স্থান ~ বনগ্রাম পরমানন্দ মিশন । সময় ~ ১৯৮৯, এপ্রিল । উপস্থিত ব্যক্তিগণ ~ সব্যসাচী মান্না, তরুণ
পূর্ণানন্দ মহারাজ, স্বামী স্বরূপানন্দ, স্বামী শংকরানন্দ মহারাজ এবং অন্যান্য ভক্তগণ ।
জিজ্ঞাসা :– ভাবনা—ইচ্ছা—ক্রিয়া এই ক্রমের কথা আপনি বলেন । কিন্তু মনে তাে পরপর প্রচুর ভাবনার উদয় হয়, তাহলে এদের সবই কি ক্রিয়ায় রূপ নেবে ?
গুরুমহারাজ :– ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, “কলিতে মনের পাপ –পাপ নয়”। অর্থাৎ ‘ভাবনা’ পর্যন্ত ঠিক আছে, কারণ ভাবনার স্থান মনে! কিন্তু ভাবনা, ইচ্ছায় এলেই তা ক্রিয়ায় রূপ নেবে। “ইচ্ছাময়ী মা” যেন সন্তানের ইচ্ছাকে মূল্য দেবার জন্যই এটা করে থাকেন _ জগতে এই রকমটাই হয়ে চলেছে! কিন্তু কথা হচ্ছে , এই যে বলা হোল“ভাবনা থেকে ইচ্ছা, সেখান থেকে ক্রিয়া – এইসব যে হয়ে চলেছে”, তা এখান থেকে কাজের কাজটা কি হচ্ছে ? এক-একটা জীবনে কত ভাবনা, কত ইচ্ছা, কত ক্রিয়া_ এতে হয়তো মানবজাতির বাহ্যিক উন্নতি কিছুটা হচ্ছে কিন্তু প্রকৃত যে উন্নতি অর্থাৎ আধ্যাত্মিক উন্নতি, সেইটা হচ্ছে কি ? _হচ্ছে না! তাও তাে মনের মধ্যে যত ভাবনা আসে, তার সবগুলো ইচ্ছায় আসে না– আবার যা ইচ্ছায় আসে, তা হয়তাে এক জীবনে ক্রিয়ায় রূপও নেয় না। তাতেই এত কর্ম-কোলাহল, মানুষের এত কাজ, কিন্তু কাজের কাজ ?—হচ্ছে না !
মানুষের জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য যদি জ্ঞানলাভ—সত্যলাভ বা ঈশ্বরলাভ হয়, তবে তার জন্য কি ক্রিয়া হচ্ছে ? আমি একটা পরিসংখ্যান দিয়ে বােঝানাের চেষ্টা করছি—ভাবনার বিষয়বস্তু অহেতুক বাড়িয়ে কিভাবে মানুষ জ্ঞানের গভীরতা কমিয়ে ফেলে!
মনপ্রধান মানুষ মন দিয়েই ভাবে, তাই মনকে unit ধরা যাক্—এবার মন যদি সর্বদা সহস্র ব্যাপারে বা বিষয়ে নিবদ্ধ থাকে তাহলে প্রতিটি বিষয়ের জ্ঞানলাভের ভগ্নাংশটা দাঁড়ায় ১/১০০০, যার মান খুবই কম।এই ভাবে মন যদি একশত ব্যাপারে বা বিষয়ে নিবদ্ধ থাকে তাহলে ভগ্নাংশ দাঁড়ায় ১/১০০, তার মান আগের থেকে একটু বেশি! মনের বিষয় আরও কমলে তা হতে পারে ১/১০ _অর্থাৎ সেই বিষয়গুলিতে জ্ঞানলাভের মান অনেকটাই বেশি। যদি মনের বিষয় মাত্র একটাই হয় তাহলে ভগ্নাংশ দাঁড়ায় ১/১=১ __ অর্থাৎ ব্যক্তি-মনে তখনই কোন বিষয়ের সম্বন্ধে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ সম্ভব হয়। কিন্তু অনন্ত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের জ্ঞানলাভ কি ভাবে সম্ভব ? হ্যাঁ তাও সম্ভব হয়—যদি মনকে নির্বিষয় করা যায়, অর্থাৎ যখন ভগ্নাংশ ১/০ হয় তখনই মান দাঁড়ায় Infinity অর্থাৎ অসীম। তখনই অনন্ত জ্ঞানভাণ্ডারের রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায়! বহু জ্ঞানী, মহাপুরুষ, বেদবেত্তারা এইভাবেই অনন্ত