অপরা জ্ঞান অথবা ঈশ্বর-জ্ঞান বা পরাজ্ঞান_ যে কোনো একটা জ্ঞানের ছত্রছায়ায় যে কোনো মানুষকে তো আসতেই হচ্ছে! তাই বেদের অন্তর্গত তুমি সবসময়েই আছো! আর ভগবান বা ঈশ্বরকে ‘মানা’ কি ‘না মানা’- নিয়ে ভারতীয় দর্শনে কে কবে মাথা ঘামিয়েছে? ভারতীয় সমাজ তো এই নিয়ে কখনও মাথা ঘামায় না! সমাজ দেখে তুমি ধার্মিক কি না? অবশ্য ‘ধর্ম-ধার্মিক’ এসব কথাতেও অনেকের এলার্জি আছে, কিন্তু জেনে রাখবে পৃথিবীর সকলেই ধর্মের-ই অন্তর্গত। কারণ “ধর্ম”কথাটির অর্থ-ই হোল _” যা সমস্ত কিছুকে ধরে রাখে”!
তবে মুখে যারা বলে ধর্ম-ঈশ্বর-সাধু-সন্ন্যাসী এসব মানি না_কিন্তু এরা অপরের কাছে সাধুতা বা ধার্মিকতা আশা করে! যেমন তার নিজের ছেলেটি অসাধু-সুলভ আচরণ করুক, এটা কোন বাবা-মা’ই চায় না, বাজারে ব্যবসাদারের কাছে গিয়ে অসাধুতা আশা করে না_ এইরূপ সবক্ষেত্রেই ঘটে থাকে!
আমি তোমাদের বলছি_ঐ যে “না মানা” দলের মানুষেরা রয়েছে- ওরা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক,অসাধু ব্যক্তিদের দ্বারা সবসময় সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়_ অপরদিকে প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি বা সাধু ব্যক্তির দ্বারা সমাজ কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। এইজন্য সমাজে অধিক পরিমাণে ধার্মিক ব্যক্তি থাকলে সমাজ সুন্দর হয়!
আবার কেউ যখন বলে “আমি ধর্ম মানিনা’_ একথা শুনে আমি তাদেরকে বলি তোমরা হয় ভ্রান্ত না হয় মূর্খ! কারণ “চিনি”- “চিনি”- উচ্চারণ করলে যেমন মুখ মিষ্টি হয় না, তেমনি ধর্ম ‘আছে’ বা ‘মানি’ বললেই কেউ ধার্মিক হয়ে গেল অথবা ‘ধর্ম মানিনা’ বা ‘ধর্ম নেই’- বললেই কেউ অধার্মিক হয়ে গেল__এমনটা হয় না! ‘চিনি’ খেয়ে যেমন তার স্বাদ গ্রহণ করা যায়, তেমনি ধর্মাচরণ দ্বারাই ধর্মের স্বাদ পাওয়া যায়! ধর্মের এই আচরণ গুলি হোল যথাক্রমে_ সদাচার, পরোপকার, ভালোবাসা ও সংযম ! এইগুলি অনুশীলনের দ্বারা মানুষ ‘প্রকৃত মানুষ’ হয়ে উঠতে পারে। আর যে সমাজে অধিক মানুষ এই অনুশীলনের আওতায় আসে, সেই সমাজ হয় তত সভ্য ও সুন্দর! অপরপক্ষে এগুলির অনুশীলনে অবহেলা করলে মানুষ হয়ে যায় পাশবিক,উচ্ছঙ্খল! আর এই ধরনের মানুষ যে সমাজে অধিক, সেই সমাজে অবক্ষয় শুরু হয়ে যায়। তাই ঈশ্বর না মানলেও চলবে কিন্তু সকল দেশের _সকল জাতির সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই বলবে, “হে মানব! তোমরা ধার্মিক হও !”
