সময় ~ 1984 সাল, Sept মাস ।
স্থান ~ শিবপুর—গঙ্গাবাবুর বাড়ী।
উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ গঙ্গাবাবু, সব্যসাচী, এনাঙ্কবাবু, রত্না, পূৰ্ণানন্দ মহারাজ, তৃষাণ মহারাজ ইত্যাদি।

জিজ্ঞাসা :– শ্রীমদ্ভাগবতই কি ভক্তিমার্গীদের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ?

গুরু মহারাজ : – বাবা—জলটা ফেলে দুধ খেলে তবেই তো শ্রেষ্ঠর শ্রেষ্ঠত্ব বুঝতে পারবে । নইলে জলে-দুধে মিশে থাকলে তার মধ্যে প্রকৃত দুধের স্বাদটা পাওয়া যায় কি ? ভাগবত বা পুরাণাদি গ্রন্থেও, রূপকাকারে ( অর্থাৎ দুধের সাথে জল-মিশিয়ে ) পরম সত্যের তথ্যাদি পরিবেশন করা আছে। কিন্তু শুধু দুধ-টা বা সার ভাগটা গ্রহণ করতে পারে কজন? বেশীর ভাগই তাে দেখি রাধা-কৃষ্ণকে নারী ও নর ভেবে নিয়ে তাদের প্রেমকাহিনীকে আদিরসাত্মক-রূপ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায়। অনেক ক্যালেণ্ডারেও শ্রীকৃষ্ণের বসন চুরির চিত্রটাই বেশি দেখা যায়। ভাগবত পাঠের সময়ও লক্ষ্য করবে বেশীর ভাগই ঐ অংশটা অথবা গােপিনীদের দেহ-সৌষ্ঠবের দিকটাই বর্ণনা করা হচ্ছে, আর গােটাকয়েক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাই শুনে চোখের জল ফেলছে। মানুষের অন্তপ্রকৃতি নানা দোষে দুষ্ট–অসহজ, ফলে মনের বিকৃতরূপ_ এইভাবে প্রকাশ করে ফেলে।

শুধু ‘চিনি’-‘চিনি’ মুখে বললে কি আর মুখ মিষ্টি হয়—চিনি খেয়ে দেখতে হয়, তেমনি শাশ্ত্রের অর্থ বুঝতে গেলে ব্রহ্মজ্ঞানী গুরুর চরণপ্রান্তে বসে জিজ্ঞাসা-উত্তরের মাধ্যমে সমাধান করে নিতে হয়। ভাগবতের গোপীদের ‘বসন’ স্থূলদেহের যে আবরণ সেই ‘বসন’ নয়, এখানে বসন-চুরির অর্থ হচ্ছে স্থূল-সূক্ষ্ম-কারণ এই ত্রিবিধ শরীরের বসন বা আবরণ উন্মােচন করতে পারলে তবেই কৃষ্ণ-সাক্ষাৎকার বা আত্ম-সক্ষাৎকার হয় অর্থাৎ কৃষ্ণের কৃপালাভ হয়। ত্রিবিধ শরীরের তিনটি পৃথক পৃথক আবরণ রয়েছে_মল, বিক্ষেপ এবং আবরণ! এই তিন প্রকারের আভরন’ বা বসনকেই ত্যাগ করার কথা ভাগবতে বলা হয়েছে। প্রথম দুটি অপসারিত হলেও শেষেরটি অর্থাৎ অহংকার রূপ আবরণ সহজে যায় না। একমাত্র গুরু কৃপায় এইটি অপসারিত হয় এবং জীবের অহংকার হলেই কৃষ্ণকৃপা লাভ হয়—এটাই রহস্য। এবার বলতাে_ কজন এই জ্ঞান দেবার জন্য ভাগবৎ পাঠ করেন, আর কজন শ্রোতাই বা এই ভাব বুঝতে পেরে চোখের জল ফেলেন ?

