স্থান ~ শিবপুর / গঙ্গাবাবুর বাড়ি । সময় ~ ১৯৮৯ জুলাই ৷ উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ শেখর, গঙ্গাবাবু, এনাঙ্কবাবু, রত্না ইত্যাদি ৷

জিজ্ঞাসা :— ‘ভগবান’ কি মানুষ শরীরেই আসেন নাকি অন্য জীব শরীরও ধারণ করতে পারেন?

গুরুমহারাজ :—মানুষ সাধারণভাবে মানুষ-শরীরের ভগবানকেই পায় — অন্য শরীর গ্রহণ করলে তাঁকে চিনবে কি করে? দ্যাখো,সত্যি কথা বলতে গেলেমানুষ-শরীরধারী ‘ভগবান’-কেই বা কজন চেনে? পরবর্তীকালে তাঁদের মহিমা প্রকট হলেওবহু মানুষ তাঁদের বিরোধ করে , তাই নয় কি? এবার ভগবানকে চিনতে পারার লোকটি যদি কোথাও থাকেন, তো তিনি জানেন ভগবান কোথায় _ কোন শরীরে লীলা করছেন। তখন তিনি শুধু সেই লীলার স্বাদ গ্রহণ করেন। আর পরমানন্দে মশগুল থাকেন। কিন্তু তাঁদের কথা স্বতন্ত্র; সাধারণ মানুষ কিভাবে এই তত্ত্ব জানতে পারে তার art-টা বলছি শোন।

  পৃথিবীগ্রহের শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। কারণ evolution-এর ধারায় যা "অধঃমূলম্ ঊর্ধ্বশাখম্" অর্থাৎ vegetation থেকে শুরু হয়েছিল তা "ঊর্ধ্বমূলম্ অধঃশাখম্" — অর্থাৎ মানুষ-শরীরে এসে  সম্পূর্ণ হয়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে অষ্টকলা বা অর্ধকলায় মানুষ। যেহেতু ষোলকলায় ব্রহ্ম পূর্ণরূপে প্রকাশিত, তাই অষ্ট কলাকে 'অর্ধকলা' বলা হয়। মানুষশরীর লাভ হবার পর আর এর forward movement(পশু অবস্থা বা চতুঃস্পদ অবস্থা পর্যন্ত জীব ভূমির সাথে parallelভাবে থাকে,একেই forward movement বলা হয়) হয় না — তখন হয় upward movement,কারণ এই প্রথম জীব খাড়া হোল,মাথা উঁচুতে অবস্থান করল এবং সে সমগ্র আকাশ দেখল। এখন আর evolution নয়, এবার হয় involution। কিভাবে involution হয় _এবার তাই বলছি। মানুষ শরীর ধারণ করলেই কি সবাইকে মানুষ বলা হয়? কাউকে নরাধম, কাউকে নরপিশাচও তো বলে — তার কারণ কি? কারণ একটাই, মানুষশরীর লাভ করলেও সবাই মানুষ নয়। মানুষের মধ্যে যখন 'শ্রদ্ধা' এবং 'বিবেক' জাগ্রত হয় তখনই মানুষ,_ 'মানুষ' হয়ে ওঠে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন 'মান-হুঁশ' — মানুষ। ফারসীতে 'হৌঁস' অর্থে বিবেক।  শ্রদ্ধাবান এবং বিবেকবান ব্যক্তিদের দ্বারা সমাজ যদি কোন উপকার নাও পায়, তবু এঁদের দ্বারা সমাজের কোন ক্ষতি হবে না — এটা নিশ্চিত।

   এবার ঐরূপ "মানুষের" জীবনে যদি 'ত্যাগ এবং বৈরাগ্য'- আসে, তাহলে সেই আধারে ব্রহ্ম _দশম কলায় প্রকাশিত রয়েছেন ধরা হয়। এঁদেরকে সমাজ 'দেবতা' আখ্যা দেন। দেখবে_ সমাজে খুব দানী ব্যক্তি, পরোপকারী, দয়ালু ইত্যাদিকে মানুষ বলেন "উনি মানুষ নন-গো, উনি দেবতা"। প্রকৃতপক্ষেই যাঁরা সমাজকে কোন কিছুর বিনিময়কে অগ্রাহ্য করে শুধু দিয়েই যান_ তাঁরাই দেবতা। সন্তানের কাছে পিতামাতা দেবতা। কারণ তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে, কোন কিছুর বিনিময়ের তোয়াক্কা না করেই সন্তানকে ভালবাসা দেন, ভরণ-পোষণ করেন, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন_তাই বেদ বলেছেন, "পিতৃদেবো ভব,মাতৃদেবো ভব"।