জ্ঞানভাণ্ডারের চাবিকাঠি লাভ করেছিলেন। তাঁরা সেই জ্ঞান শুধু নিজেরাই আস্বাদন করে ক্ষান্ত থাকেন নি, শ্রুতিতে অথবা লিপিতে তাঁরা উত্তরসূরিদের জন্য আভাসে-ইঙ্গিতে তার স্বাদ দানেরও প্রচেষ্টা করে গেছেন। অহেতুক জাগতিক ভাবনাসমূহ মনকে পীড়িতই বেশী করে, মনকে বিক্ষিপ্তই করে—শান্ত হতে দেয় না। যারা প্রকৃতই আনন্দ ও শান্তিলাভের প্রয়াসী, তাদেরকে অভ্যাসযােগের দ্বারা মনে আগত বিষয় সমূহকে কমিয়ে কমিয়ে 'একে’ নিয়ে আসতে হয়—ক্রমে ক্রমে পরিশেষে মনকে বিষয়শূন্য করতে পারলে নিজেকে অনন্তের সাথে যুক্ত করা যায় । অতটা না হোলেও সাধকের মনোজগতের 'ভাবনা' কমে এলে _স্বাভাবিক ভাবেই ইচ্ছা ও ক্রিয়ার ক্রমগুলি পরপর কমে আসে। এইবার নশ্বর বিষয়ের ভাবনা ত্যাগ করে যদি ভাবনার বিষয় "ঈশ্বর" করা যায়_তাহলেও অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়।
জিজ্ঞাসু : – নস্ত্রাদামস্ বলে একজন ফরাসী দার্শনিক নাকি পৃথিবী সম্বন্ধে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে বলেছেন—এটা কি হবে ?
গুরুমহারাজ :– উনি তাে দার্শনিক ছিলেন না, একজন fore-teller ৷ ভারতবর্ষেও ওইরকম অনেকে ছিলেন। ভবিষ্য-পুরাণ বলে তো একটা পুরাণই রয়েছে। তাছাড়া দক্ষিণ ভারতের বীর ব্ৰহ্মণ গারু, বাংলার প্রভু জগৎবন্ধু সুন্দর প্রমূখ অনেক ভারতীয় মহাত্মা এবং অন্যান্য দেশের কিছু fore-teller অনেক ভবিষ্যৎবাণী লিপিবদ্ধ করে গেছেন – যেগুলো হয় সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে অথবা হবার অপেক্ষায় রয়েছে। নস্ত্রাদামস্ নামটাও ঠিক নয়, ওর নাম নস্ত্রাদা—আম্—আবু ।
দ্যাখাে—এই মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটনা ঘটছে, তাতো এই মহাকালের বুকেই ঘটেছে, ঘটছে বা ঘটবে। জগত-সংসারটা তো মহাকাল এবং মহাখালীর খেলা বই আর অন্য কিছু নয়! মা জগদম্বা নেচে চলেছেন __ঘটনাসমূহ ঘটে চলেছে! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাটি নড়েনা'। তাহলে বােঝা যাচ্ছে, কালী সবই জানেন, বলা হয় – ‘কাল’ জানেন কালী। তাই ‘কাল’ প্রসন্ন হলেই ‘কালী' প্রসন্ন হন। আর কালী যদি কারও উপর প্রসন্ন হয়ে কালের কয়েক পৃষ্ঠা দেখিয়ে দেন _তো সে জানতেই পারে আগামী কয়েক শতাব্দীর উল্লেখযােগ্য ঘটনাবলী। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন না –“সাজঘর (গ্ৰীণরুম) দেখে যাত্রা শুনতে বসা।”