প্রকৃতপক্ষে ভাগবতে কোন মানব-মানবীর প্রেম-কাহিনীর কথাই নেই। সাধারণ মানুষকে বােঝাতে রূপকাকারে বেদান্তের উপলব্ধ-সত্যই পাত্র,পাত্রির চরিত্র চিত্রণ করে লিপিবদ্ধ করা আছে। এখানে ‘রাধা’ কোন মেয়েমানুষ নয়। (ভাগবতে ‘রাধার’ কোন উল্লেখও নেই)। “যা আরাধয়তে সা রাধা”। আবার বলা হয় ‘যা আরাধিকা সা রাধিকা’। অর্থাৎ ভক্ত সাধকই রাধা, এতে কোন স্ত্রী-পুরুষের লিঙ্গভেদ নেই, আর পরমপুরুষ হলেন শ্রীকৃষ্ণ। রাধাকে বলা হয়েছে আয়ান-ঘরণী, আয়ান কেমন? না_ সে ক্লীব, এখানে অসার সংসারকে‘আয়ান’-রূপে কল্পনা করা হয়েছে। জীব ভ্রমবশতঃ এই সংসারকেই স্বামী বা সার ভেবে বসে, তাই আয়ান-ঘরণী রাধা।

‘রাধা’- অর্থাৎ ভক্তের অন্তরে সদাই ব্যথা, কারণ তার স্বামী-সংসার ভাল লাগে না–যেন সর্বদা মনে হয় তার অন্য কোথাও ঘর আছে—এ ঘর তার নয়, তাই ঘরে থেকেও বাইরের দিকে টান। ঈশ্বরের জন্য পাগল সাধক বা ভক্তের‌ও এই অবস্থাই হয়, তার সংসার ভাল লাগে না, কেবলই সে চায় সংসার বিরাগী হতে। আর বৈরাগ্য থেকেই ভক্তি লাভ হয়–ঈশ্বরে প্রবল অনুরাগ জন্মে । এক্ষেত্রে রাধার অবস্থাও তাই। রাধা ছুটে ছুটে বাইরে যেতে চায় কিন্তু বাধা দেয় শাশুড়ী জটিলা এবং ননদী কুটিল। জীবের কুটিল কামনাকে ‘কুটিলা’ এবং জটিল বাসনাকে ‘জটিলা” বলা হয়েছে। জীব কামনা-বাসনাতেই সংসারে বদ্ধ হয়ে নানা কষ্ট ভোগ করে, ত্রিতাপ জ্বলায় দগ্ধ হয়—তবু আবার নতুন নতুন কামনা বা বাসনায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। এভাবেই ক্লিষ্ট জীবের একদিন মৃত্যু হয়। কিন্তু এই মৃত্যু মহামৃত্যু বা প্রকৃত মৃত্যু নয়! এই মৃত্যু যেন আবার শরীর ধারণ করে বাসনা চরিতার্থ করার জন্য। কিন্তু ভক্ত,অর্থাৎ যিনি বুঝেছেন এই রহস্য, যিনি এই ত্রিতাপ জ্বালা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সচেষ্ট_তিনি তো আর আবদ্ধ থাকতে চান না , তাই ভাগবতে বলা হয়েছে_রাধার মন ঘরে থাকে না , কোন অজানা বাঁশরিয়ার বাঁশীর সুর তাকে ঘরে থাকতে দেয় না। কিন্তু জটিলা-কুটিলার নজর এড়িয়ে কেমন করে যাবে সে প্রিয়মিলনে ? একান্তভাবে কৃষ্ণ-অনুরাগী রাধাকে সাহায্য করতে তখনই আসেন বড়াইবুড়ি (ললিতা)। তিনি এসে রাধাকে বলেন, “হ্যাঁ-লা বউ ! তোর নাকি ঘরে থাকতে মন চায় না–তা চল্ তােকে আমি যমুনার ঘাটে জল আনতে নিয়ে যাই।” রাধা জটিলা-কুটিলার কথা জানালে বড়াইবুড়ি বলেন, “আমি সঙ্গে করে নিয়ে গেলে ওরা তােকে কিছুই বলবে না বরং খুশী হবে।” এই ভাবেই বড়াইবুড়ির সাথে রাধার “জল আনতে ছল করা” অর্থাৎ শুরু হয় অভিসার।