  এই ভাবে উত্তরণের পথে, চরৈবেতি'র পথে_ চলতে থাকা মানুষের জীবনে যখন 'জ্ঞান' এবং 'প্রেম' প্রকটিত হয়, তখন তাঁরাই হ'ন "ঋষি" বা "সিদ্ধ"। এখানে ব্রহ্ম দ্বাদশ কলায় প্রকাশিত, 'ঋত' বোধকারী 'ঋক' মন্ত্রের প্রণেতা ঋষিদের 'সিদ্ধ' বলার কারণ এই যে, শস্য যেমন সিদ্ধ হলে আর তার অঙ্কুরোদগম হয় না_ তেমনি এঁদের বাসনার বীজ সিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় , সাধারণ জীবের মতো শুধু বাসনা মেটানোর তাগিদে এঁদের আর জন্মগ্রহণ করতে হয় না। যদি পরবর্তীতে শরীর ধারণ করতে হয়ও__ তা শুধুমাত্র জীবের কল্যাণের জন্য! এঁরাই জন্ম _"গ্রহণ" করেন, সাধারণ মানুষ সহ অন্যান্য জীবেরা তো জন্মায়! এরপর তখন জীবকল্যানে এঁদের শরীরধারণের প্রয়োজন হয়, তখন এঁরা অবতরণ করেন, তাই এঁদের বলা হয় "অবতার"। অবতারে ব্রহ্ম চতুর্দশ কলায় প্রকাশিত।

 সুতরাং দেখা গেল _ব্রহ্মই বিভিন্ন কলায় প্রকাশিত হয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে লীলা করছেন। 'ভগবান' সেই অমূর্ত ব্রহ্মের-ই মূর্ত প্রকাশ। বলা যায় অখণ্ডই খণ্ডাকারে ধরা দেন, অসীম-ই সীমার মাঝে প্রকাশিত হন, অখণ্ড সচ্চিদানন্দই সচ্চিদানন্দঘন-বিগ্রহরূপে আবির্ভূত হ'ন। তখনই জ্ঞানীরা সেই বিশেষ শরীরধারীকে বিভিন্ন নামে, বিভিন্নভাবে বন্দনা করেন। অজ্ঞানী মানুষ — সাধারণ জীবেরা এসব রহস্যের কি করে সন্ধান পাবে? অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি, ইন্দ্রিয় লিপ্সা — এসবের যোগান দিতে আর এগুলির চাহিদা মেটাতে গিয়ে এবং কামনা বাসনা সন্জাত উৎপন্ন সমস্যার সামাল দিতেই এদের জীবন কেটে যাচ্ছে!__ আর শুধু কি একটা জীবন? কত জন্ম-জন্মান্তর সেই একই চাওয়া আর ক্ষণিক ভোগ, পরক্ষণেই ক্লেশ — এই চলেছে। সিদ্ধ অবস্থায় যাঁরা রয়েছেন অর্থাৎ জ্ঞানীরাই এটা বুঝে বাসনার বীজকে সিদ্ধ করে দেন, ফলে এঁদেরকে বারবার শরীর ধারণের চক্রে পড়তে হয় না,তাই এঁদেরকে "মুক্ত"-ও বলা হয়।

এবার জিজ্ঞাসা আসতে পারে — সবাই মুক্ত হয় না কেন? কিন্তু হবে কি করে! দেখা যাবে, লক্ষ লোকের মধ্যে মাত্র কয়েক জনের ব্রহ্মবিদ্যা লাভের আগ্রহ জন্মে। যাঁদের আগ্রহ জন্মে সেইরূপ লক্ষজনের মধ্যে_ মাত্র কয়েক জনই ব্রহ্মবিদের অন্বেষণ করে তাঁর কাছে যান এবং তাঁর কথা শোনেন। আবার যাঁরা তাঁর কথা শুনেছেন এরূপ লক্ষ লোকের মধ্যে আবার ব্রহ্মকে জানার চেষ্টা করেন অতি অল্প কয়েকজন_আর ব্রহ্মকে ঠিক ঠিক জানেন হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন!