অনেকে আমাকে বলে এত “ধর্ম- ধর্ম” করছেন, জানেন সব ধর্মের আগে হচ্ছে “মানব ধর্ম”! আমি তাদেরকে বলি, “ওরে আহাম্মক! মানুষ বিবর্তনের ধারায় পশু থেকে মানুষে এসেছে! তাহলে “মানব ধর্মে”-র আগে ছিল “পশু ধর্ম”, তারও আগে ছিল “উদ্ভিদ ধর্ম”, তারও আগে “জড় ধর্ম” ইত্যাদি! আর যারা বলে “মানবধর্মই প্রকৃত ধর্ম আর সব ধর্ম মিথ্যা”_ এ-কথাটা শক্তদের কাছে(খ্রীষ্টান, ইহুদি, মুসলমান অর্থাৎ যারা গোঁড়া-পন্থী) বলুক তো দেখি! সেটা পারবে না _কারণ সেখানে প্রাণের ভয় রয়েছে। তাই যে বুদ্ধি বা যে ভাবনা সব স্থানে- সব অবস্থায় টেকে না, শুধু চালাকি করে কিছু মানুষকে সাময়িকভাবে বিপথগামী করার চেষ্টা করা যায় _সেই ভাবনাকে অনুসরণ করে লাভ কি! স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, “চালাকির দ্বারা কোন মহৎ কর্ম হয় না”! মহামানবদের কথাগুলি বিবেকের সাহায্যে বিচার করো, ঠিকটা গ্রহণ করো আর ভুল কে kick-out করো তাহলেই তোমারও কল্যাণ হবে এবং তুমি যে সমাজে বাস করছে তারও কল্যাণ হবে।
জিজ্ঞাসু:—সন্ন্যাসীরা সাধারণত নিরামিষাশী হন কেন?
গুরু মহারাজ:–দ্যাখো, ভারতবর্ষের জলবায়ুতে নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করাই তো শরীরের পক্ষে ভালো। কারণ এই দেশে হিউমিডিটি প্রচন্ড বেশি খাদ্য সহজে হজম হতে চায় না এজন্যই এখানকার বেশিরভাগ লোকের গ্যাস অম্বল হয়। বহুদিন থেকেই দেশে এইসব সমস্যা ছিল মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব অনেক খাদ্যের এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটিয়ে এখানকার মানুষের শরীর স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের মিশনেও নিরামিষ আহারের ব্যবস্থাও এইজন্যেই! তবে অনাথ ছেলেদের জন্য আশ্রমে বিকল্প ব্যবস্থাও রয়েছে। শীতপ্রধান দেশগুলিতেও আমিষ আহার গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে, আমিষ খাদ্য সস্তাও বটে।। ইউরোপের উন্নত দেশগুলিতে কাউকে নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করতে হলে তাকে প্রচণ্ড ধনীহতে হবে, নাহলে খেতে পারবে না। শাকসবজি-ফলমূলের ওখানে প্রচন্ড দাম।
যাইহোক, এখানে আমাদের দেশের কথা হচ্ছিল! আমাদের শাস্ত্রে রয়েছে পত্রম্- পুষ্পম্- ফলম্- নালম্- কন্দম__ এইগুলিই নিরামিষ আহার্য! দুধ বা দুগ্ধজাত দ্রব্যাদিকে অনেকে নিরামিষ মনে করেন কিন্তু এগুলিতে প্রাণিজ প্রোটিন থাকায় এই খাদ্যগুলি নিরামিষ নয়। নিরামিষ খাদ্যের আহারে শরীরের সামগ্রিক পুষ্টি তো হয়ই আবার রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাও বাড়ে, ফলে শরীর নীরোগ এবং দীর্ঘায়ু হয়। এ তত্ত্ব বর্তমানে উন্নত দেশসমূহ গবেষণা করে জেনেছে এবং বিদেশে নিরামিষাশীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
নিরামিষ খাদ্যের আহারে শরীরের গ্রন্থি গুলি সাম্য থাকে, ফলে দেহে বিকার-জনিত অসুবিধা গুলো হয় না। সাধু-সন্ন্যাসীরা সাধারণতঃ নিরামিষাশী হন,তবে তারা দীর্ঘায়ু ও নিরোগ হতে চায় নির্ঝঞ্ঝাটে সাধনা করার জন্য! জীবনে যখন ভগবৎ_লাভের অনুরাগ এসেছে তখন যতটা সম্ভব তাকে কাজে লাগানোর জন্যই সাধুদের প্রচেষ্টা থাকে।
জিজ্ঞাসু:– অন্য কি কোন উপায়ে নিরোগ হওয়া যায়?