এইগুলির অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে –ভক্তের আকুলতা যখন চরম পর্যায়ে চলে যায়, আর সংসার যখন ‘আলুনি’ বােধ হয় _তখনই বড়াইবুড়ি রূপ ‘সদ্গুরু’ এসে ভক্তের হাত ধরেন। সদগুরুর সংস্পর্শে কামনা এবং বাসনা(জটিলা-কুটিলা) বশীভূত হয়ে থাকে–মাথা তুলতে পারে না। পরে সাধনার দ্বারা ‘সদগুরু’ শিষ্যের কুলকুণ্ডলিনীকে জাগিয়ে দেন–শুরু হয়ে যায় শিষ্যের অভিসার। ভাগবতে আছে যমুনার উজানে কদম্ব বনে কৃষ্ণ ( ময়ুর পুচ্ছধারী হয়ে) বাঁশী বাজায়। জীবনের যে ধারা জগৎমুখী হয়ে কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য বারবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে পড়ে আবর্তিত হচ্ছে (Horizonti Movement) সেই ধারাই যখন উর্ধ্বমুখী হয়ে কৃষ্ণ-অনুগামী হয় তখন সেই ধারাই রাধা হয় (Vertical Movement)। অর্থাৎ কুণ্ডলিনী শক্তি মূলাধার থেকে আজ্ঞাচক্র পর্যন্ত এই ষটচক্র ভেদ করে সহস্রারে–সহস্রদল পদ্মে প্রবেশ করলেই জীবাত্মা-পরমাত্মার মিলন হয়, আর এই স্থানকে তাই রাসমঞ্চও বলা হয়।

যাই হােক, কাহিনীর বড়াইবুড়ি এই ভাবেই রাধাকে অভিসারিকা করে গড়ে তােলে এবং যমুনার ঘাটে এসে রাধাকে শেখায়,_ “ঐ উজানে কুঞ্জবনে কদম্ববৃক্ষে যেথায় কৃষ্ণ বাঁশী বাজায়, যা সেখানে”। অর্থাৎ সদগুরু কামনা বাসনার আবর্ত থেকে শিষ্যকে বের করে নিয়ে এসে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে জীবনের চরম এবং পরম উদ্দেশ্যটি কি– তারও সন্ধান বলে দিয়ে শিষ্যের হাত ছেড়ে দেন। বাকী পথটা শিষ্যকে একাই চলতে হবে। ভাগবতে অভিসারিকা রাধার কত কষ্টের কথা বলা হয়েছে। কর্দমাক্ত পথ, গভীর রাত্রি, কণ্টকাকীর্ণ রাস্তা ইত্যাদির কথা উল্লেখ করে গ্রন্থকার বােঝাতে চেয়েছেন—সাধন-সমরে প্রবেশের পর সাধকের অবস্থা কিরূপ হয়। কিন্তু তাতেও সাধক অবিচল–লক্ষ্যে স্থির–তবেই না অবশেষে প্রিয় মিলন !ভক্ত ভগবানের মিলন অর্থাৎ আত্মা পরমাত্মার মিলন।

এবার বুঝলে তাে, ভাগবতের কাহিনীর আধ্যাত্মিক রহস্যটা কি! ভাগবতের রাধা-কৃষ্ণ, মানব-মানবী নয়–আর এখানে উল্লেখিত “প্রেম”_ অপ্রাকৃত। নর বা নারীর সাধারণ ভাব, কৃষ্ণ বা রাধায় আরােপ করলে কিসেই অপ্রাকৃত প্রেমের আস্বাদন হয়,না_ভাগবতের মহিমা বোঝা যায় ? যে চূড়ান্ত লক্ষ্যে জগতের সমস্ত জীবকে যেতে হবে, সেই গন্তব্যস্থলে যাওয়ার সহজতম উপায়কে কি সূক্ষ্মভাবে ও মনােগ্রাহী করে রূপকাকারে বর্ণনা আছে ভাগবতে_ তা ভাবলে চমৎকৃত হতে হয়। তাই শুধু ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে কি লাভ? ডুব দাও, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কুবীর গোঁসাই-এর এই গানটি গাইতেন, – “ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন, তলাতল খুঁজলে পাতাল, পাবিরে প্রেম রত্ন ধন”।