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা আছে কি নেই সে নিয়ে মানুষের মাথাব্যথার অন্ত নেই! কিন্তু এটা সকলেরই বােঝা উচিত –সম্ভাবনা সবসময়ই রয়েছে। কারণ যুদ্ধ তাে মানুষের মনেই রয়েছে! মানুষ কি নিজে প্রকৃত অর্থে “শান্ত” হয়ে “শান্তি”-র কথা ভাবতে পারছে?শুধু মুখে “শান্তি”-র কথা বললে কি হবে ? ছােট-ছােট পরিবারেই ঝগড়া-মারামারি লেগে আছে, আর একটু বড় আকারে সমাজে, আরও বড় আকারে রাজ্যে বা রাষ্ট্রে। এই রকম ভাবেই এক দেশের সাথে আর এক দেশের যুদ্ধও তাে থেমে নেই– চলছেই তাে! স্বার্থ রক্ষার জন্য, অধিকার কায়েম করার জন্য, অর্থনৈতিক সুবিধা ভােগের জন্য__বাইরে থেকে শক্তিশালী কোন দেশ ঐসব যুদ্ধকে মদত লাগাতে শুরু করলেই দুটো বৃহৎশক্তি দুদিকে দাঁড়িয়ে যাবে, আর এইরকম হলেই তাকে “বিশ্বযুদ্ধ” নাম দেওয়া যাবে।।
তা তােমার কি মনে হচ্ছে_ পৃথিবী থেকে যুদ্ধবাজরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে ? তা যখন হবে ,তখন জানবে পৃথিবী-গ্রহ অনেকটাই প্রগতির দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু সেদিন আসতে এখনও অনেকটাই দেরী আছে।
জিজ্ঞাসু :— একটু আগেই বলছিলেন—”সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা”, তাহলে জগতে এত হানাহানি, অপরাধ প্রবণতা কেন ?
গুরু মহারাজ :– হ্যাঁ, সবই ঈশ্বরের ইচ্ছা! কিন্তু ঈশ্বরকে কেবল দয়াময় অথবা করুণাময় ভাবাটা কি সঠিক ? সৃষ্টি এবং স্থিতি যেমন তাঁর কাজ, প্রলয়ও তাে তাঁরই কাজ। মধুর রস যেমন আছে ভয়ঙ্কর রসও তাে রয়েছে। একটাকে গ্রহণ করবে অন্যটাকে এড়াতে চাইবে—তা কি করে হয় ? আমি তাে আগেও বহুবার বলেছি যে, জগৎ ত্রিগুণ প্রপঞ্চময় । আর ত্রিগুণময়ী মা জগদম্বা-ই সবকিছুর মধ্যে দিয়ে এই ত্রিগুণের খেলা খেলছেন। এখানে সবকিছুই রয়েছে সবকিছুই থাকবে– স্থূলে, নাহলে সূক্ষ্মতে থাকবে, তাও না থাকলে “কারণে”—বীজাকারে রয়ে যাবে। সুতরাং তােমরা জগতে ‘অপরাধ-অনাচার’রূপে যেগুলো দেখছাে, হয়তাে এর থেকেও ভয়ঙ্কর অপরাধের বীজ রয়ে গেছে। উপযুক্ত আধারে সেই সব অপরাধ কোনদিন ক্রিয়াশীলও হয়ে যেতে পারে। তাই জগতের রহস্য কোনদিনও জানতে পারবে না_ আর ঐ চেষ্টা করাটাও বােকামি! বরং এটা বােঝ যে, যে কোন কর্মের কর্মফল রয়েছে—সুকর্মের সুফল, কুকর্মের কুফল ! একমাত্র নিষ্কাম কর্মেই কর্মফলের নাশ হয় । এইবার তুমি নিজে বিচার কর, এদের মধ্যে কোন দলে রয়েছ। এইভাবেসবার বিচার না করে, মানুষ যদি আগে নিজের বিচার করে _তাহলেই ব্যক্তি ও সমাজ উভয়েরই মঙ্গল হবে।
জানবে, সমাজে বিভিন্ন মানুষ রয়েছে এবং তাদের মানসিকতাও ভিন্ন ভিন্ন। তাই ভিন্ন মানসিকতার ব্যক্তি একই কাজের মূল্যায়নও করে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। যেমন ধরো, কোথাও খুন হল যা তােমার চোখে খুবই নৃশংস—জঘন্য—অমানবিক ইত্যাদি। কিন্তু হয়তো দেখা যাবে, সেই খুনীটি বা তার দল এমনকি তার আত্মীয়-স্বজনেরাও হয়তাে শত্রু নিপাতের আনন্দে মশগুল হয়ে রয়েছে। তাহলে কি সিদ্ধান্ত করবে ? খুনী ব্যক্তিটির বা তার আত্মীয়-স্বজনের আনন্দ না নিহত ব্যক্তিটির পরিবার বর্গের দুঃখ বা শােক—কোনটিকে তুমি ঈশ্বরের ইচ্ছার বাইরে ফেলবে ?