গুরু মহারাজ:–চিকিৎসা বিজ্ঞান এই নিয়ে এখন খুবই গবেষণা করছে। জানো, এখন জাপান সহ অন্যান্য কিছু দেশ গর্ভবতী মায়েদের কোমর পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে রেখে সন্তান প্রসব করাচ্ছে! ওরা গবেষণাতে দেখেছে যে, এর ফলে ওই সন্তান গুলি নীরোগ বেশি হচ্ছে এবং শিশু মৃত্যুর হার কম হচ্ছে_ সর্বোপরি মায়ের কষ্ট কম হচ্ছে, সিজার করার ঝামেলা থাকছে না! অবশ্য আমাদের আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ও এই ধরনের প্রসবের কথা উল্লেখ রয়েছে! দ্যাখা যায়, যে সমস্ত মানুষ অধিকক্ষন জলে কাজ করে_অর্থাৎ যাদের নাভি দীর্ঘক্ষন জলে ডুবে থাকে_ তাদের শরীরের বিভিন্ন অন্তক্ষরা গ্রন্থিগুলি সাম্য অবস্থায় থাকে এবং এর ফলে তারা দীর্ঘায়ু হয় বা এদের রোগ-ভোগ কম হয়। তবে মাঝি-মাল্লারা তো উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করে, তাই এই সুফলটা তারা কাজে লাগাতে পারে না।
যাইহোক, দীর্ঘ জীবন লাভের আসল রহস্যটা কিন্তু অন্য জায়গায়, শরীরে যে তিন প্রকার কোষ আছে_ life cell,neuro cell এবং germ cell, এদের মধ্যে neuro cell-এর নিধন কমাতে পারলেই মানুষ দীর্ঘায়ু হবে। accidental death বা আকস্মিক মৃত্যুর কথা আলাদা, এখানে সাধারণ মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে। germ cell এর আবির্ভাব শরীরে দেরিতে হয় অর্থাৎ এটি যৌবনকালে সৃষ্টি হয়_ কিন্তু অনিয়মিত অপব্যবহারের ফলে এগুলির দ্রুত নিধন ঘটে থাকে, আর তখনই life cell থেকে শক্তি ক্ষয় হতে থাকে! তাছাড়া মানুষের জীবনযাপন চূড়ান্ত বিশৃংখল থাকায় life cell গুলি এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়ে। এইজন্য দেখা যায় সমাজে মানুষের অকাল বার্ধক্য এবং পরিণতি মৃত্যু। কিন্তু মানুষের মৃত্যু হলেও মস্তিষ্ক কোষ বা neuro cell-গুলি পরীক্ষা করলে দেখা যায়_ এগুলি তখনও তরুণ অবস্থায় রয়েছে!
সপ্ততত্ত্বে মানবশরীর দ গঠিত। এই ‘সাত’ সংখ্যাটি পৃথিবীর যে কোন ক্ষেত্রে খুবই উল্লেখযোগ্য। মানুষের সাধারণ আয়ু 147 বছর। এই বয়সে মানুষের জীবন চক্র সম্পূর্ণ হয় অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ ঠিক মতো জীবন যাপন করলে 147 বছর পর্যন্ত বাঁচা সম্ভব। 7- বছর পর্যন্ত বাল্য, 7×2=14 বছর পর্যন্ত কৈশোর, 7×3=21 বছরে যৌবন। তার মানে 21 বছর বয়সে শরীরের সম্পূর্ণতা আসে। তাই 21×7=147 বছর হোল পূর্ণ জীবন চক্র! এবার যদি কেউ 147 বছরেও মারা না যায়_ তাহলে আবার তার নতুন করে দাঁত বেরোয়, শরীরে লোম গজায় অর্থাৎ আবার তার মধ্যে শৈশবের লক্ষণগুলি ফুটে উঠতে পারে। আমার গুরুদেব রামানন্দ অবধূত 157 বছর বয়সী ছিলেন_ তাঁর শরীরে ঐ লক্ষণগুলি দেখা গিয়েছিল।
তবে সঠিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে পারলে তবেই তো এই আয়ু লাভ করা সম্ভব হবে! তবে যেসমস্ত সাধক বা যোগীরা একবার সংযত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, তাঁরা ইচ্ছা করলে হাজার বছরও শরীর ধারণ করে থাকতে পারেন। হিমালয়ে ঘোরার সময় ঐরূপ কিছু মহাত্মাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল।
জিজ্ঞাসু:– আপনি একথা বলছেন বটে, তবে অবতার পুরুষ বা বিভিন্ন মহাপুরুষরা বেশিরভাগই তো অল্পায়ু হন?