তােমরাও ডুব দাও, যা শুনলে তার মনন কর, আর মনন করতে করতে গভীরতায় ঢােকো— ঠিকই দেখবে রাধারাণীর কৃপা লাভ হবে।

জিজ্ঞাসু :— বৈষ্ণবেরা এত রাতদিন হরিনাম-সংকীর্ত্তন ইত্যাদি করে কিন্তু তাদের তো সেরকম আধ্যাত্মিক উন্নতি হতে দেখা যায় না?

গুরুমহারাজ :— ছোটবেলায় আমারও এই একই জিজ্ঞাসা একবার মনে এসেছিল। আমার পূর্বাশ্রমের নিকটেই কালনা-নবদ্বীপ, ওপারে শান্তিপুর। কাজেই বুঝতেই পারছেন, ওখানে হরিনাম-হরিবাসরের কি ধূম! ৩ দিন, ৫ দিন, ৭ দিন পর্যন্ত চলে এক একটা হরি বাসর আর তাতে ‘হরেকৃষ্ণ’ নাম কত বিচিত্র সুরে যে গাওয়া হয়, তার ইয়ত্তা নেই। খোল বাজিয়েরা তো নেচে-কুঁদে খোল একেবারে ভেঙে ফেলার যোগাড় করে। আর দর্শক শ্রোতাদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায় — কারও বা ভাব হয়, ভাবে সকলকে কোলাকুলি-আলিঙ্গন করতে থাকে — ইত্যাদি অনেককিছুই দেখেছি। কিন্তু এতো দেখেছি হরিবাসর শেষ হওয়ার পর ঐ লোকগুলিই নানা বাজে কাজ করে বসে — উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করে, সামান্য কারণে প্রতিবেশীর সঙ্গে মামলা মকদ্দমাও বাধায়!তখনই আমার মনে এই জিজ্ঞাসা এসেছিল যে, বৈষ্ণব মহাজনেরা যে বলেছেন, “একবার হরিনামে যত পাপ হরে, পাপীর সাধ্য নাই তত পাপ করে,” — তাহলে এরা তো অনেক হরিনাম করছে কিন্তু কাজের কাজটি হচ্ছে কই? মহাপ্রভুর অবতরণ, নিত্যানন্দের কেঁদে কেঁদে নাম-বিলানোর কি এই ফল! এই রহস্য জানার জন্য গঙ্গার ধারে বসে চিন্তার গভীরে ডুব দিলাম। ওখানে বসে থাকতে থাকতেই আমার একটা দর্শন হয়েছিল, সেটাই বলছি।