এবার বিচারে এস, দেখতে পাবে কোন ব্যক্তির স্বার্থের অনুকূলে যা কিছু কাজ, তাই তাকে সুখ দেয়, অপরপক্ষে কোন ব্যক্তির স্বার্থের প্রতিকূলে যা কিছু বা যে কোন কাজ—তা তাকে দুঃখ দেয় । এইভাবে সাধারণ মানুষ দুঃখ বা সুখ ভােগ করে। কিন্তু এবার নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করে বলোতো যে, সত্যিই কি এগুলি সুখ অথবা দুঃখ ? জ্ঞানীর দৃষ্টিতে তাই জাগতিক সুখ বা দুঃখের কোন মূল্যই থাকে না। এই জন্যই বলা হয় “লােক না পােক।” কিন্তু জগৎ সম্বন্ধে তাঁদের এই উদাসীনতাকেও আবার সাধারণ মানুষ সমালোচনা করে থাকে—এটা মানুষেরই নির্বুদ্ধিতা!
জ্ঞানীরা—মহাজনেরা তাই সমাজের মানুষকে যখনই শিক্ষাদান করেন, তখন বলেন—"নিঃস্বার্থ হও—পরােপকারী হও, অপরকে ভালবাসো"। কারণ তাঁরা জানেন, এইভাবে ধীরে ধীরে অভ্যাসের ফলেই ব্যক্তির জীবনে নিঃস্বার্থপরতা প্রকট হবে, আর তখনই তার জীবনে প্রকৃত সুখ বা আনন্দের আস্বাদন হবে। যখন এই আনন্দের সন্ধান সে পাবে, তখন ঐ ব্যক্তি ইন্দ্রিয়জ সুখের মােহে আর জীবন কাটাবে না। একটা টান যেন সর্বদা সে অনুভব করবে—“হেথা নয়, হেথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।”
জেনে রাখবে_এই জগৎ-সংসারের কোন ব্যভিচার, কোন হানাহানি মা জগদম্বার গােচরের বাইরে নয়!:সেইজন্যই যাঁরা তাঁর কৃপা লাভ করেছেন—তাঁরা কখনই ঐসব ঘটনায় বিচলিত হন না বরং তাঁরা মায়ের নানারকম লীলা বিলাসের বৈচিত্র্য দেখে জগত থেকে আনন্দ নেন—আনন্দে নৃত্য করেন! সাধারণ মানুষ এটাকেই পাগলামি ভাবে—হয়তাে রাগায়, হয়তাে আঘাত করে। কিন্তু তাঁদের সহজতা, তাঁদের সত্যবােধ—তাঁরা ত্যাগই বা করেন কি করে ! তাঁরা সাধারণ মানুষের অত্যাচারে যদি মারাও যান, তবু মারা যাবার আগে, তাদের জন্যই সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করেন “হে ঈশ্বর ! ওরা জানেনা ওরা কি অপরাধ করছে, ওদের তুমি ক্ষমা কর।”
জিজ্ঞাসু :– ভগবানকে ভালবাসতে গিয়েও তাে প্রাণে ব্যথা লাগে _মহারাজ?