তাহলে এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেল যে, সমাজে ব্রহ্মবিৎ বা প্রকৃত ব্রাহ্মণ সব সময়ই খুবই অল্প সংখ্যক থাকেন, সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সংখ্যাই সব সময় বেশি। এই পরিসংখ্যান দেখে বুদ্ধিমানেরা অনেক সময় সংশয় হয় যে, তাহলে বেশিরভাগ মানুষই কি ভুল করছে? মাত্র কয়েক জনই কি ঠিক? সেই জন্যই পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, প্রকৃত রহস্যটা কি? জগত সংসারে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে তাই ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, ভগবান কৃষ্ণ, ভগবান বুদ্ধ, ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ ইত্যাদি কয়েক জনকেই “ভগবান” বলা হয়েছে। তবে তুমি তোমার গুরু(যিনি শিষ্যকে অজ্ঞান-অন্ধকার থেকে জ্ঞানালোকের দিকে নিয়ে চলেন)-কে “ভগবান” বলতে পারো। এইভাবে দেখবে অনেক সম্প্রদায়ের শিষ্যেরা তাঁদের গুরুকে “ভগবান” আখ্যা দিয়েছেন। এটা ঠিকই আছে — মর্তের “গুরু”-ই ভগবান। কিন্তু জানবে, “গুরু-ভগবান” এই আখ্যাটা শিষ্যদের দেওয়া গুরুদের সম্বন্ধে শ্রদ্ধাব্যঞ্জক একটা বিশেষণ। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সেই “অখণ্ডই” যখন ভোগায়তন শরীরধারণ করে কোন না কোন লীলা সম্পন্ন করেন, তখন সেই শরীর-ধারীকেই বলা হয় “ভগবান”। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় — যেমন সূর্য স্বতঃই প্রকাশিত কিন্তু কয়লায় তার প্রতিবিম্ব প্রায় পাওয়া যায় না বললেই হয় — কিন্তু কয়লা সরিয়ে ঐ স্থানে যদি একটি জলপূর্ণ পাত্র রাখা যায়_ তাহলে সূর্যের প্রতিবিম্ব পাওয়া যায়। এবার জলপূর্ণ পাত্র সরিয়ে কাচ রাখলে প্রতিবিম্বের ঔজ্জল্য আরও বৃদ্ধি পাবে — হীরক রাখলে একেবারেই জ্বলজ্বল করে উঠবে। এই ভাবে আধার ভেদে প্রতিবিম্বিত সূর্যের প্রকাশের তারতম্য হয়। সেইরূপ ব্রহ্মের কোন বিকার নেই শুধুক্ষেত্র বা আধার ভেদে প্রকাশের তারতম্য হয়। ভগবান যখন ভাগবতী তনু গ্রহণ করেন — সেটাই মানুষরূপের Highest manifestation! যেমন ২৫০০ বছর আগে ভগবান বুদ্ধ ছিলেন তৎকালীন মানুষের মধ্যে Highest Manifestation! এইরূপ সবসময়ই জানবেএক‌ই রকমের ঘটনা ঘটে। মানুষেরই একমাত্র Neuro-cell এর বিবর্তন অর্থাৎ সংবর্তন(involution)হয় কিন্তু মনুষ্যেতর প্রাণীদের শুধু Germ cell এবং Life cell এর বিবর্তন দেখা যায়। ফলে মনুষ্যশরীর ছাড়া অন্য শরীরে Highest manifestation হবে কি করে?

   তবে, এমন হোতে পারে যে — হয়তো কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বা হঠাৎ নতুন ধরনের কোন virus-এর আক্রমণে কোন প্রজাতির প্রাণী অবলুপ্ত হতে চলেছে, কিন্তু ব্রহ্মের বিবর্তবিলাসে সেই প্রাণীটির টিকে থাকা প্রয়োজন; তখনই সেই বিশেষ প্রজাতিকে বাঁচানোর জন্য, সেই প্রজাতিতেই ঈশ্বরের অবতরণ হতে পারে। কিন্তু এ সব কথা চিরকালই সাধারণ মানুষের বুদ্ধির অগোচরেই থেকে গেছে এবং থাকবেও। নিজে নির্মল ও স্বচ্ছ না হওয়া পর্যন্ত এরূপ অনেক রহস্যই ধরা মানুষের পক্ষে সম্ভব হবে না। একমাত্র মহাত্মা মহাপুরুষেরাই এই ধরনের লীলার খোঁজ রাখেন।

জিজ্ঞাসু :— ভারতবর্ষের আর্যচিন্তার সঙ্গে semitic ধর্মাবলম্বীদের চিন্তার মৌলিক পার্থক্য কি?