দেখলাম আমার চোখের সামনে থেকে গঙ্গা অন্তর্হিত হোল, আর সামনে বিশাল জলরাশি নিয়ে বিরাজমান সমুদ্র। তার গর্জনকারী ঢেউগুলো একের পর এক উঠছে এবং তীরের দিকে ধেয়ে আসছে। আবার দেখছিলাম ঢেউগুলো তীরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রের দিকে। এই ভাবে ফিরে যাবার সময় ঢেউগুলির দু-একটা,এগিয়ে আসা ঢেউয়ের বাধায় প্রতিহত হয়ে Surface-য়েই ফিরে যাচ্ছে, আবার কোন কোনটা এগিয়ে আসা ঢেউ এর তলা দিয়ে প্রবল বেগে গভীর সমুদ্রাভিমুখী হয়ে চলে যাচ্ছে — আর ফিরছে না। এই ভাবে উপরেরটা Surface current, আর নীচেরটা যেন Under current! এই দর্শন থেকে আমার উপলব্ধি হোল যে,_ জগতের যতকিছু বস্তু বা ব্যক্তি এমনকি ঈশ্বরের‌ও রূপ “নামে”(তারকব্রহ্ম নাম) ভাসছে। বাহ্যিকভাবে হরিনাম সংকীর্তন করার সময় যে সমস্ত ব্যক্তিদের মন বহির্মুখী, তারা কিছুক্ষণ ঐ নামসমুদ্রে ভাসছে, তারপর আবার Surface-current তাদেরকে ডাঙায় এনে ফেলছে! তারা ডাঙায় পড়ে ছটফট্ করছে_ আবার হয়ত পরের ঢেউয়ের ফিরতি টানে তাদেরকে ফের কিছুটা নিয়ে যাচ্ছে, পরক্ষনেই আবার ডাঙায় !এরাই সাধারণ জীব, যারা শূধুমাত্র হরিনাম করার সময়কালীন অবস্থায় ঈশ্বরমুখী হয়ে থাকে কিন্তু সংসারে ফিরে গিয়ে আবার নানান জ্বালায় ক্লিষ্ট হয়। কিন্তু যারা নামের গভীরতায় ডুব দেয়, তারাই ঐ অন্তর্মুখী টানে পড়ে! আর একবার ঐ Under current-এ পড়তে পারলে, তাদের আর ফিরতে হয় না — ঐ টান-ই তাকে অরূপের কাছে নিয়ে যায়, তখন সেই রূপ(সাধক)-ই অপরূপ হয়।

উত্তর পেলে তো? ভাসা-ভাসা জ্ঞান বা ভাব আরোপ করলে তার প্রাপ্তিও সেরকমই হয়। ভাবের গভীরে ঢুকতে হয় — জ্ঞানের গভীরে ডুব দিতে হয়। রহস্য না বুঝে হাজার হরিনাম করলেও সেইজন্য কিছুই হয় না। কিন্তু প্রকৃতই যিনি রহস্য বুঝেছেন, তাঁর একবার হরিনাম করলেই হয়ে যাবে। আসল কথা হ’ল গভীরতায় যাওয়া। শাক্ত পদাবলীতেও রয়েছে একই কথা “ডুব দেরে মন কালী বলে, হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।” ঐ জন্যই বলা হয়েছে ‘যত মত তত পথ’, কিন্তু সব পথই যেহেতু সেই একই লক্ষ্যে নিয়ে যায়, তাই এক জায়গায় এসে সব পথই মিলিত হয়। সুতরাং বলা যায়_” ভিন্ন-ভিন্ন মত কিন্তু পথ সেই একটাই”। যেমন রাজদর্শনে আসতে হলে রাজধানীতে বিভিন্ন পথ দিয়ে আসা যায়, কিন্তু রাজার কাছে যেতে গেলে তো রাজপথ অবলম্বন করতেই হয়। অন্তিমে পথ সেই একটাই, রাজপথ-ই পথ। সুষুম্না মার্গই তো পথ, না কি গো – অন্য কোন পথ আছে না কি?

[এই কথা বলে গুরুমহারাজ হেসে উঠলেন।]

জিজ্ঞাসু :– অরবিন্দ রচনা পড়ার পর বিবেকানন্দ রচনা পড়তে গেলে খুবই জোলো বলে মনে হয়–এ ব্যাপারে আপনার কি মত?