গুরুমহারাজ :– ঠিক ঠিক ভালবাসতে পারলে ব্যথা তাে লাগবেই! তাঁর সুখেই সুখ—তাঁর দুঃখেই দুঃখ। গােপীদের এইভাব সর্বক্ষণের জন্য বজায় থাকতো, তাই তাঁরা আদর্শ ভক্ত। স্বামীজী বলেছিলেন, “যত উচ্চ তােমার হৃদয়–তত দুঃখ জানিবে নিশ্চয়।” এই দুঃখ কি শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধির প্রতিকূলজনিত দুঃখ না তার পারিবারিক সমস্যার দুঃখ, না তা নয়—এটা হচ্ছে জগতের সমস্ত আর্তের ব্যথা_ যা উচ্চ হৃদয়ে সদা-সর্বদা এসে আঘাত হানে_, তাই দুঃখবােধ। আর ঈশ্বরের অবতারগণ তো সর্বদা জগতের দুঃখমােচনের জন্য উন্মুখ। ঋষিরা তাে নিজেদের জন্য প্রার্থনা করেন নি—করেছেন সকলের জন্য :–
“সর্বেষাং মঙ্গলং ভূয়াৎ সর্বেসন্তু নিরাময়াঃ।
সর্বে ভদ্ৰাণি পশ্যন্তি, মা কশ্চিদ্ দুঃখভাগ ভবেৎ।”
দ্যাখাে সব্য, মানুষ কোন মহাপুরুষকে কি দেয় ! শুধু দুঃখই তাে দেয় । এক-একটা মানুষ মহাপুরুষের ভালবাসার টানে তাঁর কাছে আসে, আর এসে যেন তার অন্তর্জগতে মত বিষ ছিল তার সবটা উগরে দেয়! মানুষ কি আর ‘মানুষ’ হয়েছে সব্য ! উপরটা ভদ্রলােকের মতো—মনােজগতটা যেন সহস্র কামনা-বাসনার পােকায় কিলবিল করছে । তাই সব মহাপুরুষকেই—যাঁরা সমাজে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে আসেন, তাঁদের সকলকেই ‘মানুষ’-কে খুব নীচু হয়ে দেখতে হয়। মনের কথা বলার লােক খুঁজতে গিয়ে না পেয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মায়ের কাছে কেঁদেছিলেন—যাতে শুদ্ধসত্ত্ব ত্যাগী ছেলেরা তাঁর কাছে আসে। সুযােগ্য উত্তরসূরি ছাড়া কোন মহাপুরুষের আগমনের উদ্দেশ্যটাই যে ব্যাহত হয়ে যাবে !
তাই যীশুর crucifixion-এ আর কতটা কষ্ট হয়েছিল ? তার আগেই তিনি মানুষকে ভালবেসে যে কষ্ট পেয়েছেন—তার তুলনায় crucifixion অর্থাৎ দৈহিক নির্যাতন আর এমন কি ? দেখছো না_ crucifixion-এর মতো ঐ ভয়ঙ্কর যন্ত্রনার মধ্যেও তিনি কত স্থির-সৌম্য-শান্ত। মানবপ্রেমের চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠার বাণী তখনও তাঁর কন্ঠে—“হে ঈশ্বর ! তুমি ওদের ক্ষমা করাে......।”
এই ভাবেই মহাপুরুষদের জীবন থেকে নিজের জীবনে শিক্ষা নিতে হয়। মহাপুরুষদের সমালােচনা করা আর তাঁদের দোষ ধরার একটা প্রবণতা কিছু বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে দেখা যায়, এটা সবসময়েই থাকে_ কিন্তু এতে কি হয় ? এর দ্বারা কখনই কি সেইসব মহাপুরুষদের মহিমা ক্ষুন্ন হয় না, তাঁরা মানুষের মনােজগতে সবসময়েই উজ্জ্বল হয়ে থাকেন! মানুষের মনে তাঁদের স্মৃতি কখনোই ম্লান হয় না। তাই বুদ্ধিমান মানুষের উচিৎ নয়, নিজের ‘বুদ্ধির জগৎ’-কে কোন সমালোচকের বুদ্ধির চক্রে ফেলে, নিজেকে ‘হীন বুদ্ধি’ করা। তাতে নিজেরই ক্ষতি হয়, বুদ্ধির বিকৃতি ঘটে, আবার সমাজেরও ক্ষতি হয়। তাই গ্রহণ করা উচিত সেই পথ— “মহাজনাে যেন গতঃ স পন্থা। পিতামাতার উচিৎ ছেলে-মেয়েদের শিশু অবস্থা থেকেই তাদের সামনে ত্যাগী মহাপুরুষদের জীবনাদর্শ তুলে ধরা। তাহলেই ছেলে-মেয়েরা নিজের জীবনে সেইসব আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রচেষ্টা করবে। তাতে জীবন সুন্দর হবে ও তা সমাজের উন্নতিরও অনুকূল হবে এবং কালে কোন মহাপুরুষের কৃপা ও সান্নিধ্যে এসে তারা জীবনের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সচেতন হতে পারবে। তােমরা যারা এখানে আসছ, তারা অন্ততঃ সেইভাবে ছেলে-মেয়েদের গড়ে তােলার চেষ্টা করাে ।৷