গুরুমহারাজ :— ভারতবর্ষের আর্যচিন্তা বলেছে ‘জানো’ আর semitic মতগুলি বলেছে ‘মানো’ — এটাই মৌলিক পার্থক্য। ভারতের বেদান্ত দর্শন বা অন্যান্য দর্শনশাস্ত্রগুলিতে দেখতে পাওয়া যায় জিজ্ঞাসার পর জিজ্ঞাসা এবং গুরু বা আচার্যরা সেই সব জিজ্ঞাসার মীমাংসা করছেন। ‘জিজ্ঞাসা’ অর্থাৎ জানার ইচ্ছা, এই ইচ্ছাই শিষ্যকে গুরুর কাছে নিয়ে যায় এবং ‘জ্ঞানী’ অর্থাৎ যিনি জানেন — তিনিই গুরু হয়ে শিষ্যের সংশয়ের অবসান ঘটান। এভাবে উপনিষদগুলিতে উদ্দালক-শ্বেতকেতু, যম-নচিকেতা, যাজ্ঞবল্ক্য-গার্গী ইত্যাদি আরো অনেকের জিজ্ঞাসা ও উত্তরের মাধ্যমে জগৎ-জীবন ও ঈশ্বরের রহস্য এবং আত্ম-সাক্ষাৎকারের উপায় জানানো হয়েছে। কিন্তু semitic মতাবলম্বীদের চিন্তায় জিজ্ঞাসার অবকাশ নেই। পূর্বে যা বলা হয়েছে আজও তোমাকে সেটাই ঠিক বলে মেনে নিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে দ্যাখো_ এই জগত তো পরিবর্তনশীল! সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই জগতের সবকিছুই পাল্টে-পাল্টে যায়। শুধু “সত্য”-ই অপরিবর্তনীয়। আর তাছাড়া আচার-অনুষ্ঠান, পোষাক, আহার এমনকি মানুষের শরীরের গঠনেরও পরিবর্তন হয় — সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে। এসব বিচার করেই আর্যঋষিরা যুগে যুগে মহামানব বা যুগাচার্যগণের বারবার আগমনের বার্তা শুনিয়েছিলেন। কিন্তু semitic মতাবলম্বীদের চিন্তায় এটা মানা হয়না। তবু একেবারেই যে মানা হয় না এমনটাও বলা যায় না কখনও কখনও এইসব মৃতের কোন কোন উন্নত মানুষ, হয়তো চিন্তার জগতে নবজাগরণ ঘটিয়ে পূর্ববর্তী মত ও তার আচারকে পরিবর্তন করে কিছু নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেছেন! ফলে তাঁকে কেন্দ্র করে আবার একটা নতুন সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। মার্টিন লুথার সেরকমই একজন — যাঁকে কেন্দ্র করে ‘প্রোটেষ্টান্ট’ নামে একটা নতুন দল গড়ে উঠেছিল খ্রীষ্টান সমাজে।ইসলামীয়া সমাজেও বাহাইয়া,আহমদীয়া ইত্যাদি কিছু মত সৃষ্টি হয়েছে_যেগুলি পুরোনোপন্থা থেকে অনেকটাই সরে আসতে পেরেছে।

 আর্যচিন্তায় "আত্মা"-কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে — ঈশ্বর-সত্তায় বা তাঁর সৃষ্টিতে নারী বা পুরুষ বলে কোন ভিন্নতা আরোপ করা হয়নি(দেব-দেবীর concept ভারতীয় দর্শনে অনেক পরে সংযোজন হয়েছে, পৌরাণিক সাহিত্য রচনার সময়ে), কিন্তু  semitic দার্শনিকগণের চিন্তায় — আদম বা পুরুষকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কারণ ঈশ্বর আদমকে সৃষ্টি করেছেন, আর হাভা (বা ইভ্) সৃষ্টি হয়েছে আদমের পাঁজর থেকে। তাই নারীর আত্মা নেই —। এমনকি (খ্রীষ্টান মতে) অখ্রীষ্টান পুরুষদেরও রয়েছে পাপাত্মা। baptised হবার সময় ঘুঘুরআকারে পবিত্র আত্মা ওই পুরুষের শরীরে প্রবেশ করে__Heavenly God — Son of God — Holy Ghost — Amen.