গুরুমহারাজ :– [ভিড়ের মধ্যে কে বললেন কথাটা, গুরুমহারাজ তা দেখতে পাননি–তাই বললেন] কে বললেন কথাটা –দেখি আপনার মুখটা ? ওঃ!_ আপনি বললেন একথা–কি করেন আপনি ?… আচ্ছা- আচ্ছা, ডাক্তারী করেন। দেখুন, M. B. B. S পাশ করতেই তো আপনার জীবনের বহুবছর কেটে গেছে–তারপর কয়েক বছর House Staff হয়ে কাটিয়েছেন, এরপর হয়তো M.D করেছেন! তারপর আবার private- Practice-এ নেমেছেন, পসার করতে হয়েছে– এইসব করতেই তাে আরও কত বছর! এখন আবার রোগী দেখা, সংসার করা, হাট-বাজার, ও লোকলৌকিকতা—এসবেও সময় যায় বই কি! তা ডাক্তারবাবু_আপনার তো স্বামী বিবেকানন্দ বা অরবিন্দকে নিয়ে গবেষণা করার সময় হয়ে ওঠার কথা নয়, তবু আপনার মত লােকেরা মহাপুরুষদের তুলনামূলক মূল্যায়ন করেন– এটাই দুঃখের । যে বিষয়টা আপনি জানেন, যেটা নিয়ে আপনার জীবনের মূল্যবান সময়গুলো ব্যয় হয়ে গেছে—সেই সম্বন্ধে আপনার বক্তব্য শুনলে তবু ভাল লাগত, কিন্তু যাঁদের সম্বন্ধে আপনার কোন ধারণাই তৈরী হ’লনা–শুধু দুটো বই হয়তো আপনি পড়েছেন, অমনি দুম্ করে একটা মন্তব্য করে বসলেন ? ডাক্তারী বিদ্যা নিয়ে তো আপনি এতবছর কাটাচ্ছেন, বলুনতাে—ডাক্তারী বিজ্ঞানের সব কিছুই কি আপনার জানা হয়েছে ? আর শুধু আপনি নিজে কেন, বলা ভালো যে_ Medical Science এখনও নিজেই সম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি-Right । তাহলে একটা অসম্পূর্ণ বিজ্ঞানের শাখার লােক হয়ে পৃথিবী গ্রহের সর্বোন্নত যে বিজ্ঞান অর্থাৎ আধ্যাত্মিক-বিজ্ঞানের মহাজনদের সম্বন্ধে আপনার এরূপ মন্তব্য করা শোভনীয় নয়!

যাইহােক, আমি আপনার জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছি – মন দিয়ে শুনুন। আমি জানি আধ্যাত্মিক রাজ্যে স্বামী বিবেকানন্দ বা শ্ৰীঅরবিন্দের কোন বিরােধ নেই কিন্তু সাধারণ মানুষের এই ধরনের জিজ্ঞাসা-র উত্তরে কিছু তুলনামূলক আলোচনা এসে যাবে। আমি আশা করব আপনারা তার থেকে ‘সার’-টা গ্রহণ করার চেষ্টা করবেন। আমি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই বিচার করার চেষ্টা করছি। যদি শুধু সাহিত্যের বিচারে এই দুই মনীষীর রচনাবলীকে ধরেন, তাহলে দেখবেন স্বামী বিবেকানন্দ বাংলাভাষাকে উন্নত করার জন্য নতুন ধরনের রচনাশৈলীর প্রবর্তন করেছেন। তাঁর চিঠিপত্রে তিনি নিজে এইরূপ style ব্যবহার করেছেন এবং বন্ধু-বান্ধবদেরও ঐ শৈলী ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছেন। আপনি জানবেন _স্বামীজীর প্রবন্ধ ও কবিতাবলী অথবা চিঠি-পত্র লেখার যে Style—সেটি পরবর্তী কালের বাংলা সাহিত্যে যত অনুসৃত হয়েছে, ভাষাটি ততই সমৃদ্ধ হয়েছে।

এবার অন্য প্রসঙ্গে আসছি— অরবিন্দ প্রথম জীবনে স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, এটা এমন কিছু উল্লেখযােগ্য নয় কারণ তৎকালে অরবিন্দ অপেক্ষা অনেক বীর সংগ্রামীরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। অরবিন্দের মহত্ত্ব তাঁর সাধন জীবনের পর্যায়ে। সেখানে দেখা যায় জেলখানায় দু-বার স্বামীজী সূক্ষ্মদেহে অরবিন্দের নিকট প্রকট হন এবং তাঁকে উপবাসে দেহ-ত্যাগ করার বাসনা থেকে নিবৃত্ত করেন। এমন‌ও কথিত আছে যে—এখানেই স্বামীজী, অরবিন্দকে গীতার মর্মার্থ শিক্ষা দেন।