গুরু মহারাজ:—ভালো জিজ্ঞাসা করেছো_ এসবের কারণ মানুষের জানা দরকার! কিন্তু এখানে একটা কথা বলবো, তোমরা যে কোন প্রসঙ্গ উঠলেই হুট্ করে কোন না কোন মহাপুরুষের উপমা উপস্থাপনা করে বস_ এটা ঠিক নয়! কারণ, কোন মহাপুরুষের কার্যাবলী, তাঁর জীবন যাপনের রহস্য_ আর একজন মহাপুরুষ ভিন্ন কখনোই কেউ জানতে পারে না! যখন কোন মহাপুরুষ কোথাও জন্মগ্রহণ করেন, তখন তিনি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো জন্মান না, তাঁরা বিশেষ কোন কার্য সম্পন্ন করার জন্যই শরীরধারণ করেন। সেই কাজ শেষ হলেই তাঁরা চলে যান। সুতরাং তাঁদের ক্ষেত্রে বয়স কোনো factor নয়, যদি তাঁর কাজ নয়(9) বছরে শেষ হয়ে যায় কেন তারা 90 বছর বাঁচবেন? আধুনিক কালের মহাপুরুষদের মধ্যে শুধু ভগবান বুদ্ধ 80 বছর বেঁচে ছিলেন, তাছাড়া অন্য সকলেই তাড়াতাড়ি শরীর ছেড়ে দিয়েছেন। এঁদের মৃত্যু হয় না, এঁরা শরীর ছেড়ে দেন। তেমনি এঁরা জন্মান না, এঁরা জন্ম “গ্রহণ” করেন! সাধারণ মানুষের জন্ম এবং মৃত্যু হয়₹ এনারা মৃত্যু “বরণ” করেন! তাছাড়া বাবা_ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহাপুরুষদের তো তোমরাই মেরে ফেলেছো_ তাঁদেরকে আর তোমরা বাঁচতে দিলে কোথায়? অবতারকল্প মহাপুরুষেরা মানুষের সমাজে আসেন মানুষের কল্যাণ করতে, অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাতে কিন্তু বিনিময়ে মানুষ কি করে? সারাজীবন ধরে শুধু তাঁদেরকে আঘাত করে! ক্ষমার অবতার তাঁরা, তাই তাঁরা কারো দোষ দেখেন না বা অপরাধ গ্রহণ করেন না_ সকলকে ভালবাসেন তাই সবকিছু ক্ষমা করেন! কিন্তু সবার সকল অপরাধ,পাপ-তাপ তাঁকে তাঁর নিজের শরীরে গ্রহণ করতে হয়!এর ফলেই পাঞ্চ ভৌতিক শরীর জীর্ণ হয়ে যায়। এই ভাবেই অকালে তাদের শরীর ছেড়ে চলে যেতে হয়_বাবা! এইসব রহস্য একমাত্র স্বয়ং ভগবান এবং তাঁর কোন কোন ভক্তরা জানেন_ অন্যরা এই রহস্য কি করে জানবে, কি করে বুঝবে?
যাক্, তুমি তো বুঝতে পারলে! এবার তুমি যদি সত্যিই এই কথাগুলি ঠিক ঠিক বোঝো, তাহলে তুমি সঠিক জীবন যাপন করো_ যেন তোমাদের জীবনের কালিমা কোন মহাপুরুষকে স্পর্শ না করে, তাহলেই তোমারও মঙ্গল আর তাঁরও আগমনের সার্থকতা।।