      আর্যচিন্তার যে সৃষ্টিক্রম তা সম্পূর্ণভাবে মিলে যায় বর্তমানের জড় বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে। এমনকি অতি আধুনিকতম আবিষ্কারও দেখা যাচ্ছে ঋষিদের প্রণীত কোন না কোন সুক্তে, সূত্রাকারে রয়ে গেছে। কিন্তু  semitic মতাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থগুলিতে উল্লেখিত যে সৃষ্টিক্রম _তা বর্তমান বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সাথে একেবারেই মেলে না। এরফলে বর্তমান জড়বিজ্ঞানে উন্নত ইউরোপ বা আমেরিকার দেশগুলি_ ভারতের প্রাচীন শাস্ত্রগুলো নিয়ে রীতিমত গবেষণা শুরু করেছে এবং জেনেছে যে জড়-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষণায় আবিষ্কৃত তথ্যসমূহ ভারতের প্রাচীন শাস্ত্রগুলিতে আগে থেকেই রয়েছে! অতএব নতুন কিছু আবিষ্কার করতে গেলে, সেই সব সূত্র‌ও হয়তো সরাসরি ভারতীয় শাশ্ত্রগুলি থেকেই পাওয়া যেতে পারে — এই জন্যই ভারতের প্রাচীন-গ্রন্থগুলির বর্তমানে প্রাশ্চাত্তের দেশগুলিতে এত কদর!

 সে যাই হোক, তোমার জিজ্ঞাসার উত্তরে এসব কথা বলতে হোল — কিন্তু আমি জানি  semitic‌ ,ভারতীয় অথবা অন্য কোন দর্শনের মতাবলম্বীরা— অপর মতের বিরোধ না করে,সবাই যদি নিজ নিজ সংস্কৃতিকে ঠিক ঠিক ধরে থাকতে পারে এবং যদি তারা নিজ নিজ ধর্মমতের আচার, অনুষ্ঠান, শিক্ষা, সাধনপদ্ধতি শ্রদ্ধাসহকারে অবলম্বন করে তাহলে সকলেরই আধ্যাত্মিক উন্নতি এবং "পরমসত্য"-লাভ সম্ভব। নিজ নিজ সংস্কৃতি বা বৈশিষ্ট্যকে অশ্রদ্ধা করে কখনোই ঠিক ঠিক ধর্ম-আচরণ হয় না। দেশ, কাল এবং পাত্রের জ্ঞান রাখতে হবে। এই তিন-এর ভিন্নতায় অনেক কিছুই ভিন্ন হতে পারে — এটাতো সাধারণ জ্ঞান! একই দেশের পাহাড়ী এলাকার মানুষ এবং সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার মানুষের কাঠামোগতই সাদৃশ্য থাকে না সুতরাং তাদের আচার-অনুষ্ঠান, ধর্মমতের ভিন্নতা হতেই পারে।

  প্রকৃতি থেকে এসব শিক্ষা নেবার কথাই বলেছেন ঋষিরা, আর ভারতীয় চিন্তা বা আর্যচিন্তা বলতে শুধু একটা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ মানুষের কথা ভেবো না। এই দেশেরই মানুষ, অথচ নিজের দেশের ইতিহাস বা সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে যারা__ তারা কি করে দাবী করে যে 'আমাদের ঋষি' 'আমাদের বেদ'?এইজন্য "আর্য" কোন জাতি নয়, 'আর্য' একটা সংস্কৃতি। যিনি বা যাঁরা ওই সংস্কৃতির মধ্যে আছেন তিনি বা তাঁরাই আর্য। "কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম্" — এখানে ভারতীয় অথবা অভারতীয় কোন ভেদ টানা হয়নি।

মনে কোন সংশয় সৃষ্টি হোলে জিজ্ঞাসার দ্বারা সেটি মিটিয়ে নিতে হয়! কিন্তু জানবেজিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়াটাই শেষ কথা নয়_ যা শিখলে তা গভীরভাবে মনন করতে হয়। এইভাবে দীর্ঘ দিনের অভ্যাসের ফলে ঠিক ঠিক ধারণা জন্মে। আর ধারণা যতক্ষণ না পাকা হচ্ছে ততক্ষণ সংশয় যেতে চায় না! তাই শুধু জিজ্ঞাসার জন্য জিজ্ঞাসা নয় —জানার জন্য জিজ্ঞাসা করতে হয়, জ্ঞানকে হৃদয়ে ধারণ করার চেষ্টা করতে হয়। কোন জিনিসের ভাসা-ভাসা জ্ঞান ভাল নয় কারণ এর ফলে তর্ক-বিতর্ক বা বিরোধ সৃষ্টি হোতে পারে, কিন্তু পাকা ধারণাযুক্ত ব্যক্তি কখনই নিজেকে বিতর্কে বা বিরোধে জড়ান না।