এরপর আমরা অরবিন্দকে পাই পণ্ডিচেরী আশ্রমে। তাঁর যোগ-সাধনা এবং Life divine আদি পুস্তকে তাঁর দর্শন প্রকাশিত হয়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তাঁর জীবনের শেষ কটা বছর শ্রীমা(এক উচ্চ-আধ্যাত্মিক ফরাসী মহিলা মীরা আলফাসা)-র অন্তরালে নীরবে কেটে যায়। এই সময়ের মধ্যে, না তিনি মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন না কোন নতুন বই লিখে নিজের গভীর সাধনার উপলব্ধ সত্যের কথা জানিয়েছেন!

তাহলে, সাধারণ মানুষ অরবিন্দের কাছ থেকে পেল পণ্ডিচেরী আশ্রম, আর অরবিন্দ দর্শনের কিছু বই। আর স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে মানুষ পেয়েছে তাঁর জীবন ও বাণী এবং পেয়েছে স্বামীজী প্রতিষ্ঠিত “রামকৃষ্ণ মিশন।”

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথায়—স্বামীজী ছিলেন সপ্তঋষির এক ঋষি। শুধু জীবের প্রতি করুণা পরবশ হয়ে তিনি জীবকল্যাণে অবতরণ করেছিলেন। নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করেই আবার তিনি নির্দিষ্ট লােকে চলে গেছেন। পৃথিবী গ্রহের সৌভাগ্য যে, এই ধরনের মহাপুরুষদের মাঝে মাঝে আবির্ভাব ঘটে সেখানে। এঁরা জন্মান না– এঁদের আবির্ভাব হয়। অর্থাৎ এঁরা নিজেরাই পিতামাতা Selection করে তবে আসেন। শেষ সময়ে একবার স্বামীজী তাঁর গুরুভাইদের বলেছিলেন – “যদি আর একটা স্বামী বিবেকানন্দ থাকতো তাহলে সে বুঝতে পারতো—বিবেকানন্দ কি করে গেল”। তাহলেই বুঝুন _সাধারণের সাধ্য কি স্বামীজীকে বোঝে? তাদের স্পর্ধাই বা হয় কি করে যে, তাঁর সমালােচনা করে ?

গিরিশচন্দ্র বলেছিলেন ঠাকুরের দুটি সন্তানকে মা মহামায়াও বাঁধতে পারেননি, তার একজন নাগমশায় ( দুর্গাচরণ নাগ ), ওঁনাকে মা যত বাঁধতে গেছেন, উনি ততই ছােট হয়ে ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে গেছেন (নাগ মশায় খুবই_সহজ সরল, দীন হীন ভাবে জীবন কাটাতেন)। আর একজন নরেন –মা নরেনকে যতই বাঁধতে গেছে নরেন ততই এত বড় হয়েছে যে, মহামায়ার বাঁধার দড়িতে আর কুলোয়নি।

এবার বলুন তো, ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে এইসব মহাপুরুষদের লীলা কি বোঝা সম্ভব ? সেই জন্যই আমি এখানে উপস্থিত সকলকে বলব__ এর ওর সম্বন্ধে না কৌতুহলী হয়ে নিজের সম্বন্ধে কৌতুহল বাড়ান! নিজের সততা, সাধুতা, সংযম কি করে বাড়ানো যায় সেইসব চেষ্টাতেই তো আপনার নিজের মঙ্গল! আর আপনি সৎ, সংযমী হয়ে উঠলে আপনার দ্বারা সমাজ উপকৃত হবে। এইভাবে সমাজের এক-একটা unit যদি সৎ-সুন্দর হয়ে ওঠে – সামগ্রিকভাবে সমাজও সুন্দর হবে। এটাই স্বামীজীর ভাবনার সার্থক রূপায়ণ।